মহাকবি দান্তে আলিগিয়েরি: চির নির্বাসনে থাকা এক কিংবদন্তী

অনেক সময় লেখকের চেয়ে লেখকের কৃতকর্ম বেশি খ্যাতি পেয়ে যায়। যেমন ধরুন সারাবিশ্বে যত মানুষ মহাভারত বা রামায়নের নাম জানেন ততটা হয়ত ব্যাসদেব বা বাল্মীকির নাম জানেন না। দান্তে আলিগিয়েরির ক্ষেত্রে কোনটা ঘটেছে তা অনুমান করা বেশ মুশকিল। সারা বিশ্বে ব্যক্তি দান্তে আলিগিয়েরি বেশি বিখ্যাত নাকি তার অমর কীর্তি ‘ডিভাইন কমেডি’ বেশি বিখ্যাত? বিখ্যাত যিনিই বেশি হোক না কেন, কৃতিত্ব তো লেখক আলিগিয়েরিরই! আর এই মহান লেখকের জন্মে হয়েছিল ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। শহরটি এখনো টিকে আছে সগর্বে। বর্তমানে ফ্লোরেন্স ইতালির খুবই বিখ্যাত একটি শহর। ইউরোপে যে রেনেসাঁ বা সভ্যতার পুনর্জন্ম হয়েছিল তা প্রধানত এ ফ্লোরেন্সকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা ইতালিতে। তারপর ধীরে ধীরো সমগ্র ইউরোপে। মূলত দান্তের হাত ধরেই ইতালির সাহিত্যভাণ্ডার সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

দান্তে আলিগিয়েরি; image source : wikimedia.org

ইতালির মানচিত্রটি দেখতে বেশ মজার, অনেকটা পুলিশের বুটজুতোর মতো। দু’পাশ আর পায়ের নিচে সব সাগর, উপরটা ছুঁয়ে আছে আল্পস পর্বতমালা সংলগ্ন ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও স্লোভেনিয়া। আর এই বুটজুতোর ঠিক মধ্যখানে দান্তের জন্মস্থান ফ্লোরেন্স নগরী। অার্নো নদীর তীরে গড়ে ওঠা বেশ পুরনো শহর। সম্ভবত দান্তের কারণেই শহরটি পেয়েছে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি।

ইতালির মানচিত্র; image source : Pinterest

ফ্লোরেন্সের এক অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করেন দান্তে। তার জন্মদিন নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। ফলে সুনির্দিষ্ট জন্মদিন ধার্য করা কিছুটা মুশকিল, তবে ১২৬৫ সালের ১৮ই মে থেকে ১৭ই জুনের মধ্যকার কোনো একটি তারিখে তার জন্ম বলে অনুমান করা যায়। তার প্রপিতামহ ছিলেন কাচ্চাগুইদা, যিনি বৃদ্ধ বয়সে সম্রাট তৃতীয় কোররাদোর কাছ থেকে ‘মিলিৎসা’ বা নাইটহুড বা উপাধি পেয়েছিলেন। কাচ্চাগুইদা থাকতেন ফ্লোরেন্সের পুরনো বাজার এলাকায়। কিন্তু কাচ্চাগুইদার মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা সান মার্তিনো দেল ভেস্কোভো নামক ভিন্ন এক এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন।

দান্তের জন্ম এই মার্তিনো দেল ভেস্কোভোতেই। যে ঘরে তিনি জন্মলাভ করেছিলেন সেটি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। তার পিতার নাম ছিল আলিয়াগিয়েরো, আর মাতার নাম ছিল বেল্লা। পিতামহের নাম ছিল বেল্লিনচোন, আর মাতামহের নাম ছিল দুরান্তে। অনেক গবেষকের ধারণা, মাতামহ দুরান্তের নাম অনুসারেই দান্তে আলিগিয়েরির নামের একাংশ ‘দান্তে’ অংশটি চয়ন করা হয়েছিল। অপর অংশটি চয়ন করা হয়েছিল পিতা আলিয়াগিয়েরোর নামানুসারে। যদি এই অনুমান সঠিক হিসাবে ধরে নেয়া হয় তবে দান্তের নামের মধ্যে তার বাবা ও নানার নামের সুরভী মিশে আছে।

দান্তের একটি ভাস্কর্য; image source : wikimedia.org

দান্তের বাবা দুটি বিয়ে করেছিলেন, তার প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান ছিলেন মহাকবি দান্তে আলিগিয়েরি। তিনি যখন মাত্র ছয় বছরের বালক তখন তার মা মারা যান। তারপর থেকে সৎ মা লাপার কাছে তিনি লালিত হন। আঠারো বছর বয়সে তার বাবা আলিয়াগিয়েরো মারা যান। দান্তের সৎ ভাই ছিলেন একজন, নাম ফ্রাঞ্চেস্কো। আর সৎ বোন ছিলেন দুজন। এক বোনের নাম গাইতানা, যদিও তার ডাকনাম ছিল তানা। আর অন্য বোনের নাম সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে তিনি লেওন পোজ্জি নামে এক ভদ্রলোকের স্ত্রী ছিলেন। এদেরই ছেলে আন্দ্রেয়া দেখতে অবিকল তার মামা দান্তের মতো ছিলেন।

বংশপরম্পরা বিবেচনায় ফ্লোরেন্সে দান্তের পরিবার ছিল বেশ পুরনো। তবে আগে থেকেই তাদের পরিবারটি অভিজাত বা সম্ভ্রান্ত বলে গণ্য হতো কিনা তাতে কিছুটা সন্দেহ থেকে যায়। এমনও হতে পারে যে, প্রপিতামহ কাচ্চাগুইদা যখন থেকে খেতাব পেলেন, তখন থেকে তার পরিবার অভিজাত হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। তাছাড়া এই অভিজাত ভাব দান্তের সময়ে এসে ফের কমে গিয়েছিল, অর্থাৎ তার সময়ে তাদের পরিবারের অবস্থা হয়ে পড়েছিল ‘গরীব অথচ অভিজাত’ বংশের মতো। দান্তের পরিবারের এই সামাজিক অবস্থাটা আমাদের একটু খেয়াল রাখা দরকার, কারণ দান্তের জন্মের সময়ে ফ্লোরেন্সের অবস্থার সঙ্গে তার সুদূরপ্রসারীদের একটা সম্পর্ক রয়েছে।

দান্তে আলিগিয়েরি; image source : tocatch.info

ফ্লোরেন্স সে সময়ে ইতালির একটি শহর হলেও কার্যত এটি ছিল একটি স্বাধীন দেশের মতোই ক্ষমতাধর। মধ্যযুগে ইউরোপের অন্যান্য শহরগুলোও স্বাধীন দেশের মতোই ক্ষমতাধর ছিল। এখন যেমন এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের শত্রুতার বা মৈত্রীর সম্পর্ক থাকে, সে সময়ে তেমনি একই দেশের ভিতরে এক শহরের সঙ্গে অন্য শহরের বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্ক থাকতো। পাশাপাশি শহরের শাসনভার নিয়ে বিভিন্ন ধনী ও অভিজাত পরিবারের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। যা-ই হোক, দান্তের জন্মের সময়ে ফ্লোরেন্সের লোকজন প্রধানত দুটো দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কেউ গুয়েলফো পার্টি করতো আর কেউ গিবেল্লিনো পার্টি। অর্থাৎ দুটো প্রধান রাজনৈতিক দলে শহরটি জনগণ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগীতা আর ক্ষমতার লড়াই লেগেই থাকতো।

সাধারণত গুয়েলফো পার্টিতে যেত গরীব অথচ অভিজাত এমন পরিবারের লোকজন। আর গিবেল্লিনো পার্টিতে যেত ধনাঢ্য, জমিদার ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদী লোকজন। স্বভাবতই দান্তে যোগ দিয়েছিল গুয়েলফো পার্টিতে। ফলে তিনি সারা জীবন গিবেল্লিনো দলের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তখন শুধু ফ্লোরেন্স নয়, ইতালির অন্যান্য শহরও ভাগ হয়ে গিয়েছিল এ দুটো দলে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। গুয়েলফো পার্টির ভিতরেও ছিল দুটি ভাগ- শ্বেত গুয়েলফো ও কৃষ্ণ গুয়েলফো। দান্তে ছিলেন শ্বেত গুয়েলফো। আর এই রাজনীতিই কাল হয়ে দাঁড়ালো তার জন্য।

বর্তমান ফ্লোরেন্স শহর; image source : handluggageonly.co.uk

দান্তে যখন কবিতা লেখা শুরু করলেন তখন প্রধানত প্রেমের কবিতাই লিখতেন। তার প্রথম কবিতার বই ‘লা ভিতা নুওভা’। এটি মূলত একত্রিশটি কবিতার সংকলন। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১২৯২ বা ১২৯৩ সালের দিকে। তার এই প্রথম বইটিই প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। আর তার সর্বশেষ জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’। এটির মূল নাম ছিল ‘লা কোম্মেদিয়া’। বইটি মূলত লেখা হয়েছিল ফ্লোরেন্সের স্থানীয় ভেনেশিয়ান ভাষায়। বইটি তিন খন্ডে বিভক্ত। এতে তৎকালীন চার্চের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সমসাময়িক রাজনীতির ব্যাঙ্গাত্মক রূপ তুলে ধরা হয়েছে।

কাব্যরচনায় তার গুরু ছিলেন কবি গুইদো গুইনেৎসেল্লি। আর তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন আরেক কবি গুইদো কাভালকান্তি। কাভালকান্তিকেই তিনি তার প্রথম গ্রন্থ ‘লা ভিতা নুওভা’ উৎসর্গ করেছিলেন। এছাড়াও তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইল কনভিভিও, দে ভুলগারি এলোকুয়েন্তিয়া, দে মনার্কিয়া, অন মোনার্কি ইকলোইউজে, রিমি, অপেরি, দ্য পোর্টেব্‌ল দান্তে, দান্তে’স লিরিক পোয়েট্রি ইত্যাদি।

‘লা ভিতা নুওভা’ চিত্রায়নের একটি দৃশ্য;  image source : wikimedia.org

কবি দান্তে শুধু কাব্যচিন্তা ও কবিতা রচনাতেই মগ্ন ছিলেন না। তিনি একজন বিশিষ্ট নাগরিকও হয়ে উঠেছিলেন। নগর শাসন পরিষদে নির্বাচনের জন্য যেসব বিজ্ঞ ব্যক্তিকে ডাকা হত তিনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। ধারণা করা হয়, পৌরসভার পরিচালকমণ্ডলীর সদস্যও ছিলেন তিনি। এমনকি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেছিলেন একবার। রাজনীতিতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন তিরিশ বছর বয়সে।

‘ডিভাইন কমেডি’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ;  image source : Pinterest

তখনকার রাজনৈতিক সময়টা খুব একটা ভালো ছিল না ফ্লোরেন্সের জন্য। নানা ধরনের রাজনৈতিক অরাজকতা এবং সামাজিক অস্থিরতা চলছিল শহরজুড়ে। বিশেষ করে রোমের পোপ আর ফ্লোরেন্স নগরবাসীদের ভেতর ক্ষমতার লড়াই নিয়ে পরিবেশ বেশ গরম হয়ে উঠেছিল। দান্তে ছিলেন পোপের অন্যায় কাজকর্মের একজন কড়া সমালোচক। এমতাবস্থায় দান্তের সাথে পোপের এক ধরনের সমঝোতার জন্য সবাই দান্তেকে রোমে পাঠায়। এদিকে এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই দান্তের চোখের আড়ালে ফ্লোরেন্সের ক্ষমতার রদবদল ঘটে যায়। ঘটনাটি ঘটে মূলত পোপের গোপন ইশারায়।

ইতিমধ্যে রাজনীতির নানা হিসাব নিকেশের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ গুয়েলফো পার্টি শ্বেত গুয়েলফো পার্টির চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এমন ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে নানা অজুহাত দেখিয়ে দান্তেকে রোমে আটক করে রাখে পোপ। ওদিকে ফ্লোরেন্সে তার বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ঘটনা সেখানেই শেষ নয়। উল্টো উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়। দান্তের অনুপস্থিতিতেই তার অজ্ঞাতসারে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিচার করা হয় এবং রায়ও দিয়ে দেওয়া হয়। রায়ে শাস্তি ধার্য হয়, তাকে পাঁচ হাজার ফ্লোরিন জরিমানা দিতে হবে ও আগামী দুই বছর ফ্লোরেন্স শহরে তিনি ঢুকতে পারবেন না, অর্থাৎ দুই বছরের নির্বাসন দণ্ড এবং বাকি জীবনে আর কোনো দিন রাজনীতি করতে পারবেন না। ১৩০২ সালের ২৭ জানুয়ারি দান্তের বিরুদ্ধে এই রায় দেওয়া হয়।

কিন্তু দান্তে এই বিচার বা রায় কোনোটাই মেনে নেননি। ফলে ক্ষমাপ্রার্থনা কিংবা জরিমানা দেওয়া- এসবের কিছুই করেননি তিনি। ফলে দুই মাস পর তথা ১০ মার্চ পুনরায় রায় দেওয়া হয় যে, দুই বছর নয়, আর কোনোদিনই দান্তে ফ্লোরেন্সে ফিরতে পারবেন না, অর্থাৎ আজীবন নির্বাসন। তবুও যদি ফেরার চেষ্টা করেন তাহলে শহরের সীমানায় ঢুকতেই তাকে ধরা হবে এবং জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে। এর পরের বছর এই রায়ের সঙ্গে আরও যুক্ত করা হয় তার ছেলেদের বয়স যখন চৌদ্দ বছর হবে তখন তারাও শহর থেকে নির্বাসিত হবে।

দান্তে আলিগিয়েরি; image source : American Eldritch

এভাবেই দান্তের ভাগ্যে নেমে আসলো অন্ধকার, যদিও এর বারো বছর পর ১৩১৫ সালে তার কাছে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, যদি তিনি অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা করলে তাহলে তার জন্য শহরে ফেরার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু এর জবাবে দান্তে চমৎকার একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি লেখেন,

“প্রায় পনের বছর নির্বাসন সইবার পর দান্তে আলিগিয়েরিকে তার জন্মভূমিকে ফিরিয়ে নেবার জন্য এটা কি কোনো একটা উদার আহ্বান হলো? যে লোক সবসময়ে ন্যায়ের জন্য লড়াই করলো আর যার ওপর কেবলই অন্যায় করা হচ্ছে, এটাই কি তার প্রাপ্য? যারা অন্যায় করেছে তাদেরকেই ফের টাকা দিতে হবে? না, এভাবে আমি আমার নিজের দেশে ফিরতে চাই না। এ ছাড়া ফিরবার যদি কোনো পথ না থাকে তো আমি ফ্লোরেন্সে ফিরবো না। তাতে কী! যেখানেই থাকি না কেন আমার চোখে কি সূর্য-তারার আলো থাকবে না? এই আকাশের নিচে যেকোনো মাটিতে আমি কি সত্যের ধ্যান করতে পারব না? তবে? তা হলে কিসের জন্য ফ্লোরেন্স আর ফ্লোরেন্সবাসীর কাছে মানসম্মান-খ্যাতি সব বিসর্জন দিয়ে আমার দেশে ফিরতে হবে? রুটির অভাব কোথাও ঘটবে বলে আমার মনে হয় না।”

দান্তের রচনায় নরকের রূপকল্প; image source : Hesed.info

দান্তের এমন সিদ্ধান্তের ফলে পূর্বের ঘোষণা অনুসারে তার সন্তানদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে। শুধু রায় নয়, বলা হলো দান্তে যেহেতু দেশে নেই সেজন্য কালবিলম্ব না করে ছেলে দুটির গর্দান নেওয়া হোক। কিন্তু তার সন্তানদের সৌভাগ্য বলতে হবে যে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা পালিয়ে বাবার কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়।

চির নির্বাসন থেকে দান্তে আর কখনোই তার জন্মশহর ফ্লোরেন্সে ফিরে যেতে পারেননি। বিশ বছরের নির্বাসিত জীবন তাকে কাটাতে হয়েছিল বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে। ত্রেভিজো, লুচ্চা, পাদুয়া, ভেরোনো, রাভেন্না, তাসকানি, ভেনিস, মিলান প্রভৃতি জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময়ে জীবিকার জন্য নানা ধরনের কাজ তাকে করতে হয়েছে- ছাত্র পড়ানো, অলঙ্কারশাস্ত্র সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়া, দানশীল ধনাঢ্য জমিদারদের মজলিস অলঙ্কৃত করা ইত্যাদি।

দান্তে কখনো বিত্তশালী হতে পারেননি, তবে এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি তার নিজের চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কখনো বিশুদ্ধ কবিতায়, কখনো গুরুগম্ভীর প্রবন্ধে। লিখেছেন প্রেম, দর্শন, সাহিত্য, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে।

ভেরোনা শহরে দান্তে; image source : wikimedia.org

‘লা কোম্মেদিয়া’ বা ‘ডিভাইন কমেডি’ রচনার পর তিনি খুব বেশি দিন বাঁচেননি। ১৩২০ সালে তাকে ভেরোনা শহরে যেতে হয়েছিল পদার্থবিদ্যার ওপর একটি বক্তৃতা প্রদানের জন্য। ভেরোনা থেকে রাভেন্নায় তিনি ফিরেছিলেন। শেষ দুই বছর তিনি রাভেন্নাতেই ছিলেন। রাভেন্নাতেই তার মৃত্যু হয়। ১৩২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার পর ফ্লোরেন্সের অধিবাসীরা ক্রমে ক্রমে বুঝতে পেরেছিল কাকে তারা অনাদরে ও অবহেলায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। গভীর অনুশোচনায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা রাভেন্না শহরের কাছে আবেদন জানায়- মহাকবি দান্তের পবিত্র কবর তাদের ফেরৎ দেওয়ার জন্য, তারা নিজেদের সন্তানকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে সমাহিত করবে। কিন্তু তাদের আবেদন রাভেন্না কখনই গ্রাহ্য করেনি। দান্তে এখনো শুয়ে আছেন দুঃখ দিনের আশ্রয়স্থল রাভেন্নায়। দান্তে চলে গেলেও এখনো স্বমহিমায় জীবন্ত তার সাহিত্যভাণ্ডার, বিশেষত তার অমর কীর্তি ‘ডিভাইন কমেডি’।

রাভেন্নাতে অবস্থিত দান্তের কবর; image source : wikimedia.org

ফিচার ইমেজ: উইকিমিডিয়া 

সূত্র
১। দান্তে রচনাসমগ্র, অনুবাদঃ সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ, তুলি-কলম প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৭৭
২। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ সাহিত্যিক, হায়াৎ মামুদ, সাহিত্য প্রকাশ, নভেম্বর ২০০৭

Related Articles

Exit mobile version