সাদা ও কালো; কেবল রঙের মধ্যেই শব্দ দু’টি সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো। কিন্তু মানব সভ্যতায় এ দু’টি রঙ যেন হয়ে উঠেছিল বৈষম্য ও ঔদ্ধত্যের প্রতীক। একদিকে বৈষম্য, বর্বরতার শিকার কালো চামড়ার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা। আবার ঠিক তার উল্টো দিকেই ঔদ্ধত্য, অহংকার, বর্বরতায় পরিপূর্ণ সাদা চামড়ার শ্বেতাঙ্গরা। পৃথিবীর ইতিহাসে আফ্রিকান কালো মানুষদের চাইতে সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার বোধহয় আর কেউ হয়নি। কেননা আফ্রিকা মহাদেশের ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় এর সম্পূর্ণটাই বর্বর শ্বেতাঙ্গদের লুণ্ঠন, শোষণ, ধর্ষণসহ চরম অরাজকতার ইতিহাস। সেখানে মানুষদের হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে বিক্রি করা হতো আমেরিকার ‘দাসের বাজারে’। সেখানে নিজ দেশে বাস করেও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা ছিল পরাধীন।
সময়টা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ট্রান্সকেই অঞ্চলের থেম্বু নামক এক রাজপরিবারে জন্ম নেয় রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা নামে এক শিশু যার গোত্রীয় নাম ম্যান্ডেলা। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে স্কুলে পড়াশোনা করার সুবাদে তাঁর স্কুলের এক শিক্ষিকা নাম দেন নেলসন। সেখান থেকেই তাঁর নামকরণ হয় নেলসন ম্যান্ডেলা। পরবর্তীতে তাঁর গোত্রের দেয়া ‘মাদিবা’ নামে সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি অধিক পরিচিত হন।
জন্মের পর থেকেই পাড়ি দিয়েছেন নানা বিপদযুক্ত পথ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত করে গেছেন সত্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সংগ্রাম, দেখিয়েছেন মানব মুক্তির পথ। সভ্যতার আলোক শিখা জ্বেলে আফ্রিকার অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো মানুষদেরকে মুক্ত করেছেন বর্বর শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদের হাত থেকে। সাদা চামড়ার সৃষ্ট বর্ণবাদকে ভেঙে চুরমার করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষষের মাঝে সৃষ্টি করেছেন সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। এভাবে আফ্রিকার গণ্ডি পেড়িয়ে হয়ে উঠেছেন সমগ্র বিশ্বের মানবতাবাদী এক নেতা। বিশ্ব ইতিহাসে যে স্বল্পসংখ্যক মনীষী গেয়েছেন সাম্যের জয়গান তাঁদের মধ্যে অনন্য একটি নাম নেলসন ম্যান্ডেলা।
পড়াশোনা ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
তৎকালীন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের মধ্যে অধিকাংশই শাসক গোষ্ঠীর জন্য শ্রমিক হিসেবে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতো। এদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছিল আর রাজবংশে জন্মাবার সুবাদে তাদের মধ্যে একজন হতে পেরেছিলেন ম্যান্ডেলা। রাজপ্রাসাদের কাছেই এক মিশনারী স্কুলে পড়াশুনায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। এরপর আরও দু’টি স্কুলে পড়াশুনা শেষে ভর্তি হন ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মাদিবা।
১৯৪৩-৪৪ সালে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগদান করেন। ১৯১২ সালে জন্মানো এ সংগঠনের মূল কাজই ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী চেতনা জাগ্রত করণের মাধ্যমে বৈষম্যবাদী আফ্রিকান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। তবে মূলত বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলাই ছিল এই দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি। ১৯৬১ সালের আগ পর্যন্ত এএনসি ছিল গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের পথিক। ম্যান্ডেলা যোগদান করার পূর্ব পর্যন্ত এ সংগঠনের কোনো যুবা সংস্থা না থাকায় তিনি তা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এবং তাঁর নেতৃত্বে এই যুবা সংস্থা সমগ্র দেশময় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। অর্থাৎ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল বীজটা ম্যান্ডেলার দ্বারাই সে সময় বপন হয়।
বর্ণবাদে বিশ্বাসী আফ্রিকান দল ন্যাশনাল পার্টি ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করলে তৎকালীন শ্বেতাঙ্গরা বর্ণবাদ ও বৈষম্য ছড়ানোর বৈধ টিকেট পেয়ে যায়। এ সময় রাজনীতিতে নিদেনপক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ম্যান্ডেলা। ১৯৫২ সালে এএনসির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের পূর্ণ নাগরিকত্ব অর্জনের লক্ষ্যে বর্জন, ধর্মঘটসহ অহিংস উপায়ে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। এর ৩ বছরের মধ্যেই রচিত হয় আফ্রিকান বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূলভিত্তি যা জনগণের সম্মেলন নামে পরিচিত। এ সম্মেলনে বিখ্যাত এক ইশতেহার ঘোষণা করা হয় যা কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের মুক্তির সনদ নামে পরিচিত। ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর রাজদ্রোহের অপবাদে নেলসন ম্যান্ডেলা সহ ১৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পাঁচ বছর চলতে থাকা এ মামলায় ম্যান্ডেলাসহ বাকি ১৫৫ জনের এক জনকেও দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি আফ্রিকান সরকার।
সশস্ত্র বিপ্লব ও রিভোনিয়া মামলা
১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পেভিল শহরে প্রায় বিশ হাজার কৃষ্ণাঙ্গের এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ যা শার্পেভিল গণহত্যা নামে পরিচিত। এ হামলায় ৬৯ জন নিহত এবং আহত হয় প্রায় ১৮০ জন। মুহূর্তমধ্যে ক্ষোভ, ঘৃণা, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এএনসি । উক্ত ঘটনার নিমিত্তে ম্যান্ডেলা উপলব্ধি করেন অহিংস আন্দোলন নয়, সশস্ত্র বিপ্লবই ছিল সে সময়ের দাবী।
১৯৬১ সালে এএনসির সশস্ত্র সংগঠন ‘উমখোন্তো উই সিযওয়ে’ (বাংলায় “দেশের বল্লম”) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর নেতৃত্ব প্রদান করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লব সাধনের জন্য প্রয়োজন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ যার কিছুই ছিল না তাদের কাছে। তাই গোপনে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সমর্থন জোগাড়ে বেড়িয়ে পড়েন তিনি। ভ্রমণ করেন ইংল্যান্ড, ইথিওপিয়া, মরক্কোসহ বেশ কয়েকটি দেশে। তাঁর পরিকল্পনা মোতাবেক আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা চালতে থাকে। এর পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার পরিকল্পনা চলতে থাকে। আফ্রিকার এই সশস্ত্র যুদ্ধে কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। ম্যান্ডেলার পরিচালিত এই সশস্ত্র বিপ্লবকে মার্কিন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দেয়। এবং এর ফলাফলরূপে ২০০৮ পর্যন্ত ম্যান্ডেলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সহায়তায় ১৯৬২ সালের অগাস্টে গ্রেফতার হন ম্যান্ডেলা। শ্রমিক ধর্মঘটে উসকানি দেয়া ও অবৈধভাবে দেশ ত্যাগের অভিযোগে তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আর সশস্ত্র বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে ম্যান্ডেলাসহ অন্যান্য এএনসি নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত ও রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়; যা রিভোনিয়া মামলা নামে বিদিত। ম্যান্ডেলা অন্তর্ঘাতের দায় স্বীকার করে নিয়ে অন্তর্ঘাতের কারণ বর্ণনা করেন। আর তাঁর বিরুদ্ধে আনিত রাজদ্রোহের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। আফ্রিকান বর্ণবাদী সরকারের আদালতে ম্যান্ডেলাসহ এএনসি নেতা কর্মীর সকলেই দোষী সাব্যস্ত হন এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। জবানবন্দী প্রদানকালে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন,
“During my lifetime I have dedicated myself to the struggle of the African people. I have fought against white domination, and I have fought against black domination. I have cherished the ideal of a democratic and free society in which all persons live together in harmony and with equal opportunities. It is an ideal which I hope to live for and to achieve. But if needs be, it is an ideal for which I am prepared to die.” (আমি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি, আমার সংগ্রাম কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও। আমি সযত্নে লালন করেছি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের ধারণাকে, সেখানে সমস্ত মানুষ থাকবেন একসঙ্গে, থাকবে সম্প্রীতি-সংহতি, সমান সুযোগ-সুবিধা। এ আদর্শ অর্জনের লক্ষ্যে আমি আমার সমগ্র জীবন-যাপন করেছি এবং প্রয়োজন বোধে আমি এর জন্য আমার জীবন দিতেও প্রস্তুত”)
কারাবাসে দীর্ঘ ২৭ বছর
ম্যান্ডেলা তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রথম ১৮ বছর কাটান রবেন দ্বীপের এক কারাগারে। সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করায় ম্যান্ডেলা ও অন্যান্য নেতা কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয় চুনাপাথরের খনিতে। বর্ণবাদী সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই শ্রেণীবৈষম্য ছিল বিরাজমান। তারই অংশ হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের দেয়া হতো সবচেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা।
কারাগারের জীবনে প্রায় নিঃস্ব ছিলেন ম্যান্ডেলা। কারো সাথে কথা বলার কিংবা দেখা করার সুযোগ ছিল খুবই কম। ছয় মাস/এক বছরে একবার কারো সাথে দেখা করার সুযোগ হয়তো মিলেছে তাঁর। সেই সাথে ছিল অমানুষিক নির্যাতন। এমনকি কারাগারে তাঁকে মেরে ফেলবার জন্যেও করা হয়েছিল গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু জন্মই যার আজন্ম মৃত্যুদণ্ড বয়ে বেড়ানো, তাঁকে এত সহজে মেরে ফেলা সম্ভব হয়নি।
রবেন দ্বীপের কারাগারে থাকাকালীন ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় পড়াশোনা করেন এবং আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালের মার্চে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে পোলস্মুর কারাগারে প্রেরণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ম্যান্ডেলার সাথে আলোচনার ব্যবস্থা করা এবং রবেন দ্বীপের নতুন প্রজন্মের কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের ওপর থেকে ম্যান্ডেলার প্রভাব কমানো। উদ্দেশ্য অনুসারে হয় আলোচনা, কিন্তু যে স্বাধীনতার জন্য এত সাধনা এত ত্যাগ তা সহজে ধরা দেয় না। আলোচনায় তাঁকে সশস্ত্র বিপ্লব থেকে সরে আসার শর্তে মুক্তি দেবার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু কোনো প্রকার সমঝোতায় না গিয়ে সরাসরি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
এদিকে ম্যান্ডেলার কারাবরণের পর থেকেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর মুক্তির দাবিতে গড়ে উঠতে থাকে আন্দোলন। দিনকে দিন তা বিশাল আকার ধারণ করতে থাকে এবং এক সময় তা ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা মুভমেন্ট’ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে অধিগত হয়। কালাতিক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে আন্তর্জাতিক চাপের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
[চলবে]
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Nelson_Mandela
২) uttaradhikar.banglaacademy.org.bd/article_no/1052
৩) history.com/topics/nelson-mandela