
বয়স তখন ছিল
পনেরো তাই ছিল
স্বপ্ন দেখার ব্যারাম!মাথার ভেতর ছিল
এলভিস প্রিসলি
খাতার ভেতর তোমার নাম!ম্যারি এ্যান
ম্যারি ম্যারি এ্যান
ম্যারি এ্যান ম্যারি!
নব্বই দশকের মানুষজনের কাছে অঞ্জন দত্ত আর নচিকেতা, খুবই জনপ্রিয় দু’টি নাম। কেননা, বাস্তবধর্মী লিরিকের গানগুলো সত্যিই শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যেত। মুখে মুখে রটে যেত সেসব লিরিকের কোরাস। আবার, অনেক কিছু সম্পর্কে জানতেও পারত শ্রোতারা। এই যেমন- এলভিস প্রিসলির কথাই বলা যায়। আবার হয়তো সেই সময়ের বিশ্বসাহিত্যের বইগুলোতেও উঠে এসেছে এই শিল্পীর নাম। মাত্র ৪২ বছর বয়সে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন এই শিল্পী। কিন্তু তার প্রভাব আর খ্যাতি বিন্দুমাত্রও মলিন হয়নি আজ অবধি। বরং বলা চলে, বেড়েছে আরো কয়েকগুণ।
খুব নিচ থেকে উঠে আসা এলভিস প্রিসলি শতাব্দীর সেরা পপ মিউজিক এবং রক ‘এন’ রোলের জন্য সর্বাধিক উচ্চারিত এক নামে পরিণত করেছিলেন নিজেকে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রেডিও, টেলিভিশন এবং এমনকি রূপালি পর্দায়ও ছিল তার সরব উপস্থিতি। টানা দুই দশক দুনিয়া কাঁপিয়েছিলেন এলভিস প্রিসলি। সত্তর দশকের একদম শেষভাগে এসে মৃত্যু হয় এই শিল্পীর।
১৯৩৫ সালে ৮ই জানুয়ারি, মিসিসিপির টুপেলো শহরে জন্মগ্রহণ করেন এলভিস অ্যারন প্রিসলি। বাবা ভার্নন প্রিসলি এবং মা গ্লাডিস প্রিসলি দুজনেই ঠিক যতটা খুশি ছিলেন, ঠিক ততটাই কষ্ট পেয়েছিলেন। কেননা, তাদের যমজ সন্তান জন্ম নেবার কথা ছিল। এলভিসের জন্ম হলেও তার মাতৃজাত যমজ ভাই জেসি গ্যারন প্রিসলির মৃত প্রসব হয়েছিল। আবার, অন্যান্য জায়গায় এ তথ্যও এসেছে যে, জন্মের কিছুদিন পরই মারা গিয়েছিল জেসি গ্যারন প্রিসলি। তবে এলভিস প্রিসলিকে নিয়ে তার পিতামাতা জীবনযাপন শুরু করলেন নতুন উদ্যমে।

এলভিসের বাবা ভার্নন কিছুটা কর্মবিমুখ ছিলেন। ঠিক কর্মবিমুখও নন; কেননা যে কাজই হোক না কেন, তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারতেন না। তাই কখনো রাজমিস্ত্রী, কখনো কৃষক, কখনোবা কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। তাই দারিদ্র্য ছিল এলভিস পরিবারের নিত্যসঙ্গী। ছোটবেলা থেকেই এলভিস মায়ের কাছেই বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। বেশ ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেয়া এলভিস ছোটবেলা থেকেই চার্চে যাতায়াত করতেন। আর সে সুবাদে গীর্জার প্রার্থনাগীত তার মন কেড়েছিল। স্থানীয় গীর্জার গায়ক দলের সঙ্গে প্রার্থনাগীত গাওয়ার মধ্য দিয়েই তার সঙ্গীত জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সঙ্গীতের প্রতি প্রেমটা জন্মেছিল সেখান থেকেই।
এলভিসের একাদশ জন্মদিনের উপহারই মূলত বদলে দেয় তার ভবিষ্যৎ জীবন। এবং শতাব্দীর অন্যতম সেরা একজন মিউজিক আইকন পায় বিশ্ববাসী। তার আংকেল জনি’র (স্মিথ নামেও পরিচিত) সাহায্য নিয়ে তার বাবা-মা তাকে একটি গিটার উপহার দেন। গিটারের কিছুই জানতেন না তখন তিনি। পরে চার্চের ধর্মযাজক ফ্রাঙ্ক স্মিথের সাহচর্যে গিটারের কিছু মৌলিক কর্ড শিখে নেন তিনি। এরপর নিজেই লেগে পড়েন নিজেকে গিটার শেখানোর কাজে। পাশাপাশি টুপেলো শহরে অনুষ্ঠিত বেশ কিছু ট্যালেন্ট শো’তেও অংশগ্রহণ করেন তিনি।
১৯৪৮ সালে প্রিসলি পরিবার টুপেলো ছেড়ে চলে আসে টেনেসির মেমফিস শহরে। তখন এলভিসের বয়স মাত্র ১৩ বছর। কাউন্টি মিউজিক আর পপ মিউজিকের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে প্রিসলির। পাশাপাশি ঐতিহাসিক মেমফিস শহরের এক তরুণ হিসেবে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন রাইমস এন্ড ব্লুজ ধারার গানগুলোকে। মেমফিসের বিভিন্ন ট্যালেন্ট শো’তে পদার্পণের মাত্রা আরো বাড়ান তিনি। মেমফিসেরই হিউমস হাই স্কুলে অনুষ্ঠিত ট্যালেন্ট শো জিতে নেন। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনার পাট চুকান তিনি।

পড়াশোনা শেষ হবার পর এলভিস ক্যারিয়ার হিসেবে গায়ক হবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু একদমই ফাঁকা পকেটে চিন্তাটা খুব একটা যুতসই লাগেনি তার নিজের কাছেই। আর সদ্য পাশ করা সেই তরুণের তখন পকেট একদমই ফাঁকা। টানাটানির সংসারে বাবা চালাতেন ক্রাউন ইলেকট্রনিক নামক এক কোম্পানির ট্রাক। দ্বিতীয় কোনো চিন্তা আসার পূর্বেই নিজেও একই কোম্পানিতে ট্রাক চালক হিসেবে যোগদান করেন।
কিন্তু পেটের দায়ে আর পকেটের টানে ট্রাক চালক হলেও গায়ক হবার নেশাটা তখনো ধরে ছিল মনের গহীনে। অবসরে বসে লিরিক লিখতেন, আর তাতে সুর বসিয়ে গলা মেলাতেন তিনি নিজেই। এভাবেই চলছিল সব। সঙ্গীতজগতে ঢোকার জন্য মরিয়া ছিলেন তিনি। ট্রাক চালক হয়েও বিখ্যাত আমেরিকান গায়ক ও সুরকার এডি বন্ডের কাছে গিয়েছিলেন তিনি অডিশন দিতে। অডিশন শেষে এডি বন্ড এলভিসকে বলেছিলেন,
চালক হিসেবেই তোমাকে বেশি মানায়। গায়ক হিসেবে নয়।
কিন্তু এডি বন্ডকে ভুল প্রমাণিত করে, এমনকি তার জীবদ্দশায়ই নিজেকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন এলভিস প্রিসলি। এ ঘটনার পরপরই প্রথম গানটা রেকর্ড করেন তিনি। গানের শিরোনাম ছিল ‘মাই হ্যাপিনেস’। পরে আরো একটা গান রেকর্ড করেন তিনি; ‘দ্যাটস হোয়েন ইয়োর হার্টএকস বিগেইন’। তখনকার দিনে স্যাম ফিলিপস সান রেকর্ডস নামে একটা রেকর্ড কোম্পানি চালাতেন মেমফিসে, যা বর্তমানে সান স্টুডিও নামেই পরিচিত। যেখানে মাত্র চার ডলার জমা দেয়ার বিনিময়ে নিজের গাওয়া গান বোথ সাইডেড বা টু-সাইডেড রেকর্ডে তৈরি করে দেয়া হতো।
সেখান থেকেই অনেক কষ্টে যোগাড় করা চার ডলারের বিনিময়ে মায়ের জন্য একটা রেকর্ড উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন এলভিস। বাড়ি ফেরার পথে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে রেকর্ডটা চালান তিনি। কিন্তু সেখান থেকে রেকর্ড বাসায় নিতে আর মনে ছিল না তার। ব্যাপারটা কি অনিচ্ছায় ঘটেছিল, নাকি ইচ্ছায়- তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেননা, তখনকার দিনে প্রিসলিদের বাসায় বাজানোর মতো কোনো রেকর্ড প্লেয়ার ছিল না। কথিত আছে, সান রেকর্ডসের মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই নাকি এলভিস প্রিসলি চার ডলার খরচ করেছিলেন।
১৯৫৪ সালের জুন মাসে ‘আই উইল নেভার স্ট্যান্ড ইন ইয়োর ওয়ে/ইট উডেন্ট বি দ্য সেইম (উইদাউট ইউ)’ অ্যাসিটেট ডিস্কে রেকর্ড করান তিনি, যা এখনো সিডি হিসেবে পাওয়া যায়। জুলাই মাসে স্যাম ফিলিপসের কাছে একটা ফোন আসে, ন্যাশভিলের মিউজিক পাবলিশার স্যাম ওয়ার্থহ্যামের। এর আগে স্যাম সান রেকর্ডের নামে দারুণ একটা হিট অ্যালবাম উপহার দিয়েছিলেন। তাই, স্যামের কথার দাম ছিল ফিলিপসের কাছে। স্যাম জানান, সম্প্রতি তিনি একটা গান শুনেছেন, যেটা তার ভালো লেগেছে আর মনে হয়েছে যে, ছেলেটাকে কাজে লাগানো যাবে।
গানটা ছিল এলভিস প্রিসলির গাওয়া ‘উইদাউট ইউ’। স্যাম ফিলিপস নিজেও গানটা শুনে সেখানে কিছু একটা আভাস পান। কিন্তু গায়কটা কে, তা মনে করতে পারেন না। অবশেষে রিসিপশনিস্ট ম্যারিয়ন তাকে জানান এলভিসের কথা। ম্যারিয়নকে দিয়ে ফোন করানো হয় এলভিসকে স্টুডিওতে আসার জন্য। পরে অবশ্য এলভিস এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ফোন পেয়ে দৌড়ে গিয়েছিলেন সেখানে। এলভিস স্টুডিওতে আসামাত্রই স্যাম তাকে বলেন, যা জানেন আর পারেন, তা-ই যেন গেয়ে শোনান তাদের। তবে তিনি সাথে সাথে কোনো সিদ্ধান্ত জানান না এলভিসকে।

স্যাম ‘দ্য স্টারলাইট র্যাংলার্স’ ব্যান্ডের গিটারিস্ট স্কটি ম্যুরের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেন। পরে একই বছর, জুলাই মাসের ৪ তারিখ এলভিসকে নিজের বাসায় আমন্ত্রণ জানান স্কটি ম্যুর। সেখানে তার পরিচয় হয় ব্যান্ডের আরেক সদস্য বিল ব্ল্যাকের সঙ্গে। তারা তিনজন আলাপ-আলোচনা বাদেও বেশ গানবাজনা করেন। এলভিস চলে গেলে তারা দু’জন সিদ্ধান্ত নেন, এলভিসকে নিয়ে কাজ করার। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা জানানো হয় সান রেকর্ডের মালিক স্যাম ফিলিপসকে। স্যাম সম্মতি জানান। পরদিনই স্টুডিওতে এসে কয়েকবার প্রচেষ্টার পর তারা তিনজন মিলে প্রথমে লিওন পেইনের হিট গান ‘আই লাভ ইউ বিকজ’ কভার করেন। তারপর আচমকাই এলভিস আর্থার ক্রুডুপের আরেকটি বিখ্যাত গান ‘দ্যাটস অলরাইট’ গাইতে গাইতে নাচতে শুরু করে দেন। কেননা, এটাই ছিল প্রথম কোনো কর্মাশিয়াল কাজ, যেটায় তিনি পেশাদার গায়কের ভূমিকায় ছিলেন।
তখনো এলভিসের গলার সুর টেনেসি রাজ্যের লোকেদের মন ছুঁয়ে যেতে পারেনি। স্যাম ফিলিপস বুদ্ধি করে পরদিন ফোন করেন তখনকার রেডিও জকি ডিউই ফিলিপসকে। যদিও ডিউই প্রথমে ততটা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু স্যামের অনুরোধ আবার ফেলতেও পারেননি। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেই গানটা রেডিওতে বাজান তিনি। গান শেষ হওয়া মাত্রই ডিউইয়ের রেডিওতে ফোন আসে। পরপর কয়েকটা ফোনই আসে। কিন্তু ডিউই ভেবে নেন, এ আর এমন কী! কিন্তু তাজ্জব বনে যান, যখন অস্বাভাবিক হারে ফোনের পর ফোন আসতে শুরু করে এলভিসের সন্ধানে।
ব্ল্যাক, ম্যুর আর এলভিসের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এরইমধ্যে। যেজন্য ব্ল্যাক আর ম্যুর তাদের পুরনো ব্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন এলভিসের সাথে নতুন ব্যান্ড গড়তে। আর বব নীল নামক এক ব্যক্তি এই তিনজনের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এরপর এই ত্রয়ী ‘ইগল নেস্ট’ ক্লাবে প্রতিনিয়ত পারফর্ম করা শুরু করেন এবং সান রেকর্ডসে এসে অনুশীলনও চালিয়ে যেতে থাকেন। তাদের প্রথম স্টেজ শো ছিল ন্যাশভিলের গ্র্যান্ড ওলি ওপ্রেতে। পরবর্তীতে লুসিয়ানা হেইরাডে স্টেজ শো করার ডাক পান এলভিস প্রিসলি।
হেইরাডের স্টেজ শো’টি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, কর্তৃপক্ষ এলভিসের সঙ্গে এক বছরের জন্য চুক্তি করে নেয়। প্রতি শনিবার রাতে হেইরাডে শো করার চুক্তি গ্রহণ করেন এলভিস। এরপর এই ত্রয়ী স্থানীয় শো ছাড়াও টেক্সাস, হিউস্টেন এবং আরকানসাস জুড়ে শো করে বেড়ান। সে বছরই ডি. জে. ফন্টানাকে নিজের ব্যান্ডে ড্রাম বাজানোর আমন্ত্রণ জানান এলভিস। তখনকার সময়েই, এলভিসের গাওয়া ‘দ্যাটস অলরাইট মামা’ এবং ‘ব্লু মুন কেন্টাকি’ গান দুটো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯৫৫ সালের গোড়ার দিকে নিয়মিত হেইরাডে শো, ঘুরে ঘুরে শো করা এবং কয়েকটা রেকর্ড প্রকাশ পাওয়ায় স্থানীয় এক তারকাতে পরিণত হন প্রিসলি। কর্নেল টম পার্কারের নজরেও পড়েন তিনি। মূলত এরপর থেকেই এলভিসের কেবল গান গাওয়া এবং পারফর্ম করা ব্যতীত আর কিছু নিয়েই চিন্তা করতে হয়নি। সবকিছুর দায়িত্ব্ ছিল টমের উপর। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে, এলভিস ন্যাশভিলে নিজের রেকর্ডিংয়ের কাজ করেন প্রথমবারের মতো, আরসিএ রেকর্ডসের (আমেরিকান রেডিও কর্পোরেশন) জন্য। এলভিসের গানকে পূর্ণতা দিতে সাথে ছিলেন স্কটি ম্যুর, বিল ব্ল্যাক এবং ডি. জে. ফন্টানা। এছাড়াও, আরসিএ’র তালিকাভুক্ত পিয়ানোবাদক ফ্লয়েড ক্রামার, গিটারবাদক সেট অ্যাটকিন্স এবং তিনজন ছিলেন ব্যাকগ্রাউন্ড ভোকাল দেয়ার জন্যে; যাদের মধ্যে এমনকি জর্ডানাইরিস কুয়ার্টেটের গোর্ডন স্টোকারও ছিলেন।
অবশেষে এলভিসের প্রথম মৌলিক একক গান প্রকাশ পায় ‘হার্টব্রেক হোটেল’ নামে। তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। মুখে মুখে শোনা যায় এলভিসেরই গান। মার্চ মাসে প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশ পায় ‘এলভিস প্রিসলি’ নামেই। সান রেকর্ডিংস থেকে প্রকাশিত আগের গানগুলোসহ মোট সাতটি গান নিয়ে প্রকাশ পায় অ্যালবামটি। দুটো কান্ট্রি (অনেকটাই ফোক ঘরানার), একটা পপ, তিনটা রাইমস অ্যান্ড ব্লুজ এবং একটা ছিল রক ‘এন’ রোল ঘরানার গান; যা কার্ল পার্কিন্সের ‘ব্লু সুয়েড স্যুজ’ গানের এলভিস সংস্করণ। এলভিস প্রিসলি নামের এই অ্যালবাম এতটাই হিট হয় যে, টানা দশ সপ্তাহ এটা বিলবোর্ডের টপ চার্টের লিস্টে এক নাম্বার অবস্থান ধরে রেখেছিল। মূলত এই অ্যালবামই এলভিস প্রিসলিকে বিখ্যাত হবার দুয়ারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

পঞ্চাশের দশকটা যেন ছিল এলভিস প্রিসলির জন্যই। একে একে দারুণ সব হিট গান শ্রোতাদের উপহার দিতে থাকেন তিনি। ‘হাউন্ড ডগ (১৯৫৬)’, ‘ডোন্ট বি ক্রুয়েল (১৯৫৬)’, ‘ব্লু শ্যুয়েড স্যুজ (১৯৫৬)’, ‘লাভ মি টেন্ডার (১৯৫৬)’, ‘অল শুক আপ (১৯৫৭)’ এবং ‘জেলহাউজ রক (১৯৫৭)’; পুরো দশকটা জুড়েই এমন সব দুর্দান্ত গান উপহার দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি ষাটের দশকটার শুরুটাও হয়েছিল তার ‘ইট’স নাও অর নেভার’ এবং ‘আর ইউ লোনসাম টুনাইট’ গানগুলো দিয়ে। সেই সময় তার গায়ে ‘লিভিং লেজেন্ড’-এর তকমা লেগেছিল।
আর ঠিক সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েই টম পার্কার এলভিসকে প্রথমবারের মতো জাতীয় টেলিভিশনে নিয়ে আসেন। দু’মাসে সিবিএস চ্যানেলে মোট ছ’বার স্টেজ শো করেন এলভিস প্রিসলি। প্রাক্তন ম্যানেজারের মেয়াদ ফুরিয়ে এলে নতুন চুক্তি না করে বরং টম পার্কারকেই সকল দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন এলভিস। এরপর একে একে বিখ্যাত আর জনপ্রিয় সব টিভি শোতে দেখা গেছে এলভিস প্রিসলিকে। যার মধ্যে ছিল দ্য স্টিভ অ্যালেন শো, দ্য মিল্টন বার্লি শো, দ্য টোস্ট অভ দ্য টাউন এবং বিতর্কিত অনুষ্ঠান দ্য এড সালিভান শো।
সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে এলভিস প্রিসলি ঠিক যতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, ঠিক একইরকম জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন অভিনেতা হিসেবে। ১৯৫৬ সালেই তার অভিনীত প্রথম ফিচার ফিল্ম প্রকাশ পায় ‘লাভ মি টেন্ডার’ শিরোনামে। বক্স অফিস হিট করে সিনেমাটি। সঙ্গীতের প্রযোজকদের পাশাপাশি সিনেমার প্রযোজকদের নজর পড়ে তার উপর। যে কারণে মাত্র দু’-তিনটা সিনেমায় অভিনয় করার পরপরই আগামী দুই দশকের জন্য বক্স অফিসের হিট তালিকায় ছিল এলভিস প্রিসলির নাম। প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের টিকেট বিক্রি হয়েছিল কেবল প্রিসলির জন্যেই।

প্রিসলি এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, মার্কিন সামরিক বাহিনীতে বছরখানেকের জন্য যোগদান করার ফলেও তার খ্যাতি এতটুকুও কমেনি। তার নামে ১৯৫৭ সালে মার্কিন সরকারের তরফ থেকে ড্রাফট নোট আসে। মার্চেই তিনি যোগদান করেন সেনাবাহিনীতে। টেক্সাসের ফোর্ড হুডে তাকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। সে সময়ই তার মা মারা যান। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে এবং ব্যস্ত থাকতে সেনাবাহিনীতে ফিরে যান। এমনকি বছর দেড়েক তিনি জার্মানিতেও ছিলেন সামরিক কাজে। সেখানে তিনি পরিচিত হন প্রিসিলার সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে প্রণয় থেকে পরিণয়ের যাত্রা শুরু করেন প্রিসলি আর প্রিসিলা।
১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী থেকে ডিসচার্জ হয়েই এলভিস পুনরায় নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেন। শুরুতেই ‘জি আই ব্লুজ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি গানগুলো দিয়ে জনপ্রিয়তা আর বিলবোর্ডের চার্টের শীর্ষে নিজের অবস্থান পুনরায় শক্ত করেন। এরপর একে একে ‘ব্লু হাওয়াই (১৯৬১)’, ‘গার্লস! গার্লস! গার্লস! (১৯৬২)’ এবং ‘ভিভা লাস ভেগাস (১৯৬৪)’-এর মতো হিট সিনেমাগুলো আসে। যদিও সমালোচকদের খুব একটা নজর কাড়তে পারেনি এই সিনেমাগুলো। কিন্তু টিকেট এবং গানগুলোর রেকর্ড বিক্রি করেই লগ্নি এবং মুনাফা লাভ করা যেত। তবে ষাটের দশকের শেষের দিকে তার জনপ্রিয়তায় খানিকটা ভাঁটা পড়ে।
১৯৬৮ সালে একটি মেয়ে জন্ম নেয় এলভিস ও প্রিসিলার ঘরে। নাম রাখা হয় লিসা ম্যারি। তখন এলভিস নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে দারুণভাবে বিচলিত। কেননা, বড় বড় তারকারা প্রকাশ্যেই তার ক্যারিয়ার নিয়ে টিটকারি মূলক কথাবার্তা বলতেন সাংবাদিককের কাছে। অন্যদিকে তার পরপর চারটা অ্যালবামের একটাও বিলবোর্ডের সেরা দশের চার্টে উঠে আসতে পারেনি। সর্বোচ্চটাও উঠে এসেছিল ২৮ নাম্বারে। নিজেকে ‘কিং অভ রক অ্যান্ড রোল’ প্রমাণ করতে এলভিস একটা টিভি শো’র কথা চিন্তা করেন, ‘সিক্সটি এইট কামব্যাক’ নামে। নিজের প্রতিভা দিয়ে তিনি ফের মাতিয়ে তোলেন শ্রোতা আর দর্শকদের। এনবিসিতে প্রচারিত সব অনুষ্ঠানের তুলনায় ৪২ শতাংশ দর্শক এনেছিল শুধুমাত্র এলভিসের এই শো।

কোনো এক অদ্ভুত কারণে ষাটের দশকের শেষ থেকে আশির দশক অবধি গোটা পৃথিবী এক বিষণ্ণতায় ভুগেছিল। যা আমরা জানতে পারি সিনেমা কিংবা বইয়ের পাতা থেকে। বিষণ্ণ সেই সময়টাতে পারিবারিক টানাপোড়েনে জর্জরিত হন এলভিস প্রিসলিও। সত্তর দশকের শুরু থেকেই প্রিসলি আর প্রিসিলার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে। ফলে ১৯৭৩ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
স্থানীয় আদালত একমাত্র মেয়ে লিসা ম্যারির দায়িত্ব দেয় মা প্রিসিলার কাছে। তবে আদালতের এমনটা করার পেছনে অন্য আরেকটা কারণ ছিল। প্রিসলি সেই সময়টাতে মাদকের নেশায় ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমনকি মাদক সংক্রান্ত কারণে তাকে হাসপাতালেও কাটাতে হয়েছিল। এত কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও, তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। ভাঁটা পড়েনি তার সেই রাশভারি কণ্ঠে কিংবা স্টেজ শোতে সেই অদ্ভুত দুলুনির পারফর্ম্যান্সে।
১৯৭৭ সালের জুন মাসে ইন্ডিয়ানার কনসার্ট করেন এলভিস প্রিসলি। দর্শকদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গ্রেসল্যান্ডের মেমফিশ ম্যানশনে নিজের বাসায় ফিরে আসেন। পরবর্তী কনসার্টের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। অগাস্টের ১৭ তারিখ হবার কথা ছিল সেই কনসার্ট। কিন্তু ঠিক আগেরদিন ১৬ অগাস্ট প্রিসলিকে নিজের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই ভিন্ন এক জগতে পাড়ি জমান এলভিস প্রিসলি। ময়নাতদন্তে অতিরিক্ত মাদক সেবনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

বর্ণাঢ্য এই ক্যারিয়ারে, তিনি আমেরিকাতে রক ‘এন’ রোল সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেছিলেন। গসপেল রেকর্ডিংয়ের জন্য তিনবার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস জিতেছেন। এলভিস প্রিসলিই একমাত্র সঙ্গীতশিল্পী, যিনি কিনা রক ‘এন’ রোল হল অভ ফেইম, গসপেল মিউজিক হল অভ ফেইম এবং কান্ট্রি হল অভ ফেইম অর্জন করেছেন।
একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র অভিনেতা, টিভি শো পারফর্মার এবং স্টেজ শো বা লাইভ কনসার্টে দর্শকদের মাতানোতে এলভিস প্রিসলির দারুণ দক্ষতা ছিল। আর তাই জনপ্রিয়তা জেঁকে ধরেছিল তাকে। বিশ্বব্যাপী হিসেবে তার রেকর্ড বিক্রির সংখ্যা প্রায় ১ বিলিয়ন। পুরো আমেরিকা জুড়ে তার সর্বমোট ১৩১টি অ্যালবাম ও একক গান যথাক্রমে গোল্ড, প্লাটিনাম এবং মাল্টি-প্লাটিনামের খেতাব অর্জন করেছে, যা একজন রক সঙ্গীতশিল্পীর জন্য ইতিহাসই বটে। গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস থেকে তিনি পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।

মার্কিন সেনাবাহিনীতে কাজ করার মধ্য দিয়ে দেশসেবাও করেছেন এলভিস। তার প্রতিভা, সুদর্শন চেহারা, ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব এবং রসাত্মক কথাবার্তা তাকে জনপ্রিয় করে রেখেছিল। গান গাইবার সময়ে তার সেই অঙ্গভঙ্গি এখনো স্টেজ শো কিংবা কনসার্টগুলোতে পারফর্ম করে এককন সঙ্গীতশিল্পীরা। এলভিসের শরীরী মৃত্যু হলেও আজো তিনি মাতিয়ে রেখেছেন বিশ্বের কোটি ভক্তদের।