(পর্ব ৫ এর পর থেকে)
“রক্তের বদলে রক্ত! মৃত্যুর বদলে মৃত্যু! শত্রুর পরিপূর্ণ পরাজয়! সম্মান এবং মুক্তির জন্য, আমাদের মাতৃভূমির জন্য, আমাদের পবিত্র মস্কোর জন্য!” (সোভিয়েত সৈন্যদের উদ্দেশ্যে গিওর্গি ঝুকভ, ১ নভেম্বর ১৯৪১)
অক্টোবর, ১৯৪১। জার্মান–নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি কর্তৃক ‘ইহুদি–বলশেভিক’দের দ্বারা শাসিত এবং ‘স্লাভিক, এশিয়াটিক, তুর্কি–মঙ্গোলয়েড অবমানব’দের দ্বারা অধ্যুষিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত আক্রমণ ‘অপারেশন বার্বারোসা’ সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড অক্ষশক্তির করতলগত হয়েছে। অক্ষবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে বিশ্ব কমিউনিজমের কেন্দ্র এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের হৃদভূমি মস্কোর দিকে। মস্কোর পতন ঘটলে সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের পতন ছিল প্রায় সুনিশ্চিত। জার্মানরা মস্কো দখল করে নিলে সেক্ষেত্রে লাল ফৌজ হয়ত আরো পূর্বে পশ্চাৎপসরণ করত, কিন্তু এই পরাজয়ের ফলে যে মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো, সেটি কাটিয়ে উঠে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারত কিনা সন্দেহ। তদুপরি, মস্কোর পতন ঘটলে অক্ষশক্তির এশীয় সদস্য জাপান কর্তৃক সাইবেরিয়া ও সোভিয়েত দূরপ্রাচ্যে আক্রমণ চালানোর সম্ভাবনা ছিল।
অক্ষবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে তখন পর্যন্ত লাল ফৌজের মারাত্মক রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। লাল ফৌজের প্রশিক্ষিত সৈন্যদের বড় একটি অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য লাল ফৌজের বিপুল সংখ্যক রিজার্ভ জনবল ছিল, যারা ইতিপূর্বে এক বা দুই বছর বাধ্যতামূলকভাবে লাল ফৌজে দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক রিজার্ভ সৈন্যকে একত্রিতকরণ, পুনরায় প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অস্ত্রসজ্জিত করা ছিল খুবই কঠিন ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। তদুপরি, লাল ফৌজের সামরিক সরঞ্জামও ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল। শুধু তাই নয়, জার্মানরা ইউরোপীয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অংশ দখল করে নেয়ায় সোভিয়েতরা তাদের শিল্পসম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যুদ্ধের জন্য ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।
অবশ্য জার্মানদের ক্ষিপ্র অগ্রগতির মধ্যেই সোভিয়েতরা জার্মান–অধিকৃত ভূখণ্ড থেকে শত শত কারখানা এবং লক্ষ লক্ষ শিল্পশ্রমিককে পূর্ব দিকে সরিয়ে নিতে পেরেছিল (যেটি ছিল সোভিয়েতদের একটি বিরাট কৃতিত্ব)। কিন্তু এই কারখানাগুলো পুনঃস্থাপন এবং সেগুলোতে অতি প্রয়োজনীয় ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান ও গোলাবারুদ উৎপাদন শুরুর জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং সেই সময় সোভিয়েতদের পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক।
অবশ্য অপারেশন বার্বারোসার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপারে জার্মানদের ভুল হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, এই অভিযানে তাদের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে না এবং সোভিয়েতদের প্রতিরোধ সহজেই ভেঙে পড়বে। কিন্তু কার্যত সোভিয়েতরা সর্বত্র তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল এবং জার্মানদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল তাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। কেবল ১৯৪১ সালের গ্রীষ্মকালেই সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জার্মানদের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তা ছিল ১৯৪০ সালে পশ্চিম ইউরোপ বিজয়ে জার্মানদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার দ্বিগুণ।
অপারেশন টাইফুন: মস্কোর উপকণ্ঠে জার্মান ঘূর্ণিঝড়
এমতাবস্থায় মস্কো দখলের জন্য জার্মানরা একটি নতুন আক্রমণাভিযান শুরু করে, যেটির সাঙ্কেতিক নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন টাইফুন’। এই অভিযানের জন্য অক্ষবাহিনী প্রায় ১০ লক্ষ সৈন্য, ১,৭০০ ট্যাঙ্ক, ১৪,০০০ আর্টিলারি পিস এবং প্রায় ১,০০০ যুদ্ধবিমান সমাবেশ করে। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব ও প্রধানমন্ত্রী স্তালিনের নির্দেশে লেনিনগ্রাদ ফ্রন্টের কমান্ডার জেনারেল গিওর্গি ঝুকভ ৬ অক্টোবর মস্কোয় এসে পৌঁছান।
৬ অক্টোবর স্তাভকা (লাল ফৌজের জেনারেল স্টাফ) ঝুকভকে রিজার্ভ ফ্রন্টে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করে। উল্লেখ্য, ইয়েলনিয়া আক্রমণাভিযানের সময় ঝুকভ এই ফ্রন্টেরই কমান্ডার ছিলেন। ৮ অক্টোবর ঝুকভকে রিজার্ভ ফ্রন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ১০ অক্টোবর স্তালিন লাল ফৌজের রিজার্ভ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টদ্বয়কে একত্রিত করেন এবং এটিকে ‘পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্ট’ নামকরণ করা হয়। ঝুকভকে এই ফ্রন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং পূর্ববর্তী পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার জেনারেল ইভান কোনেভকে ঝুকভের ডেপুটি নিযুক্ত করা হয়। অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই কোনেভকে নবগঠিত কালিনিন ফ্রন্টের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং এই ফ্রন্টকে পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের উত্তর পার্শ্ব রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার হিসেবে ঝুকভের দায়িত্ব ছিল মস্কোর অভিমুখে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করা। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনের জন্য ঝুকভের কাছে প্রয়োজনীয় জনবল ছিল না। অক্টোবরের প্রারম্ভে ভিয়াজমা ও ব্রিয়ানস্কে সংঘটিত লড়াইয়ে লাল ফৌজের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল মিনস্ক ও কিয়েভে সংঘটিত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বেশি। ভিয়াজমা ও ব্রিয়ানস্কে লাল ফৌজের মোট ৬৪টি রাইফেল ডিভিশন, ১১টি ট্যাঙ্ক ব্রিগেড এবং ৫০টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে ঝুকভের কাছে মাত্র ৯ লক্ষ সৈন্য ছিল, যা ছিল সেই রণাঙ্গনে জার্মানদের সৈন্যসংখ্যার চেয়ে কম।
অক্টোবরের মাঝামাঝিতে জার্মানরা কালিনিন দখল করে নেয় এবং তুলা শহরের দখল নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক সপ্তাহব্যাপী এক তীব্র লড়াই আরম্ভ হয়। ১৮ অক্টোবর সোভিয়েতরা মোঝাইয়স্ক ত্যাগ করে এবং এর ফলে জার্মানদের জন্য মস্কোর পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এর ফলে মস্কোর অধিবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং কেউ কেউ শহর ছেড়ে পালানোর প্রচেষ্টা চালায়। ইতোমধ্যে ১৯ অক্টোবর ‘রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা পরিষদ’ (যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্তালিন কর্তৃক গঠিত সর্বোচ্চ সংস্থা) মস্কোয় কারফিউ জারি করে এবং ঘোষণা করে যে, ঝুকভ মস্কো রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন। ২১ অক্টোবর কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘প্রাভদা’ এবং লাল ফৌজের পত্রিকা ‘ক্রাসনায়া জভেজদা’য় ঝুকভের ছবি প্রচারিত হয়। এটিই ছিল সোভিয়েত পত্রিকায় কোনো ফ্রন্ট কমান্ডারের ছবি প্রকাশের প্রথম ঘটনা এবং এর উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের মনোবল জোরদার করা।
ঝুকভের জন্য এটি ছিল চরম সঙ্কটময় মুহূর্ত। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হলে একদিকে তার ওপর অবধারিতভাবে স্তালিনের খড়গ নেমে আসত, অন্যদিকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরও বিলুপ্তি ঘটতে পারত। এমতাবস্থায় পরাজয় এড়াতে ঝুকভ তার চিরাচরিত ‘দাওয়াই’ প্রয়োগ করেন: অতি কঠোর শৃঙ্খলা, কোনো আত্মসমর্পণ বা পশ্চাৎপসরণ নয় এবং যখন ও যেখানে সম্ভব প্রতিআক্রমণ। ১৩ অক্টোবর ঝুকভ পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার হিসেবে ঝুকভ প্রথম যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটিতে বলা হয়েছিল, যেসব ‘ভীরু ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী’ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবে, অস্ত্র পরিত্যাগ করবে কিংবা অনুমতি ছাড়া পশ্চাৎপসরণ করবে, তাদেরকে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলেই গুলি করা হবে!
অবশ্য জার্মানদের প্রবল আক্রমণের মুখে ঝুকভ পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। মস্কোর উত্তর–পশ্চিমে ক্লিন থেকে ইস্ত্রার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ–পশ্চিমে সের্পুখভ পর্যন্ত একটি রেখা বরাবর ঝুকভের সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করে। কিন্তু ঝুকভ কর্তৃক গৃহীত নিয়মিত প্রতিআক্রমণ পরিচালনা ও কেবল শেষ মুহূর্তে পশ্চাৎপসরণের নীতির ফলে জার্মানদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অক্টোবরের শেষদিক নাগাদ জার্মান আক্রমণ গতি হারিয়ে ফেলে। তদুপরি, সেসময় ছিল শরৎকাল এবং শরতের ঐ অঞ্চলের রাস্তাঘাট ব্যাপকভাবে কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে জার্মান সৈন্যদের অগ্রসর হওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় জার্মানরা আক্রমণ থামিয়ে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়।
জার্মানদের আক্রমণ স্থগিত রাখার ফলে ঝুকভও তার শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ পান। ১ থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টে ১ লক্ষ অতিরিক্ত সৈন্য, ৩০০ অতিরিক্ত ট্যাঙ্ক এবং ২,০০০ অতিরিক্ত আর্টিলারি পিস সংযুক্ত হয়। এদিকে ১ নভেম্বর স্তালিন ঝুকভকে তলব করেন এবং ৭ নভেম্বর বলশেভিক বিপ্লবের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উদযাপন করা নিরাপদ হবে কিনা সেটি জানতে চান। ঝুকভ মতামত প্রদান করেন যে, এটি নিরাপদ হবে। এরপর ৭ নভেম্বরে যথারীতি বলশেভিক বিপ্লবের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় এবং রেড স্কয়্যারে লাল ফৌজের প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্তালিন একটি বিখ্যাত ভাষণ প্রদান করেন। বস্তুত এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা, কারণ মস্কোর দোরগোড়ায় জার্মান সৈন্যদের উপস্থিতির মধ্যেই এই প্যারেডের আয়োজন করা হয়েছিল।
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে কর্দমাক্ত রাস্তাগুলো জমে গেলে জার্মানরা পুনরায় আক্রমণ আরম্ভ করে এবং কিছু অঞ্চল অধিকার করে, কিন্তু লাল ফৌজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত ছিল মস্কোর পশ্চিমে। নভেম্বরের শেষদিকে স্তাভকা রিজার্ভ সৈন্যদের রণাঙ্গনে প্রেরণ করে এবং তারা ঝুকভের প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর ফাঁকগুলো পূরণ করে। ইতোমধ্যে তীব্র শীত পড়তে শুরু করে এবং শীতকালীন যুদ্ধের জন্য জার্মানদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না। একদিকে সোভিয়েতদের ক্রমাগত সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যদিকে ক্রমশ খারাপ হয়ে আসা আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানদের আক্রমণাভিযানের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এ সময় জার্মান সৈন্যরা মস্কো শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে ছিল।
সোভিয়েতদের প্রতিআক্রমণ: ঝুকভের গৌরবময় মুহূর্ত
ঝুকভের সৈন্যরা যখন মস্কোর উপকণ্ঠে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করায় ব্যস্ত, স্তাভকা তখন একটি প্রতিআক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। বস্তুত ৫ অক্টোবরেই স্তালিন এরকম একটি প্রতিআক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে ১০টি আর্মির সমন্বয়ে একটি ‘কৌশলগত রিজার্ভ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, লাল ফৌজে কয়েকটি ডিভিশনের সমন্বয়ে একটি ‘আর্মি’ গঠিত হত। এই কৌশলগত রিজার্ভের একাংশ জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু এর সিংহভাগই পরিকল্পিত প্রতিআক্রমণের জন্য রেখে দেয়া হয়।
৩০ নভেম্বর ঝুকভ প্রতিআক্রমণ পরিচালনার জন্য তার ফ্রন্টের পরিকল্পনা স্তাভকার কাছে পেশ করেন এবং স্তালিন পরিকল্পনাটি অনুমোদন করেন। ঝুকভের পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে যে জার্মান সৈন্যদলগুলো মস্কোকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছিল, সেগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া এবং মস্কোর পশ্চিমে অবস্থানরত জার্মান সৈন্যদের গতি রোধ করে রাখা। একই সঙ্গে পরিস্থিতি সুবিধাজনক হলে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে জার্মান ‘আর্মি গ্রুপ সেন্টার’কে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা এবং স্মোলেনস্কের রাস্তা উন্মুক্ত করাও ছিল এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।
৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত প্রতিআক্রমণ শুরু হয় এবং ঝুকভের পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের পাশাপাশি কোনেভের কালিনিন ফ্রন্ট এবং তিমোশেঙ্কোর দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টও এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রতিআক্রমণে অন্তত ৩০,০০০ জার্মান সৈন্য নিহত হয় এবং সোভিয়েত সৈন্যরা ৪০০টি গ্রাম ও শহর মুক্ত করে (যেগুলোর মধ্যে ছিল ঝুকভের নিজের গ্রাম স্ত্রেলকোভকা)। ১৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে ঝুকভের কৃতিত্বের খবর প্রচারিত হয় এবং তার বড় একটি ছবি ছাপা হয়। এই সময় থেকে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমও ঝুকভকে নিয়ে প্রচারণা শুরু করে এবং ‘লন্ডন ইলাস্ট্রেটেড নিউজে’র প্রথম পাতায় ঝুকভের ছবি ছাপা হয়। একই সঙ্গে জার্মানরাও ঝুকভকে সোভিয়েতদের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করে।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ লাল ফৌজ একটি বিস্তৃত রণাঙ্গন জুড়ে জার্মান সৈন্যদের পিছু হটিয়ে দেয় এবং ১০০–১৫০ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এর মধ্য দিয়ে জার্মানদের নিকট মস্কোর পতন ঘটার আশঙ্কা দূরীভূত হয় এবং সোভিয়েত সৈন্য ও জনসাধারণের মনোবল বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগতভাবে, ঝুকভের জন্য এই বিজয় ছিল অতি গৌরবময়। এই বিজয়ের পর থেকে লাল ফৌজের সৈন্যরা তাকে আলেক্সান্দর সুভোরভ ও মিখাইল কুতুজভের মতো মহান সমরনায়ক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। উল্লেখ্য, সুভোরভ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন আজীবন অপরাজিত রুশ সেনানায়ক, যিনি ওসমানীয় সাম্রাজ্য, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সকে পরাজিত করেছিলেন, আর কুতুজভ ছিলেন সেই রুশ সেনানায়ক, যিনি ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। বস্তুত, মস্কোকে রক্ষা করার মধ্য দিয়ে ঝুকভ সোভিয়েত জনমানসে প্রায় দেবতুল্য একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
রঝেভ–ভিয়াজমা আক্রমণাভিযান: ঝুকভের পরাজয়
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে মস্কোর উপকণ্ঠে সোভিয়েতদের সাফল্য নতুন একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী আক্রমণাভিযান পরিচালনার জন্য সোভিয়েত সরকারকে উৎসাহিত করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি স্তাভকা কর্তৃক পরিকল্পিত এই নতুন আক্রমণাভিযানের উদ্দেশ্য ছিল রঝেভ ও ভিয়াজমা পর্যন্ত অগ্রসর হওয়া এবং শহর দুইটির রেখার পূর্বে অবস্থানরত সমস্ত জার্মান সৈন্যদলকে ধ্বংস করে দেয়া। এই অভিযান সফল হলে জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টারের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যেত। ঝুকভের পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টকে এই আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং তাদেরকে সহায়তা করার জন্য কোনেভের কালিনিন ফ্রন্টকে নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ‘রঝেভ–ভিয়াজমা অপারেশন’ নামে পরিচিত এই আক্রমণাভিযান শুরু হয়। এই অভিযানের জন্য সোভিয়েতরা প্রায় ৫০ ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ ঝুকভের ওপর অভিযানটির সামগ্রিক দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় এবং তিন মাসের বেশি সময় ধরে এই আক্রমণাভিযান চলে। কিন্তু এই অভিযানটিতে সোভিয়েত সৈন্যরা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। জার্মান আর্মি গ্রুপ সেন্টারকে ঘিরে ফেলা বা ধ্বংস করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং তারা বেশিদূর অগ্রসর হতেও পারেনি। অবশেষে ২০ এপ্রিল সোভিয়েতরা এই অভিযান স্থগিত রাখে। এই ব্যর্থ অভিযানে ঝুকভের পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্ট এবং কোনেভের কালিনিন ফ্রন্ট অন্তত সাড়ে ৭ লক্ষ সৈন্য হারায়।
সামগ্রিকভাবে, এই অভিযানটি ছিল ঝুকভের জন্য একটি বড় ধরনের পরাজয়। পরবর্তীতে ঝুকভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, সেসময় তারা ভিয়াজমা অঞ্চলের পরিস্থিতি ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেননি। তারা নিজেদের সামর্থ্যকে বড় করে দেখেছিলেন এবং জার্মানদের শক্তিমত্তাকে খাটো করে দেখেছিলেন।
অবশ্য প্রথম অভিযানের ব্যর্থতার পর ১৯৪২ সালের জুলাইয়ের শেষদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় ও কালিনিন ফ্রন্ট রঝেভ–ভিয়াজমা অঞ্চলে আরেকটি আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই আক্রমণ চলে, কিন্তু এই অভিযানও বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এই অভিযান চলাকালে ১৯৪২ সালের ১৭ আগস্ট স্তালিন একটি বার্তায় ঝুকভকে তিরস্কার করেন। এর কারণ ছিল, পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্টের তিনটি ডিভিশনকে জার্মান সৈন্যরা ঘিরে ফেলার পর ফ্রন্ট তাদেরকে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অবশেষে সেপ্টেম্বরের শেষদিকে সোভিয়েতরা এই অভিযান স্থগিত রাখে। এই ব্যর্থ অভিযানে পশ্চিমাঞ্চলীয় ও কালিনিন ফ্রন্ট দুই লক্ষাধিক সৈন্য হারায়।
অবশ্য দ্বিতীয় রঝেভ–ভিয়াজমা অভিযানের পুরো সময় ঝুকভ যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন না। ২৬ আগস্ট ঝুকভকে মস্কোয় ডেকে পাঠানো হয় এবং স্তালিন তাকে লাল ফৌজের ডেপুটি সুপ্রিম কমান্ডার নিযুক্ত করেন। পরবর্তী দিন ঝুকভকে ‘প্রথম উপ–প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদও প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, স্তালিন সেসময় নিজেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও লাল ফৌজের সুপ্রিম কমান্ডার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ঝুকভকে নিজের ডেপুটি নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি এক ঝটকায় তাকে ‘সোভিয়েত সমরযন্ত্রের মুখ্য প্রকৌশলী’তে পরিণত করেন। অবশ্য এর পশ্চাতে তার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। ইতিপূর্বে যেরকম লেনিনগ্রাদ ও মস্কোকে রক্ষা করার জন্য ঝুকভকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, এবার অনুরূপভাবে স্তালিনগ্রাদকে রক্ষার দায়িত্ব তার ওপরে অর্পণ করা হয়।
অপারেশন ব্লাউ: দ্বিতীয় বার্বারোসা এবং ঝুকভ
বস্তুত ঝুকভ যখন রঝেভ–ভিয়াজমা অঞ্চল থেকে জার্মান সৈন্যদের অপসারণ করার চেষ্টা করছিলেন, তখন জার্মানরা অন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ১৯৪২ সালের মার্চ নাগাদ জার্মানরা সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে মোতায়েনকৃত মোট সৈন্যসংখ্যার অন্তত ৩৫% তো তারা হারিয়েছিলই, তদুপরি, তারা হাজার হাজার ট্যাঙ্ক, ৪০,০০০ ট্রাক, ৪০,০০০ মোটরবাইক এবং প্রায় ৩০,০০০ গাড়ি হারিয়েছিল, যার ফলে তাদের গতিশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে জার্মানরা তাদের রসদপত্র পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত অন্তত ১,৮০,০০০ ঘোড়াও হারিয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে জার্মানদের পক্ষে বার্বারোসার অনুরূপ বহুমুখী আক্রমণাভিযান পরিচালনা করা আর সম্ভব ছিল না। এজন্য তারা একটি নির্দিষ্ট রণাঙ্গনের ওপর জোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং অবশেষে দক্ষিণ দিকে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ককেশাস পর্বতমালার দক্ষিণে অবস্থিত বাকুর তেলক্ষেত্রগুলো দখল করা এবং বাকু পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পথে ইউক্রেন, দক্ষিণ রাশিয়া ও ট্রান্সককেশিয়ার কৃষিজমি ও খনিজসমৃদ্ধ ভূমি অধিকার করা। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের জ্বালানির প্রায় ৯০% আসত বাকুর তেলক্ষেত্রগুলো থেকে। সুতরাং জার্মানরা বাকু দখল করে নিতে পারলে সোভিয়েতদের সমরযন্ত্র শীঘ্রই অকার্যকর হয়ে পড়ত।
১৯৪১ সালে জার্মানরা ক্রিমিয়ার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ দখল করে নেয়, কিন্তু ১৯৪২ সালের প্রথমদিকে লাল ফৌজ কের্চ উপদ্বীপ পুনর্দখল করে। ৮ মে জার্মান সৈন্যরা পুনরায় কের্চ উপদ্বীপ দখল করে নেয়। ২ জুন জার্মানরা সেভাস্তোপোল অবরোধ করে এবং সোভিয়েতদের তীব্র প্রতিরোধ সত্ত্বেও জুলাইয়ের প্রথম দিকে শহরটি দখল করে নেয়। ইতোমধ্যে ১৯৪২ সালের ২৮ জুন দক্ষিণ অভিমুখে জার্মানদের নতুন আক্রমণাভিযান শুরু হয়। এই অভিযানটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘অপারেশন ব্লাউ’ (ব্লু)।
ব্লাউ প্রাথমিক পর্যায়ে বিশেষ সাফল্য অর্জন করে। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ জার্মান সৈন্যরা দনবাস অঞ্চলের সম্পূর্ণ অংশ এবং দন অঞ্চলের অধিকাংশ দখল করে নেয়। আগস্টের শেষ নাগাদ জার্মান সৈন্যরা ভোলগা নদীর তীরে উপনীত হয় এবং স্তালিনগ্রাদ অবরোধ করে। আরো দক্ষিণে তারা ককেশাস পর্বতমালার পাদদেশে পৌঁছায়, মাইকোপের তেলক্ষেত্র অধিকার করে, গ্রোজনির তেলক্ষেত্রগুলোর সন্নিকটে পৌঁছায় এবং মাউন্ট এলব্রুজের ওপর জার্মান পতাকা উত্তোলন করে।
কিন্তু এই সাফল্য অভিযানটির পরিধি বিস্তৃত করার জন্য জার্মান নেতা অ্যাডলফ হিটলারকে উৎসাহিত করে। হিটলার ‘আর্মি গ্রুপ এ’কে রোস্তভের দক্ষিণে অবস্থানরত সোভিয়েত সৈন্যদলকে ধ্বংস করে এবং এরপর কৃষ্ণসাগরের সমগ্র পূর্ব উপকূল দখল করে বাকু পর্যন্ত পৌঁছানোর নির্দেশ দেন। অন্যদিকে, ‘আর্মি গ্রুপ বি’কে তিনি স্তালিনগ্রাদ দখল করে দন ও ভোলগা নদীর মধ্যবর্তী স্থল যোগাযোগ রুদ্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। এর ফলে অপারেশন ব্লাউয়ের অধীনে জার্মান সৈন্যরা একই সঙ্গে দুটি কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালায় – বাকু দখল এবং স্তালিনগ্রাদ অধিকার। ১৯৪২ সালের ১৭ জুলাই চির নদীর তীরে জার্মান ও সোভিয়েত সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিখ্যাত স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ।
যুদ্ধ শুরুর প্রায় দেড় মাস পর আগস্টের শেষ নাগাদ স্তালিন ঝুকভকে মস্কোয় ডেকে পাঠান এবং এরপর ঝুকভকে স্তালিনগ্রাদে প্রেরণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ঝুকভের জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
(এরপর দেখুন ৭ম পর্বে)