Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বেঞ্জামিন কার্সন: একজন প্রতিভাধর নিউরোসার্জনের উপাখ্যান

লেখার শুরুতে যদিও উল্লেখ করা হয়েছে বেঞ্জামিন কার্সন নামক এক ব্যক্তির নাম, কিন্তু এই গল্পটি একজন মায়ের, এমন একজন মা যিনি তার সন্তানদের শৈশবেই বিশ্বাস করিয়েছেন যে, তাদের দ্বারা সবকিছু সম্ভব, তারা ইচ্ছা করলেই পুরো পৃথিবী জয় করে নিতে পারে। অর্ধেক বিশ্বের নেতা নেপোলিয়ন একজন মায়ের প্রয়োজনীয়তাকে উল্লেখ করে যথার্থই বলেছিলেন, “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো”। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন একটি নবজাতককে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে একজন মায়ের গুরুত্ব কতটুকু।

১৯৭৩ সালে ইয়েল থেকে স্নাতক অর্জনোত্তর সময়ে মা সোনিয়া কার্সনের সঙ্গে তোলা ছবি; Source: achievement.org

বেঞ্জামিন সলোমন কার্সন; যদি এই নামের সঙ্গে তার মা সোনিয়া কার্সনের নাম না নেয়া হয়, তবে পুরো নামটিরও কোনো সার্থকতা নেই। সোনিয়া কার্সন ছিলেন বলেই বেঞ্জামিন কার্সন আজকের বিশ্বের একজন সফল ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের একজনে পরিণত হতে পেরেছেন। বেঞ্জামিনের সাফল্যের প্রতিটি ধাপে জুড়ে রয়েছে তার মা সোনিয়ার নাম।

দারিদ্র‍্যকে সঙ্গী করে জন্ম নেয়া সোনিয়ার জীবনের প্রথমাংশ প্রচন্ড দুঃখভারাক্রান্ত। আমেরিকার টেনেসি স্টেটে বসবাসকারী একটি অতিদরিদ্র পরিবারে জন্মান সোনিয়া, পরিবারের দারিদ্রতায় পড়াশোনাও বিশেষ কিছু করা হয়ে ওঠেনি তার। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সোনিয়ার বিয়ে হয়ে যায় এলাকার চার্চের ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার রবার্ট কার্সনের সঙ্গে। সোনিয়া ভাবেন, এবার হয়তো জীবনের মোড় ঘুরবে। কিন্তু দুঃখ যার জন্মসঙ্গী, তার দুঃখ কি আর এত সহজে ঘুঁচে? বিয়ের পরপরই তারা পাড়ি জমান ডেট্রয়েটে। তাদের কোল আলো করে জন্ম নেয় দুই সন্তান; কার্টিস ও বেঞ্জামিন।

সময়গুলো আনন্দেই কাটতে থাকে সোনিয়ার। একটা সময়ে তিনি জানতে পারেন তার স্বামী আরো একটি বিয়ে করেছে গোপনে, গোপনেই সেই পরিবারের একজন কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এই নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব, সোনিয়ার জীবনে আরো একবার নেমে আসে দুঃসহ কঠিন এক সময়। এবার পালা সিদ্ধান্ত নেবার, সোনিয়া কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের বিনিময়ে দুই সন্তান নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হতে পারে সেই ব্যাপারেও কিছু ভাবেননি তিনি।

সোনিয়া আর রবার্টের ডিভোর্সের সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটে তাদের সংসার জীবনের। রবার্ট চলে যায় তার অপর পরিবারের সাথে বসবাস করতে। সোনিয়ার সাথে থেকে যায় তার দুই সন্তান। কার্টিসের বয়স তখন ১০ আর বেঞ্জামিনের বয়স তখন ৮। আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত সোনিয়া তখন শুরু করেন এক কঠোর সংগ্রাম। পড়াশোনা না জানা সোনিয়ার জন্য যে কাজের খুব একটা সুযোগ ছিলো তা-ও না, তবু তিনি একাই লড়তে শুরু করে দিলেন তার দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে। তিনজন মানুষের খরচের ভার উঠানোর জন্য সোনিয়াকে একসাথে ২-৩টি কাজও করতে হতো, সবসময় কাজের সন্ধানও মিলতো না। যেহেতু পড়াশোনা জানা নেই, শারীরিক পরিশ্রম করা ছাড়া সোনিয়ার কাছে আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। এমনও দিন কেটেছে তাদের যে, সোনিয়াকে মানুষের বাড়ি-বাড়ি আয়ার কাজ করতে হয়েছে। প্রচন্ড শারীরিক আর মানসিক পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে গিয়েও তিনি চেয়েছেন তার দুই সন্তান যাতে ভালো একটি জীবন পায়, ভালো স্কুলে পড়তে পারে, সন্তানরা যেন কোনোদিন তাদের বাবার অভাববোধ না করে সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন সোনিয়া।

সোনিয়া নিজে পড়াশোনা করেননি, পড়াশোনার মূল্য তাই খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। সন্তানের পড়াশোনায় কখনোই তিনি ছাড় দিতেন না, যত বাধা, ঝড়-ঝঞ্ঝা এসেছে তাদের জীবনে, সোনিয়া একাই সেটি গোপনে সামলে নিয়েছেন, সন্তানদের জানতে পর্যন্ত দেননি। সবসময় তিনি চেয়েছেন, নিজে যেহেতু পড়াশোনা করেননি, সন্তানদের গড়ে তুলবেন সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে। শৈশবে তার দুই সন্তান, বিশেষ করে বেঞ্জামিনের পড়াশোনা করতে প্রচুর সমস্যা হয়েছে। বেঞ্জামিন যা-ই পড়তো, মনে রাখতে পারতো না। এই সমস্যা দূরীকরণেও সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বেঞ্জামিনের মা সোনিয়া কার্সনের।

দুই ছেলে বেঞ্জামিন আর কার্টিসের ভরণপোষণের জন্য সোনিয়া যেখানে যেখানে আশা খুঁজে পেতেন সেখানেই ধরনা দিতে এতটুকুও কার্পণ্য কিংবা লজ্জাবোধ করেননি। তার প্রধান চিন্তাই ছিলো তার দুই সন্তানের পড়াশোনা। সোনিয়ার এই কষ্টগুলোকে ভিত্তি করেই যেন দুই ছেলে বড় হয়ে ওঠে, উচ্চশিক্ষিত হয়ে ওঠে। দুঃসময়গুলো মানুষের মনে থাকে, সুখের দিন বেশিদিন মনে থাকে না। আপনি কষ্ট পেয়ে একশবার ব্যর্থ হয়ে একবার সফলকাম হয়ে দেখুন, মানুষ আপনার সফলতাকে দেখবে, কিন্তু আপনার কাছে আপনার সফলতা থেকেও দামী বস্তু হয়ে দাঁড়াবে ব্যর্থতাগুলো। সেগুলো সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।

সোনিয়া তার সন্তানদের এই শিক্ষাই দিয়েছেন, সবকিছু সম্ভব তুমি যা চাও, কষ্ট করে শুধু তোমাকে সেটা সম্ভব করতে চাইতে হবে। বেঞ্জামিন কার্সনের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়, তিনি কেন একজন চিকিৎসক হতে চাইলেন। তিনি বলেন যে, তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বোস্টন আর ডেট্রয়েটে। এই দুই শহরে তার পরিবারের কারো যদি চিকিৎসার প্রয়োজন হতো, তাহলে ঘন্টার পর ঘন্টা হাসপাতালে অপেক্ষা করতে হতো কেবলমাত্র একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে দেখাতে। অনেক সময় ধরে অপেক্ষার পর কার্সন দেখতে পেতেন যে, চিকিৎসক আর নার্সরা সবাই তাদের নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী হাসপাতালে প্রবেশ করছে, বেরিয়ে যাচ্ছে। সকলেই চিকিৎসকদেরকে ডাকতে গিয়ে নামের শুরুতে জুড়ে দিচ্ছে ‘ডক্টর’ শব্দটি। তিনি ভাবলেন, তিনিও একদিন তাদেরই মতো একজন চিকিৎসক হবেন। তার মা বিশ্বাস করেন তার দুই সন্তানকে দিয়ে সবকিছু সম্ভব। তাকেও সবাই একদিন সম্বোধন করবে ‘ডক্টর কার্সন’ বলে।

চলুন প্রবেশ করা যাক, সেই মানুষটির জীবনের গল্পে। যার হয়তো পড়াশোনা শেষ করবার পূর্বেই ঝরে যাবার কথা ছিলো, তার পরিবর্তে মানুষটি স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বের সেরা সার্জনদের মাঝে।

মা সোনিয়ার সাথে বেঞ্জামিন কার্সনের স্ত্রী ক্যান্ডি ও তাদের সন্তানাদি; Source: achievement.org

মিশিগানের ডেট্রয়েটে ১৯৫১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর সোনিয়া কার্সন ও রবার্ট কার্সনের কোল জুড়ে জন্ম নেয় একটি শিশু, যার নাম রাখা হয় বেঞ্জামিন কার্সন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন নিউরোসার্জন। পড়াশোনা করতে না পারা এক মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া বেঞ্জামিনকে শৈশবে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে পড়াশোনায় দক্ষতা তৈরি করতে। তার মা সর্বক্ষণই দুশ্চিন্তা করতেন কীভাবে আরো ভালোভাবে তার সন্তানদের পড়াশোনা করানো যায়। তিনি শুধু তাদের বলতেন, তারা যেন নিজের উপর কোনোভাবেই বিশ্বাস না হারায়। ছোটবেলায় বেন ঠিকমতো পড়তেই পারতেন না। কেবলমাত্র মায়ের চেষ্টাতেই তিনি শুধু যে পড়তে শিখেছেন কিংবা উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন তা নয়, মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিজেকে পরিচিত করে তুলেছেন জন্স হপকিন্স হাসপাতালের ‘পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জারী’ বিভাগের পরিচালক হিসেবে।

শৈশবে বেঞ্জামিনের যখন বইয়ের লেখা পড়তে সমস্যা হতো কিংবা স্কুলের পড়া পড়তে সমস্যা হতো, তার মা তখন নানাভাবে তাদের সাহায্য করবার কথা ভাবতেন। কীভাবে পড়াশোনার প্রতি আরো আগ্রহী করা যায় সেটাও দেখতেন। তাদের দুই ভাইয়েরই প্রচন্ড নেশা ছিলো টেলিভিশনের প্রতি। মা তাই তাদের টিভি দেখার সময়টাকেও সীমাবদ্ধ করে দেন।

এছাড়াও বেঞ্জামিনের মা একদিন হুট করে নিয়ম জারি করেন যে, লাইব্রেরী থেকে যেকোনো ধরনের দুইটি বই নিয়ে প্রতি এক সপ্তাহের মাঝে পড়া শেষ করে প্রতিটির উপর একটি করে লিখিত সারাংশ পেশ করতে হবে তার নিকট। ঠিক এই অভ্যাসটিই পরবর্তীতে বেঞ্জামিনের একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবারও অনুপ্রেরণা যোগায়। লাইব্রেরি থেকে নিজের খুশিমতো প্রচুর বই নিয়ে পড়েছেন তিনি। প্রথমদিকে ভালো লাগেনি, মায়ের এই নির্দয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতাই বরং করেছেন বেঞ্জামিন। কিন্তু একটা সময় তার কাছে মনে হলো এই বই পড়ার মধ্যেই তিনি একধরনের আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন।

বেঞ্জামিন তার শৈশবে কোনোকিছু কল্পনা করতে পারতেন না, কিন্তু এই বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হবার পর থেকে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তিনি প্রতিটি বইয়ের প্রধান চরিত্র হিসেবে নিজেকে কল্পনা করছেন, এই বইগুলো পড়বার মধ্য দিয়ে কল্পনার করে করে যেকোনো স্থানে তিনি চলে যাচ্ছেন, প্রবেশ করছেন বইটির লেখকের কল্পিত এক জগতে।

যে ছেলেটিকে স্কুলে সবাই জানতো ফেল করার ছাত্র হিসেবে, কেউ ফেল না করলেও বেঞ্জামিন ফেল করবে এটা নিশ্চিত ধরে নিতো সবাই- সেই ঘটনার মোড় ঘুরে গেলো। এক বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে বেঞ্জামিনের ফলাফল ভালো হতো শুরু করলো। ক্লাসের সবাইকে অবাক করে দিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে বেঞ্জামিন পুরো স্কুলের মাঝে প্রথম স্থান অধিকার করলো। এরপর আর তাকে থামায় কে? শিক্ষকদের প্রশংসা আর তার মায়ের চেষ্টাতেই তিনি হয়ে উঠতে লাগলেন অসাধারণ একজন মানুষ।

১৯৬৯ সালে মিশিগানের সাউথওয়েস্টার্ন হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশনের দিন তোলা ছবি; Source: achievement.org

এই ঘটনাগুলোর পর থেকে বেঞ্জামিনকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তার পড়াশোনা নিয়ে। তবে একজন সফল মানুষ হতে গিয়ে নানারকম বাধা এসেছে তার জীবনে। তবে তিনি ক্লান্ত হয়ে ছিটকে পড়ে যাননি, সবসময় মাতো ছিলেনই আশেপাশে। তার দৈনন্দিন জীবনে প্রধান যে সমস্যাটি তিনি উল্লেখ করেছেন সেটি হলো তার প্রচন্ড রাগ, অপছন্দের যেকোনো বিষয়েই তার প্রচন্ড রাগ হতো। হুট করে একজন মানুষের উপর রাগে ফেটে পড়তেন তিনি। সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না নিজের এই রাগকে। রাগের বশে স্কুলের একজনের মাথাও ফাটিয়েছেন তিনি একবার। তিনি তার আত্মজীবনীতে এমনটা উল্লেখ করেছেন যে, পছন্দের পোশাক কিনতে রাজী না হওয়াতে প্রচন্ড রাগে নিজের মায়ের দিকে তেড়ে যান হাতুড়ি হাতে। মা-সন্তানের মাঝে এমন সময়ও এসেছে, মনে হতে পারে যে, এই মা তার সন্তানের জন্য কতটা কষ্ট স্বীকার করেছেন, অথচ সন্তানেরা এমন ব্যবহার করে এই মায়ের সাথে। তাই বেঞ্জামিনের উপর পাঠককূলের খানিকটা ক্ষোভ তৈরি হতে পারে। রাগের বশে বেঞ্জামিন এই কাজটি হয়তো করে বসেছেন, কিন্তু সেই মুহূর্তের পরপরই তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, বুঝতে পেরেছেন কত বড় অন্যায় তিনি করেছেন। সেই অনুশোচনাই পরবর্তীতে তাকে করে তুলেছে নিজ মায়ের প্রতি অনুগত।

গল্পটি বেঞ্জামিনের সফলতার নয়, গল্পটি পুরোটাই বেঞ্জামিন ও তার মায়ের গল্প, শুরুতেই এই ব্যাপারে বলা হয়েছে।

মা আর ভাইয়ের সাথে সমস্ত সুসময়, দুঃসময় কাটিয়ে বেঞ্জামিন একটা সময় মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কুল অব মেডিসিনে ভর্তি হন আর স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি একজন নিউরোসার্জন হবেন। মেডিসিনে ভর্তি হবার পূর্বে বিনা বেতনে তিনি ‘ইয়েল’-এ পড়াশোনা করেছেন মনোবিজ্ঞান বিভাগে। সেই সময়ে লাসিনা ক্যান্ডি  রাস্টিন নামক একজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ১৯৭৫ সালে ক্যান্ডিকে বিয়ে করেন বেঞ্জামিন। স্কুল অব মেডিসিনে পড়াশোনা শেষে বেঞ্জামিনের রেসিডেন্সি হয় মেরিল্যান্ডের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৭ সালে বেঞ্জামিন ও তার স্ত্রী পাড়ি জমান মেরিল্যান্ডে। তার অসাধারণ কৃতিত্বের দরুণ, তিনি ১৯৮২ সালে জন্স হপকিন্সের প্রধান রেসিডেন্ট সার্জন হন।

স্ত্রী ক্যান্ডি কার্সনের সঙ্গে বেঞ্জামিন কার্সন; Source: pinterest.com

১৯৮৩ সালে কার্সন একটি চিঠি পান অস্ট্রেলিয়ার স্যার চার্লস গের্ডনার হাসপাতাল থেকে, হাসপাতালে একজন নিউরোসার্জনের প্রয়োজন ছিলো। তাকে সেই পদটি পূর্ণ করবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাড়ি থেকে এতদূর যাবেন না, যাবেন না করেও তিনি অবশেষে আমন্ত্রণে সাড়া দেন। পরবর্তীতে উল্লেখ করেন যে, অস্ট্রেলিয়ায় থাকা একটি বছরের অভিজ্ঞতা তার সার্জারী জীবনের সেরা কিছু অভিজ্ঞতার মাঝে একটি।

এক বছর পর ১৯৮৪ সালে তিনি আবারো ফিরে আসে জন্স হপকিন্সে, আর যোগদান করেন পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জারী বিভাগে, একজন পরিচালকরূপে। সেই সময় তার বয়স মাত্র ৩৩। আমেরিকার ইতিহাসে এমন সুযোগ পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি তিনি তখন।

অবশেষে আসে সেই মুহূর্তটি, ১৯৮৭ সালে সংঘটিত হওয়া বিখ্যাত সেই অপারেশনটি, যা বেঞ্জামিনের সুখ্যাতিকে ছড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। জার্মান এক দম্পতির দুই সন্তানের জন্ম হয়। জমজ সন্তান, সবকিছুই ঠিক আছে, জমজ সন্তানেরা জন্মগ্রহণ করেছে যুক্ত অবস্থায়। তাদের মাথার পেছনের দিক জন্মের সময় যুক্ত ছিলো। শিশুদের নিউরোসার্জারিতে কৃতিত্ব থাকায় জমজ সন্তানের বাবা-মা যোগাযোগ করে বেঞ্জামিনের সাথে। বেঞ্জামিন জার্মানিতে গিয়ে বেশ ভালোমতো শিশুদের বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি দেখতে পান, শিশু দুটির মাথা যদিও যুক্ত, কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ পৃথক। তাই তিনি তাদের পৃথক করার মাঝে আশা খুঁজে পান।

এ ধরনের অপারেশনে প্রচুর রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। সাত মাসের এই শিশু দুটির শরীরে রক্ত এমনিতেই কম, তাই অপারেশন করে পৃথক করাটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিলো। এ ধরনের অপারেশন আগে কখনো সফল হয়নি। বেঞ্জামিন জানতেন তাকে প্রথাগত নিয়ম থেকে বেরিয়ে ভিন্ন কিছু করতে হবে। তিনি সময় চেয়ে নিলেন, দীর্ঘ পড়াশোনা শুরু করলেন এ নিয়ে। প্রচুর অনুশীলন, আলোচনা আর চিন্তাভাবনা শেষে হাজির হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ; ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭। ২২ ঘন্টার দীর্ঘ অপারেশন শেষ করে বেঞ্জামিন যখন বেরিয়ে আসেন তার চোখে তখন ভিন্ন এক প্রশান্তি। এই ধরনের অপারেশন প্রথমবারের মতো সফল হয়, জমজ শিশু দুটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থাতেই পৃথক করতে সক্ষম হন বেঞ্জামিন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেঞ্জামিনের দ্বারা সম্পন্ন সমস্ত অপারেশনের সাথে সাথে উঠে আসতে শুরু করে তার শৈশব জীবন। মানুষ জানতে শুরু করে দরিদ্র এক পরিবারে জন্ম নেয়া বেঞ্জামিন যেখানে ছোটবেলায় পড়াশোনাই করতে পারতেন না ঠিকমতো, তিনি পুরো পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন অসাধ্যকে সাধন করার মধ্য দিয়ে।

বেঞ্জামিনের চিকিৎসা জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি ছিলো ২০০৩ সালে। এর পূর্বে যুক্ত থাকা দু’জন শিশুকে আলাদা করবার অনেকগুলো অপারেশন তিনি করেছেন। সফলতা আর ব্যর্থতা দুটোই ছিলো বেঞ্জামিনের হাতে। ২০০৩ সালে তার হাতে আসে পূর্ণবয়স্ক দুই ইরানিয়ান সহোদর। তারাও যুক্ত ছিলো মাথার মাধ্যমে। ২৯ বছর একসাথে যুক্ত থেকেছে তারা, শুধু যে ঘরে বসে থেকেছে তা নয়, দুজনই পড়াশোনা করেছে। তারা আইনবিভাগে স্নাতক করেছে। ২৯ বছর পর এসে দুজনেই চাচ্ছিলো পৃথক হতে। যুক্ত থাকতে যেন আর মন সায় দিচ্ছিলো না কারোই, এসব ভেবেই তারা শরণাপন্ন হয় বেঞ্জামিনের।

বেঞ্জামিন তাদের রিপোর্ট পড়ে ভালোই বুঝেছিলেন যে, এই অপারেশন সফল করা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু জমজ দুজন খুব করে চাচ্ছিলো অপারেশনটি হোক। বেঞ্জামিন তাদের ভালোমতো বুঝানোর চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু তাদের একজনের ভাষ্য ছিলো, “আর একদিনও এমন থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভালো”।

২৯ বছর বয়সী ইরানিয়ান লাদান (বাম) ও লালেহ্ (ডান) বিজানি, যাদের মাথাকে সফলভাবে পৃথক করা সম্ভব হয়নি; Source: gettyimages.com

অগত্যা বেঞ্জামিনকে রাজি হতেই হয়। ১০০ জন সার্জন, বিশেষজ্ঞ আর সহকারীর সমন্বয়ে গঠিত দল নিয়ে তিনি যান সিঙ্গাপুরে। অপারেশন চলে ৫২ ঘন্টা যাবৎ। বেঞ্জামিন তার সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাদের দুজনের কাউকেই বাঁচাতে পারেননি।

একজন অসামান্য নিউরোসার্জনের পাশাপাশি বেঞ্জামিন খুব উঁচুমানের একজন লেখকও ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি আত্মজীবনী লেখেন- ‘গিফটেড হ্যান্ডস’, যা নিয়ে পরবর্তীতে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। এছাড়াও জীবনের নানা সময়ে দ্য বিগ পিকচার, টেইক দ্য রিস্ক, থিংক বিগ- নাম্নী বেশ কিছু বই লিখেছেন।

Source: achievement.org

২০০০ সালের দিকে লাইব্রেরী অব কংগ্রেস বেঞ্জামিনকে একজন জীবন্ত কিংবদন্তী আখ্যা দেয়। স্বাস্থ্যখাতের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসে ২০১৩ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে, চিকিৎসা পেশা থেকে সম্পূর্ণরূপে অবসর গ্রহণ করবেন তিনি। সেই অনুযায়ী পুরোপুরি অবসর নিয়ে নেন বেঞ্জামিন।

২০১৪ সালের মে মাসে প্রকাশ করেন তার নিউইয়র্ক বেস্টসেলার বই ‘ওয়ান ন্যাশন’। স্বাস্থ্যসেবা থেকে অবসর গ্রহণের দুই বছর পর তিনি প্রবেশ করেন রাজনীতিতে। রিপাবলিকানের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চেয়েছিলেন বেঞ্জামিন, কিন্তু রিপাবলিকান বেছে নেয় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। পরবর্তীতে বেঞ্জামিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ভোকাল সাপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পান। ট্রাম্প সরকার বিজেতা হবার পর, ট্রাম্প তার অধীনস্থ ডিপার্টমেন্ট অব হাউজিং এন্ড আর্বান ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেন বেঞ্জামিনকে। বর্তমানে বেঞ্জামিন এই পদেই কর্মরত আছেন।

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ কার্সনকে ফোর্ডস থিয়েটার লিংকন পদক ও রাষ্ট্রপতির স্বাধীনতা পদক পরিয়ে দিচ্ছেন; Source: achievement.org

চিকিৎসাখাতে প্রত্যক্ষভাবে হয়তো আর সেবাদান করতে পারছেন না বেঞ্জামিন, কিন্তু নিজের দায়িত্বপ্রাপ্ত পদে বসে পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যখাতের জন্যেই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি কখনোই সেই রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না, রাজনৈতিকভাবে কী কী মানিয়ে কাজ করতে হবে, তিনি বিশ্বাস করতেন যা সঠিক তাই তিনি করে যাবেন, যা হবার হবে।

ভাবলে অবাক হতে হয়, একজন মানুষ, অতি দরিদ্র এক পরিবারে জন্মেছেন, পড়াশোনার সুযোগ যদিও পেয়েছেন, কিন্তু পড়াশোনা কিছুই হতো না তার দ্বারা যদি না তার মা সোনিয়া না থাকতেন এই গল্পে। সাহসী এক তরুণী এবং মা এই সোনিয়ার কৃতিত্বেই বেঞ্জামিন চলে এসেছেন এতটা দূরে, ধুঁকে ধুঁকে আসতে হয়নি, চিতাবাঘের ন্যায় দ্রুতগতিতে দৌড়ে পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শিখরে। একজীবনে মানবজাতিকে উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সব চিকিৎসাব্যবস্থা।

ফিচার ইমেজ:  sandiegouniontribune.com

Related Articles