যুদ্ধ-বিগ্রহ, পরিবেশ দূষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর সহিংসতা থেকে শুরু করে নানাবিধ টানপোড়ন যেন এই গ্রহের নিয়মিত এবং প্রভাবশালী বাসিন্দা। শান্তি যেন এখানে জীবন্ত জীবাশ্ম। আন্তর্জাতিক থেকে জাতীয়, সকল পর্যায়ে শান্তির বার্তা বাহক ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই এখানে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান শান্তিকে বাণিজিকীকরণ করতে মনোযোগী।
আশার কথা হলো এখনও পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যারা সেই করুণ চাহনির আর্তনাদের ভাষা বোঝেন। আর তাই তারা চাকচিক্যময় দুনিয়ার সকল মোহ ত্যাগ করে, ব্যক্তিস্বার্থ দূরে ঠেলে নীরবে-নিভৃতে নিজের মেধাশক্তি দ্বারা শান্তির মশাল বহন করে যান প্রতিনিয়ত। আর তাদের সেই মশালে আলোকিত হয়েই টিকে থাকে এই পৃথিবী। এই মানুষগুলো যেন শান্তির অগ্রদূত।
এমনই এক অগ্রদূত হলেন ডেনিস মুকওয়েগে, যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোর ধর্ষিতা নারীদের আশ্রয়স্থল। ডেনিস মুকওয়েগে এ পর্যন্ত যৌন সহিংসতার শিকার ৫০,০০০ এর অধিক নারীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন। তিনি তার সুবিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে দিন রাত নিরন্তর সেবা দিয়ে গিয়েছেন কঙ্গোর ধর্ষিতা নারীদের, পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা চালিয়ে যাচ্ছেন অনবরত। বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন এবং ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের করার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির মতো অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ২০১৮ সালে তিনি নাদিয়া মুরাদের সাথে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। শান্তির এই বার্তা বাহকের জীবনের গল্প নিয়ে আজকের লেখা।
ডেনিস মুকওয়েগে ১৯৫৫ সালের ১ মার্চ কঙ্গোর বুকাভুতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মায়ের ৯ সন্তানের মধ্যে ডেনিস ছিলেন তৃতীয়। যার হাতে সেবা পাবে কঙ্গোর হাজার হাজার ধর্ষিতা, যিনি হবেন সমাজ সংসার থেকে ছেঁটে ফেলা ধর্ষিতাদের বটবৃক্ষ, মানবজীবনের সংকটময় মূহুর্তগুলোর সাথে তার পরিচয় জন্মের পর থেকেই। কেননা ডেনিসের বেড়ে ওঠা বুকাভুতে আর শৈশব থেকেই তিনি দেখতে থাকেন বুকাভুর সঙ্গিন অবস্থা। রোগ, জরা, মহামারীতে তখন বিপর্যস্ত ছিল বুকাভু। কিন্তু এর থেকে নিরাময় পাওয়ার কোনো পথ তাদের কাছে খোলা ছিল না। কেননা সেখানে ছিল না কোনো স্বাস্থ্য নিরাময় কেন্দ্র, ছিল না কোনো চিকিৎসক।
রোগ জরাক্রান্ত মানুষগুলোর এমন অসহায় অবস্থা দেখতে দেখতেই বেড়ে উঠেন মুকওয়েগে। মুকওয়েগে প্রায়ই তার পিতাকে এই রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর সুস্থতা চেয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে দেখতেন। মহামারী আর জরায় আক্রান্ত বুকাভু বালক মুকওয়েজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বলা চলে, এই মহামারীর করালগ্রাসে থাকা বুকাভুই তার ভবিষ্যতের রাস্তা নির্ধারণ করে দেয়।
আর ঠিক এ কারণেই বালক মুকওয়েগে সিদ্ধান্ত নেন বড় হয়ে তিনি চিকিৎসক হবেন। আর তার চিকিৎসক হওয়ার উদ্দেশ্যটা ছিল শুধুমাত্র অসুস্থ বুকাভুকে সুস্থ করে তোলা।কেননা মুকওয়েগে উপলব্ধি করেছিলেন প্রার্থনা না, বুকাভুকে বাঁচাতে প্রয়োজন চিকিৎসা, প্রয়োজন ওষুধ। আর তাই তিনি তার বাবাকে বলেছিলেন, তুমি প্রার্থনা কর। আর আমি চিকিৎসা সেবা দিবো এই জনপদকে।
যিনি ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করেন মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকর্তাও হয়তো তাকে সেই পথেই হাঁটান। ১৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ বুরুন্ডি থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন মুকওয়েজ। সেদিনের সেই অসুস্থ বুকাভুকে সারিয়ে তুলতে চিকিৎসক হতে চাওয়া বালক তখন সদ্য পাশ করা তরুণ চিকিৎসক। অপেক্ষা শুধু স্বপ্ন বাস্তবায়নের।
এমন লক্ষ্য নিয়েই মুকওয়েগে কঙ্গোতে ফিরে আসেন এবং ল্যামেরা নামক গ্রামে অবস্থিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। এই হাসপাতালে যোগদানের পর এক নতুন অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় হয় মুকওয়েগের। তিনি দেখতে থাকেন হাসপাতালে আসা রোগীদের অধিকাংশই হলো গর্ভবতী নারী। সন্তান জন্মদানের সময় উদ্ভুত বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন এই নারীগণ।
মেডিসিনে স্নাতক সম্পন্ন করা ডেনিস মুকওয়েগে এদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম হলেও তাদের সম্পূর্ণ চিকিৎসা দিতে সক্ষম ছিলেন না। এর নেপথ্যে ছিল তার স্ত্রীরোগের উপর অভিজ্ঞতার অভাব। কিন্তু মুকওয়েগে তো থেমে যাওয়ার পাত্র নন। কেননা মানবতার সেবাই যার মূল লক্ষ্য তাকে কি কোনো প্রতিবন্ধকতা বেঁধে রাখতে পারে? মুকওয়েগে উপলব্ধি করলেন, এই নারীদের স্বাভাবিক জীবন দানের তাকে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ (Gynecologist) হতে হবে। যার ফলস্বরূপ ১৯৮৯ সালে ফ্রান্সে গাইনিকোলোজি নিয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। দু’চোখে তখন তার একটাই স্বপ্ন। আর কোনো গর্ভবতী নারীকে মৃত্যমুখে পতিত হতে দেবেন না মুকওয়েজ।
এমন স্বপ্ন স্নায়ুতে বহন করে ফ্রান্স থেকে কঙ্গোতে ফিরে এলেন মুকওয়েগে। কিন্তু তিনি ফিরে এসে যা দেখলেন তা ছিল আরো ভয়াবহ। কেননা কঙ্গো তখন যুদ্ধ কবলিত একটি দেশ। পুরো দেশটিতে তখন চলছে লাশের মিছিল, বাতাসে ভাসছে বারুদের গন্ধ। কঙ্গোর আকাশ বাতাস ক্রমাগত ভারী হয়ে চলেছে স্বজন হারা ও আহতদের আর্তনাদে। মাতৃভূমির এমন এক ক্রান্তিলগ্নে এই মানবতার সেবক নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলেন দেশের তরে।
সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশনের সহায়তায় তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন পানজি হসপিটাল। লক্ষ্য একটাই, যুদ্ধে আহতদের সেবাদান করা। হাসপাতালটি চালু হতে না হতেই রোগীতে ভরে গেল। হাজার হাজার রোগী আসতে শুরু করলো হাসপাতালে। এই রোগীদের ৬০ শতাংশই ছিল যুদ্ধে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া নারী।
এদের নিয়ে আসা হতো মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায়। তাদের অবস্থা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, গণধর্ষণের ফলে কারো কারো যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে গিয়েছে, কারো বা অস্ত্রের আঘাতে জরায়ু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কখনো কখনো অনেক নারীকে আহত ও নগ্ন অবস্থাতেই হাসপাতালে আনা হতো। এমন বীভৎস অবস্থায় মুকওয়েজকে একাই সব সামলাতে হতো। কেননা ঐ অঞ্চলে তিনিই ছিলেন একমাত্র স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। ফলস্বরুপ, পানজি হাসপাতাল হয়ে ওঠে যুদ্ধাহতদের একটি শরণার্থী শিবির। এ অবস্থায় ড. মুকওয়েগে যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সেবা দিতে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেন যাদের নিয়ে নিরলস পরিশ্রম করে যান এই নারীদের চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতে।
কঙ্গো যুদ্ধে নারীর প্রতি এমন ভয়াবহ যৌন সহিংসতা থেকে মুকওয়েগে যে বিষয়টি উপলব্ধি করেন তা হলো ধর্ষণ এখানে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলাফল এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, তিন বছর বয়সী শিশুও রেহাই পাচ্ছিল না এর হাত থেকে। এই পরিস্থিতি মুকওয়েগেকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের শারীরিক মানসিক অবস্থার করুণ অবনতি তাকে হতবিহ্বল করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটিই উপায়। সেটি হলো নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বন্ধ করা। যৌন সহিংসতা সমাধানের পথ শুধু চিকিৎসা না, এর জন্য প্রয়োজন নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেনতা সৃষ্টি করা।
আর এ উদ্দেশ্যে মুকওয়েগে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা রোধে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যান। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে মুকওয়েগে বক্তৃতা করেন জাতিসংঘে, তুলে ধরেন তার মাতৃভূমির ১৬ বছর ধরে স্থায়ী দীর্ঘকালীন জটিলতার কথা। তিনি এর জন্য দায়ী করেন কঙ্গো সহ অন্যান্য দেশের সরকারকে। যার ফলস্বরুপ কঙ্গোর যৌন সহিংসতার জন্য দায়ী কঙ্গো সরকার ও তার মিলিশিয়া বাহিনীকে বিচারের আওতায় আনা হয়।
মানবতার সেবক ডেনিসের এই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ যে খুব মসৃণ ছিল তা কিন্তু নয়। এর জন্য তাকে খেসারতও দিতে হয়েছে, এমনকি বুলেটের সম্মুখীনও হতে হয়েছে তাকে। জাতিসংঘে বক্তৃতা করার কয়েক সপ্তাহ পরই ডেনিস একদল দুষ্কৃতিকারী কতৃক আক্রান্ত হন। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ৫ জন সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে আক্রমণ করে। এই হামলায় সৌভাগ্যক্রমে মুকওয়েজ বেঁচে গেলেও এসময় অস্ত্রধারীদের গুলিতে প্রাণ হারান মুকওয়েজের বিশ্বস্ত বন্ধু জোসেফ বিজিমানা এবং মুকওয়েজের একজন দেহরক্ষী।
এই প্রাণঘাতী আক্রমণের পর ডেনিস মুকওয়েজ তার নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করেন। কিন্তু মুকওয়েগে চলে গেলেও বেশি দিন মাতৃভূমিকে ছেড়ে থাকতে পারলেন না। তার ফিরে আসার নেপথ্যে ছিল অসংখ্য রোগীর মায়া এবং সহকর্মীদের অশ্রুসিক্ত প্রার্থনা। যে জরাক্রান্ত কঙ্গো একদা তাকে তার ভবিষ্যতের লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করেছিল সেই কঙ্গোকে ভুলে থাকতে পারলেন না তিনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার সহকর্মী ও হাজার হাজার রোগীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে মুকওয়েগে আবার ফিরে আসেন কঙ্গোতে তার নিজ হাতে গড়া হাসপাতাল পানজিতে।
তার এই ফিরে আসা কঙ্গোতে ‘এক দেবতার মর্ত্যে ফেরার’ মতো ছিল। সেদিন মুকওয়েগেকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশই ছিল তার রোগী যাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে পদচারণা ছিল শুধুমাত্র ডেনিস মুকওয়েগের অবদান। আরও একটি অবাক করা বিষয় হলো তারা এই মহারথীকে ফিরতি টিকেট কিনে দিয়েছিলেন তাদের জমিতে ফলানো পেঁয়াজ ও আনারস বিক্রির টাকা দিয়ে!
ডেনিস মুকওয়েগে তার কার্যক্রমের মাধ্যমে আজ হয়ে উঠেছেন বিশ্ব মানবতার মূর্তপ্রতীক। মানবতার এই সেবক তার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পান ২০১৮ সালে। গতবছর নোবেল কমিটি বিশ্বব্যাপী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন এবং ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির স্বীকৃতি স্বরুপ মানবাতার এই মূর্তপ্রতীককে শান্তিতে নোবেল পদকে ভূষিত করে।
ডেনিস মুকওয়েগেকে নাদিয়া মুরাদের সাথে যৌথভাবে পুরস্কার দেয়া হয়। তবে এর পূর্বেও ডেনিস তার কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার পুরস্কার (২০০৮), রাইট লাইভিলিহুড অ্যাওয়ার্ড (২০১৩) এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৪) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে তালিকাভুক্ত করে এবং কার্টার ফাউন্ডেশন তাকে মিটিজেন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড সম্মাননায় ভূষিত করে।
নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি