স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লেমেন্স নামটা কি চেনা মনে হচ্ছে? চেনা মনে হবার কোনো কারণই নেই। মার্ক টোয়েন এই বিখ্যাত ছদ্মনামের আড়ালে যে আসল নামটি ঢাকা পড়ে গেছে সেই কবে। মার্ক টোয়েন শব্দটি মূলত আমেরিকার মিসিসিপি এলাকার স্টীমবোট চালকদের একটি পরিভাষা, যার অর্থ ১২ ফুট গভীর জল! “এডভেঞ্চার অফ টম সয়্যার” আর তার সিকুয়েল “এডভেঞ্চার অফ হাকলবেরী ফিন“-এর মতো জনপ্রিয় সাহিত্যকর্মের জন্যে বিশ্বজোড়া মার্ক টোয়েন নামেই সমাদৃত আমেরিকান এই লেখক।
টোয়েন বড় হয়েছেন আমেরিকার মিসৌরি অঙ্গরাজ্যে। এডভেঞ্চার অফ টম সয়্যার আর হাকেলবেরি ফিনের প্লটটিও তাই সেই মিসৌরি স্টেটেই গড়ে তুলেছিলেন। নিজের শৈশবের দুরন্তপনাকেই যেন ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন টোয়েন তার লেখায়। মার্ক টোয়েন যদিও তার লেখার প্রধান পাঠক হিসাবে শিশু-কিশোরদের বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকায় বাচ্চাকাচ্চাররা দুষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে-মেয়েদের মার্ক টোয়েনের বই পড়তে দিতেন না। এই নিয়ে একবার এক সাংবাদিক টোয়েনকে প্রশ্ন করেছিলেন, আর তার উত্তরে টোয়েন বলেছিলেন- “আমিও আমার বাচ্চাদেরকে আমার বই পড়তে দেই না!”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এক পুত্র আর তিন কন্যার জনক মার্ক টোয়েন নিয়মিত হাস্যরসাত্মক সব উত্তর দিতেন।
হাজারো শিশুর শৈশবকে রঙিন করা এই সাহিত্যিকের শৈশবটা ছিলো অনেকটাই বিবর্ণ। টোয়েনের ১২ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান তার বাবা। বাবার মৃত্যুর পর স্কুলের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা শুরু করেন। “হানিবাল কুরিয়ার” নামে স্থানীয় পত্রিকায় প্রতিদিনের খাদ্যের বিনিময়ে টাইপসেটার হিসেবে চাকরি নেন তিনি। পরবর্তীতে বড়ভাই ওরিয়ন ক্লেমন্সের সম্পাদনায় চালিত পত্রিকা “হানিবাল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন” পত্রিকায় টাইপিং এর পাশাপাশি লেখালেখি আর সম্পাদনা করার সুযোগ পান টোয়েন।
বড়ভাই এর নানান কাজে ব্যস্ততার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেন ছোটভাই। পরবর্তী জীবনে লেখালেখির এই অভিজ্ঞতা যে কাজে লেগেছে তা বলাই বাহুল্য। থিতু হলেন না কোথাও; ১৮৫৭ সাল, ২১ বছরের টোয়েন স্টীমবোট চালক হবেন বলে মনস্থির করলেন। মিসিসিপিতে এক স্টীমবোটে পাইলট হবার দায়িত্ব পেয়ে গেলেন হাসিখুশি এই তরুণ। স্বপ্ন ছিলো জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দেবার। তবে ভাগ্য সহায় ছিলো না বলে ১৮৬১ সালের আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় সেই চাকরীতে ইস্তফা দেন। তবে জলপথ আর স্টিমার তার ভালো লেগে যায়। লেখালেখিতে ছদ্মনামটা তাই স্টিমারের পরিভাষা “মার্ক টোয়েন” অর্থাৎ “১২ ফুট গভীর জল” বেছে নিলেন।
থিতু হওয়া ভাগ্য ছিলো না তার, স্বর্ণের খনিতে মাইনিং এর কাজ নিলেন। কিন্তু বেশীদিন এই তীব্র পরিশ্রম করতে না পেরে “ভার্জিনিয়া সিটি টেরিটোরিয়াল” সংবাদপত্রে রিপোর্টার হিসাবে আবারো ফিরলেন। ছদ্মনাম হিসাবে “মার্ক টোয়েন” নিয়ে সংবাদকে হাস্যরসাত্মক ভাবে উপস্থাপনের কাজ শুরু করলেন।শুধু সংবাদই না ব্যঙ্গচিত্র আকায় বেশ পটু ছিলেন টোয়েন। সাংবাদিকের পাশাপাশি ছোটগল্পকার হিসাবে খ্যাতি বাড়তে থাকে টোয়েনের। মাইনিং ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার লেখা ছোটগল্প “Jim Smiley and His Jumping Frog” প্রকাশ পায়। এই ছোটগল্পটি মূলত সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যরসাত্মক লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটায়।
টোয়েনের জীবনে ইচ্ছা ছিলো নাবিক হয়ে দূর সমুদ্রে জাহাজ নিয়ে ভেসে বেড়াবার। কিন্তু নাবিক না হলেও পর্যটক হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে পবিত্রভূমি প্যালেস্টাইন যাত্রার বাস্তব কাহিনীকে হাস্যরসিকতার রঙ চড়িয়ে ১৮৬৭ সালে তিনি লিপিবদ্ধ করেন “Innocents Abroad” নামক বইয়ে। প্রকাশের প্রথম বছরেই ৭০ হাজার কপির বিক্রি টোয়েনকে খ্যাতির তুঙ্গে পৌছে দেয়। ১৮৭২ নাগাদ ১,০০,০০০ কপির বিক্রি হয়। তাই মার্ক টোয়েন মজা করে এই বইয়ের একটি নতুন নামকরণ করেছিলেন “The New Pilgrims’ Progress“! নিউ ইউর্ক এক্সপ্রেস এর লেখা এক বুক রিভিউতে টোয়েনের এই ভ্রমণকাহিনী নিয়ে বলা হয়েছিল-“Very few will be able to read it without laughing at least half the time.”
মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই মার্ক টোয়েন সাংবাদিক থেকে আমেরিকার সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখকদের একজন হয়ে ওঠেন। ১৮৭০ এর ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করেন অলিভিয়া ল্যাংডনকে। তার বিখ্যাত উপন্যাস “এডভেঞ্চারস অভ টম সয়্যার” প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। সেই বছরেই তার সিকুয়েল “এডভেঞ্চারস অফ হাকেলবেরী ফিন” লেখা শুরু করেন। মূলত তার বাস্তব জীবন আর শৈশবকে তিনি এই দুটি উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এমনকি মার্ক টোয়েন টম সয়্যার চরিত্রটিকে নিজের শৈশবের প্রতিচ্ছবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাকেলবেরী ফিন চরিত্রটিও কাল্পনিক ছিলো না, সমাজের বাস্তবতা থেকেই উঠে এসেছে। টম সয়্যার সিরিজের আরো দুটি সিকুয়েল আছে একটি “Tom Sawyer Abroad (1894)” আরেকটি “Tom Sawyer, Detective (1896)”। তবে এডভেঞ্চার অফ হাকেলবেরী ফিন মার্ক টোয়েনের জীবনের সেরা কাজ বলেই বিবেচিত।
পরবর্তীকালের আমেরিকান সাহিত্যে এই উপন্যাসের প্রভাব এতই বেশী যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৯৩৫ সালে বলেছিলেন, “All modern American literature comes from one book by Mark Twain called Huckleberry Finn“।
১৮৮৪ সালে যখন “এডভেঞ্চার অভ হাকেলবেরি ফিন” প্রকাশিত হয়। ততদিনে মার্ক টোয়েন আমেরিকার সেরা ধনীদের একজনে পরিণত হয়ে যান। ১৮৮৫ সালে টোয়েন তার নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞানের প্রতি ছিলো মার্ক টোয়েনের অনুরাগ। নিকোলা টেসলা ছিলেন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। টেসলার ল্যাবরেটরিতে একইসাথে তারা অনেক সময় কাটিয়েছেন। টেসলার সাথে এই বন্ধুত্ব তাকে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখায় অনুপ্রাণিত করে।
১৮৮৯ এ প্রকাশিত হয় তার প্রথম সায়েন্স ফিকশন “A Connecticut Yankee in King Arthur’s Court“। আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান সবে তখন একটু একটু করে ডানা মেলছে। মার্ক টোয়েন যে শুধু কল্পকাহিনী লিখেই থেমেছিলেন ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন পরীক্ষা তিনি নিজ হাতে করার চেষ্টা করতেন। এর জন্যে বেচারা টাকা-পয়সা কম খরচ করেন নি। অটোমেটিক টাইপসেটিং মেশিন বানাতে তখনকার সময়েই প্রায় ২ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেন। ১৮৯০-এ ২ লাখ মার্কিন ডলার কতটা মূল্যবান ছিলো তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। টেসলার বিভিন্ন কাজেও তিনি বিনিয়োগ করেছেন বলে জানা যায়। তবে তা শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে। এরকম অসফল বেশকিছু বিনিয়োগ তাকে আর্থিক দূরাবস্থায় ফেলে দেয়। মানসিক চাপে পড়ে লেখালেখিও কমে আসে। তার অনেক অসম্পূর্ণ কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি “The Chronicle of Young Satan“।
টোয়েনের জীবনের শেষ ১৫ বছরে ছিলো তার জীবনের অন্যতম সেরা সময়। তখন পৃথিবীব্যাপী মানুষের কাছে সমাদৃত হন তিনি। অক্সফোর্ড থেকে ইয়েল নামিদামী সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর ফুলঝুরিতে ভেসে গিয়েছেন এই সাহিত্যিক।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের সবচেয়ে জনপ্রিয় আমেরিকান ব্যক্তিত্ব ছিলেন এই মার্ক টোয়েন। ১৮৯৫-৯৬ মৌসুমে সারা ইউরোপ ঘুরে বেরিয়েছেন আর লেকচার দিয়েই কাটিয়েছেন বেচারা। টোয়েনের জন্ম হয়েছিলো ১৮৩৫ এ যখন হ্যালির ধুমকেতু দেখা যায়। আর মারা যান ৭৫ বছর পরে ১৯১০ সালে যখন আরেকবার হ্যালির ধুমকেতুর আবির্ভাব হয়। ১৯০৮ সালে মারা যাবার বছর দুই আগেই এই ব্যাপারে টোয়েনের একটা ভবিষ্যৎবাণী মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় করেছিলো, যা অনেকটা এমন-
“১৮৩৫ এ আমি আর হ্যালির ধুমকেতু এসেছিলাম একসাথে! আগামী বছর সে আবার আসছে। জীবনের সবচেয়ে বড় না পাওয়া হবে তার সাথে আমার যেতে না পারা। ঈশ্বর হয়তো পাকাপাকি করেই রেখেছেন- ব্যাটারা এসেছিলো একসাথে, যাবেও একসাথে!“
ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করে দিয়ে ১৯১০ এর ২১ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান টোয়েন। ঠিক এর আগের দিনই হ্যালির ধুমকেতু পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে দৃশ্যমান হয়। মৃত্যুর পর মৃতদেহ পোড়ানো হোক, অন্তত “Life on the Mississippi“-তে মার্ক টোয়েন তা-ই চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। শেষ অবধি ১২ ফুট মনুমেন্টে অর্থাৎ “মার্ক টোয়েন”-এ সমাধিস্থ হলেন মার্ক টোয়েন।