ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশিবার নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হবার রেকর্ডটির অধিকারী হলেন আর্নল্ড জোহানস উইলহেলম সমারফিল্ড। সর্বমোট ৮৪ বার নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হওয়া এই ব্যক্তি ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী একজন পদার্থবিদ। পদার্থবিজ্ঞানে তার অতুলনীয় অবদানের পাশাপাশি তিনি একজন শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন বেশ জনপ্রিয় এবং সফল। কারণ তার অনেক ছাত্র পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদানের জন্য রীতিমতো তারকা বনে গিয়েছিলেন। সমারফিল্ডের ছাত্রদের মধ্যে চারজন ডক্টরেট। তার তিনজন স্নাতকোত্তর পাশ ছাত্র নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যার এতজন ছাত্র নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছে।
১৮৬৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জার্মানির কনিগসবার্গে উইলহেলম সমারফিল্ড জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে তার নিজ শহরের কনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিজীবন শুরু করেন মূলত গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে। সেখান থেকে ১৮৯১ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর প্রায় দু’বছর তাকে বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা প্রদান করতে হয় সেনাবাহিনীতে।
কনিগসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার পর তিনি গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি আরো দুই বছর গণিতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকেন। তারপর ১৮৯৫ সালে তিনি তার ‘প্রাইভেটডোজেন্ট’ তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাদানের অনুমতিপত্র পান। এরপর থেকে তার দ্রুত পদোন্নতি হতে থাকে। ১৮৯৭ সালে তিনি গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান হন। এরপর তিনি তৎকালীন জনপ্রিয় Enzyklopädie der mathematischen Wissenschaften এর সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি ১৯২৬ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
এরপর সমারফিল্ড Königliche Technische Hochschule Aachen এ ফলিত বলবিদ্যা বিভাগেরও চেয়ারম্যান হন। এখানে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি তার থিওরি অফ হাইড্রোডাইনামিকস প্রকাশ করেন। এ সময়ে তিনি পিটার ডেবাইকে নিজের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন, যিনি পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
১৯০৬ সালে উইলহেলম সমারফিল্ড মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্যগঠিত তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের পরিচালকের পদে আসীন হন। এখানে থাকা অবস্থাতে তিনি বেশ কিছু ছাত্রদের দীক্ষা দেন। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গকে তিনি প্রথমে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন হাইড্রোডাইনামিকস থিওরির উপর। হাইজেনবার্গ পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে তার সৃষ্ট কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য পদার্থে নোবেল পুরষ্কার পান। এরপর মিউনিখেই সমারফিল্ড ওলফগ্যাং পলিকেও শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি পলিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর শিক্ষা দেন। পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে পলি তার ‘ইপোনিমাস পলি এক্সক্লুসন প্রিন্সিপাল’ এর জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালক হিসেবে থাকা অবস্থায় সমারফিল্ড আরেকজন ছাত্র, হ্যানস বেথাকেও দীক্ষা দেন, যিনি ১৯৬৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান তার ‘স্টেলার নিউক্লিয় সিন্থেসিস’ এর জন্য।
সমারফিল্ডের নিজের বেশ অবদান ছিল তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়। বিশেষ করে কোয়ান্টাম তত্ত্বের উপর তার যুগান্তকারী অবদান ছিল। পাশাপাশি তার শিক্ষাদানের কৌশলের জন্যও তিনি ছিলেন বিখ্যাত। আলবার্ট আইনস্টাইন তাকে একবার বলেছিলেন,
“তোমার যে বিষয়টি আমাকে বেশ অভিভূত করে, তা হলো তোমার শিক্ষকতা। যার মাধ্যমে তুমি অনেক নতুন মেধাবী মুখ বের করতে পেরেছ।”
গণিতবিদ মরিস ক্লাইন একবার সমারফিল্ড সম্পর্কে বলেন,
“তিনি ছিলেন তড়িৎচৌম্বকীয় তত্ত্ব, রিলেটিভিটি এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকনির্দেশক। পাশাপাশি তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ একজন শিক্ষক, যিনি এই শতকের প্রায় ত্রিশ বছরে আগত যুগান্তকারী সব পদার্থবিদদের গুরু।
বিখ্যাত গণিতবিদ, পদার্থবিদ এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ম্যাক্স বর্ন সমারফেল্ডের তরুণ মেধাবী মুখ বের করার ক্ষমতা সম্পর্কে বলেন,
“তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা সবসময়েই তরুণদের আকর্ষণ করে। আর এই উৎসাহী তরুণদের কিভাবে দিক নির্দেশনা দিয়ে পরিচালনা করতে হবে তা খুব ভালোভাবেই সমারফিল্ড জানতেন। তিনি তাদের দুর্বলতা খুঁজে বের করতেন, এবং ধাপে ধাপে তাদের প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতেন। শত ব্যস্ততা, যেমন তার নিজের কাজ এবং গবেষণার মাঝেও তিনি তার ছাত্রদের জন্য সময় বের করতেন।”
উইলহেলম সমারফিল্ডের অন্যতম অর্জন হলো, তিনি ১৯১৮ সালে Deutsche Physikalische Gesellschaft এর চেয়ারম্যান হন, যে পদটি পূর্বে আলবার্ট আইনস্টাইনের ছিল। সেসময়ে জার্মানিতে নাৎসি দলের উত্থানে সমারফিল্ডকে তার সমসাময়িক অনেক সহকর্মীকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখতে হয়, যা তাকে খুব ব্যথিত করে। এ সম্পর্কে মরিস ক্লাইন বলেন,
“জার্মানির কিছু কর্মকাণ্ডে সমারফিল্ডের জীবন শেষকালে দুঃখময় হয়ে উঠে। দেশটিতে ইহুদি-বিদ্বেষ ছিল বেশ প্রখর। নামিদামি সব ব্যক্তিদের সন্দেহ করা শুরু হয় ইহুদি সমব্যথী হিসেবে। এদের মধ্যে আইনস্টাইন নিজেও ছিলেন। যার ফলে তাকেও দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। এসবের পাশাপাশি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে জার্মানির বৈজ্ঞানিক মেধা প্রায় শেষ হয়ে যায়। এজন্য সমারফিল্ড তার সাধারণ অবসরের বয়স তথা ৬৫ বছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নিজে থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা প্রদান করে যান শুধুমাত্র জার্মানিকে মেধাশূন্য হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে।”
তবে সমারফিল্ডের ১৯৩৬ সালেই অবসর গ্রহণের ইচ্ছা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন নিজের একজন উপযুক্ত শিষ্যের উপর সব দায়িত্ব দিয়ে তিনি অবসরে যাবেন। এক্ষেত্রে তিনি নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হাইজেনবার্গকেই উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু সমারফিল্ডের সাথে সাথে হাইজেনবার্গকেও সন্দেহ করা হয়েছিলো ইহুদী সমব্যথী হিসেবে। এজন্য পরবর্তীতে সমারফিল্ডকে তার পদ থেকে সরিয়ে উইলহেলম মুলারকে সেখানে বসানো হয়, যিনি মোটেও একজন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ ছিলেন না। এসব দেখে এবং হিটলার ক্ষমতায় আসার পর সমারফিল্ড একটি চিঠিতে আইনস্টাইনকে দুঃখভারাক্রান্ত মনে বলেছিলেন,
“আমাদের দেশের শাসকদের ‘জাতীয়তা’ শব্দটির অপব্যবহার আমার নিজের জাতীয় অনুভূতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। এখন আমার জার্মানিকে পরাশক্তির কোনো দেশের তুলনায় বরং কোনো শান্ত ইউরোপীয় দেশে পরিণত হয়ে যেতে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
উইলহেলম সমারফিল্ডের অন্যান্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে ম্যাক্স-প্লাংক পদক, লরেন্টজ পদক এবং অয়েরস্টেড পদক। তিনি রয়্যাল সোসাইটির একজন সদস্যও ছিলেন। পাশাপাশি তিনি আরও যে সকল একাডেমির সদস্য ছিলেন সেগুলো হলো- ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্স, দ্য ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্স এবং একাডেমি অফ সায়েন্সেস অফ ইউএসএসআর।
যদিও সমারফিল্ড সর্বোচ্চ ৮৪ বার নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন, তবুও একবারও তিনি তা জিততে পারেননি। তার নিকটবর্তী যে ব্যক্তিটি বেশিবার নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, তিনি অট্টো স্টার্ন। তবে স্টার্ন মোট ৮২ বার মনোনীত হয়ে অবশেষে ১৯৪৩ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতেছিলেন। সমারফিল্ড পদার্থে যে সালগুলোয় নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিলেন, তা হলো-
- ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯১৯ সালে দুবার,
- ১৯২০, ১৯২২ সালে চারবার,
- ১৯২৩ সালে দুবার,
- ১৯২৪, ১৯২৫ সালে ছয়বার,
- ১৯২৬ সালে তিনবার,
- ১৯২৭ সালে তিনবার,
- ১৯২৮ সালে তিনবার,
- ১৯২৯ সালে নয়বার,
- ১৯৩০ সালে চারবার,
- ১৯৩১ সালে দুবার,
- ১৯৩২ সালে পাঁচবার,
- ১৯৩৩ সালে আটবার,
- ১৯৩৪ সালে ছয়বার,
- ১৯৩৫, ১৯৩৬ সালে দুবার,
- ১৯৩৭ সালে আটবার,
- ১৯৪০, ১৯৪৮, ১৯৪৯ সালে তিনবার,
- ১৯৫০ সালে তিনবার এবং
- ১৯৫১ সালে চারবার।
দুঃখের বিষয়, এই কালজয়ী পদার্থবিদ একটিবারের জন্যও নোবেল পুরস্কার হাতে পাননি।
১৯৫১ সালের ২৬ এপ্রিল সমারফিল্ড মারা যান। সে সময়ে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। একদিন নিজের নাতি-নাতনিদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটার সময় একটি দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। সেসময়ে তার শ্রবণশক্তি ছিল খুবই দুর্বল। যে কারণে অন্যদের জোরগলার সতর্কবাণী শুনতে না পেয়ে একটি চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সড়ক দুর্ঘটনা থেকে আঘাত পাওয়ার প্রায় দুই মাস পর তিনি মারা যান।
ফিচার ইমেজ: Edited by writer