সময়কাল ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত রাজস্থানের মেরতার কাছাকাছি চকরি গ্রাম। মরুভূমির বিস্তৃত ধু ধু প্রান্তরে চলতে চলতে ক্লান্ত শ্রান্ত এক বৃদ্ধ সাধু হাজির হন চকরি গ্রামে। সারাদিন ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে সাধু আশ্রয় নেন যোধপুরের মেরতার শাসক রতন সিং এর বাড়িতে। রাঠোড় বংশের মেরতা-শাসক রাও দুদার ছোট ছেলে রতন সিং। রাও দুদা আবার রাও যোধার ছেলে – যিনি ছিলেন যোধপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। বিদায় নেওয়ার কালে সাধুজী তার হাতে তুলে দেন শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি। রতন সিং এর মেয়ে মীরা। সবেমাত্র বয়স তিন হয়েছে তার। পুতুলখেলার এই বয়সে বাবার হাতে কৃষ্ণের মূর্তি দেখে চেয়ে বসে মীরা। রতন সিং জানতেন পুতুলটি এক বিশেষ আশীর্বাদ। তাই ছোট মীরা যথার্থ সম্মান দিতে পারবে কিনা এই ভয়ে মূর্তিটি মীরাকে দিতে নারাজ। এদিকে মূর্তিটি না পাওয়া পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া বন্ধ মীরার। কোনোকিছুতেই মানানো যায় না তাকে। অবশেষে মেয়ের আবদারের কাছে হার মানতেই হলো রতন সিংকে।
সারাদিনের খেলার সাথী এই পুতুলটি ছিল মীরার কাছে শ্রীকৃষ্ণের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। ধীরে ধীরে বড় হয় মীরা। একদিন রাজস্থানের পাথুরে রাস্তা দিয়ে বাদ্য বাজিয়ে যাচ্ছে বিয়ের শোভাযাত্রা। প্রাসাদের জানালা দিয়ে তা দেখে আর চোখের পলক পড়ে না ছোট্ট মীরার। এক দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করে বসলো, মা, আমার বর কই? সাত বছরের মেয়ের প্রশ্নের কী জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না মা। হাত ধরে নিয়ে গেলেন গিরিধারীর (কৃষ্ণের অপর নাম হরি, গিরধর, শ্যাম) মূর্তির সামনে। বললেন, এই তো তোমার বর।
তারপর যে কী হল মীরার। কৃষ্ণ প্রেমে এতটাই বুঁদ হলেন যে, কৃষ্ণই হয়ে উঠল তার একমাত্র বন্ধু, প্রেমিক এবং স্বামী আর এই প্রতিশ্রুতিতে তিনি ছিলেন আমৃত্যু অবিচল।
মীরাবাঈ এর অন্যতম পরিচয় তিনি একজন মরমী কবি। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে লিখেছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি ভজন বা ভক্তিগীতি যা আজও ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে কৃষ্ণপ্রেমীদের কণ্ঠে শোনা যায়। যদিও ৫ হাজারের মধ্যে প্রায় ৪০০ গান তার লেখা বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৪৯৮ সালে মেরতায় জন্ম নেন মীরাবাঈ। অতি অল্প বয়সেই বাবা মাকে হারান তিনি। বর্ণিত আছে, বাবা রতন সিং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান। অন্যদিকে মাত্র ৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে মীরা প্রতিপালিত হন দাদা রাও দুদার আশ্রয়ে। রাও দুদা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তিনি মীরাকে ধর্ম, রাজনীতির ব্যাপারে পাঠদান করেন। পাশাপাশি গান এবং শিল্পকলায় ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন মীরা।
কিশোরী বয়সে পৌঁছানোর আগে ভারতবর্ষের মেয়েরা যেমন মথুরা-বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যান সম্পর্কে জেনে যায় মীরাও হয়তো জেনেছিলেন। কৃষ্ণ প্রেমে পাগল হয়ে তাই নজরুলের মত মীরা হয়তো লিখেছিলেন-
ওরে নীল যমুনার জল, বলরে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম।
মীরা এবং যুবরাজ ভোজরাজের বিয়ে
মীরা যতই বলেন যে, তার স্বামী কৃষ্ণ, তার অভিভাবকেরা এই পাগলামি মেনে নিতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। শুরু হল বিয়ের আয়োজন। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে মেওয়ারের যুবরাজ ভোজরাজের সাথে বিয়ে হয় এবং বিয়ের পর তিনি চিত্তর প্রাসাদে তার স্বামী এবং নতুন পরিবারের সাথে বসবাসের জন্য চলে যান। কিন্তু তার মতে, শ্রীকৃষ্ণই তার একমাত্র স্বামী। তাই বিয়ের পরও পার্থিব সকল বিষয় থেকে নিজেকে আলাদা রাখেন মীরা। চিত্তরের যুবরাজের সাথে বিয়ে তার সামাজিক মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও প্রাসাদের আভিজাত্য কখনোই আকর্ষণ করেনি তাকে। কৃষ্ণই ছিলেন তার ধ্যান, জ্ঞান। বিভ্রান্ত ভোজরাজ বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। শুরুতে তিনি মীরাকে পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। শীঘ্রই তিনি মীরার এই গভীর প্রণয় বুঝতে পেরেছিলেন। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তাদের সম্পর্ক। পরবর্তীতে তিনিই মীরাকে উৎসাহিত করেন কবিতা লিখতে এবং তার উপাসনার জন্য মন্দিরও বানিয়ে দিয়েছিলেন।
মীরা এবং সম্রাট আকবর
মীরার খ্যাতির পাশাপাশি তার রচনা করা ভজনগীতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার খ্যাতি এবং আধ্যাত্মিকতা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মোঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। সম্রাট আকবর যেহেতু বিভিন্ন ধর্মীয় পথ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, তাই তিনি মীরাবাঈ এর সাথে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। কিন্তু সমস্যা হলো আকবর এবং মীরার পরিবার একে অপরের প্রতিপক্ষ এবং দীর্ঘদিনের চলা যুদ্ধে উভয়পক্ষের অনেকেই মারা গেছে। কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতা সম্রাট আকবরকে তার উদ্দেশ্য থেকে হটাতে পারেনি। ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তানসেনকে সাথে নিয়ে হাজির হন মীরার কাছে। আকবর তার প্রাণবন্ত সঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গানে এতটাই আসক্ত হয়েছিলেন যে, ফিরে যাওয়ার সময় মীরার চরণে তার পরিহিত মূল্যবান গলার মালা উৎসর্গ করে যান। যদিও তাদের সাক্ষাতের ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে।
একসময় ভোজরাজের কানে আকবর এবং মীরার সাক্ষাতের ঘটনা পৌঁছালে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে, মীরাকে পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেওয়ার নির্দেশ দেন। মীরা স্বামীর আদেশ পালন করতে যখন পানিতে ঝাঁপ দিবেন তখনই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে এবং তিনি মীরাকে নির্দেশ দেন বৃন্দাবনে পালিয়ে যেতে। মীরা তখন তার কয়েকজন অনুগামী্দের নিয়ে বৃন্দাবনে গিয়ে কৃষ্ণের উপাসনায় মগ্ন হলেন। শীঘ্রই ভোজরাজ ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুতপ্ত হয়ে ওঠেন। বুঝতে পারেন, তার স্ত্রী প্রকৃতপক্ষে একজন সাধু এবং তাকে ফিরিয়ে আনতে বৃন্দাবন যান এবং মীরাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। মীরাবাই সম্মত হন, কিন্তু ভোজরাজের পরিবার কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে নি।
ভোজরাজের মৃত্যু
দুর্ভাগ্যবশত, ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে এক যুদ্ধে ভোজরাজ মারা যান। এই মৃত্যুর প্রভাব মীরার উপর ছিল অত্যন্ত গভীর। তিনি শুধু একজন বন্ধু নয়, হারিয়েছিলেন তার পরামর্শদাতা এবং একজন অভিভাবককে, যিনি সকল সমালোচনা নিন্দা থেকে মীরাকে রক্ষা করেছিলেন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর মীরা আধ্যাত্মিক চর্চায় আরো বেশি নিজেকে উৎসর্গ করতে শুরু করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্দিরে গান গাইতেন এবং সেই গান শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকে জনসাধারণ আসতে শুরু করে। রাজবংশের হয়েও মীরার এ ধরনের আচরণ ভোজরাজের পরিবার মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কোনো কিছুই মীরাকে কৃষ্ণের উপাসনা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কৃষ্ণ প্রেমে পাগল মীরার জন্য পার্থিব জীবন ছিল নেহায়েত মূল্যহীন।
পরিবারের সাথে সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে তখন শ্বশুর রানা সংগ্রাম সিং মীরাকে আদেশ দেন স্বামীর পাশাপাশি মীরাকেও যেন সতীদাহ করা হয়। কিন্তু মীরা উত্তর দেয় আমাকে কেউ সতীদাহে বাধ্য করতে পারবে না। আমি গেয়ে যাব গিরধরের গান আর আমার অন্তর জুড়ে আছে কেবল গিরধর। তিনিই আমার স্বামী।
এর পরিণামে যা হলো মীরার উপর অত্যাচার বহুগুণে বেড়ে যায়। কিন্তু যতই অত্যাচার করা হোক না কেন তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত। কোনো কিছুই গিরধরের সাথে তার যে গভীর সম্পর্ক তা বিনষ্ট করতে পারেনি। সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে ভোজরাজের পরিবার মীরাকে হত্যার জন্য দুবার অপচেষ্টা চালায়। একবার বিষাক্ত সাপ এবং আরেকবার খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে মারার চেষ্টা করা হলেও মীরা বলেন কৃষ্ণের কৃপায় উভয় যাত্রায় তিনি পার পেয়েছেন। তার কৃষ্ণই তাকে রক্ষা করেছেন।
শাশুড়ি আর দেবরের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মীরা প্রাসাদ ত্যাগ করলেন। ষোল শতকে ভারতবর্ষের পথে ঘাটে দেখা যায় এক পাগলিনী সন্ন্যাসীকে যার কণ্ঠে শুধুই কৃষ্ণের গান। মীরা মথুরা গেলেন, গেলেন বৃন্দাবনে। কৃষ্ণ প্রেমে রচনা করলেন হাজার হাজার গান। কৃষ্ণ প্রেমে নারী পুরুষ সেই গান শুনে হয় মুগ্ধ।
প্রেমের আগুনে জ্বলে জ্বলে আমি ব্যথা নিয়ে ঘুরে বেড়াই, আমার ব্যথা যে কমে না, আমার শ্যাম যে আসে না।
রাজকুমারী হয়ে জন্ম নিলেও মীরা আত্মার শান্তি খুঁজে পান বৃন্দাবনের রাস্তায়। সকল যন্ত্রণা সমালোচনার ঊর্ধ্বে মীরা কেবল তার শ্যামকেই ভালোবেসেছেন। তার জীবন ভক্তির এক উজ্জল নিদর্শন। মীরাবাঈ দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র প্রেমের মাধ্যমেই একজন সাধক ঈশ্বরের সাথে মিলিত হতে পারেন। রাজপুত এই নারী বরং শিখিয়েছেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কৃষ্ণপ্রেমে বিলীন হতে প্রাসাদের বিলাসিতা বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন তিনি। যিনি ঘোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের মতো করে কাটিয়েছেন সারা জীবন, আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে!
ফিচার ইমেজঃ exoticindiaart