জার্মানির বিজ্ঞানী উলহেলম রন্টজেন ‘এক্স-রে’ বা রঞ্জনরশ্মি নামক বিস্ময়কর কিছু একটা আবিষ্কার করেন, যা সাড়া ফেলে সমগ্র বিশ্বে। সালটা ছিল ১৮৯৫, যখন এক্সরে নিয়ে গবেষণারত ছিলেন আরো অনেকেই। এ খবর দ্রুতই পৌঁছে যায় জার্মানি থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ার শহর অ্যাডিলেডে বসবাসকারী এক অখ্যাত পদার্থবিদ উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগের কানেও। আর এটাই ছিল তার বিখ্যাত হবার সিঁড়ি। তিনি রঞ্জনরশ্মির প্রতি এত বেশি আকর্ষণ অনুভব করেন যে নিজ বাড়িতেই এক্সরে যন্ত্রপাতি বসিয়ে নিলেন। তারপর শুরু করলেন গবেষণা।
কিন্তু, কিছুদিন পর দেখা গেল তার ৬ বছর বয়সী ছেলে লরেন্স ব্র্যাগের কৌতুহল তার চেয়েও বেশি। এক্সরে কক্ষে লরেন্সের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন হেনরি। কিন্তু যেভাবেই হোক, লরেন্সের তো সেখানে প্রবেশ করা চাই। তিনি বাবার মুখে শুনেছিলেন যে, এক্সরে এমন এক অদ্ভুত ব্যাপার যা দ্বারা মানবদেহের ভেতরকার ছবিও তোলা সম্ভবপর হতে পারে। শুধুমাত্র সে কক্ষে প্রবেশ করতেই শিশু লরেন্স একদিন ইচ্ছা করে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে নিজের পা ভাঙল, যেন তাকে এক্সরে কক্ষে নিয়ে তার পা পরীক্ষা করা হয়! এই ঘটনার ১৯ বছর পর, এক্সরে নিয়ে গবেষণা করেই নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন সেদিনের কৌতূহলী শিশু লরেন্স ব্র্যাগ।
শৈশবেই বিজ্ঞানের প্রতি ছেলের অনুপম ঝোঁক আবিষ্কার করেন অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হেনরি ব্রাগ। তিনি তাই লরেন্সের প্রাথমিক শিক্ষাটা দিতে লাগলেন নিজেই। গণিত, রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞানে জোর দিলেন বেশি। এর ফলাফলও হাতেনাতেই পেলেন। ৯ বছর বয়সে লরেন্সকে ভর্তি করা হলো অ্যাডিলেডের বিখ্যাত কুইন্স স্কুলে। স্কুলটি এর কঠোর পাঠ্যক্রমের জন্য পরিচিত ছিল। কঠোর অধ্যবসায় ছাড়া ঐ স্কুলে পাস করাই যেখানে মুশকিল হতো, সেখানে প্রতিটি পরীক্ষায় অনায়াসে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করেন লরেন্স। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর গণিতে তার মেধা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তার শিক্ষকরাও।
১৯০১ সালে সেন্ট পিটার্স কলেজে ভর্তি হন লরেন্স। এই কলেজে পদার্থবিজ্ঞান ছিল না। তবে রসায়ন আর গণিতেই পড়ালেখা সন্তুষ্টচিত্তে চালিয়ে যান লরেন্স। তিনি পরীক্ষাগুলোতে তার নিকটতম প্রতিযোগীদের চেয়েও এত বেশি এগিয়ে থাকতেন যে, তাকে দ্রুত উপরের ক্লাসে উন্নীত করে দেয়া হয়!
১৯০৬ সালে, ১৫ বছর বয়স হতে হতেই কলেজের পাট চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখেন লরেন্স। অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত, রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন তিনি। যথারীতি সেখানেও সকলকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়ে চার বছরের স্নাতক ২ বছরেই ফার্স্ট ক্লাস অর্জন করে সমাপ্ত করেন! এরকম সাফল্যময় শিক্ষাজীবন কিন্তু লরেন্সের জন্য মোটেও সুখের ছিল না। তার জীবনের এই সময়কালটাই পরবর্তীকালে তার ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে দেয়। পড়ালেখায় সকলের চেয়ে আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকা এবং অতিদ্রুত উপরের ক্লাসে উন্নীত হওয়ায় তার কোনো বন্ধুই জুটলো না! কারণ একটা সময় তিনি ক্লাসে সবার চেয়ে বয়সে ঢেঁড় ছোট ছিলেন!
১৯০৯ সাল; লরেন্স যখন দুরন্ত গতিতে একাডেমিক সাফল্য নিয়ে এগিয়ে চলেছেন, তার বাবা হেনরিও তখন বসে ছিলেন না। ততদিনে তিনি পদার্থবিজ্ঞান জগতের একজন অন্যতম পরিচিত মুখ। ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে দেয়া হলো পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ক্যাভেন্ডিস চেয়ার। এ ব্যাপারটা একই সাথে সম্মানজনক এবং কাকতালীয় ছিল। তার এই প্রাপ্তির ঘোষণার কয়েকদিন পরই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ লাভ করেন লরেন্স। ফলে, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল এবং পুরো ব্র্যাগ পরিবারই চলে এলো ইংল্যান্ডে। লরেন্স ভর্তি হয়ে গেলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়তে। তবে বাবার উপদেশে গণিত ছেড়ে পদার্থবিজ্ঞানকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আর অত্যন্ত ‘স্বাভাবিকভাবেই’ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে এম.এস.সি শেষ করেন!
স্নাতকোত্তর শেষ করেই লরেন্স যোগ দেন থমসন ল্যাবরেটরিতে। তার বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার শুরু সেখানেই। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞান সমাজে বিশ্বাস ছিল যে, এক্সরে হচ্ছে একপ্রকার কণা যার অপবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু ১৯১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স ভন লাউ আবিষ্কার করেন যে এক্সরে হচ্ছে একপ্রকার তরঙ্গ, যার ক্রিস্টাল দ্বারা অপবর্তন ঘটে। আর সে বছরের শেষভাগে লরেন্স তার বিজ্ঞানী জীবনের প্রথম আবিষ্কারটি করেন যা ‘ব্র্যাগস ল অব এক্সরে ডিফ্র্যাকশন’ নামে পরিচিত। এর সাথে পরিচিত হবার আগে অপবর্তন এবং ব্যাতিচার কী তা জানা দরকার।
কোনো সূক্ষ্ম প্রতিবন্ধকের ধাঁর ঘেঁষে কিংবা কোনো সরু ছিদ্রের মধ্য দিয়ে যাবার সময় আলোর বেঁকে যাবার ঘটনাকেই আলোর অপবর্তন বলে। আর, কোনো সুসঙ্গত উৎস থেকে নির্গত দুটি একই বা প্রায় কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে তাদের বিস্তারের যে হ্রাস-বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে তাকে ব্যাতিচার বলে। ব্যাতিচার দুই প্রকার হয়। যে সকল স্থানে তরঙ্গ দুটির উপরিপাতন সমদশায় হয়, সে স্থানগুলোতে লব্ধি তরঙ্গের বিস্তার এবং তীব্রতা বেশি হয়। একে গঠনমূলক ব্যাতিচার বলে। আবার যেসব স্থানে তরঙ্গদ্বয় বিপরীত দশায় মিলিত হয়, সেখানে লব্ধি তরঙ্গের তীব্রতা হ্রাস পায়। একে ধ্বংসাত্মক ব্যাতিচার বলে। আলো, শব্দ, বেতার তরঙ্গ, এমনকি পানির উপরিতলের তরঙ্গেও ব্যাতিচার ঘটে। অপবর্তন তখনই সৃষ্টি হয়, যখন কোনো তরঙ্গ কোনো বাঁধা বা ফাঁকা স্থানের সম্মুখীন হয়।
অপবর্তনের এই দৃশ্যপটে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আবির্ভূত হন লরেন্স ব্র্যাগ। তিনি তখন মাত্র ২১ বছরের এক যুবক, যার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়েছে সবে। তার পক্ষে সে সময়কার প্রতিষ্ঠিত ঝানু পদার্থবিদ লাউয়ের ভুল ধরা কি চাট্টিখানি কথা? এই দুঃসাহসটাই দেখালেন লরেন্স। নিজের প্রকাশিত গবেষণাপত্রে, এক্সরের ধর্ম এবং ক্রিস্টালের মধ্যে পরমাণুর বিন্যাস লাউ ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি! তিনি, লাউয়ের অপবর্তনের চিত্রগুলো ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দেন যে, লাউ আসলে যে ব্যাপারটাকে অপবর্তন মনে করছেন, তা অপবর্তন নয়, ব্যাতিচার! এবার ব্র্যাগের সূত্রে যাওয়া যাক।
এখানে,
λ= তরঙ্গদৈর্ঘ্য,
n একটি ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা,
d= ক্রিস্টালের মধ্যে পরমাণুসমূহের দূরত্ব এবং
θ= যে কোণে সর্বোচ্চ পরিমাণ অপবর্তন সৃষ্টি হবে
লাউয়ের ছবিগুলো ব্যাখ্যা করে লরেন্স দেখান যে, লাউ যে কালো বিন্দুগুলোতে অপবর্তন হয়েছে বলে দাবি করেছেন, সেখানে আসলে গঠনমূলক ব্যাতিচার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো সিদ্ধান্তে আসেন যে, এই ঘটনা তখনই ঘটে, যখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য কোনো ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যার গুণিতক হয়। ফলে ক্রিস্টালের মধ্য থেকে এক্সরে তরঙ্গের অপবর্তনের ছবি নিয়ে, সেখান থেকে সহজেই d নির্ণয় করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ ক্রিস্টালের মধ্যে পরমাণুসমূহের যথার্থ দূরত্ব নির্ণয় মানুষের আয়ত্বে চলে আসে! এটি ছিল বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ, এই আবিষ্কারের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে ক্রিস্টালের ছবি নিয়ে এর সম্পূর্ণ গঠন জানা সম্ভব। ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বস্তুর গঠন পারমাণবিক স্কেলে দেখা সম্ভব হলো এবং উন্মুক্ত হলো বস্তুর পারমাণবিক গঠনের থ্রিডি মডেল নির্মাণের পথ। লরেন্সের গর্বিত এবং মুগ্ধ বাবা হেনরি, ছেলের কাজ নিয়ে লিডসে গবেষণা শুরু করেন এবং প্রথম ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টাল গঠন নির্ণয় করেন।
লরেন্স ব্র্যাগ তার সূত্রের জন্য ১৯১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জেতেন। তবে পুরস্কারটা তিনি একা জেতেননি। বস্তুর থ্রিডি গঠন নির্ণয়ে কাজ করার জন্য ছেলের সাথে নোবেল ভাগ করে নেন হেনরিও! বাবা ছেলের একত্রে নোবেল পুরস্কার জয়ের মাঝে একটি অনন্য রেকর্ড করেন লরেন্স। ২৫ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার জিতে, সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে নোবেল জয়ের রেকর্ড করেন তিনি। ২০১৪ সালে মালালা ইউসুফ শান্তিতে নোবেল জিতে এই রেকর্ড ভাঙেন। তবে, লরেন্স এখনো বিজ্ঞানে নোবেল জয়ীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন লরেন্স ব্র্যাগ। গবেষণাগারে যিনি একনিষ্ঠ গবেষক, যুদ্ধক্ষেত্রেও তিনি সমানভাবে পারদর্শী এক বীর। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের জন্য তিনি ‘মিলিটারি ক্রস ফর গ্যালান্ট্রি’ পদক জিতেছিলেন। ‘সাউন্ড রেঞ্জিং’ নামক বিশেষ পদ্ধতির ব্যবহার করে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের আর্টিলারির অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। ১৯১৫ সালের শেষ দিকে যুদ্ধে তার ছোট ভাই মারা যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষেও নানা ছোটখাট গবেষণা চালিয়ে গেছেন লরেন্স ব্র্যাগ। ১৯৩৮ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড মৃত্যুবরণ করলে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ক্যাভেন্ডিস চেয়ার লাভ করেন। ১৯৪১ সালে ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জ তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি ক্রিস্টাল নিয়ে গবেষণা করছিলেন। যুদ্ধের কারণে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে তার গবেষণার কাজে যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। যুদ্ধ শেষ হতেই ১৯৪৬ সালে তিনি তৈরি করেন ‘এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি’, তার জীবনের শেষ বড় সাফল্য। এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি হচ্ছে একটি জটিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা দ্বারা কোনো ক্রিস্টালের আণবিক এবং পারমাণবিক গঠন অধিকতর নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা সম্ভব।
১৮৯০ সালের ৩১ মার্চ, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশের রাজধানী অ্যাডিলেডে জন্মগ্রহণ করেন উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ। তার বাবা উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ ছিলেন একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। আর মা গেন্ডোলিন টড ছিলেন একজন চমৎকার জলরঙের চিত্রশিল্পী। প্রাথমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যন্ত অ্যাডিলেডেই শেষ করেন তিনি। ১৯০৯ সালে নিজের বিস্ময়কর মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ লাভ করেন। একই বছর তার বাবাও ইংল্যান্ডে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে যোগ দিলে তার পুরো পরিবারই ইংল্যান্ড চলে আসে। এরপর আর স্বদেশে ফিরে যাওয়া হয়নি তার। আমৃত্যু বসবাস করেছেন ইংল্যান্ডেই। ১৯২১ সালে তিনি অ্যালিস হপকিনসনকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে ৪ সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের পহেলা জুলাই ৮১ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লরেন্স ব্র্যাগ। ক্যামব্রিজের চ্যাপেল অব ট্রিনিটি কলেজে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই মহান বিজ্ঞানী।
ফিচার ছবি: blog.nus.edu.sg