Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেমস হাটন: আধুনিক ভূতত্ত্বের শুরু যার হাত ধরে

ধরুন, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আপনার পা একটা পাথরে ধাক্কা খেলো। পাথরটি আপনি হাতে তুলে নিলেন। সেখানে আপনি কী দেখবেন? বেশিরভাগ পাঠকই হয়তো শুধু একটা পাথরই দেখবেন। খয়েরী, বাদামী বা ধূসর রঙের পাথর, হয়তো চকচক করছে হাতের মাঝে। খুব অসাধারণ কিছু মনে হবে না আপনার কাছে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর ভূতত্ত্ববিদ জেমস হাটন এই সাধারণ পাথরের মাঝেই অসাধারণ কিছু দেখতে পেয়েছিলেন। তার চোখে পাথর কখনোই শুধু পাথর ছিল না, সেগুলো ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের কর্ণধার। একেকটি পাথর তাকে কোটি কোটি বছরের গল্প বলতো। আর এ গল্প তিনি এমন সময় শুনেছিলেন, যে সময় গোটা ইউরোপ ভাবতো পৃথিবীর বয়স মাত্র ছয় হাজার বছর।

শিলাস্তরের মাঝে পৃথিবীর ইতিহাস দেখতে পেয়েছিলেন জেমস হাটন; source: wallpapersafari.com

জেমস হাটনের জন্ম ১৭২৬ সালের ৩রা জুন, স্কটল্যান্ডের এডিনবুরায়। তরুণ বয়স থেকেই তিনি বেশ স্বাধীনচেতা ছিলেন। বিদ্যালয়ে যেমন থিতু হননি, বিশ্ববিদ্যালয়ও তিনি বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করেছিলেন। তবে এসব করতে গিয়ে খুব বেশি সমস্যার মুখোমুখি তাকে হতে হয়নি। যদিও তার পিতা যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তখন তার বয়স মাত্র তিন, কিন্তু যেহেতু উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি অনেক সম্পদ এবং ক্ষেত-খামার পেয়েছিলেন, তাই এই স্বাধীনচেতা জীবন কাটাতে গিয়ে কোনো আর্থিক প্রতিকূলতা তার সামনে আসেনি। তার শিক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি গণিতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু রসায়ন অনেক ভালোবাসতেন। তিনি শেষ পর্যন্ত এই সবকিছু ছেড়ে পড়াশোনা শেষ করেন একজন ডাক্তার হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার থিসিস ছিল রক্ত সঞ্চালন নিয়ে, যেখানে আমাদের রক্ত যে ক্রমাগত ধ্বংস এবং নতুন করে তৈরি হচ্ছে, সেই ব্যাপারটা তিনি ধরতে পেরেছিলেন।

তবে একসময় হাটন বুঝতে পারেন, আসলে চিকিৎসাশাস্ত্রেও তার মন বসছে না। তখন তিনি বারউইকশায়ারে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া খামারে কৃষি নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। আর এই গবেষণাই ভূতত্ত্ব নিয়ে তার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। এই আগ্রহই তাকে ১৭৬৮ সালে আবার তার জন্মস্থান এডিনবুরায় ফিরিয়ে আনে এবং সেখানে এসে তিনি পুরোদমে ভুতত্ত্বে মনোনিবেশ করেন। হাটনের সময়ে বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করতো পৃথিবী বর্তমান অবস্থায় এসেছে বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরপ্রদত্ত নানা আকস্মিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে। কিন্তু হাটন দেখলেন কোনো আকস্মিক বিপর্যয় না, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে অনেকটা আমাদের দেহের রক্তের মতোই ক্রমাগত ধ্বংস এবং পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে। তিনি বললেন, পাথর এবং মাটি ক্ষয় হয়ে সমুদ্রে আসে, সমুদ্রের তলদেশে উচ্চচাপে সেগুলো পৃথিবীর নিরেট প্রস্তরকে তৈরি করে। সমুদ্রের নিচে তৈরি হওয়া ভূমিই একসময় পৃথিবীর উপরের স্তরে চলে আসে যখন পূর্ববর্তী ভূমিটি সম্পূর্ণ ক্ষয় হয়ে যায়। এই তত্ত্বটির রূপরেখা পাওয়া যায় তার “থিওরি অব আর্থ” নামক প্রকাশনায়।

সিকার পয়েন্টের হাটনের আনকনফর্মিটি; source: newstatesman.com

এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বিভিন্ন শিলার গঠনে তার তত্ত্বের প্রমাণ খুঁজে পেতে শুরু করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতি পেয়েছিল তার সিকার পয়েন্টের আবিষ্কার। এটি স্কটল্যান্ডের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি খিলান যা লাল বেলেপাথর এবং গ্রেভ্যাকের (একটি গাঢ় ধরনের বেলেপাথর) স্তর দিয়ে সজ্জিত। স্তরগুলো একে অপরের উপর বসানো ছিল, কিন্তু তারা আবার পাশাপাশি লম্বভাবেও সজ্জিত ছিল। এই সজ্জাকে এখন বলা হয় অ্যাঙ্গুলার আনকনফর্মিটি। তিনি ধারণা করেছিলেন, এ ধরনের শিলাস্তর গঠিত হতে অনেক লম্বা সময় এবং উচ্চচাপের প্রয়োজন, ছয় হাজার বছরে তার ছিটেফোঁটাও সম্ভব না, অন্তত কয়েকশো কোটি বছর সেখানে লাগবেই। এখন আমরা জানি, তার ধারণাটি ভুল ছিল না।

সিকার পয়েন্টের এই শিলাসজ্জা, যেটাকে স্কটল্যান্ডের আরো বেশকিছু জায়গাতেই পাওয়া যায়, একে হাটনের সম্মানে নাম দেয়া হয়েছে হাটনের আনকনফর্মিটি। গ্র্যানাইটকে আগ্নেয় শিলা হিসেবে তিনিই প্রথম চিনতে পারেন। বেলেপাথরের মাঝে গ্র্যানাইটকে আঁশের মতো ছড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন এমনটা হওয়া শুধুমাত্র উচ্চ তাপমাত্রাতেই সম্ভব। হাটন এই ব্যাপারটিকে দেখেন ভূগভীরে গলিত শিলা থাকার ইঙ্গিত হিসেবে, যা পরে সত্য হিসেবেই উপনীত হয়।

তার এসব আবিষ্কার ১৭৮৮ সালে তিনি একটি পেপারে সম্মিলিত করেন। কিন্তু তার আবিষ্কারগুলো তখন বিজ্ঞানীমহলে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি, কারণ তার বেশিরভাগ ধারণাই বাইবেলের বিশ্বতত্ত্বের সাথে ছিল অসামাঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া অনেক বিজ্ঞানীর ভূতত্ত্ব সম্পর্কিত তত্ত্বই ছিল বাইবেলে বর্ণিত মহাপ্লাবনকে সত্য ধরে প্রস্তাবিত, হাটনের ক্ষেত্রে এমনটা ছিল না। তাই তার ধারণাগুলো তখনকার মানুষের জন্য ছিল অস্বস্তিদায়ক। কিন্তু পরবর্তীতে তার কাজগুলোই ভবিষ্যত বিজ্ঞানীদের জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়।

তার কাছে কার্বন ডেটিংয়ের মতো প্রযুক্তি ছিল না, তিনি জানতেন না লোহিত রশ্মির ব্যবহার বা থ্রিডি মডেলিং, তারপরও পৃথিবীর ভূত্বকের বয়স বা শিলার গঠন সম্পর্কে অনেককিছুই সঠিকভাবে বুঝে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে উনবিংশ শতাব্দীতে চার্লস লায়েলের মতো বিজ্ঞানীরা তার অনুসরণেই ইউনিফর্মিটারিয়ানিজমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাটনের দেখানো ভূত্বকের লম্বা সময় ধরে বিবর্তনের ধারণা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই ডারউইন তার বিবর্তনের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  

হাটনের আবিষ্কৃত গ্র্যানাইটের শিলাসজ্জা; source: windsorscottish.ca

হাটন বলেছিলেন, অতীত থেকে পৃথিবী বর্তমান অবস্থায় যেভাবে এসেছে, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতেও ঠিক সেভাবেই যাবে। তার এই ধারণা থেকেই ‘ডিপ টাইম’ নামক ধারণার সূত্রপাত ঘটে এবং সেখান থেকে গবেষণার সূত্রপাত হয়েই আজ আমরা জানি পৃথিবীর বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর।

জেমস হাটনের পৃথিবী সম্পর্কে করা বিখ্যাত উক্তি; source: oreilly.com

১৭৯১ সালে হাটন মূত্রথলিতে পাথরজনিত সমস্যায় অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবছরই তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ভূতত্ত্বের উপর গবেষণায় ক্ষান্ত দেন এবং খুবই বিপজ্জনক একটি অস্ত্রোপচারের মুখোমুখি হন। কিন্তু সেই অস্ত্রোপচারের পর তার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ে। সে বছরই জন্মস্থান এডিনবুরাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৬৫ বছরের জীবনে তিনি কখনো বিয়ে করেননি। তবে ১৭৪৭ সালের দিকে এডিংটন নামের এক নারীর সাথে তার একজন পুত্রসন্তান হয়, নাম জেমস স্মিটন হাটন। তার এই ছেলের জীবনে হাটন খুব একটা উপস্থিত না থাকলেও সবসময়ই আর্থিক সহায়তা চালিয়ে গিয়েছেন।

স্কটিশ ন্যাচারাল পোর্ট্রেট গ্যালারিতে জেমস হাটনের ভাস্কর্য; source: wikimedia commons

যুগে যুগে প্রথাগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই মানবসভ্যতা নতুন নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে, আর সেসব নতুন নতুন ধারণাই আমাদেরকে নিয়ে এসেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিখরে। আর জেমস হাটন ছিলেন এই প্রশ্নবিদ্ধ করা মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম একজন। তার করা প্রশ্নগুলোই ভূবিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, তার উত্তরগুলো জন্ম দিয়েছে নতুন সব ধারণার। আর সেকারণেই সংস্কারহীন মনের অধিকারী এই তুখোড় পর্যবেক্ষক ভূতত্ত্বে কোনো ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও আজ স্মরণিত ‘আধুনিক ভূতত্ত্বের জনক হিসেবে।

This article is written in Bengali language. References are hyperlinked in the article.

Featured Image: wikimedia commons

Related Articles