Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যান্সারের নিশিকাব্য: বেসবাবা সুমন

বেসবাবা সুমন নামে আমরা যে মানুষটিকে চিনি, তার পুরো নাম সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন। বেসবাবা নামটি অর্থহীনের ভক্তদের দেয়া। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের অন্যতম বিখ্যাত ব্যান্ড ‘অর্থহীন’ এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। অর্থহীনের গানগুলোতে কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি বেস গিটার বাজিয়ে থাকেন। অর্থহীন ছাড়াও তার একক গান এবং অ্যালবামও রয়েছে।

৪৬ বছর বয়সের জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন সুমন। অসংখ্যবার মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এসেছেন। তার জন্য ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধটা দৈনন্দিন জীবনের নিতান্তই তুচ্ছ কোনো ব্যাপার। 

বেসবাবা সুমন; Image Source: Flickr.com

গানবাজনা কখনোই সুমনের পেশা ছিল না; অনেকবার সেটা উল্লেখ করছেন তিনি। আবেগের বশেই গান শুরু করেছেন এবং থামেননি।

তার ভাষায়,

আমি আঠারোটা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, আরো সাতটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আমার টাকা নিয়ে কখনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কিন্তু আমি কখনোই সেটি আমার পরিচয় হিসেবে রাখি না। আমার পরিচয়- আমি একজন গায়ক।

ছোটবেলা থেকে টিভিতে রকস্টারদের দেখে তাদের মতো গিটার বাজাতে চাইতেন। তার গিটারের প্রতি এত আগ্রহ দেখে সাত বছর বয়সে মা একটি গিটার উপহার দেন তাকে। সেটি ছিল হাওয়াইয়ান গিটার। এই ধরনের গিটার বসে পায়ের ভাঁজে রেখে বাজাতে হতো। কিন্তু সুমন চাইতেন রকস্টারদের মতো গিটার বাজাবেন, যা এই গিটার দিয়ে যা করা সম্ভব না! তারপরও সেই বয়স থেকে গান ও গিটার বাজানো শিখতে লাগলেন। রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত এবং দেশাত্মবোধক গান সেই গিটার দিয়ে বাজানো শিখলেন।

তিন-চার বছর পর তার মনে হলো, এখন রকস্টারদের মতো গিটার বাজানো উচিত। তখনই একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকানে নিজের হাওয়াইয়ান গিটার ও ৫০০ টাকা দিয়ে একটি স্প্যানিশ গিটার নিয়ে আসেন। দু’বছর ধরে স্প্যানিশ গিটার বাজানোর পর আয়রন মেইডেনের একটি ভিডিওতে বেস গিটার বাদক স্টিভ হ্যারিসের বাজানো দেখে তারও মনে হলো, তিনি বেস বাজাবেন। কিন্তু বেস গিটার না থাকায় নিজের স্প্যানিশ গিটারের দুটো তার ছিঁড়ে সেই গিটারকে বেস গিটার হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলেন!

এভাবে দু’বছর বেস বাজানোর পর ফিলিংস ব্যান্ডের কর্ণধার জেমস তাকে ফিলিংসে বেস বাজানোর আমন্ত্রণ জানান। সদ্য এসএসসি পাশ করা সুমন সেই সুযোগ লুফে নেন এবং কোনো বেস গিটার ছাড়াই ফিলিংসে বেস বাজানো শুরু করেন!

ফিলিংসের বাজানো শুরু করার তিন বছর পর সুমন তার প্রথম বেস গিটার কেনেন। তখন থেকে তার বেস বাজানোর আসল পথচলা শুরু। মাত্র ১৯ বছর বয়সের মধ্যে অনেকগুলো ব্যান্ডে বেস বাজানোর সৌভাগ্য হয় তার। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ওয়ারফেজ’-এ বাজানো শুরু করেন তিনি। দুই বছর ওয়ারফেজে বাজানোর পর ভাবলেন, একক এলবাম বের করবেন। ১৯৯৯ সালে নিজের প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুমন ও অর্থহীন’ বের করেন তিনি। অ্যালবামটি অনেক জনপ্রিয়তা পায়, বাংলাদেশের সংগীত জগতে সে বছর থেকেই অর্থহীন ব্যান্ডের যাত্রা শুরু।

বেসবাবা সুমন এবং জেমস; Image Source: Facebook

২০০১ সালের কথা। কনসার্টে গান গাচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে হলো, তিনি আর চোয়াল বন্ধ করতে পারছেন না! সে সময় ডাক্তার অবস্থা দেখে বলেছিলেন, চোয়ালের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। ডাক্তার জানালেন, এই চোয়াল নিয়ে আর কখনো গান গাওয়া যাবে না! তরুণ সুমনের তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। আর কখনোই তিনি গান গাইতে পারবেন না! এ কেমন কথা।

তখন ডাক্তারের দেয়া চোয়ালবন্ধনী গালে লাগিয়ে ঘুরতে হতো তাকে। সেই অবস্থাতেই তিনি ঠিক করলেন, গান গাইতেই হবে। গান ছাড়া থাকা যাবে না। ঠিক তার এক বছর পর মুখে চোয়ালবন্ধনী নিয়েই তিনি কনসার্টে গান করেন। ডাক্তার দেখে বললেন, “আমি জানি না তুমি অলৌকিক এই ব্যাপার কীভাবে করছ, কিন্তু আস্তে আস্তে তোমার চোয়ালের উন্নতি হচ্ছে!

চার বছর চোয়ালবন্ধনী পরে গান করবার পর সেটি খুলে দেন ডাক্তার। চোয়ালের লিগামেন্ট ঠিক হয়ে গেছে এই চার বছর গান করতে করতে!

খেতে খুব বেশি ভালোবাসতেন তিনি। সে সময় সুমনের ওজন ছিল অস্বাভাবিক রকমের বেশি; ১৭৪ কেজি! বর্তমান ছবি দেখে যা মোটেই মনে হবে না কারও। কোমরের সাইজ ছিল ৫৮! পায়জামা বিদেশ থেকে নিয়ে আসা  হতো, এ দেশে এত বড় সাইজ পাওয়া যেত না বলে। সে সময় তার হাঁটাচলা করতেও কষ্ট হতো।

সুমনের প্রথম একক অ্যালবাম; Image Source : Youtube

সাল তখন ২০০৪, সুমন ঠিক করলেন তিনি ওজন কমাবেন। যেমন কথা তেমন কাজ। শুরু করলেন ডায়েট এবং ব্যায়াম। দেড় বছর তিনি সচরাচর খাবার বলতে যা বোঝায় তা খাননি। ভাত, রুটি দেড় বছর ধরে এড়িয়ে গিয়েছেন। শসা, গাজর, টমেটো, ডাল খেয়ে এই আঠারো মাস কাটিয়েছেন।

এবং এই কষ্টের ফল খুবই চমৎকারভাবে পান তিনি। দেড় বছরে ৯১ কেজি ওজন কমান! কোমর ৫৮ থেকে ৩২ এ নামিয়ে আনেন। শরীরের এতই পরিবর্তন হয়েছিলো যে বিমানবন্দরে তাকে বোঝাতে হতো, পাসপোর্টের বর্ণনা করা মানুষই তিনিই। পরবর্তী সময়ে সুমন বলছেন,

ওজন যখন কমানো শুরু করি, প্রথম যেদিন দেখলাম যে আমার ওজন ১০-১২ কেজি কমে গেছে, তখন আমি বুঝলাম যে এটা সত্যিই আমি পারবো। আসলে নিজের মনের মধ্যে যখন আমি বিশ্বাস গেঁথে নিয়েছি যে আমি পারবো, তার মানে আমি পারবোই। এই পুরো ঘটনাটা নিয়েই আমি খুব গর্ববোধ করি যে আমি পেরেছি!

এ সময়ের মধ্যে তার ও আনিলার দ্বৈত অ্যালবাম মুক্তি পায়। সেটা বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ব্যান্ড অর্থহীনের অ্যালবাম ‘অসমাপ্ত ১’ মুক্তি পায় এই সময়ে। সেটিও অনেক সাড়া ফেলে শ্রোতাদের কাছে।

সময় খুব ভালো যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎই ক্যান্সার ধরা পড়ে সুমনের। ডাক্তাররা তার মেরুদণ্ডে দুটি টিউমার খুঁজে পান, যা প্রথম ধাপের ক্যান্সার। এই খবর সুমনের মনোবল ভেঙে দেয়। তার পরিবারে ক্যান্সারে মারা যাওয়া মানুষ থাকায় ভয় পেয়ে যান তিনি। তা-ও নিজের মনকে শক্তি যুগিয়ে ডাক্তারের ছুরির নিচে যান। সার্জারি করার পর ১০ মাস ভালোই ছিলেন। গান শুরু করার কথা ভাবছিলেন যখন ঠিক তখনই ক্যান্সার আবার আঘাত হানলো! এই সময়ে পাকস্থলীতে চতুর্থ ধাপের! আবারো সার্জারি, কেমোথেরাপি। সুমনের পাকস্থলীর ৮৫% কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো।

২০১৩ সালে আবার ক্যান্সারের আক্রমণে পড়েন সুমন। পিটুইটারি গ্লান্ডের টিউমার ছিল এটি। আবারো সার্জারি করার পর সুস্থভাবে সংগীত জগতে ফিরে আসেন তিনি।

এরপরও আরো কয়েকবার ছোট-বড় ক্যান্সারের জন্য বার বার ডাক্তারদের ছুরির নিচে যেতে হয়েছে তাকে। থুতনির টিউমার অপসারণের জন্য সার্জারি করতে ব্যাংকক যেতে হয়। সার্জারি শেষে বিকালে হসপিটাল থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তা পার হবার সময় একটি গাড়ি ধাক্কা দেয় তাকে। এজন্যও পাশের হসপিটালে ১১ ঘণ্টাব্যাপী নয়টি সার্জারি হয় তার!

কিডনি, পাকস্থলী, মাথা, ত্বক- সব ক্যান্সারই ভুগিয়েছে তাকে। ২০১৭ সালে মেরুদণ্ডের সমস্যার জন্য আটটি ধাতব স্ক্রু লাগানো হয় তার মেরুদণ্ডে। মেরুদণ্ডে মোট ১১টি স্ক্রু নিয়ে ঘোরেন তিনি। সে সময়ই আবারও পাকস্থলীর সার্জারিতে পুরো পাকস্থলীই কেটে ফেলে দেয়া হয়।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বেসবাবা; Image Source : Facebook

ক্যান্সারকে কখনোই জিততে দেননি। সুমনের প্রতিটি গানের কথার পেছনে একটি ছোট গল্প লুকিয়ে থাকে। নিজের ক্যান্সার সম্পর্কেও তার দুটি গান রয়েছে ‘ক্যান্সার’ এবং ‘ক্যান্সার এর নিশিকাব্য’ নামে!

নিজের সন্তানদের খুব ভালোবাসেন তিনি। ছেলে-মেয়েকে আলাদাভাবে উৎসর্গ করা গান রয়েছে, যাতে সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা প্রবলভাবে বোঝা যায়। এরকম একটি গান হলো ‘ঘুমপাড়ানির গান’, যা নিজের মেয়ের জন্য লিখেছেন। গানটি বের হওয়ার কয়েকমাস পরই যুক্তরাজ্য থেকে একটি ফোনকল পান, যেখানে জনৈক ব্যক্তি সুমনকে বলেন, “আমার মেয়ে আমার সাথে থাকে না আজ দু’বছর হলো। আপনার এই গান শুনে সে আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে, আপনাকে আমি কী বলে ধন্যবাদ দিবো আমি জানি না।” এই সকল ছোট ছোট ব্যাপার সুমনকে অনেক প্রেরণা যোগায়।

তার এডিসন্স রোগ নামে দুর্লভ একটি রোগ আছে যা মানুষকে অপারেশন এর আগে অজ্ঞান করা হলে জ্ঞান ফিরে আসার চান্স থাকে শতকরা ৫০ ভাগ! একবার ক্যান্সারের সার্জারির জন্য তাকে অজ্ঞান করার সময় তিনি ডাক্তারের হাত ধরে বললেন, “ডাক্তার আমি বাঁচতে চাই!” ডাক্তার জবাব দিলেন, অবশ্যই বাঁচবো তুমি। তিনি উত্তর দেন, “না, পিটার জ্যাকসনের দ্য হবিট সিনেমাটি মুক্তি পাবে দু’দিন পর। আমি ওটা দেখতে চাই!

প্রত্যেকটা সময় স্পষ্ট থাকতে চান এবং জীবনটা উপভোগ করতে চান যতটুকু সম্ভব। যখন প্রথমবার ক্যান্সার ধরা পড়ে, তার মনে হলো পুরো বাংলাদেশ ঘোরা উচিত। যেমন কথা তেমন কাজ। বাংলাদেশের যত জেলায় রাস্তায় গাড়ি যায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। আমেরিকায় ৩১ দিনে ২৮টি প্রদেশ ঘুরেছেন সাড়ে ১৪ হাজার মাইল গাড়ি চালিয়ে।

তার ভাষায়,

আমার হাতে দুটি রাস্তা। হয় এভাবে জীবনটা উপভোগ করা, সব সময় পজিটিভ থাকা, নয়তো ‘হায় আল্লাহ! আমার ক্যান্সার! আমার কী হবে, আমি তো মারা যাবো‘ বলে বসে থাকা। আমি প্রথম পথই বেছে নিয়েছি।”

পুরো বাংলাদেশ ঘোরায় সঙ্গী; image Source : Facebook

প্রত্যেকবারই ক্যান্সারকে পেছনে ফেলে বারবার ভক্তদের কাছে ফিরে আসেন বেসবাবা সুমন হয়ে। এত ক্যান্সার, এত সমস্যার পরও হাসিখুশি থাকেন কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,

আমি আমেরিকায় থাকাকালে এক উদ্বাস্তু মানুষের মুখে একটা কথা শুনি এবং কথাটা মেনে চলার চেষ্টা করি। কথাটি হলো- “Happiness is a choice and life is beautiful!”

This Bangla article is about Saidus Sumon's 2014, mostly based on his speech on TedX talk 'Why i lived happily despite being afflicted by cancer' also some other talks.'

Featured Image © Flickr.com

References:
1. https://bit.ly/2ViioFu

2. https://bit.ly/2Euh0tN

Related Articles