জন্মেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার ছোট্ট গ্রাম পেত্রোভিচিতে। মাত্র ৩ বছর বয়সে বাবা-মার সাথে চলে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। তখন কেই-বা জানত এই ছেলে একদিন সর্বজয়ী লেখক হবে, হবে সায়েন্স ফিকশন ধারার লেখার জগতের মহান পথিকৃৎদের একজন; মানুষ তাকে মনে রাখবে দ্য গ্র্যান্ডমাস্টার অফ সায়েন্স ফিকশন হিসেবে। জর্জ লুকাস তার বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানিয়ে ফেলবেন স্টার ওয়ার্স এর মতো ব্লকবাস্টার মুভি সিরিজ। ইন্টারস্টেলার এর মতো মাস্টারপিস মুভির স্ক্রিপ্ট রাইটার জোনাথন নোলান তাকে মানবেন গুরু হিসেবে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করবেন তার ফাউন্ডেশন সিরিজের কথা। আর আধুনিক রোবোটিকসের সাথে তার নাম চিরদিন উচ্চারিত হবে তারই বানানো বিশ্ববিখ্যাত থ্রি ল’ অফ রোবোটিকসের জন্য। তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর– জাতি, বয়স আর পেশা নির্বিশেষে। তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তার পরের প্রায় সব সায়েন্স ফিকশন লেখক। আর তার কলমের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে হাজার হাজার বছর পরের মানব সভ্যতা। তার লেখা পড়ে শিহরিত হয়েছেন অসংখ্য পাঠক, অনেকেই হয়তো দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে কয়েক হাজার বছর পরের মানুষ কেমন হবে তা নিয়ে খানিকটা ভাবনা চিন্তাও করে ফেলেছেন।
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন কার কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যাঁ, তিনি আইজ্যাক আসিমভ, সর্বকালের সর্বসেরা সায়েন্স ফিকশন লেখকদের মধ্যে অন্যতম। আসুন প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক তার ‘আসিমভ’ হয়ে ওঠার গল্প।
যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পর বাবার দোকানে সময় দিতে হতো তাকে, যেখানে আরো অনেক কিছুর সাথে বিক্রি হতো নানান ধরনের বই আর পত্র-পত্রিকা। ছোট্ট আসিমভ তখন থেকেই ছাপা অক্ষরের প্রেমে পড়ে যান। যেখানে যা হাতে পেতেন, সব সঙ্গে সঙ্গে পড়ে ফেলতেন তিনি। আর এভাবে পড়তে পড়তেই মাত্র ১১ বছর বয়সে লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয় তার। ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় ‘অ্যামেজিং স্টোরিস’ ম্যাগাজিনে। এরপর থেকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে লিখেছেন তিনি, মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
তবে তিনি সবার নজরে পড়েন তার বিখ্যাত গল্প ‘নাইটফল’ দিয়ে। ১৯৪১ সালে তখনকার বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন ম্যাগাজিন ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ এ ছাপা হওয়া এই গল্প তাকে রাতারাতি দেশজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। গল্পটা এতটাই আলোড়ন তুলেছিল যে, ১৯৬৮ সালে আমেরিকান সাই-ফাই লেখকদের ভোটে এটি সর্বকালের সর্বসেরা সাই-ফাই ছোটগল্প হিসেবে নির্বাচিত হয়।
যদিও আসিমভ অমর হয়ে আছেন তার বিশ্ববিখ্যাত সায়েন্স ফিকশনগুলোর জন্য, তার লেখার পরিধি আরো অনেক ব্যাপক। বলা হয়ে থাকে, বই ক্ল্যাসিফিকেশনের জন্য যে ডিউয়ি ডেসিম্যাল সিস্টেম সারা দুনিয়ার ব্যবহার করা হয়, তার ১০টি প্রধান ক্যাটেগরির ৯টিতেই আসিমভের কোনো না কোনো বই আছে! আর বইয়ের সংখ্যা? বেশি না, মাত্র ৫০০! সায়েন্স ফিকশন থেকে শুরু করে, ফ্যান্টাসি, মিস্ট্রি, হিস্টোরি, পপুলার সায়েন্স, নন-ফিকশন, এমনকি বেশ কিছু হিউমার আর স্যাটায়ারও লিখেছেন তিনি।
এত বই লিখেছেন তিনি, এত বিশাল তার কাজের ক্ষেত্র, কিন্তু তার ‘আসিমভ’ হয়ে ওঠার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজের। এই সিরিজের প্রথম ৩টি বই তিনি লিখেছিলেন ’৫০ এর দশকে। বই তিনটি হচ্ছে: ফাউন্ডেশন, ফাউন্ডেশন এন্ড এম্পায়ার এবং সেকেন্ড ফাউন্ডেশন। এই তিনটি বইকে বলা হয় অরিজিনাল ফাউন্ডেশন ট্রিলজি। এরপর প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই সিরিজ নিয়ে আর এগোননি। কিন্তু পাঠকের প্রচণ্ড চাপে বাধ্য হয়ে ’৮০র দশকে এই সিরিজের আরো ৪টি বই লেখেন তিনি: ফাউন্ডেশন’স এজ, ফাউন্ডেশন এন্ড আর্থ, প্রিল্যুড টু ফাউন্ডেশন এবং ফরওয়ার্ড দ্য ফাউন্ডেশন। পরের এই চারটি বইয়ের শেষের দুটো আবার অরিজিনাল ফাউন্ডেশন ট্রিলজির প্রিক্যুয়েল। সবশুদ্ধ এই ৭টি বই নিয়ে হচ্ছে ফাউন্ডেশন সিরিজ।
তো কী আছে ফাউন্ডেশনে? আছে পুরো গ্যালাক্সি জুড়ে শাসন করা গ্যালাক্টিক এম্পায়ার; সুবিশাল এই সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে– হারাচ্ছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক ক্ষমতা। আছেন মহান বিজ্ঞানী হ্যারি শেলডন, যার হাত ধরে জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞানের নতুন শাখা– সাইকোহিস্টোরি। সাইকোহিস্টোরির সাহায্যে শেলডন হিসাব নিকাশ করে দেখতে পেলেন যে, এই আপাত বিশাল গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের আয়ু আছে আর মাত্র ৩০০ বছর। তারপর? ভেঙে খানখান হয়ে যাবে বিশাল সাম্রাজ্য। ৩০ হাজার বছরের অন্ধকার যুগ নেমে আসবে পুরো মানব জাতির উপরে। থাকবে না সভ্যতার কোনো ছোঁয়া, আবার আদিম যুগে ফিরে যাবে মানুষ। তাহলে উপায়? সেটাও বাতলে দিলেন শেলডন, তৈরি করলেন শেলডন প্ল্যান। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে ৩০ হাজার বছরের অন্ধকার যুগ মাত্র ১ হাজার বছরেই শেষ হবে। আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের স্থানে মাথা তুলবে শক্তিশালী, নতুন এক সম্রাজ্য। তো এই প্ল্যান অনুযায়ী শেলডন গ্যালাক্সির দুই প্রান্তের দুই গ্রহে প্রতিষ্ঠা করলেন দুই ফাউন্ডেশন। একটিতে থাকবেন বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানীরা, তারা উঁচু করে ধরে রাখবেন মানব সভ্যতার লাখো বছরের আহরিত জ্ঞানের মশাল। আরেকটিতে থাকবেন সব সাইকোহিস্টোরিয়ান, তাদের কাজ হচ্ছে শেলডন প্ল্যান ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা সেটার দিকে লক্ষ্য রাখা।
আসলেই কি শেলডন প্ল্যান সফল হয়? মানব সভ্যতা কি রক্ষা পায় ৩০ হাজার বছরের অন্ধকার যুগ থেকে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা নিয়েই ফাউন্ডেশন সিরিজ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আসিমভ ফাউন্ডেশন সিরিজের জন্য অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন রোমান সম্রাজ্যের ইতিহাস থেকে। ঠিক রোমান সাম্রাজ্যের মতোই গ্যালাক্টিক এম্পায়ারও অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। রোমানরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, কিন্তু তাদের তো আর একজন হ্যারি শেলডন ছিল না!
আসিমভের আরো দুটো বিখ্যাত সিরিজ হচ্ছে এম্পায়ার সিরিজ আর রোবট সিরিজ। প্রথম দিকে এই সিরিজগুলোর লেখা আলাদা পটভূমিতে থাকলেও পরে এগুলো একটি কমন ইউনিভার্সে নিয়ে আসা হয়েছে। এম্পায়ার সিরিজের উপন্যাস ৩টি আর রোবট সিরিজের উপন্যাস ৫টি। এছাড়াও আছে অনেক ছোটগল্প, যেগুলো উপন্যাসের ফাঁক-ফোঁকরগুলো পূরণ করেছে।
২০০৪ সালের মুভি ‘আই, রোবট’ আসিমভের একই নামের ছোটগল্প সংকলনের উপর ভিত্তি করে বানানো। ১৯৯৯ সালের ‘বাইসেন্টিনিয়াল ম্যান’ মুভিটিও আসিমভের ‘দ্য পজিট্রনিক ম্যান’ উপন্যাস অবলম্বনে বানানো। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে যে, স্কাইড্যান্স আসিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজকে টিভি সিরিজে রূপান্তর করবে। ফাউন্ডেশন ভক্তরা তাই এখন অধীর আগ্রহে বসে আছেন এর টিভি অ্যাডাপ্টেশন দেখার জন্য।
ব্যক্তি জীবনে আসিমভ দু’বার বিয়ে করেছিলেন এবং প্রথম স্ত্রীর ঘরে তার দুই সন্তান হয়। সারাজীবন সাই-ফাই আর ইন্টারগ্যালাক্টিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে পড়ে থাকলেও, আসিমভ আকাশে উড়তে খুব ভয় পেতেন– জীবনে মাত্র দু’বার তিনি বিমানে উঠেছেন! তিনি ক্লস্ট্রোফাইল ছিলেন– ছোট্ট বদ্ধ জায়গা ছিল তার খুব পছন্দের। প্রাণ-রসায়নে তার ডক্টরেট ডিগ্রী ছিল, বোস্টন ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ মেডিসিনে তিনি পড়িয়েছিলেন বেশ কিছুদিন; যদিও একসময় লেখার চাপে পড়ানোর কাজে ইস্তফা দিতে হয়েছিল।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই লেখক ১৯৯২ সালে পরলোকে পাড়ি জমান। তিনি বেঁচে থাকবেন তার অগণিত পাঠকের মাঝে, তার সৃষ্ট অসংখ্য চরিত্র আর তাদের বিখ্যাত সব উক্তির মাঝে।
দেখুন এমন কয়েকটি উক্তি (wikiquote.org থেকে নেওয়া):
“Violence is the last refuge of the incompetent.”
“The fall of Empire, gentlemen, is a massive thing, however, and not easily fought. It is dictated by a rising bureaucracy, a receding initiative, a freezing of caste, a damming of curiosity- a hundred other factors. It has been going on, as I have said, for centuries, and it is too majestic and massive a movement to stop.”
“Scientific truth is beyond loyalty and disloyalty.”
“Weak emperors mean strong viceroys.”
“Encyclopedias don’t win wars.”