কুসংস্কার কিংবা গোঁড়ামি অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক ও বৌদ্ধিক উন্নতির পথে অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে সব যুগেই কিছু ব্যক্তি থাকেন যারা সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেন। এরকমই একজন মানুষ হলেন মধুসূদন গুপ্ত।
তখনকার দিনে গোঁড়া হিন্দু সমাজে শব ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ ছিল। তাই ১৮৩৬ সালের আগে ইউরোপিয়ান এলোপ্যাথি উপায়ে চিকিৎসা করবে এরকম কোনো চিকিৎসক ছিল না উপমহাদেশে। কারণ এলোপ্যাথিক উপায়ে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হলে শব ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে শারীরতত্ত্ব পড়তে হবে। হিন্দু সমাজে এ ধরনের কাজকে গর্হিত এবং ধর্মহীনতার লক্ষণ বলে বিবেচনা করা হতো। একজন আয়ুর্বেদী শল্য চিকিৎসক হিসেবে মধুসূদন গুপ্ত সর্বপ্রথম এ কাজে এগিয়ে আসেন। ১৮৩৬ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে শব ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে এ ইতিহাস গড়েন।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সেই প্রাচীনকালের চিকিৎসাবিজ্ঞানী সুশ্রুতের পর এই প্রথম মধুসূদন গুপ্তের মাধ্যমে শব ব্যবচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। মধুসূদন গুপ্ত রক্ষণশীল এবং প্রাচীনপন্থী সকল হিন্দু মোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ কাজে অংশ নেন। নিষেধের সকল বাধা পেরিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল তাঁর হাত ধরেই।
তাঁর জন্ম খুব সম্ভবত ১৮০০ সালে। এ সময় কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। তিনি ছিলেন হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামের এক আয়ুর্বেদিক বৈদ্য পরিবারের সন্তান। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় তাঁর পরিবারের খুব প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল বলে জানা যায়। পিতামহ ছিলেন হুগলির নবাব পরিবারের গৃহ চিকিৎসক। ছেলেবেলায় তিনি অবশ্য একদম পড়াশোনা করতে চাইতেন না । তাঁর বাবা তাঁকে পড়াশুনায় অমনোযোগী বলে একবার বাড়ি থেকে নাকি বেরও করে দিয়েছিলেন।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি ভর্তি হন সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগে। আয়ুর্বেদে অসাধারণ দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি সংস্কৃত, ন্যায়শাস্ত্র, অলংকার প্রভৃতি বিষয় পাঠে যথেষ্ট বৈদগ্ধ্যের পরিচয় দেন।
সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি কেবলরাম কবিরাজ নামে এক আয়ুর্বেদিক বৈদ্যের কাছে দেশজ পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ দেওয়ার বিধি-বিধান সম্বন্ধে হাতে কলমে শিক্ষা নেন। সে সময় তিনি বিভিন্ন বৈদ্যের সাথে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখতে যেতেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁকে চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধে ব্যুৎপত্তি অর্জনে পরবর্তীতে সাহায্য করেছিল।
যখন তিনি সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র পড়তেন তখন থেকেই শারীরতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি কাঠ বা মোম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন অস্থি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। মাঝে মধ্যে নিজ থেকেই বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহ ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে তিনি ব্যবচ্ছেদ কার্যে আস্তে আস্তে পটু হয়ে উঠেন ।
তাছাড়া ধীরে ধীরে তাঁর জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণাও বাড়তে থাকে। বুদ্ধি ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি হয়ে উঠতে থাকেন স্থির ও সাবলীল। কলেজে অনেক ইংরেজি ভাষায় রচিত চিকিৎসা শাস্ত্রীয় বই ছিল। ইংরেজি ভালো মতো রপ্ত করে সেগুলো পড়ে ফেলেন। সংস্কৃত কলেজে থাকার সময়েই হুপারের লেখা Anatomist’s Vade Mecum বইটি সংস্কৃতে অনুবাদ করে ১,০০০ টাকা পুরস্কার অর্জন করেন।
স্থানীয়দের চিকিৎসাদানের জন্য ১৮৩২ সালের প্রথমে সংস্কৃত কলেজের পাশে একটি একতলা বাড়িতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষকেরা এসে এখানে ক্লাস নিতেন এবং চিকিৎসা বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। মধুসূদন গুপ্ত সেসব বক্তৃতা শুনতেন যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে। ফলে বিভিন্ন সহপাঠির চেয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অনেক বেশি প্রখর ও ঋদ্ধ।
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ খোলার পর সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের বিভাগটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মেডিকেল কলেজের ডেমোনস্ট্রেটরের কাজে নিযুক্ত হন ও সহকারী অধ্যাপকের কাজ করতে থাকেন। কিন্তু একজন সহপাঠীর কাছ থেকে পাঠ নিতে শিক্ষার্থীরা আপত্তি করে। তাই পাশ করা ডাক্তারের ডিগ্রি নিতে হয় তাঁকে। এজন্য যে পরীক্ষা তাঁকে দিতে হয় তাতে তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণও হন। এরপর ১৮৩৬ সালের ১০ই জানুয়ারি সৃষ্টি হয় সেই ইতিহাসের। যে ঘটনার মাধ্যমে এক নতুন যুগ আসে ভারতীয় উপমহাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে। সে দিনের রোমাঞ্চকর স্মৃতিচারণা-
….মেডিকেল কলেজের সব ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পাছে এই বিধর্মী কাজ বন্ধ করার জন্য প্রাচীনপন্থীরা কলেজে আক্রমণ চালায়! মেডিকেল কলেজের মর্গে তিল ধারণের ঠাই নেই, সেখানে উপস্থিত মেডিকেল কলেজের সব ইংরেজ অধ্যাপক, ছাত্রেরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছে ঘরের বাইরের দরজায়, জানালার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রেখে অপেক্ষা করছে অনেকে। সারা ক্যাম্পাস ফাঁকা। নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার গুডিভের সঙ্গে দৃপ্তপদে ঘরে ঢুকলেন একদা সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগের ছাত্র পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত। বর্তমানে পণ্ডিত গুপ্ত একই সঙ্গে মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্র। ডাক্তারী শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ সার্জারি, যা ভারতে এখনও করানো সম্ভব হয়নি, শব ব্যবচ্ছেদ নিয়ে বর্ণহিন্দুদের গোঁড়া কুসংস্কারের জন্য, সেই কাজটিই আজ করতে এসেছেন পণ্ডিত মধুসূদন, হাতে তাঁর একটি শব ব্যবচ্ছেদ করার তীক্ষ্ণ ছুরি। তাঁর সঙ্গে যোগ দেবার জন্য দলে নাম ছিল উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীন চন্দ্র মিত্রের। কিন্তু তাঁরা দরজার বাইরেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঘরে ঢুকে মধুসূদন বিনাদ্বিধায় এগিয়ে গেলেন শবের দিকে। শবদেহের নির্ভুল জায়গায় ছুরিটি প্রবেশ করালেন তিনি। মুখে কোনও আড়ষ্টতা বা অস্থিরতার চিহ্ন নেই। খুব নিখুঁতভাবে আর সুন্দরভাবে বিনাদ্বিধায় সম্পন্ন করলেন ব্যবচ্ছেদের কাজ। ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞানী শুশ্রূতের পরে এই প্রথম হলো শবব্যবচ্ছেদ। দীর্ঘকালের কুসংস্কারের আর গোঁড়া পন্ডিতদের বিধি-নিষেধের বেড়া ভেঙে দিলেন তিনি এই একটি কাজের মাধ্যমে। নিষেধের জগদ্দল ভার সরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভারত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল।”
১৮৪৭ এ চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটের সম্পাদকে একটি চিঠিতে ডাক্তার গুডিভ এ সময়টাকে স্মরণ করে লিখেছিলেন-
The most important blow which has yet been struck at the root of native prejudices and superstition, was accomplished by the establishment of the Medical College of Calcutta, and the introduction of practical anatomy as a part of the professional education of Brahmins and Rajpoots, who may now be seen dissecting with an avidity and industry which was little anticipated by those who know their strong religious prejudices upon this point twenty years since.
ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে আহত ভারতীয় সৈন্যদের চিকিৎসার সুবিধার জন্য ১৮৩৯ সালে কলকাতা মেডিকেলের সাথে একটি হিন্দুস্থানী শ্রেণী খোলা হয়। ১৮৪২-৪৩ এর দিকে এই বিভাগটি যখন ঢেলে সাজানো হয় তখন এর অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন মধুসূদন গুপ্ত। এই বিভাগ পরিচালনা এবং বিশেষত তৎকালীন প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের অস্ত্রোপচারের জন্যে রাজী করানোর ক্ষেত্রে তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৪৫ সালেই তিনি লন্ডন ফার্মাকোপিয়ার অনুবাদ শেষ করেন, যা ছাপা হয় ১৮৪৯ সালে। বইটির পুরো নাম দেওয়া হয় “লণ্ডন ফার্ম্মাকোপিয়া/অর্থাৎ/ইংলন্ডীয় ঔষধ কল্পাবলী”।
বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বাংলা ভাষায় চিকিৎসাশাস্ত্রীয় বই দেখতে পাই- এর শুরুটা কিন্তু হয়েছিল তাঁর হাত দিয়ে। ১৮৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজের একটি অনুষঙ্গ রূপে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। এই বিভাগে চিকিৎসা বিষয়ক যাবতীয় বিষয় বাংলার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। এই বিভাগে অধ্যক্ষ হিসেবে মধুসূদন যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তখন বিভিন্ন জেলা শহর ও গ্রামগুলোতে চিকিৎসকের প্রয়োজন ছিল প্রচুর আর চিকিৎসা সংক্রান্ত সবকিছু ইংরেজি ভাষায় হওয়ায় সকল ছাত্র ভর্তি হয়ে পুরোপুরি পড়া শেষ করতে পারতো না। তার উপর ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ছিল এখনকার তুলনায় অপ্রতুল। এজন্য মধুসূদন তাঁর সহপাঠীদের নিয়ে বিভিন্ন ইংরেজি বই অনুবাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৮৫৩ সালে মধুসূদন প্রকাশ করলেন ‘এনাটমি’। আজ আমরা এনাটমির বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করি ‘শারীরবিদ্যা’। এই শারীরবিদ্যা শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন মধুসূদন গুপ্ত।
তিনি শুধু একজন দক্ষ শল্য চিকিৎসকই ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্বও। দেশের জনস্বাস্থ্য, পানীয় জলের স্বচ্ছতা ও জীবাণুমুক্তকরণ, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও দূষণমুক্ত করা ইত্যাদি নানা জনহিতকর কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ডায়াবেটিকের রোগী ছিলেন। কিন্তু বারণ না শুনে সংক্রমণের ঝুকি নিয়েও তিনি অনবরত শবব্যবচ্ছেদ করতেন এবং অন্যদের সাহস যোগাতেন। ফলে জীবাণুর সংক্রমণে ডায়াবেটিক সেপ্টিমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে এই শল্যচিকিৎসকের মৃত্যু হয়। দিনটি ছিল ১৮৫৬ সালের ১৫ই নভেম্বর। তাঁর মৃত্যুতে কলকাতার মেডিকেল কলেজের শোকবার্তায় তৎকালীন অধ্যক্ষ উইলসন লেখেন –
To him a debt of gratitude is due by his countrymen. He was the pioneer who cleared a space in the jungle of prejudice, into which others have successfully pressed, and it is hoped that his countrymen appreciating his example will erect some monument to perpetuate the memory of the victory gained by Muddoosoodun Gooptu over public prejudice, and from which so many of his countrymen now reap the advantage.
তথ্যসূত্র ও সহায়িকা
- কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গোড়ার কথা ও পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত – ডা. শংকরকুমার নাথ
- বাংলা অনুবাদ সাহিত্য ১৮০১-১৮৬০ শ্রী যোগেশচন্দ্র বাগল – নির্বাচিত এক্ষণ (প্রবন্ধ সংকলন প্রথম খণ্ড) সম্পাদনাঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশ্রুকুমার সিকদার
- কে ? – রাজেশ বসু
- GCPI, 1856–1957, p. 200.
- Buckland, C. E., Bengal under the Lieutenant-Governors; Being a Narrative of the Principal Events and Public Measures during their Periods of Office, from 1854 to 1898, S. K Lahiri & Co, Calcutta, 1901, vol. I, p. 206.
- Lassek, A. M., Human Dissection: Its Drama and Struggle, Charles C. Thomas, Illinois, 1958.
- Harrison, M., Medicine in an Age of Commerce and Empire: Britain and its Tropical Colonies, Oxford University Press, Oxford, 2010, p. 4.
- Kerr, J., Review of Public Instructions in the Bengal Presidency, from 1835 to 1851, Part II, William H. Allen and Co, London, 1853, p. 210.
ফিচার ছবি-সম্পাদিত