ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞানকে যারা পশ্চিমের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং দেশের বাইরে নিজেদের প্রতিভার ছাপ রেখে এসেছেন, তাদের মধ্যে ভারতীয় বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জয়ন্ত নারলিকারের নাম একদম প্রথম সারির দিকে রাখতে হবে।
একাধারে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাকাশবিদ, বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারী, হার্ডকোর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক, উদ্যোক্তা- প্রফেসর জয়ন্ত নারলিকার শুধু নিজের সাথেই তুলনীয়। The Abdus Salam International Centre for Theoretical Physics (ICTP) এর ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বই বের করা হয়, যার নাম One Hundred Reasons to be a Scientist। সেই বইতে বর্তমান যুগের সব বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের নিজেদের বৈজ্ঞানিক হয়ে ওঠার গল্প বলতে দেখা যায়। সেখানে বড় বড় সব নামের মাঝে নারলিকারের নামও আছে।
১৯৬৫ সালে কেমব্রিজে থাকাকালীন সময়ে তার গবেষণার ফলাফল এতই জনপ্রিয় এবং ফলপ্রসূ হয় যে, ভারত সরকার থেকে তাকে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ‘পদ্মভূষণ’ দিয়ে সম্মানিত করা হয়, যেটা ছিল সবচেয়ে কম বয়সে এই পুরস্কার পাবার নজির। এখনও এটি রেকর্ড হিসেবে আছে। যদিও নারলিকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার গবেষণার কাজ আরও কিছু বাকি ছিল। সেই কাজ এখন হয়েল-নারলিকার থিওরি নামে পরিচিত। বলে রাখা ভালো, আমাদের ড. জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন কেমব্রিজে তার সহপাঠী। অমলকুমার রায় চৌধুরী, যার নামে রায়চৌধুরী সমীকরণ আছে এবং যাকে অনেকে বাংলার আইনস্টাইন বলে থাকেন, তাকে পশ্চিমে পরিচয় করে দিয়েছিলেন নারলিকার।
১৯৩৮ সালে ভারতের কোলাহপুরে জয়ন্ত নারলিকারের জন্ম। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। বাবা বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকার ছিলেন ভারতের স্বনামধন্য গণিতবিদ, মা ছিলেন সংস্কৃতের পণ্ডিত। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পরিবেশে বড় হন তিনি। পড়াশোনা, গণিত, বিজ্ঞান– এসবের প্রতি আলাদা ঝোঁক ছিল তার সেই প্রথম থেকেই। তিনি বিভিন্ন জটিল জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পছন্দ করতেন। পারিবারিকভাবেও পেয়েছেন উৎসাহ। তার বাবা বিজ্ঞানের বড় প্রফেসর হবার বরাতে ছোটবেলা থেকেই তিনি গণিতের Men of Mathematics, The World of Mathematics, Living Biographies of Great Scientists– এ ধরনের উৎসাহদীপ্ত বই পড়ে নিজেকে মানসিকভাবে বৈজ্ঞানিক হবার জন্য বিকশিত করেছেন।
নারলিকারের এক মামা ছিলেন– মরু মামা। পরবর্তীতে তিনি মুম্বাই সায়েন্স ইন্সটিটিউটের পরিচালক হন। নারলিকার যখন ক্লাস এইটে পড়েন, তখন সেই মামা তাদের বাসায় আসেন পড়াশোনা করবার জন্য। তাদের বাসায় তাদের ঘরে দুটো বড় বড় বোর্ড ছিল। যখন নারলিকারের মামা জানতে পারলেন জয়ন্ত গণিতের নানা সমস্যার সমাধান করতে পছন্দ করেন, তখন সেই বোর্ডে তিনি কঠিন কঠিন অঙ্ক দিয়ে রাখতেন এবং লিখে রাখতেন “Problems for JVN”। নারলিকার নিজেই দাবি করেছেন, ঐ সমস্যাগুলো তার বয়সের তুলনায় কঠিনই ছিল। তবুও সেগুলো করতে তার ভাল লাগত। দিনের পর দিন চলে যেতো, কিন্তু সমাধান হতো না। একেকটা সমস্যার সমাধান করতে হলে একেকটা নতুন নতুন ধারণার দরকার ছিল, যেগুলো সেই বয়সে তিনি জানতেন না। এভাবে আস্তে আস্তে তিনি যেকোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারতেন। গাণিতিক সমস্যা সমাধান করার মজাটা তিনি তখন থেকেই পান, যেটা পরবর্তী জীবনে তাকে সাহায্য করেছিল। এরকম আরও ঘটনা আছে।
ঘটনাটা কেমব্রিজে পিএইচডি করার সময়কার। তার প্রফেসর ফ্রেড হয়েল এবং রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানী মারটিন রাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৬১ সালের কথা। জয়ন্ত নারলিকার মাত্র ৬ মাস হলো এখানে এসেছেন। আর এসেই নিজের পছন্দ অনুযায়ী Steady State Theory নিয়ে কাজ শুরু করেন। ফ্রেড হয়েল প্রথম এই থিওরির কথা বলেন, কিন্তু গাণিতিকভাবে এবং এক্সপেরিমেন্ট করে এটি প্রমাণ করা হয়নি। রাইল তখন রেডিও ডাটা নিয়ে কাজ করছিলেন। ওসব ডাটা থেকে তিনি দাবি করেন, এই ধরনের কোনো থিওরি হতেই পারে না। হয়েল এতে বিরক্ত হন এবং মনে করলেন, নিশ্চয় ডাটাতে কোনো সমস্যা আছে। কারণ ততদিনে নারলিকার আর হয়েল মিলে এই থিওরির কাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এখন হয়েল-রাইল বিতর্ক রয়্যাল সোসাইটিতে সামনাসামনি প্রকাশ করতে হবে এবং নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।
সব কিছু ঠিকঠাক। তারিখও ঘনিয়ে আসছে। এমন সময় হঠাৎ করে হয়েল এর কাজ বেরিয়ে আসে, যেটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তখন দায়িত্ব পড়ল নারলিকারের উপর। মারটিন রাইল তখন বিখ্যাত লোক। আর নারলিকার মাত্র পিএইচডি শুরু করেছেন। এ তো রীতিমতো অসম লড়াই। নারলিকার হতভম্ব। হয়েল তখন তাকে বোঝান, বিজ্ঞানে বিখ্যাত লোক বা সুখ্যাতি, সম্মান এসব মনে করে ভয় পাবার কিছু নেই। এটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। যেটা দরকার সেটা হচ্ছে তুমি তোমার কাজ নিয়ে নিজে কতটুকু আত্মবিশ্বাসী আর তোমার কাজে কোনো ফাঁকি নেই এটা তুমি নিজে জান কিনা। নারলিকার পরে বলেছিলেন, এই কয়েকটা কথা তার জীবন বদলে দেয়। তিনি একাই রাইলের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামেন এবং জিতেও যান। এরপর তার জীবনের পুরোটা সময় শুধু সমস্যার উত্তর খুঁজেই পার করে দেন যেগুলোর উত্তর সম্পর্কে তিনি নিজেই শুধু কেন, কেউই জানত না। কিন্তু একটা বিশ্বাস ছিল যে তিনি পারবেন।
এরপরে তিনি ভারতে চলে আসেন। এখানে এসে টাটা ইন্সিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR) এ প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। ভারতে এসেও তিনি তার Steady State Theory নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেন, এর সাথে সাথে Electrodynamics, Gravity, Cosmology এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার ডক্টরেট ছাত্র ছিলেন আরেক বিখ্যাত গবেষক থানু পদ্মনাভান, যিনি মহাকর্ষ নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত। ১৯৯৩ সালে নারলিকার এবং হয়েল বিকল্প মহাকাশবিদ্যা (Alternative Cosmology) নামের নতুন একটি শাখা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
নারলিকার হচ্ছেন একজন গোঁড়া বিগব্যাং বিরোধী। তার কথা হচ্ছে বিগব্যাং হয়েছিল ১৪ বিলিয়ন বছর আগে। এর মানে ১৪ বিলিয়ন বছর আগে এসব কিছুর সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছু কিছু নক্ষত্র পাওয়া গিয়েছে যাদের বয়স ৩০ বিলিয়ন বছর। এই ধরনের আরও কিছু বিতর্কিত উদাহরণ আছে যা তাকে বিগব্যাং নিয়ে নিরুৎসাহিত করেছে। যদিও হকিংয়ের সাথে তার সম্পর্ক কেমব্রিজে থাকতেই ভালো ছিল। হকিং ছিলেন তার জুনিয়র। হকিং অক্সফোর্ড থেকে কেমব্রিজে এসেছিলেন হয়েলের সাথে কাজ করতে। কিন্তু হয়েলের রিসার্চ টিম মেম্বার অনেক বেশি হবার কারণে তাকে ডেনিস শামার সাথে কাজ করতে হয়।
১৯৮৮ সালে তিনি Inter-University Center for Astronomy and Astrophysics (IUCAA) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। এছাড়া জয়ন্ত নারলিকার যেকোনো কঠিন গাণিতিক সমীকরণ বা সমস্যা ব্যাখ্যা করার জন্য বিখ্যাত। একজন হার্ডকোর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকার হিসেবে তিনি নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। কল্পকাহিনী লেখার ভিতরও তিনি Extreme Science নিয়ে এসে আমাদের বিশ্বাস করাবেনই যে, বাস্তবে এমন জিনিস আসলেই আছে। তার কল্পকাহিনী লেখার উৎসাহ আসে হয়েলের কাছ থেকেই। হয়েলের একটি গবেষণা প্রবন্ধ, যেটাতে তিনি প্রথম আন্তঃনাক্ষত্রিক জৈব এবং অজৈব অণু থাকার কথা বলেন, সেটি বাদ পড়ে যায়। বার বার যখন বাদ পড়ে গেল, তখন তিনি The Black Cloud নামের একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখেন। এ বই অনেক জনপ্রিয়তা পায়। এরপরের দশকেই আমরা দেখি যে, হয়েলের কথার প্রমাণ বাস্তবেই পাওয়া গিয়েছে।
নারলিকার একবার আহমেদাবাদে এক বৈজ্ঞানিক কনফারেন্সে যান। সেখানে একটি সেশনে তার কোনো এক বৈজ্ঞানিকের পেপার পড়ার সময় ঘুম ঘুম আসে। সেটা কাটানোর জন্য কনফারেন্স প্যাডে বসে বসে ‘কৃষ্ণবিবর’ নামের গল্প লেখেন মারাঠি ভাষায়। সেটাই তার প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখা। এই গল্প লিখে তিনি পুরষ্কারও পান। এ গল্প তিনি মারাঠি বিজ্ঞান পরিষদের কোনো এক কম্পিটিশনে নাম পরিবর্তন করে পাঠান। তার নাম হয় নারায়ন বিনায়ক জগতাপ এবং হাতের লেখা হয় তার স্ত্রীর। পরে যখন পুরষ্কার পান, তখন তিনি তার আসল পরিচয় প্রকাশ করেন।
বর্তমানে তিনি আবারও পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। তিনি এখন Troposphere আর Stratosphere-এ ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন, যাতে করে পৃথিবীতে প্রাণ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই সম্পর্কে কিছু জানা যায়। এ সম্পর্কে তার কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশও পেয়েছে।
প্রফেসর নারলিকার কেমব্রিজে ফেলো হিসেবে থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু, তিনি তার নিজের দেশ থেকে দূরে থাকতে পারেননি। দেশে থেকেও যে বড় বড় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান এবং কাটিং এজ গবেষণা করা যায় সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। আমাদের উপমহাদেশের জন্য বিরাট একটা সমস্যা হচ্ছে “মেধা পাচার” (Brain Drain)। এসব ছাত্র-ছাত্রী, যারা বাহিরের দেশে পড়াশুনা করতে গিয়ে আর দেশে ফিরে আসতে চায় না (যদিও এর পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে), তাদের জন্য ড. নারলিকার অনুপ্রেরণা হতে পারে। প্রফেসর নারলিকার তার প্রতিষ্ঠান IUCAA-কে যেভাবে গবেষণার দিক দিয়ে উন্নতির চরম শিখরে উঠিয়েছেন, সেখান থেকে প্রেরণা পেয়ে ভারত সরকার এখন IUCAA এর মত অন্যান্য বিষয়ের জন্য এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করার ইচ্ছা পোষণ করেছে।