২৪ অক্টোবর, ১৯১৭। আল্পসের কিনার ঘেঁষে বেড়ে ওঠা কাপোরেতো শহরের পাশেই অবস্থান নিয়েছে ইতালীয় বাহিনী। অস্ট্রো-হাঙ্গেরি আর জার্মানির যৌথ সেনাদল পর্বতের উপরেই অবস্থান করছে। ইতালীয় বাহিনীর তুলনায় যৌথ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। তাই উপরের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে বলা হলো।
এদিকে যুদ্ধ করে ক্লান্ত জার্মান রয়্যাল মাউন্টেইন ব্যাটালিয়নের রসদে টান পড়েছে। খাবারের অভাব, খেতে হচ্ছে রেশন করে, ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে পুরো দল। এমন সময় উপরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেই এক তরুণ লেফটেন্যান্ট সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে চলা যাবে না, নিজেই আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের কোম্পানির মাত্র ১৫০ জন সৈন্যকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন শত্রুপক্ষের এলাকায়। লুকোচুরি খেলে ইতালীয় বাহিনীর অগোচরে চলে গেলেন তাদের পিছনে, ঘিরে ধরলেন চারপাশ থেকে।
হঠাৎ শুরু হলো অতর্কিত হামলা, চারদিকে হাতেগোণা কয়েকজন সৈন্য, কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইতালীয় বাহিনী প্রতিপক্ষের সৈন্য সংখ্যা আঁচ করতে পারেনি। মাত্র ১৫০ জনের দল নিয়ে ইতালীয় বাহিনীর ৯ হাজার সেনাকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করালেন ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট এরউইন রোমেল, সাথে আটক করা হলো ৮১টি আর্টিলারি। বিনিময়ে রোমেল হারিয়েছেন মাত্র ৬ জনকে! রোমেলের ঝটিকা আক্রমণের পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে বাকি ইতালীয় সেনাদেরকেও আটক করা হলো, ইতালির সেনাবাহিনীর ইতিহাসে লেখা হলো সবচেয়ে বড় পরাজয়। ব্যাটল অফ কাপোরেতোতে যৌথ বাহিনীর ৭০ হাজার সেনার বিপরীতে ইতালীয়রা হারিয়েছে ৩ লক্ষাধিক সেনা! আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যার, সেই রোমেলকে দেওয়া হলো সম্মানসূচক ‘পৌর লে মেরিট’ পদক।
জার্মানির ইতিহাসের সেরা এই জেনারেল হয়তো সামরিক বাহিনীতেই যোগ দিতেন না, কিন্তু তার ভাগ্য অন্যরকমভাবে লেখা হয়েছিল।
রোমেল ‘দ্য ইঞ্জিনিয়ার’
১৮৯১ সালে জার্মানির হাইডেনহেমে জন্মগ্রহণ করা এরউইন রোমেলের পরিবারের সাথে সামরিক বাহিনীর তেমন কোনো যোগসূত্র ছিল না। রোমেলের বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক, যদিও তরুণ বয়সে আর্টিলারি বিভাগের লেফটেন্যান্ট ছিলেন। তার অন্য তিন ভাই-বোনের মধ্যে কেউই সামরিক ক্যারিয়ার বেছে নেননি। দুই ভাইয়ের একজন ছিলেন ডেন্টিস্ট, অন্যজন অপেরা গায়ক, আর বোন ছিলেন আর্ট শিক্ষক। রোমেল যে ছোটবেলাই থেকে শক্ত-সামর্থ্য ছিলেন এমনটা নয়, এমনকি দুর্বল শরীর বলেও খ্যাপানো হয়েছে তাকে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই খেলাধুলার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। নেতৃত্ব যেন তার জিনের মধ্যেই ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই বনে যান স্কুলের স্পোর্টস টিমের অধিনায়ক। তবে শুধু খেলাধুলাই নয়, গণিত আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রতিও তার অসাধারণ প্রতিভা চোখে পড়ল।
কিশোর বয়সেই নিজেই গ্লাইডার তৈরি করে ফেললেন তিনি। অবসর সময় কাটাতেন বিভিন্ন যন্ত্র আলাদা করা আর জোড়া লাগানোর মধ্যে দিয়ে, এমনকি পুরো মোটরসাইকেলের সবটুকু খুলে ফেলে আবার জুড়ে চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। তবে এই ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিভা তার স্কুলের গ্রেডের উপর বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা অধরাই থেকে গেল রোমেলের। এদিকে যন্ত্রের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তাকে ঠেলে নিয়ে গেল ফ্যাক্টরির দিকে। তার ইচ্ছা ছিল কোনো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে ঢুকে নিজের প্রতিভাকে আরও বিকশিত করা। কিন্তু তার বাবার নিষেধের মুখে শেষমেষ তাকে ঢুকতে হলো সামরিক বাহিনীতে।
১৮ বছর বয়সে রোমেলকে ভর্তি করা হলো ডানজিগের অফিসার ক্যাডেট স্কুলে। ক্যাডেট স্কুলে থাকার সময়েই রোমেলের সাথে পরিচিয় হয় তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী লুসি মুলেনের সাথে। দুই বছর পর সেখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে বের হওয়ার পর যোগ দিলেন ভাইনগার্টেনের ১২৪ ইনফ্যান্টি রেজিমেন্টে, লেফটেন্যান্ট হিসেবে। এদিকে ভাইনগার্টেনে থাকার সময় রোমেল ওয়ালবার্গার স্টেমারের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। স্টেমার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তিনি স্টেমারকে বিয়ে করার প্রতিজ্ঞা করলেও শেষমেশ তা রক্ষা করেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রোমেল স্টেমারকে চিঠি পাঠান যে, তাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। স্টেমারের মতো সাধারণ মেয়ে রোমেলের মতো সামরিক অফিসারের সাথে মানাবে না বলে তিনি সরে আসেন। এদিকে যথাসময়ে স্টেমার একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়, রোমেল তার নাম রাখেন গারট্রুড। এদিকে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রোমেল জার্মানিতে ফিরে আসেন এবং বিয়ে করেন ক্যাডেট স্কুলে পরিচয় হওয়া সেই লুসি মুলেনের সাথে। রোমেলের বিয়ে হওয়ার সংবাদ শুনেও রোমেলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রতিজ্ঞা করেন স্টেমার, গারট্রুডকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নেন। স্টেমার আশা করেছিলেন অন্তত লুসির গর্ভে রোমেলের কোনো সন্তান হবে না। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞাও ভঙ্গ করেন রোমেল। ১৯২৮ সালে লুসির গর্ভে ম্যানফ্রেডের জন্মের পর আত্মহত্যা করে বসেন স্টেমার। স্টেমার মারা যাওয়ার পর রোমেল গারট্রুডকে স্টুটগার্টে নিজের কাছে নিয়ে আসেন, এবং পরিচয় দেন নিজের ভাতিঝি হিসেবে। লুসির সহযোগিতায় গারট্রুড রোমেলের মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই ছিল। ম্যানফ্রেডও পরবর্তীতে স্টুটগার্টের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষক
১৯১৪ সালে মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রোমেলের জায়গা হলো ভার্দুনে প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তার সাহসিকতার জন্য। একবার গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর শুধু বেয়নেট নিয়েই ফরাসি সৈন্যদের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন তিনি। পায়ে গুলি লেগে পড়ে গেলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন সেবার, আর সেই পায়ের আঘাত যুদ্ধক্ষেত্রের অসংখ্য আঘাতের প্রথমটি। প্লাটূন কমান্ডার হলেও যুদ্ধের একেবারে প্রথম সারিতে দেখা যেত তাকে। ফলে নিজের সৈন্যদের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। শুধু নেতৃত্ব নয়, বরং যুদ্ধে নতুন নতুন কৌশল বের করার কারণেও রোমেলকে প্রশংসার চোখে দেখা হতো। ১৯১৭ তে ব্যাটল অফ কাপোরেতোর অবদানের জন্য অর্ডার অফ মেরিট পদক পাওয়ার আগেও আয়রন ক্রস নিজের গলায় ঝুলিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর লেফটেন্যান্ট থেকে তাকে ক্যাপ্টেনে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রেও রোমেল ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার, নৃশংস আক্রমণের চেয়ে কূটনীতিক পদ্ধতিকেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। লিন্ডাউ শহরে হঠাৎ বিদ্রোহ শুরু হলে রোমেল আক্রমণ না করে নিজেই কথার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করেন। আর এ কারণেই তাকে যুদ্ধের পর ড্রেসডেন ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তরুণ উদীয়মান সামরিক অফিসার খুঁজে বের করার জন্য। ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে রোমেল তা-ই শেখাতেন, যা তিনি নিজে মেনে চলতেন।
“নিজের সৈন্যদের কাছে উদাহরণ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলো, যখন তুমি দলের সাথে থাকো, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও। সবসময় কৌশলী হও এবং অবশ্যই ভদ্র ব্যবহার করো এবং অধীনস্তদেরকেও তা করতে পরামর্শ দেও। কখনোই উঁচু স্বরে কথা বোলো না, ঔদ্ধত্য প্রকাশ কোরো না, কারণ তা দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে যা তা লুকিয়ে রাখতে চায়।”
ইনফ্যান্ট্রি স্কুলে শিক্ষক হওয়ার সময়েই সামরিক কৌশল নিয়ে বই লেখেন তিনি। প্রায় ১৫ বছর পর শিক্ষক থাকার পর তাকে আবার রেজিমেন্ট প্রধান হিসেবে গসলাতে পাঠানো হয় সৈন্যদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য। ১৯৩৭ এর শুরুতে সৈন্যদের অবস্থা দেখতে হাজির হন হিটলার এবং সেখানেই রোমেলের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তার। সেনাপতি হিসেবে রোমেলের সামর্থ্য ও খ্যাতি সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানতেন ফুয়েরার, তাই তার কিছুদিন পরেই রোমেলকে হিটলার ইয়ুথের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষা বিভাগের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। যদিও রোমেল নাৎসি পার্টির সদস্য ছিলেন না, তবে জার্মানির সামরিক শক্তি আবারও বৃদ্ধি করার ফলে হিটলারের প্রতি মৌন সমর্থন দিয়েছিলেন। এদিকে হিটলার ইয়ুথের আরেক অফিসারের সাথে মনোমালিন্য এবং যুদ্ধ পরিকল্পনা ও স্ট্র্যাটেজির সাথে একমত না হওয়ায় তাকে এক বছরের মধ্যেই তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে হিটলার রোমেলের মতো বিচক্ষণ কাউকে হাতে রাখতে চেয়েছিলেন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কাজে লাগানোর জন্য। ফলে রোমেলের জায়গা হয় হিটলারের ব্যক্তিগত বাহিনীতে, ফলে রোমেল শুধু ফ্যুয়েরারের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগই পেলেন না, বরং নিজের পুরনো আগ্রহ- গণিত আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এও মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পেলেন। তবে সেই সুযোগ বেশিদিন স্থায়ী হলো না।
যুদ্ধের ডাক
সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯। জার্মান ব্লিৎসক্রেইগে পোল্যান্ড ধরাশায়ী হওয়ার পর হিটলার ইউরোপের বাকি দেশগুলোর দিকে নজর ফেরালেন। শুরু হলো ২য় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রস্তুতির সময়েই রোমেলকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হলো। যদিও যুদ্ধ শুরুর পর বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি হিটলারের ব্যক্তিগত বাহিনীতেই ছিলেন এবং তার নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো দেখতেন। অবশেষে ১৯৪০ সালে তাকে ৭ম পাঞ্জার ডিভিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলো।
ট্যাংক ডিভিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর রোমেল তার দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পেলেন। প্রাথমিকভাবে তাকে মাউন্টেন ডিভিশনের প্রধান বানালেও হিটলারের সহযোগিতায় রোমেল তার উপযুক্ত ডিভিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। তার সাথে পেলেন একদন রাইফেল রেজিমেন্ট, একটি মোটরসাইকেল ব্যাটালিয়ন এবং ইঞ্জিনিয়ারদের একটি ব্যাটালিয়ন। বলা চলে, রোমেল হিটলারের সুবিধা নিয়েই নিজের দল গোছাচ্ছিলেন এবং তা ছিল সেনাবাহিনীর নিয়ম বহির্ভূত। এদিকে সেনাবাহিনীর আরও উচ্চপদস্থ ও অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে থাকা জেনারেলদেরকে টপকিয়ে রোমেলের এরূপ আচরণ তাদের ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু রোমেল নিজেকে প্রমাণ করলেন যুদ্ধক্ষেত্রে, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়। কয়েক মাসের দীর্ঘ ট্রেনিং এর পর ১৯৪০ এর মে মাসে রোমেল তার বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শুরুটা তেমন ভালো হলো না রোমেলের।
ব্রিজের ওপাশ থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে ফরাসি বাহিনী, গুলির দেয়ালের সামনে এগোতেই পারছে না রোমেলের বাহিনী। রোমেলের নির্দেশে ব্রিজের এপাশ স্মোক গ্রেনেডের ধোঁয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। একপাশ থেকে নিজের বাহিনীকে গুলি চালাতে বললেন নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে ভুল বোঝানোর জন্য, অন্যপাশ থেকে শুরু করলেন আরেকটি ব্রিজ বানানো। ব্রিজ বানানো শেষ হতেই নিজের বাহিনী নিয়ে ফরাসি বাহিনীকে পেছন দিক থেকে ঘিরে ফেললেন রোমেল। ১০ হাজার ফরাসি সৈন্য ধরা পড়লো রোমেলের হাতে, বিনিময়ে মাত্র ৩ ডজন সৈন্য হারাতে হলো তাকে। এই বিশাল জয়ের জন্য রোমেলের ঝুলিতে যুক্ত হলো নাইটস ক্রস পদক।
এদিকে একের পর এক অভিযান পরিচালিত হতে থাকলো রোমেলের হাত ধরে। ফ্রান্সের এমাথা থেকে ওমাথা একের পর এক ফরাসি বাহিনীর পতন হতে থাকলো। এত দ্রুত রোমেল তার বাহিনী নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা থেকে ছুটছিলেন যে জার্মান হাই-কমান্ডও রোমেলের খোঁজখবর রাখতে পারছিলেন না। এদিকে রোমেলের এই একক ইচ্ছানুযায়ী চলার প্রবণতা জার্মান বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন গুজবের জন্ম দিলো। ঐ সময়েই ফ্রান্সে আত্মসমর্পণ করা কৃষ্ণাঙ্গ ফরাসি সৈন্যদের উপর চালানো গণহত্যার পেছনে রোমেলকে দায়ী করা হয়, কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদের মতে রোমেলের অধীনে থাকা সেনারা এই গণহত্যা চালালেও রোমেলের আদেশে তা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
মরুভূমির শেয়াল
জুন, ১৯৪০। পুরো ফ্রান্স দখল করার পর হিটলারের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল ব্রিটেনের উপর চড়াও হওয়া, আর এর পেছনে প্রধান দায়িত্ব তুলে দেওয়ার কথা ছিল রোমেলের কাঁধে। কিন্তু ব্রিটেন দখল করার জন্য জার্মান এয়ারফোর্স লুতওয়াফের প্রস্তুতি যথেষ্ট না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা মুলতবি রাখা হলো। জার্মানরা এবার নজর ফেরালো আফ্রিকার দিকে। জার্মান বাহিনীর নতুন ডিভিশন আফ্রিকানকর্পসের প্রধান হিসেবে পাঠানো হলো জেনারেল রোমেলকে। উত্তর আফ্রিকায় নাস্তানাবুদ ইতালীয় বাহিনীর সহযোগিতার জন্য রোমেল হাজির হলো তার বাহিনী নিয়ে।
১৯৪১, লিবিয়া। ইতালীয় বাহিনীর নির্দেশ ছিল ব্রিটিশদের আক্রমণ ঠেকিয়ে যাওয়া। কিন্তু রোমেলের ইতালীয়দের এই স্ট্র্যাটেজি পছন্দ হলো না। ইতালীয়দের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেই তিনি ব্রিটিশ শিবিরে হানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে ব্রিটিশরাও তাদের গুপ্তচরদের মাধ্যমে সংবাদ পেয়েছিল রোমেল হয়তো ইতালীয় জেনারেলদের নির্দেশমতোই কাজ করবেন। কিন্তু রোমেলের অতর্কিত আক্রমণে ব্রিটিশরা ধরাশায়ী হলো। রোমেল সফল হলেও আদেশ অগ্রাহ্য করায় অসন্তুষ্ট হলেন ইতালীয় জেনারেল গ্যারিবল্ডি। কয়েক মাস পর ব্রিটিশরা পুনরায় তোব্রুক শহর দখল করার ঘটনা ছিল রোমেলের অন্যতম বড় পরাজয়। এদিকে এ ঘটনার পর রোমেলকে ইতালিতে ডাকলেন হিটলার, সাথে ছিলেন আরেক জার্মান ফিল্ড মার্শাল আলবার্ট কেসেলরিং। লিবিয়ায় কীভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে তা নিয়ে দুই ফিল্ড মার্শাল মুখোমুখি হলেন এবং শেষমেশ হিটলার কেসেলরিংয়ের পক্ষে রায় দিলেন। ফলে কেসেলরিং পেলেন আফ্রিকানকর্পসের দায়িত্ব, অন্যদিকে রোমেলের বাগ্যে জুটলো ফ্রান্সের উপকূলে থাকা সৈন্যদের দায়িত্ব।
অ্যান্টি-ফ্যুয়েরার রোমেল
দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় হিটলারের উপর মনঃক্ষুণ্ণ হলেন রোমেল, হিটলারের ভুলগুলো আরও প্রকটভাবে তার চোখে ধরা পড়তে থাকলো। যুদ্ধক্ষেত্রে সুৎসটাফেলদের নৃশংসতার সমালোচনা করেন তিনি, তাছাড়া যুদ্ধের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পক্ষে ছিলেন তিনি। সরাসরি না হলেও হিটলারের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের বিরোধী ছিলেন তিনি।
১৯৪৩ এ ফ্রান্সের উপকূল রক্ষার দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রতিরক্ষার জন্য পুরো উপকূল জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া আর মাইন পুঁতে রাখার ব্যবস্থা করেন। তিনি চেয়েছিলেন উপকূলের কাছাকাছি আরও ট্যাংক জড়ো করার জন্য। কিন্তু উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তারা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। আর ঠিক তা-ই হলো, যা তিনি আশঙ্কা করেছিলেন।
১৯৪৪ এর ৫ জুন। স্ত্রী লুসির জন্মদিনের জন্য ফ্রান্স থেকে জার্মানির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন রোমেল। পরদিন ৬ তারিখ, ফ্রান্সের আবহাওয়াও বেশ খারাপ। জার্মানরা ভেবেছিলো এই আবহাওয়ায় মিত্রপক্ষের কাছ থেকে তেমন কোনো বাধা আসবে না, আর আসলেও তা আসবে ক্যালায় থেকে। জার্মানদের দুর্বল গুপ্তচর বাহিনীকে প্ররোচিত করে নাৎসিদের নজর ক্যালায়ের দিকে সরিয়ে রেখেছিলো মিত্রপক্ষ। এদিকে জার্মানিতে স্ত্রীর জন্মদিন পালন করতে থাকা রোমেলের কাছে হঠাৎ ফোনকল আসলো, নরম্যান্ডির সৈকত থেকে স্রোতের মতো মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা ফ্রান্সে ঢুকতে শুরু করেছে। সাথেসাথেই বাড়ি ছাড়লেন রোমেল, কিন্তু এই আচমকা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না জার্মানরা। ফ্রান্সের একের পর এক জায়গা নাৎসিমুক্ত হওয়া শুরু করলো। কিছুদিনের মধ্যেই নরম্যান্ডি দিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য ফ্রান্সে ঢুকে পড়লো। এদিকে মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমানের ছোঁড়া বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হওয়া রোমেল যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা পর্যালোচনা করে হিটলারকে পরামর্শ দিলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কথাবার্তার মাধ্যমে বা যেভাবেই হোক শান্তিচুক্তি করা। কিন্তু রোমেল হয়তো ভাবতে পারেননি, এই মিটিংটিই হবে তাদের শেষ দেখা। হিটলার সরাসরি রোমেলের পরামর্শ নাকচ করে দিয়ে তার গোঁয়ার মনোভাব বজায় রাখলেন।
এদিকে হিটলারের গোয়ার্তুমি দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ হিটলারকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। তবে এই পরিকল্পনায় রোমেল আদৌ ছিলেন কিনা তা সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নয়। তবে পরবর্তীতে রোমেলের স্ত্রী লুসির কাছ থেকে শোনা যায়, তিনি হিটলারকে যুদ্ধাপরাধের কারণে শুধু বিচারের মুখোমুখি করতে চেয়েছিলেন।
২০ জুলাই, ১৯৪৪। হিটলারের টপ সিক্রেট কনফারেন্স রুম ‘ওলফ’স লেয়ার’-এ ঢোকার সুযোগ পান কাউন্ট স্টাফেনবার্গ, তার সাথে রয়েছে ব্রিফকেসভর্তি বিস্ফোরক। ব্রিফকেস থেকে বিস্ফোরকের ফিউজ জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করতেই এক কর্মচারী তাকে ডাকা শুরু করেন। স্টাফেনবার্গ তাড়াহুড়ো করে মাত্র একটা বিস্ফোরকের ফিউজই জ্বালাতে পারেন এবং তা নিয়েই কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়েন। তিনি টেবিলের নিচ দিয়ে যতটা সম্ভব হিটলারের দিকে ব্রিফকেসটা ঠেলে দেন। বিস্ফোরণ ঘটে ঠিকই, কিন্তু একটা বিস্ফোরক হিটলারকে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না; বিস্ফোরণের আঘাতে চারজন মারা যায় এবং বাকিরা ভালোমতোই আহত হন। স্টেফানবার্গ ধরা পড়েন, তার সাথে আরও কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারীর নাম উঠে আসে, এবং সে তালিকাতেও ছিল রোমেলের নামও।
অক্টোবর, ১৯৪৪। রোমেলের বাংকারে হাজির হয় হিটলারের দুই নাৎসি জেনারেল, আর সাথে রয়েছে সুৎসটাফেল বাহিনী। দুই জেনারেল রোমেলকে বললেন হয় তিনি হিটলারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য সরাসরি হিটলারের কাছে জবাবদিহি করার সুযোগ পাবেন এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, অথবা এখনই সায়ানাইড পিল খেয়ে আত্মহত্যা করতে পারবেন, সেক্ষেত্রে তার পরিবার এবং তার স্টাফদের বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, এবং তাকে যথাযথ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হবে। রোমেল দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিলেন।
স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে সব ব্যাখ্যা করার পর দুই জেনারেলের সাথে এসএস-এর গাড়িতে উঠলেন রোমেল, এবং গাড়ির মধ্যেই সায়ানাইড পিল খেয়ে আত্মহত্যা করলেন দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সেরা এই জেনারেল। তাকে কথামতো যথাযথ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হলো, এবং প্রকাশ করা হলো মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমানের ছোঁড়া সেই বোমার আঘাতের পর অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার পর তিনি মারা যান। তবে যুদ্ধের পর অবশেষে রোমেলের মৃত্যু সম্পর্কিত রহস্য বিশ্ববাসীর কাছে খোলাসা হয়।
তার প্রজন্ম এমনকি ইতিহাসের অন্যতম সেরা জেনারেল হলেও রোমেল এমন এক শাসকের হুকুম পালন করেছিলেন যার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছিল এক অনিশ্চয়তার মুখে। আর তার বিরোধিতা করার কারণেই নিজের প্রাণ নিজেকেই হরণ করতে হলো এই আসল আত্মমর্যাদাবান জার্মানকে।