এখন বলিউড পাড়া সঞ্জয় দত্তের জীবনের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র সঞ্জু নিয়ে মেতে আছে। রিলিজের পর থেকেই এই পর্যন্ত এই চলচ্চিত্রটি কামিয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি রুপি! বিখ্যাত পরিচালক রাজকুমার হিরানি আজ থেকে ১৫ বছর আগে সঞ্জয় দত্তেরই মাধ্যমে বলিউডের আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন- মুন্না ভাই এমবিবিএস।
চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত সবাই এটিকে একটি সুখকর, পারিবারিক, ভালো মানের চলচ্চিত্র হিসেবে বলে এসেছে। কিন্তু খুব কম উঠে এসেছে এর নেপথ্যের গল্পটি।
মুন্না ভাই কাল্পনিক চরিত্র হলেও রাজকুমার হিরানি কিন্তু মুন্না ভাই চরিত্রের স্বপ্নদ্রষ্টা নন। মুন্না ভাই চরিত্রটি যার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে তিনি ড. হান্টার অ্যাডামস ওরফে প্যাচ অ্যাডামস।
প্যাচ অ্যাডামস কে?
প্যাচ অ্যাডামসের জন্ম ১৯৪৫ সালে ওয়াশিংটনে। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিজ্ঞানের ভক্ত ছিলেন। তিনি তার জীবনীতে বলেন, “আগে আমি এমন কিছুই বিশ্বাস করতে পারতাম না যা বিজ্ঞান সমর্থন করে না। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে শিখি যে এমন কিছু আছে পৃথিবীতে যা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে অক্ষম”। তার বাবা রবার্ট লরিজ অ্যাডামস যুক্তরাষ্ট্রে সেনা কর্মকর্তা ছিলেন এবং ১৯৫০ এর কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
অ্যাডামস ছোটবেলা থেকেই অরাজকতা, অনিয়ম সহ্য করতেন না। বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থাকায় তিনি ঠিক করলেন বড় হয়ে চিকিৎসক হবেন। কোরিয়ান যুদ্ধ থেকে ফেরত আসার পর তার বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। প্যাচ তার সবই দেখতে পান। বাবার মানসিক অবসাদ, চারপাশের চিকিৎসার নামে চলা ব্যবসা দেখে তিনি মর্মাহত হন।
এভাবেই মাত্র ৯ বছর বয়সে অ্যাডামস তার বাবাকে হারান। যেখানেই তিনি অরাজকতা দেখতেন, প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতেন। এটিই কাল হলো তার। সবার সমালোচনা তাকে পেয়ে বসল। ১৮ বছরের যুবক একই বছরের মধ্যে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। তিনবার ভর্তি হলেন হাসপাতালে।
তার অবসাদ দেখে মায়ের পরামর্শেই ভর্তি হলেন ভার্জিনিয়ার একটি মানসিক হাসপাতালে। মানসিক হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, শুধু ওষুধ বা চিকিৎসা একজন মানুষকে সুস্থ করতে পারে না; বরং দরকার পড়ে ভালোবাসা ও বিশ্বাসের। সেখানেই তিনি উপলব্ধি করলেন তিনি মানুষকে সাহায্য করতে অনেক ভালোবাসেন।
ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা অনেক আগেই ছিল। কিন্তু হতাশা তাকে পেয়ে বসেছিল। সে সময়ে তিনি ভাবলেন, নিজেকে মেরে কোনো লাভ নেই; এই অবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে।
১৯ বছরের, সদ্য হতাশায় ভোগা কিশোর হান্টার অ্যাডামস সিন্ধান্ত নিলেন তিনি একজন বিনামূল্যের চিকিৎসক হবেন। আমেরিকায় সবচেয়ে ব্যয়বহুল যে ‘সেবা’ সেটিকে তিনি বিনামূল্যে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
“I am a Doctor Working for Social Change” – Patch Adams
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৯৬৭ সালে তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনে স্নাতকে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র হলেও পড়ালেখায় তেমন সময় ‘নষ্ট’ করতেন না অ্যাডামস। তিনি তার মেডিকেল স্কুলের পড়ানোর কায়দায় খুব নাখোশ ছিলেন। মেডিকেল স্কুলে তাদের শেখানো হতো কী করে ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে সবসময় একটি পেশাদারী দেয়াল থাকতে হবে। ডাক্তারদের কড়াভাবে নিষেধ করা হতো তারা যেন কোনোভাবেই রোগীর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে না তোলেন।
অন্যদিকে অ্যাডামস বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যতীত ডাক্তার আর রোগীর কোনো সম্পর্ক হতে পারে না। তিনি তার বই হাউজ কলস– এ বলেন, তার জীবনে তিনি ৬টি আদর্শ মেনে চলেন-
…to be happy, funny, creative, cooperative and thoughtful
জীবনের সেই সময় থেকে আজ অবধি তিনি এই ৬টি আদর্শ মেনেই চলে এসেছেন। তিনি বলেন, আমাদের শরীরের প্রতিটি অসুখের সাথে আমাদের মানসিক অবস্থার এক গভীর সম্পর্ক আছে। মেডিকেল স্কুলের ডাক্তাররা তাকে শেখান, সুস্থ থাকা মানে ‘রোগের অনুপস্থিতি’; যার রোগ বালাই নেই তাকেই স্বাস্থ্যবান বলে। কিন্তু অ্যাডামস বলেন, একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী বা প্যারালাইজড রোগীকেও সুস্থ বলা যায়। শর্ত থাকে, সেই রোগীর মানসিক অবস্থা যেন সুস্থ থাকে। তিনি সবাইকে পরামর্শ দেন সবসময় যেকোনো রোগের ভালো দিকটি দেখতে। হয়তো আপনার এমন রোগ আছে যার জন্য আপনি হাঁটাচলা করতে পারবেন না; ভেঙে না পড়ে এই সুযোগকে কাজে লাগান ঐসব কাজ করতে যা আপনি এতদিন ধরে ব্যস্ততার জন্য পারছিলেন না!
তিনি একজন স্বনামধন্য এম ডি (ডক্টর অব মেডিসিন) ডিগ্রীধারী হলেও ওষুধের ক্ষমতায় বিশ্বাসী না। তিনি যে ধরনের ওষুধ দেন রোগীকে তাকে বলা হয় অলটারনেটিভ মেডিসিন। অলটারনেটিভ মেডিসিন বলতে ঐসব চিকিৎসা পদ্ধতিকে বোঝায় যা বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং যাদের কার্যকারিতা উপলব্ধি করা যায় না। অনেকটা ঝাড়ফুঁকের মতো! অলটারনেটিভ বা বিকল্প এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর ভিত্তি থাকে ধর্মীয় বিশ্বাস, লোককথা বা অনেক সময় স্রেফ কুসংস্কার।
তার মানে এই না যে অ্যাডামস তার রোগীদের একেবারেই ওষুধ দেন না! কিন্তু তিনি ওষুধ এবং বর্তমানের যে গৎবাঁধা চিকিৎসা পদ্ধতি আছে তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন রোগীদেরকে একটি কমিউনিটি বা দলের অন্তর্ভুক্ত করাকে। তিনি বলেন, তিনি এমন একজন ডাক্তার যিনি সমাজ পরিবর্তন করতে চান।
গাজেনঢাইট ইন্সটিটিউট: রুপকথার হাসপাতাল
প্যাচ অ্যাডামস শুধু চিকিৎসা পদ্ধতির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেই বসে ছিলেন না। ১৯৭১ সালে মাত্র ২০ জন ডাক্তার নিয়ে তিনি একটি হাসপাতাল তৈরি করেন। নাম দেন গাজেনঢাইট! –একটি জার্মান প্রবাদ। এটি প্যাচ অ্যাডামসের স্বপ্নের হাসপাতাল। এটি পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত ছোট একটি বাড়ি।
প্যাচ বলেন, একজন রোগীর স্বাস্থ্য তার পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনো ভালো করা যাবে না। অথচ আমাদের হাসপাতালের নিয়মই হলো রোগীকে একঘরে করে দেয়া। আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীরা হাসপাতালকে ভয় পায়, অস্বস্তিবোধ করে। প্যাচের গাজেনঢাইটে রোগী এবং ডাক্তাররা বন্ধুর মতো একটি ছাদের নিচে থাকেন এবং সেখানেই সবাই ডাক্তার, আবার সবাই রোগী!
গাজেনঢাইট ইন্সটিটিউটের বৈশিষ্ট্য-
· চিকিৎসা সেবা সম্পূর্ণ ফ্রি।
· কোনো আমলাতান্ত্রিক শ্রেণীকাঠামো নেই। ডাক্তার, নার্স এবং ঝাড়ুদারের বেতন একই, মাসে ৩০০ ডলার করে।
· তারা কোনো জীবন বীমা গ্রহণ করেন না। এবং ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো লাইসেন্স রাখেন না। কারণ তারা মনে করেন ডাক্তাররাও ভুল করতে পারে। ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্ক যেন কোনো ব্যবসা কেন্দ্রিক লেনদেনের রূপ না নেয় তাই এই নিয়ম।
· হাসপাতালের কর্মচারীরা ইন্সটিটিউটেই বসবাস করেন এবং তাদেরও দেখাশোনা করতে পারে সেখানে থাকতে আসা রোগীরা
· প্রতিটি রোগীকে তাঁরা ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা যাবত পর্যবেক্ষণ করেন! অবশ্যই তাদের সাথে একটি ব্যক্তিগত, বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলেন
· রোগীকে সুস্থ করার জন্য ভালোবাসা, বিশ্বাস ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধপাতির ব্যবহারও তাঁরা করেন। যদিও খুব সামান্য।
বিশ্বাস হয় যে এমন একটি হাসপাতাল থাকাও সম্ভব? প্যাচ অ্যাডামস মনে করেন যে, এটি শুধু সম্ভবই না; বরং প্রয়োজনও। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত গাজেনঢাইট! ইন্সিটিউট কোনোরকম অর্থসাহায্য ছাড়া রোগীদের সেবা প্রদান করে আসছিল। ভার্জিনিয়ার সেই কমিউনাল বাসায় রোগীর বিছানা ছিল মাত্র ৪০টি। এছাড়াও বাইরে থেকে অনেক রোগীই আসতেন প্যাচের কাছে। প্যাচ নিজেও প্রতিটি রোগীর বাসায় যেতেন এবং তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোগীর বাসাও পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি বলেন, “একজন মানুষকে যত ভালোভাবে জানা সম্ভব তার সব পন্থা আমি গ্রহণ করতাম”।
মিডিয়া আকর্ষণ
এখন আপনাদের মনে দুটি প্রশ্ন আসতে পারে- ১। হাসপাতাল যদি বিনামূল্যের হয়, তবে তারা তা পরিচালনার অর্থ পেতেন কী করে? ২। এতদিন প্যাচ অ্যাডামসের কথা কেন জানতে পারেন নি?
রোগীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ফি না নিলেও হাসপাতাল চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন তো রয়েছেই। এই জন্য ডাক্তাররা স্বয়ং তাদের পেশার বাইরে কিছু বাড়তি রোজগার করতেন এবং তা দিয়েই তারা এটি চালাতেন। অ্যাডামস মিডিয়ার সামনে আসতে চাননি কারণ তিনি তার কাজের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে চাননি। কেননা তিনি জানতেন এই ব্যাপারটি ছড়িয়ে গেলে তার এই মহৎ উদ্যোগও ব্যবসায় পরিণত হবে। তাই ১৯৮৪ পর্যন্ত তারা নীরবে নিভৃতে সেবা করে গেছেন এবং কয়েকজন পৃষ্ঠপোষকের অর্থসাহায্য পেয়েছেন।
ক্লাউন ট্রিপ
১৯৮৪ সালের পর তারা বুঝতে পারেন যে এভাবে চললে গাজেনঢাইট একটি বড় হাসপাতালে কখনো পরিণত হবে না এবং তাদেরকে জনগণের সামনে আসতে হবে। তাই তারা আরেকটি চমৎকার উপায় বের করেন নিজেদের পরিচয় করানোর- ক্লাউন ট্রিপ। ক্লাউন বা ভাঁড় সেজে আসল ডিগ্রিধারী ডাক্তাররা পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ানোই ক্লাউন ট্রিপ। প্যাচ সবসময়েই হাসপাতালে ভাঁড় সেজে সবাইকে হাসাতেন। কিন্তু ক্লাউন ট্রিপ হাসপাতালের গণ্ডি পার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে যায়।
দুর্ভিক্ষ, খরা, যুদ্ধ বা যেকোনো কষ্টে ভোগা মানুষকে তারা হাসানোর মহান দায়িত্ব নেন। GO! CLOWNS নামের এই মিশনে এই পর্যন্ত তারা বসনিয়া, মেসেডোনিয়া, আফগানিস্তানের মতো শরণার্থীপ্রবণ দেশগুলোতে ক্লাউন ট্রিপ করেছেন। বিনা বেতনের এই অসাধারণ সুযোগে সাড়া দিয়েছেন প্রায় ১২০টি দেশের চিকিৎসকরা!
১৯৯৮ সালে প্যাচ অ্যাডামসের এই মহান উদ্যোগকে কেন্দ্র করে হলিউড একটি চলচ্চিত্র তৈরি করে- প্যাচ অ্যাডামস। সেখানে প্যাচের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রবিন উইলিয়ামস। মুভিটির কারণে প্যাচ অ্যাডামসের নাম বিশ্বব্যাপী আরও প্রসারিত হয়। যদিও অ্যাডামস মনে করেন মুভিটিতে তাকে শুধু একটি হাস্যকর ডাক্তার হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তার লক্ষ্য শুধু হাসানো নয়, তিনি বিশ্বাস করেন চিকিৎসা সেবা একটি মহৎ পেশা যেখানে মানবিকতা অপরিহার্য।
প্যাচ অ্যাডামস মুভিটির ট্রেইলার দেখতে পারবেন এখানে:
মুন্না ভাই এমবিবিএস এর মতো এই মুভিটিতেও চলচ্চিত্রের খাতিরে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। যেমন হান্টার অ্যাডামসকে প্যাচ অ্যাডামস বলা হয় কারণ তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করে সবসময় হাতে কালো ফিতা বেঁধে রাখতেন। কিন্তু হলিউডের মুভিটিতে এই ব্যাপারটি ভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে।
যদি আপনি প্যাচ অ্যাডামসকে কোনো বার্তা পৌঁছাতে চান তাহলে চলে যান patchadams.org এ। তিনি বলেন, “আমি প্রত্যেকটি চিঠির উত্তর দেই” ।
বি: দ্র: অর্থ সংগ্রহের জন্য ১৯৮৪ থেকে গাজেনঢাইট ইন্সটিটিউটে রোগী দেখা বন্ধ রয়েছে। অ্যাডামস আশা করছেন শীঘ্রই গাজেনঢাইট একটি পূর্ণ হাসপাতালে পরিণত হবে।
Feature Image: anewkindofhuman.com