খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ অব্দের গল্প। তৎকালীন পৃথিবী শাসন করতেন রোমান সম্রাটরা। তখন রোমের সিংহাসনে আসীন ছিলেন দিগ্বিজয়ী সম্রাট জুলিয়াস সিজার। যুদ্ধবাজ সম্রাট হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিল তার। সেবছরও তিনি হিস্পানিয়া অঞ্চলে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন।
সিজারের সেনাবাহিনী তখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী। তাদের সামনে পৃথিবীর বহু পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য ধূলায় লুটিয়ে পড়েছে। অনেকে নিশ্চিত পরাজয় জেনে যুদ্ধের আগেই আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু হিস্পানিয়ানরা সিজারের নিকট নতিস্বীকার করতে চাইলো না।
সংঘবদ্ধভাবে হিস্পানিয়ানরা ঝাঁপিয়ে পড়লো রোমান বহরের উপর। নৌপথে অগ্রগামী রোমানরা হিস্পানিয়ার আক্রমণের তোপে প্রাথমিকভাবে পিছু হটতে বাধ্য হলো। কিন্তু ততক্ষণে বহু নৌবহর ধ্বংস হয়ে সাগরতলে সলিল সমাধিস্থ হয়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, ডুবে যাওয়া রোমানদের মাঝে সিজারের বহু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরিজন ছিলেন। আবার অনেকে শত্রুসীমানায় বন্দী হয়েছেন।
শত্রুশিবির থেকে খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে সিজার তার সৈন্যবহর নিয়ে আশ্রয় নিলেন। শত্রু সীমানায় আটকে পড়া কেউ ফিরে আসবে, সে আশা ত্যাগ করে তিনি নতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা করতে থাকেন। ঠিক তখন রোমান শিবিরে সৈন্যরা হর্ষধ্বনি করতে থাকে।
সিজার তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন এই চিৎকারের কারণ জানার জন্য। তারপর দেখলেন, হাজার সৈনিকের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন তার ভাগ্নিপুত্র গাইয়াস অক্টাভিয়াস। মাত্র ১৬ বছর বয়সী এই রোমান যুবক শত্রুপক্ষের জলসীমানায় আটক ছিলেন। কিন্তু অসীম সাহসিকতায় শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে পুরোটা পথ সাঁতার কেটে ফিরে এসেছেন সিজারের পক্ষে যুদ্ধ করতে!
জুলিয়াস সিজার এই বালকের সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। হিস্পানিয়া যুদ্ধ শেষে তিনি রোমে ফিরেই জানিয়ে দিলেন তার উত্তরাধিকারীর নাম। আর তা হচ্ছে গাইয়াস অক্টাভিয়াস, যাকে ইতিহাসের পাতায় ‘অগাস্টাস সিজার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
কে এই অক্টাভিয়াস?
জুলিয়াস সিজার ক্ষমতায় আরোহণের পূর্বে রোমান সাম্রাজ্য প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিচালিত হতো। রোমের সিনেটররা কিছুটা গণতান্ত্রিক উপায়ে রোমের সকল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা করতেন। কিন্তু জুলিয়াস সিজারের আগমনের পর রোমের রাজনৈতিক দৃশ্যে বড় রকমের পরিবর্তন আসে। রোমের প্রজাতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং তিনি সাম্রাজ্য বর্ধনের নেশায় মত্ত হয়ে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।
পরবর্তীকালে জুলিয়াস সিজার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রুটাস এবং তার সহযোগীদের দ্বারা নিহত হওয়ার পর রোম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। অস্থিতিশীল রোমকে পুনরায় তার শ্রেষ্ঠত্বে ফিরিয়ে আনার জন্য ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হন দুজন রোমান- মার্ক অ্যান্থনি এবং অগাস্টাস সিজার। পরবর্তীতে অগাস্টাস একচ্ছত্রভাবে রোম শাসন শুরু করেন এবং যুদ্ধবিগ্রহের অবসান ঘটান। আনয়ন করেন ২০০ বছর দীর্ঘ ‘প্যাক্স রোমানা’ বা শান্তিপূর্ণ রোমের।
অগাস্টাস সিজারের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ২৭ অব্দে। যেটি জুলিয়াস সিজারের হিস্পানিয়া যুদ্ধেরও প্রায় ১৬ বছর পরের ঘটনা। পাঠকরা বোধহয় ভাবছেন, সালের হিসেবে বুঝি গরমিল হয়ে গেল। তাহলে হিস্পানিয়া যুদ্ধের সেই যুবক কে ছিলেন? মোটেও তা নয়। এর কারণ, ২৭ খ্রিস্টপূর্বের আগে তার নাম ছিল গাইয়াস অক্টাভিয়াস। এই গাইয়াস অক্টাভিয়াসের জন্ম ৬৩ খ্রিস্টপূর্বের ২৩ সেপ্টেম্বর। সম্পর্কে জুলিয়াস সিজার ছিলেন তার খুড়ো। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজার তাকে পোষ্য সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তার নাম বদলে গাইয়াস জুলিয়াস সিজারে পরিণত হয়।
অক্টাভিয়াসের পিতা একজন সিনেটর ছিলেন। তিনি প্রজাতন্ত্র রোমের গভর্নর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আর তার মা আতিয়া ছিলেন সিজারের আপন বোন জুলিয়ার কন্যা। পারিবারিক সূত্র এবং নিজস্ব প্রতাপের কারণে অল্প বয়স থেকে অক্টাভিয়াস রাজকার্যে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। তার এই অভিজ্ঞতা সিজারের প্রয়াণের পর রোমের হাল ধরতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। পরবর্তীতে রোমান সিনেট কর্তৃক তাকে ‘অগাস্টাস’ বা কীর্তিমান উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ইতিহাসবিদগণ রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট হিসেবে অভিহিত করেন।
ক্ষমতায় আরোহণ
হিস্পানিয়া যুদ্ধের এক বছরের মাথায় জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করা হয়। তখন তার উত্তরাধিকারী অক্টাভিয়াস অ্যাপোলোনিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তিনি তার অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য তৎক্ষণাৎ রোমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। মৃত সম্রাটের পক্ষের সিনেটররা অক্টাভিয়াসের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন এবং তাকে সিংহাসন গ্রহণ করার অনুরোধ করেন।
কিন্তু রোমের শূন্য সিংহাসন দখল করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ইতোমধ্যে ক্ষমতালোভী শত্রুপক্ষ নানা দিক থেকে রোম আক্রমণের চেষ্টা করতে থাকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতাপশালী ছিল মার্ক অ্যান্থনি। উচ্চাভিলাষী অক্টাভিয়াস পর্যাপ্ত সৈনিক জড়ো করে মার্ক অ্যান্থনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। উত্তর ইতালিতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হন এবং পরিষ্কারভাবে সিংহাসনের উপর তার কর্তৃত্ব ঘোষণা করেন। কিন্তু তিনি তার শাসনামলের শুরুতে কারো সাথে শত্রুতার জন্ম দিতে চাননি। তাই মার্ক অ্যান্থনি এবং মার্কাস অ্যামেলিয়াস লেপিদাসের সাথে সন্ধি স্থাপন করে রোম সাম্রাজ্য তিনভাগে ভাগ করে শাসন করতে থাকেন।
এই ত্রয়ী তাদের ক্ষমতার প্রথম স্বাক্ষর রাখেন বিরুদ্ধশক্তির রাজনীতিবিদদের হত্যা করার মাধ্যমে। শত বছরের যুদ্ধে জর্জরিত রোমে নতুন করে রক্তপাতের সূচনা হয়। শত্রুনিধন পর্বের পর তারা রোমের বাইরে অবস্থানরত সিজারের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৪২ খ্রিস্টপূর্বে অনুষ্ঠিত ফিলিপির যুদ্ধে ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস বাহিনী পরাজিত হয়।
পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে বিশ্বাসঘাতক ব্রুটাস আত্মহত্যা করে। ব্রুটাসের পর তাদের নজর পড়ে সেক্সটাস পম্পেইয়াসের উপর। জুলিয়াস সিজারের শাসনামলে তার পিতা ছিলেন রোমের সবচেয়ে বড় শত্রু। অক্টাভিয়াস কোনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ রাখতে চাননি। রোমের ত্রয়ীর বিশাল সেনাবহরের নিকট পম্পেইয়াসের বাহিনী খড়কুটোর মতো উড়ে যায়।
একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে আবির্ভাব
অক্টাভিয়াসের ত্রয়ী শাসন ব্যবস্থা বেশিদিন টেকেনি। অবশ্য এ কথা অক্টাভিয়াস নিজেও জানতেন যে টিকবে না। ইতিহাসবিদদের মতে, নিজের স্বার্থোদ্ধারের নিমিত্তে তিনি এই সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবার পর তিনি নিজেই শক্ত হাতে বাকি দু’জনকে হটিয়ে দেন।
তবে হুট করেই সন্ধিভঙ্গ হয়ে যায়নি। সন্ধিভঙ্গের সূচনা হয় ৪১ খ্রিস্টপূর্বে মার্ক অ্যান্থনি এবং মিশরের রানী ক্লিওপেট্রার প্রণয়ের মাধ্যমে। এমনকি রোমান সিনেটের অনুমোদনে অক্টাভিয়াসের বোন অক্টাভিয়ার সাথে তার বিয়ে হলেও তিনি ক্লিওপেট্রার সাথে সম্পর্কের অবসান ঘটাননি। এ ঘটনা অক্টাভিয়াসের কানে গেলে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে।
এদিকে পম্পেইয়াসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর লেপিদাস নিজেকে অক্টাভিয়াসের চেয়ে শক্তিশালী ভাবা শুরু করেন এবং তাকে অপমান করেন। দু’দিক থেকে বিরোধের পরেও তিনি নিয়ন্ত্রণ হারাননি। উল্টো বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনি ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে লেপিদাসের পুরো বাহিনী ক্রয় করে ফেলেন। সবকিছু হারিয়ে বেচারা লেপিদাস বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকেন একা। অক্টাভিয়াস তার সকল ক্ষমতা রদ করে তাকে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেন।
লেপিদাস গেল, রইল বাকি দুই। এই দুইয়ের মাঝে বিরোধ আগে থেকেই ছিল, যা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে যখন মার্ক অ্যান্থনি ৩২ খ্রিস্টপূর্বে অক্টাভিয়াকে তালাক দিয়ে দেন। এটা ছিল অক্টাভিয়াসের জন্য অপমানজনক। তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে মার্ক অ্যান্থনি ও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন। অক্টাভিয়াসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্কাস আগ্রিপা বিশাল নৌবহর নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আগ্রিপার অভিনব যুদ্ধকৌশলের নিকট মার্ক অ্যান্থনির শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তাকে সাহায্য করতে ক্লিওপেট্রা নৌবহর প্রেরণ করেছিলেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে এই প্রেমিক দম্পতি আত্মহত্যা করার মাধ্যমে পুরো রোমের অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হন গাইয়াস জুলিয়াস সিজার অক্টাভিয়াস।
অক্টাভিয়াস থেকে অগাস্টাস
ক্লিওপেট্রা ও মার্ক অ্যান্থনির পরাজয়ের মাধ্যমে ৩১ খ্রিস্টপূর্বে শুরু হয় অক্টাভিয়াসের রাজত্ব। ইতিহাসের পাতায় অবশ্য রাজত্বের দিনক্ষণ নিয়ে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে, মার্ক অ্যান্থনির পরাজয়েরও চার বছর পর তার আসল রাজত্ব শুরু হয়। কারণ, সেবছর তিনি সিনেটের নিকট গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। তার এই অর্জনকে স্মরণীয় করতে সিনেটরগণ তাকে অগাস্টাস উপাধি প্রদান করেন।
মূল নামের চেয়ে তার অগাস্টাস নামই সবার কাছে বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এর কারণ, অগাস্টাস নামের সাথে যুক্ত আছে মহাপ্রতাপশালী ‘সিজার’ নামটুকু। যদিও এর আগেও তার নামের সাথে সিজার সংযুক্ত ছিল। তবে অক্টাভিয়াস নামের সাথে সিজার শব্দ ব্যবহার করা হতো না, যা অগাস্টাসের বেলায় হয়ে থাকে। মার্ক অ্যান্থনি তার মৃত্যুর পূর্বে একবার অগাস্টাসকে বলেছিলেন, “হে বালক! তোমার এত প্রতাপ শুধু ওই সিজার নামের জন্যই হয়েছে।”
অগাস্টাস সিজারকে রোমের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয়। তার শাসনামল ‘রোমের স্বর্ণযুগ’ হিসেবে পরিচিত। তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পর পুনরায় সিনেট প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রজাতন্ত্রের চল রোমে ফিরিয়ে আনেন, যদিও সিনেটের সর্বক্ষমতার উৎস হিসেবে তিনি আসীন ছিলেন। অগাস্টাস সিনেটের যেকোনো সিদ্ধান্তে ‘ভেটো’ দিতে পারতেন। অগাস্টাসের আবির্ভাব রক্তক্ষয়ী হলেও তিনি রোমের যুদ্ধনীতির অবসান ঘটান। তার শাসন থেকে শুরু হয় যুদ্ধবিহীন শান্ত রোমের যাত্রা, যাকে ইতিহাসবিদরা‘প্যাক্স রোমানা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
অল্প সময়ের মাঝে তিনি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবার মন জয় করতে সক্ষম হন। তিনি তার অর্থায়নে প্রায় ৮২টি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। রোমের বিখ্যাত গণস্নানাগারগুলো তার আমলে নির্মিত হয়েছিল। তিনি রোমের পুনর্গঠন এবং সংস্কারে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। খ্রিস্টপূর্ব ১৯ অব্দে তাকে রোমের সর্বক্ষমতার উৎস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
তার আমলে রোমে শিল্প, সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে। ২ খ্রিস্টপূর্বে তাকে ‘রোমান জাতির জনক’ উপাধি দেওয়া হয়। তার সম্মানে বছরের ৮ম মাস হয় ‘আগস্ট’। তিনি রোমে বিভিন্ন সংস্কারমূলক আইনের প্রচলন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রোমানদের মাঝে ব্যভিচার, বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ব্যভিচারের দায়ে তিনি তার নিজের মেয়ে জুলিয়াকে পর্যন্ত নির্বাসন দিয়েছিলেন। কিন্তু পরস্পরবিরোধী ব্যাপার হচ্ছে, তিনি নিজেও ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বিশেষ ক্ষমতাবলে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করতেন, তাই তার কোনো শাস্তি হয়নি।
সাম্রাজ্য প্রসারণ
সম্রাটের মাহাত্ম্য সাম্রাজ্য প্রসারণে- এমন নীতি প্রচলিত ছিল প্রাচীন যুগে। রোমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেও অগাস্টাস সিজার রোমান সাম্রাজ্য প্রসারণ থেকে পিছপা হননি। তার আমলে রোমান সাম্রাজ্য জুলিয়াস সিজারের চেয়ে দ্বিগুণ বর্ধিত হয়েছিল। তবে এসব যুদ্ধে তিনি নিজে সরাসরি অংশ নেননি। অগাস্টাস যখন রোম সংস্কারের কাজে মগ্ন ছিলেন, তখন তার বন্ধু মার্কাস আগ্রিপা রোমান সেনাবাহিনী নিয়ে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলে মিশর, স্পেন, দ্য আল্পস, বলকান অঞ্চল এবং জার্মানির কিছু অংশ রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। কয়েকটি অভিযানে অগাস্টাস নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। গল, স্পেন, গ্রিস এবং এশিয়ার বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি সশরীরে অংশ নেন। কিন্তু তারপরও, তিনি নিজে ভালো যোদ্ধা ছিলেন না। এর কারণ, তিনি প্রায়ই যুদ্ধক্ষেত্রে অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
অগাস্টাসের সম্প্রসারণ নীতিতে একমাত্র ব্যর্থতা ছিল টিউটোবার্গ যুদ্ধে জার্মানদের হাতে পরাজয়। অবশ্য পরবর্তীতে রোমানরা হৃত অঞ্চল পুনরায় দখলে নিয়েছিল।
পারিবারিক জীবন এবং উত্তরাধিকার রহস্য
অগাস্টাস সিজার তার জীবনে তিনবার বিয়ে করেছিলেন।লাখ প্রথম স্ত্রী ক্লডিয়া পুলচ্রা ছিলেন মার্ক অ্যান্থনির সৎ-কন্যা। ক্লডিয়ার সাথে বিচ্ছেদের পর তিনি স্ক্রিবোনিয়া নামক এক মহিলাকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে জুলিয়া নামক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। এছাড়া তার আর কোনো সন্তান ছিল না। ৩৯ খ্রিস্টপূর্বে তিনি লিভিয়া দ্রুসিলাকে বিয়ে করেন। লিভিয়া ছিলেন অগাস্টাসের আমৃত্যু সহধর্মিণী।
তবে লিভিয়ার পূর্ব সংসারে দুই সন্তান ছিল- টাইবেরিয়াস এবং দ্রুসাস। অগাস্টাস তার কন্যা জুলিয়ার সাথে টাইবেরিয়াসের বিয়ে দেন। ইতিহাসবিদদের মতে, লিভিয়া বেশ প্রভাবশালী নারী ছিলেন। অগাস্টাসের শাসনামলে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। এছাড়া তিনি বেশ উচ্চাভিলাষী ছিলেন। নিজে রোমের সিংহাসনে বসতে না পারলেও তিনি আজীবন স্বপ্ন দেখতেন তার সন্তান টাইবেরিয়াস রোমের শাসক হবেন।
অগাস্টাসের যেহেতু পুত্র সন্তান ছিল না, তাই তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করতেন। রহস্যজনকভাবে, তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। শুধু বেঁচে ছিলেন টাইবেরিয়াস। অনেকে মনে করেন, এর পেছনে তার স্ত্রী লিভিয়ার ষড়যন্ত্র রয়েছে। তার উত্তরাধিকারীর তালিকায় ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্কাস আগ্রিপা, ভাগ্নে মার্সেলাস, নাতি গাইয়াস, লুসিয়াস এবং জার্মানিকাস।
অগাস্টাসের প্রয়াণ
জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর ভগ্ন রোমকে তার হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া সম্রাট অগাস্টাস ১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি নোলা নগরীতে অবস্থান করছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বেশ কিছু বক্তব্য রেখে যান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,
“আমি রোমকে নরম কাদা হিসেবে পেয়েছিলাম। সেখান থেকে নিজ হাতে আমি তাকে শক্ত মার্বেল হিসেবে গড়ে তুলেছি।”
তবে তার স্ত্রী লিভিয়ার মতে, তিনি মরার পূর্বে প্রশ্ন করেছিলেন,
“আমি কি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? যদি পেরে থাকি, তোমরা করতালি দাও। আমি প্রস্থান করি।”
অগাস্টাসের মৃত্যুতে রোমে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার সম্মানে একদিনের জন্য রোমের সকল বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার সৎকার অনুষ্ঠানে হাজার হাজার জনগণ রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গনে ভিড় করেছিল। সেদিন তার সৎ-পুত্র এবং উত্তরাধিকারী টাইবেরিয়াস সম্রাটের সম্মানে স্তুতি করেছিলেন।
রোমান ঐতিহ্য অনুযায়ী, অগাস্টাসের দেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অগাস্টাসের সৌধে তার ছাই সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে রোম তাদের শ্রেষ্ঠ সম্রাটকে‘দেবতা’ হিসেবে গ্রহণ করে মন্দির নির্মাণ করেছিল। অগাস্টাসের পর রোমে বহু সম্রাট এসেছেন। অগাস্টাসের শুরু করা প্যাক্স রোমানা আরো শত বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো। কিন্তু কেউই অগাস্টাসের অভাব পূরণ করতে পারেনি।