ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের নামকরা এক লেখক চার্লস ল্যাম্ব। তিনি একাধারে লিখেছেন প্রবন্ধ, কবিতা, ফিকশন এবং নাটক। এই চিন্তাশীল ও চিত্তাকর্ষক লেখক তার কর্মসমূহের মধ্য দিয়ে রোমান্টিক যুগটি পুরোপুরিই তুলে ধরেছেন।
উল্লেখ্য, ইংরেজি সাহিত্যে ‘রোমান্টিক’ কথাটির সাথে রোমান্স বা প্রেমঘটিত কোনো বিষয় জড়িত নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইউরোপজুড়ে শিল্প, কলা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের জগতে এক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়ন শুরু হয়। এর নাম দেওয়া হয় রোমান্টিসিজম। ইউরোপের সমাজ জীবনে তখন চলছে শিল্পবিপ্লব আর মনন জগতে চলছে বোধোদয়ের যুগ (Age of Enlightenment)। এই দুয়ের মিলিত ফসল হয়ে ইংল্যান্ডের সাহিত্য জীবনে আসে রোমান্টিসিজম। অতীতপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, উচ্চ পর্যায়ের কল্পনা, বিষাদ, পলায়ন প্রবৃত্তি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয় অনুভূতি প্রভৃতি হলো রোমান্টিসিজমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ১৭৯৮ থেকে ১৮৩২ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগ ধরা হয়।
১৮২০ থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যে চার্লস ল্যাম্ব লেখক হিসেবে প্রখ্যাত হয়ে ওঠেন। এই সময়কালে লন্ডন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তার ব্যক্তিগত প্রবন্ধসমূহ সুবিবেচক ইংরেজ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই প্রবন্ধগুলো পরবর্তীতে ‘Essays of Elia’ (1823) ও ‘The Last Essays of Elia’ (1833) নামে সংকলিত হয়। ‘Elia’ ছিল ল্যাম্বের ছদ্মনাম। এই খ্যাতনামা ইংরেজ সাহিত্যিককে নিয়ে কিছু কথা জানা যাক।
১৭৭৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ল্যাম্ব জন্ম নেন লন্ডনে। তার বাবা ছিলেন জন ল্যাম্ব, আর মা এলিজাবেথ ফিল্ড। তিন ভাই-বোনের সবার ছোট ছিলেন চার্লস ল্যাম্ব। লন্ডনে আইনজীবঈদের স্বর্গ, ‘দ্য অনারেবল সোসাইটি অব ইনার টেম্পল’-এ তাদের পরিবার বাস করতো। ল্যাম্বের বাবা ছিলেন স্যামুয়েল সল্ট নামে এক ব্যারিস্টারের কর্মচারী। ল্যাম্ব পড়াশোনা করেন নিউগেট স্ট্রিটের ক্রাইস্ট’স হসপিটালে। নামে হসপিটাল হলেও এটি ছিল মূলত একটি দাতব্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে ল্যাম্বের সাথে পরিচয় হয় স্যামুয়েল টেইলর কলরিজের। কলরিজ হলেন সেই দুই ব্যক্তির একজন, যাদের হাত ধরে ইংরেজি সাহিত্য রোমান্টিক যুগে প্রবেশ করে; অপরজন হলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। কলরিজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মিলিত প্রয়াসে ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত হয় “Lyrical Ballads”। এটি প্রকাশের মধ্য দিয়েই ইংরেজি সাহিত্য প্রবেশ করে রোমান্টিক যুগে। ল্যাম্বের কাব্যপ্রতিভার উন্মেষে কলরিজ যথেষ্ট প্রভাব রাখেন। বাকি জীবন তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েই ছিলেন।
ছাপার হরফে ল্যাম্বের প্রথম আত্মপ্রকাশ হয় কলরিজ ও চার্লস লয়েডের লেখার সংকলন ‘A Tale of Rosamund Gray’ লেখাটির মাধ্যমে। সে ছিল ১৭৯৮ সাল। এরপর ১৮০২ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘John Woodvil’। ল্যাম্ব ও তার বোন মিলে ১৮০৭ সালে ‘Tales from Shakespeare’ এবং ১৮০৯ সালে ‘Mrs. Leicester’s School’ নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশ করেন। ১৮০৮-এ ল্যাম্ব মহাকাব্য ‘ওডিসি’র শিশুদের সংস্করণ ‘The Adventure of Ulysses’ প্রকাশ করেন।
চার্লস ল্যাম্বের সবচেয়ে বড় চমক ছিল ‘ইলিয়া’ ছদ্মনামে ‘লন্ডন ম্যাগাজিনে’ লেখা তার পত্র ও প্রবন্ধগুলো। তার লেখার ধরন ছিল সহজ, কিন্তু মোটেই সাধারণ নয়। লেখাগুলোয় ছিল আত্মজীবনীমূলক উপাদান। কখনো রসবোধে, কখনো বিষাদে এগুলো ফুটিয়ে তুলতো অতীত জীবনের সুখ-ব্যথা, চেনা মানুষগুলোর কথা আর বাল্যস্মৃতি। নিজের কল্পনা আর পরিহাসপ্রিয়তা দিয়ে ঠিক নিজের একটা আলাদা লেখার ধরন তৈরি করে নিয়েছিলেন ল্যাম্ব। আপাতদৃষ্টিতে ক্রীড়ামোদীসুলভ মনে হলেও ল্যাম্বের এসব লেখা রোমান্টিসিজমের অন্যতম উৎকৃষ্ট উৎপাদ বলে বিবেচিত হতে পারে।
ল্যাম্বের প্রথমদিকে লেখা সনেট ‘Innocence’ প্রখ্যাত ফরাসি সমালোচক চার্লস অগাস্টিন সেইন্ট বুভের এত ভালো লাগে যে তিনি সেটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেন। তবে বেশিরভাগ সমালোচকের মতেই ল্যাম্বের গদ্যসাহিত্যের মতোই তার কাব্যসাহিত্যেরও যথেষ্ট উষ্ণতা ও ছন্দের দরকার ছিল। আবার এর বিপরীত চিন্তাধারার মানুষও ছিলেন। ল্যাম্বের সমসাময়িক অ্যালারিক এ ওয়াটসের ভাষ্যমতে, ল্যাম্বের গদ্যগুলোই যথেষ্ট ছন্দময়, সুতরাং আমরা তার ছন্দ থেকে বঞ্চিত হইনি। ল্যাম্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্ম হলো Blank-verse বা অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে কাজগুলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তার হৃদয়ছোঁয়া কবিতা “The Old Familiar Faces” এর কথা-
“Ghost-like I paced round the haunts of my childhood.
Earth seemed a desert I was bound to traverse,
Seeking to find the old familiar faces.”
“ভুতের মতো ঘুরে ফিরেছি আমার শৈশবের আস্তানাগুলোয়।
পৃথিবী যেন এক ধূ ধূ মরু যাকে ডিঙোতে আমি বাধ্য,
পুরোনো চেনা মুখগুলোর খোঁজে।”
কী গভীর বেদনাবোধ থেকে লাইনগুলোর উৎসারণ তা বুঝতে পাঠকের বেগ পেতে হয় না।
১৭৯১ সালে ল্যাম্ব সাউথ সি হাউস (South Sea House) নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। কয়েক মাস পরেই সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কেরানী হিসেবে যোগদান করেন। এখানেই তিনি পরবর্তী তেত্রিশটি বছর কাজ করেন। ব্যবসা, হিসাব-নিকাশ এসবে আগ্রহ তার কখনোই ছিল না। কিন্তু কবিদেরও তো পেট চালাতে হয়।
১৭৯৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, এক বৃহস্পতিবারের দিনে ল্যাম্বের জীবনে এক চরম বজ্রাঘাত হয়। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে তিনি দেখেন তার বড় বোন মেরি আকস্মিক পাগলামির শিকার হয়ে তার মাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ফেলেছে, আর তার বাবার মাথায় কাঁটাচামচ ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। বিচারে মেরি অসুস্থ প্রমাণিত হন। তবে তাকে আজীবন পাগলা গারদে রাখার সিদ্ধান্ত থেকে বাঁচান ল্যাম্ব। নিজেই তার দেখভাল করার দায়িত্ব নেন। বাকি জীবন অসহায় মেরিকে ছোট ভাই ল্যাম্বই আগলে রেখেছেন।
ল্যাম্ব প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন অ্যান সিমন্স নামে এক মেয়ের। হার্টফোর্ডশায়ারের ব্লেক্সওয়্যারে ল্যাম্বদের গ্রামের বাড়ি ছিল। স্কুলের দিনগুলোতে সেখানে ল্যাম্ব তার দাদীর কাছে ছুটি কাটাতে যেতেন। এখানেই তিনি অ্যানের দেখা পান ও প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। এই প্রত্যাখ্যানের আঘাত সহ্য করতে না পেরে ল্যাম্ব মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দেখা দেয়। আসলে পাগলামিটা সম্ভবত তার বংশগত ছিল।
উদভ্রান্ত ল্যাম্ব ১৭৯৫ সালে ছয়টি সপ্তাহ পাগলাগারদেও কাটান। এই অ্যানকে নিয়ে ল্যাম্ব ‘অ্যানা’ নামে একটি সনেট সংকলন লেখেন। ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত ল্যাম্বের উপন্যাস ‘A Tale of Rosamund Gray’ এর কাহিনীও তার জীবনের অ্যান পর্ব দ্বারা প্রভাবিত। ল্যাম্ব দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েন ১৮১৯ সালে। এবারের নারীটি ছিলেন ফ্যানি কেলি নামে এক অভিনেত্রী। ফ্যানি ল্যাম্বের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, কিন্তু তারা বন্ধু হয়ে ছিলেন। হয়তো ল্যাম্বের মানসিকভাবে অসুস্থ বোনের সংসারে ফ্যানির নিজেকে মানিয়ে নেয়াটা সম্ভব ছিল না।
ল্যাম্ব তার পুরোটা জীবন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদোন্নতিবিহীন, বৈচিত্রহীন চাকরিতেই কাটিয়ে দিয়েছেন। ১৮২৫ সালে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর সঞ্চয়হীন ল্যাম্ব পড়লেন অথৈ জলে। এদিকে মেরির পাগলামিটাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। নিঃসহায়, নিঃসঙ্গ ল্যাম্ব কোনোদিকে দিশা খুঁজে না পেয়ে শেষে মদে ডুব দিলেন। মদের নেশায় তীক্ষ্ণ কষ্টের অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করার চেষ্টা করলেন। ১৮৩৪ এর জুলাইয়ে কলরিজ দেহত্যাগ করেন। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকার শেষ উপলক্ষটাও বোধহয় হারিয়ে ফেলেন ল্যাম্ব। একই বছর ২৭ ডিসেম্বর অ্যারিসিপেলাস নামক একধরনের ত্বকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ল্যাম্ব পরলোকগমন করেন।
চিরদুঃখী চার্লস ল্যাম্ব জীবনটাকে যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে কখনো পাননি, নিজের অনুভূতিগুলো তাই ছদ্মবেশে সাজিয়ে গেছেন সাহিত্যে। কালের ক্লিষ্টতায় জরাজীর্ণ একজন ল্যাম্ব রেখে গেছেন ছাপ মহাকালে, অন্তহীন অমরত্বে।