শুধু অপূর্ব রূপসীই ছিলেন না তিনি, ছিলেন খুবই দয়ালু, উদার ও স্নেহপূর্ণ মনের অধিকারীও। সেই সাথে ছিলেন নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ও দৃঢ়চেতা একজন নারী। সমাজের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, পরিবারের তীব্র অনিচ্ছা, এমনকি নিজের ব্যক্তিগত জীবনকেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি অভীষ্ট লক্ষ্যের সামনে। তাঁর সমসাময়িক সমাজে নারীদের ছিল না ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ছিল না অর্থনৈতিক কোনো অধিকার। নারীদের সম্মান তখন নির্ধারিত হতো উপযুক্ত ছেলেকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার মাধ্যমে। এমতাবস্থায় তরুণীর অসাধারণ রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত ছেলেরা ছিল তাঁর পাণিপ্রার্থী, কিন্তু তাঁর কাছে মানবসেবায় নিজের হৃদয়ের ডাকের সামনে তুচ্ছ হয়েছিল নিজের ব্যক্তিগত জীবনের নিশ্চয়তা।
নারী অধিকার আন্দোলন ইউরোপীয় সমাজে তখন তুঙ্গে। কিন্তু তিনি কোনো আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন না। তিনি নিজেই যেন হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির এক অপূর্ব উদাহরণ। কেবল দৃঢ়তা না, মনের কোমলতায় আর দুর্বলের প্রতি স্নেহেও তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ। তাইতো অন্যান্য ডাক্তার-নার্সরা যখন ঘুমে ঢুলে পড়তো রাতে, তিনি একাই প্রদীপ হাতে প্রত্যেক রোগীর কাছে গিয়ে দেখতেন যেন মহামারীর সময়টাতে কেউ নিজের রোগযন্ত্রণায় স্নেহহীন হয়ে না পড়ে। হ্যাঁ, বলছি ইউরোপের অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হাতে সেই নারীর কথা, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের কথা, ক্রিমিয়ান যুদ্ধের বিপর্যস্ত সৈন্যরা তাঁকে ডেকেছিলো ‘ক্রিমিয়ার ফেরেশতা’ নামে।
নাইটিংগেল এই পৃথিবীর সেই অতি অল্প সংখ্যক মানুষদের মধ্যে একজন, যাঁরা সময়ের আহ্বান বুঝতে পেরেছিলেন এবং পারিপার্শ্বিকতার হাজারো বাধা পার করে নিজের মন ও বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় নাইটিংগেল ও তাঁর দলের অসাধারণ কর্মদক্ষতা আর দায়িত্বের প্রতি আত্মোৎসর্গ প্রথমে ব্রিটিশ বেস ক্যাম্পে ও পরে পুরো ইউরোপে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এক নতুন আশার দুয়ার খুলে দেয়। নাইটিংগেলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বে তখনকার নিন্মবিত্তের ‘নার্সিং’ পেশা সকল শ্রেণীর সকল মানুষের কাছে এক নতুন মাত্রা পায়। আজ মানবসেবার আকাশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনের কথাই জানাবো আমরা।
১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিংগেল ও ফ্রান্সিস নাইটিংগেলের ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। মেয়ের জন্মস্থান ফ্লোরেন্স শহরের নামানুসারে বাবা মেয়ের নাম রাখেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। তাঁর পরিবার ১৮২১ সালে ইংল্যান্ডে চলে আসে। তাঁদের পরিবার ছিল ধনী, সম্ভ্রান্ত এক ব্রিটিশ পরিবার। সমাজের একেবারে উঁচুস্তরের মানুষজনের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল সেখানে। ধনী-বণিক পরিবারের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মতো নাইটিংগেলের মা, ফ্রান্সিস নাইটিংগেলেরও অহংকার আর আগ্রহ ছিলো সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স তাঁর মা-বোনের মত একেবারেই ছিলেন না, বরং এই সামাজিকতা তাঁর মধ্যে অস্বস্তি ও বিরক্তি দুটোরই জন্ম দিতো। সবসময়ই তিনি চেষ্টা করেছেন যেকোনো সমারোহকে এড়িয়ে চলতে। পরে অবশ্য এই যোগাযোগকেই তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি ও সাহায্য পেতে। হয়তো মাধ্যমের চেয়ে উদ্দেশ্যটাই বেশি তাৎপর্য রাখে!
নাইটিংগেলের বাবা ছিলেন দুটো স্টেটের মালিক এক ধনী ভূস্বামী। সন্তানের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন যেমন সচেতন, তেমনি উদার। ছোটকালেই নাইটিংগেল গণিত, সংগীত, জার্মান, ফারসি, ইটালিয়ান ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিত্তিমূলক উপর্যুক্ত শিক্ষার মধ্য দিয়ে যান। নাইটিংগেল যখন কেবল যৌবনে পা দিয়েছেন, তখন তাঁর বাবা পুরো পরিবারকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বের হন। এই ভ্রমণই তরুণী নাইটিংগেলের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই ভ্রমণের সময় তাঁর ম্যারি ক্লার্ক নামের একজন ইংরেজ বংশোদ্ভূত ফারসী মধ্যবয়স্কার সাথে পরিচয় হয়। ২৭ বছর পার্থক্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই বন্ধুত্ব সারাজীবন থেকে যায়। ম্যারিকে দেখে ফ্লোরেন্স বুঝতে পারেন মেয়েরা ছেলেদের মতোই উপযুক্ত হতে পারে। ম্যারি ছিলেন এমন একজন মহিলা যাঁর নিজের চেহারা নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। একইসাথে তিনি তখনকার সম্ভ্রান্ত মহিলাদের কর্মহীন, অলস, পরাধীন জীবনকে খুবই অপছন্দ করতেন এবং নারীসঙ্গ এড়িয়ে চলতেন (কেবলমাত্র ফ্লোরেন্স ও তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল)। তিনি বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষদের সাথে মিশতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। পরবর্তীতে ফ্লোরেন্সের জীবনেও এসবের গভীর প্রভাব দেখা যায়।
নাইটিংগেল তাঁর হৃদয়ে মানবসেবার প্রতি প্রথম টান অনুভব করেন ১৭ বছর বয়সে লন্ডনে থাকা অবস্থায়। পরবর্তীতে এই টানকে তিনি ‘ঈশ্বরের ডাক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু সেবাকে তার নিজের জীবনের ব্রত হিসাবে নেয়ার কথায় প্রবল আপত্তি আসে তাঁর পরিবার থেকে। তখন সমাজে নার্সিং ছিল নিম্নবিত্ত, অসহায়, বিধবা মহিলাদের পেশা। পরিবারের প্রবল আপত্তি, বিশেষ করে মা ও বোনের তীব্র রাগ আর হতাশাকে মাড়িয়ে, সমাজে মেয়েদের ভূমিকা শুধু মা ও স্ত্রী হওয়ার মধ্যে আটকে থাকবে- এই নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে, সমাজের ধনী, সুন্দরী, তরুণী ব্রিটিশ মেয়ের সামনের সমস্ত লোভনীয় হাতছানি আর প্রতিবন্ধকতার সামনে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি নিজেকে নার্সিংয়ের কৌশল ও জ্ঞানে দক্ষ করে তুলতে শুরু করেন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সুবাদে তিনি সেসব দেশের সেবা ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা ও অপেক্ষাকৃত উন্নত ব্যবস্থাতে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মানির ক্যাথলিক কনভেন্ট পরিদর্শন ও তাদের নার্সিং স্কুলে ট্রেনিং ও আলেকজান্দ্রিয়ায় সেন্ট ভিনসেন্ট সোসাইটির বৃহৎ হাসপাতালে ট্রেনিং। ১৮৫৩ সালের ২২ অগাস্ট লন্ডনের মেয়েদের একটি হাসপাতালে নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব নেন তিনি। তাঁর বাবা তাঁকে বার্ষিক ৫০০ ডলার (বর্তমানে প্রায় ৬৫,০০০ ইউএস ডলার) করে দিতে থাকেন যা তাঁর স্বাধীন ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনধারণের পথ করে দেয়। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর নিজের লক্ষ্যের পথে চলা।
নাইটিংগেলের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অসুস্থ সৈন্যদের পাশে দাঁড়ানো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের এই যুদ্ধে বিপন্ন সৈন্যদের অবস্থা দেশে এসে বর্ণনা করেন টাইমস ম্যাগাজিনের একজন সাংবাদিক। সংবাদপত্রের এই ভাষ্যে দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। বিচলিত হয়ে উঠলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। সে সময় প্রতিরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি সিডনি হার্বাট (নাইটিংগেলের সারা জীবনের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু ও পরামর্শদাতা) নাইটিংগেলকে লিখলেন- “যুদ্ধের এই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আহত সৈন্যদের তত্ত্বাবধান করার মত একজনও উপযুক্ত ব্যক্তি নেই। যদি আপনি এ কাজের ভার গ্রহণ করেন, দেশ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।” দেশের এই ডাক নাইটিংগেল উপেক্ষা করতে পারেননি। নিজ উদ্যোগে নার্সিংয়ের জন্য ৩৮ জনের স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করে রওনা দিলেন স্কুটারির দিকে (স্কুটারি একটি জায়গার নাম যা বর্তমানে ইস্তানবুলে অবস্থিত), যেখানে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য গড়ে উঠেছে অস্থায়ী হাসপাতাল।
এই হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে ফ্লোরেন্স রেখে যান আধুনিক নার্সিং সেবার এক অনন্য উদাহরণ। এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তীতে লিখে যান আধুনিক নার্সিংয়ের ভিত্তি স্থাপনকারী ‘Notes On Nursing’ এর মতো বই এবং বিভিন্ন বিবরণী ও হাসপাতাল ব্যবস্থার নির্দেশনা। এই যুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি পান রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে থেকে পুরস্কারস্বরূপ ‘Nightingale Jewel’ নামে পরিচিত এক বহুমূল্যবান ব্রোচসহ আরো অনেক পুরষ্কার।
যুদ্ধে তাঁর অবদান ও সম্মুখীন হওয়া প্রতিকূলতার ধারণা অল্প কিছু কথায় দেয়া সম্ভব নয়। তাঁর সেই বিশাল কর্মযজ্ঞ, ব্যক্তিগত জীবনের লুকনো কিছু কথা আর তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ের কথা থাকবে এই লেখার দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে।