Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন নির্জনতম কবি জীবনানন্দ

কবি বলেছিলেন,

“আমি কবি, সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি
ঝরাপালকের ছবি”

কিছুকালের জন্য তিনি এসেছিলেন এই পৃথিবীতে। বাংলার রূপ দেখে পৃথিবীর রূপ খুঁজতে চাননি তিনি। বাংলার ঘাস, বাংলার বাতাস, বাংলার পাখি, বাংলার শাখী, বাংলার পতঙ্গ, বাংলার বিহঙ্গ তার মন হরণ করেছিল। তিনি ছিলেন নির্জনতার কবি। কবিতায় এঁকেছিলেন অপরূপ প্রকৃতির ছবি। আরেকটি নামে তাকে ডাকা হয়- তিমির হননের কবি।

ফিচার ইমেজ; Image Source : banglanews24
ফিচার ইমেজ; Image Source : banglanews24

হ্যাঁ। জীবনানন্দ দাশের কথাই বলা হচ্ছে। পারিবারিক উপাধি ছিল দাশগুপ্ত। ব্রাহ্ম সমাজে দীক্ষিত হওয়ার পর গুপ্ত-কে কবি নিজেই ছেটে বাদ দিয়েছিলেন।

চরম দারিদ্র্য ও ক্লান্তি তার দেহকে গ্রাস করলেও তার মননকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরিশাল শহরের সত্যানন্দ দাশগুপ্তের ঘর আলো করে এসেছিলেন জীবনানন্দ। মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন বিদূষী, স্বভাবকবিও বটে। আদর করে ছোট্ট জীবনানন্দকে মা ডাকতেন ‘মিলু’। সেই মিলু একদিন বাংলা সাহিত্যের এত বড় নক্ষত্রে পরিণত হবে- সে লক্ষণ বাল্যজীবনেই মা বুঝতে পেরেছিলেন।

একদিন সকালে প্রহ্লাদ গোয়ালা দুধ দিতে এসেছিল সত্যানন্দ দাশগুপ্তের বাড়িতে। বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে বালক মিলুর ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। মুখ থেকে অবচেতনভাবেই বেরিয়ে এসেছিল,

“আপনি বড় ভালো পড়েন গো, দাদাবাবু”।

গোয়ালা সেই কবিতার মর্মার্থ বুঝতে পারেনি। আবৃত্তির সুন্দরতাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ; Image Source : thedailystar.net
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ; Image Source : thedailystar.net

আরেকদিনের ঘটনা। তখন ছিল বর্ষাকাল। মিলুদের বাড়ির আঙিনা সবুজ ঘাসে ভরে গিয়েছে। ফকির নামক এক দরিদ্র চাষিকে সত্যানন্দবাবু আঙিনা পরিষ্কার করতে ডাকেন। ফকির সবুজ নির্মল ঘাসের উপর কাস্তে চালাতে থাকে। সে দৃশ্য দেখে কাতরাতে থাকে বালক জীবনানন্দ। সে বয়সেই কয়েক গোছা ঘাসকেও মনের কুঠুরিতে স্থান দিয়েছিলেন জীবনানন্দ। ফকির সান্ত্বনা দিয়ে তাকে বলেছিল,

“চিন্তা কইরবেন না দাদাবাবু, কিছুদিন পরেই আবার নতুন, সবুজ, কচি ঘাস জন্মাবে”।

কে শোনে কার কথা? ছোট্ট মিলুর কষ্ট যেন কমতেই চায় না।

শিশু জীবনানন্দ ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ত। অসুস্থ জীবনানন্দকে নিয়ে কুসুমকুমারী কোথায় ঘুরে বেড়াননি? কলকাতা থেকে দেওঘর, লক্ষ্ণৌ থেকে আগ্রা, দিল্লী থেকে মাদ্রাজ কোথায় যাননি? মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে এভাবেই পুরো ভারত চষে বেড়িয়েছেন জীবনানন্দ। বাবাকে একটু ভয় পেতেন। সব কথার শেষকথা ছিল বাবার কথা। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন লোকহিতৈষী একজন মানুষ। তাকে সবাই শ্রদ্ধা করত। বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের একজন কর্ণধার ছিলেন তিনি। ছিলেন সুবক্তা ও সুলেখকও। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা ও মননশীলতার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। শিশুদের অল্পবয়সে স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে তার দ্বিমত ছিল।

জীবনানন্দকে তাই স্কুলে পাঠানো হয়েছিল একটু দেরিতে। তাই বলে শিক্ষা থেমে থাকেনি। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বাবার উপনিষদ পাঠ আর মায়ের মিষ্টি-মধুর গান শুনে তার দিন শুরু হতো। কুসুমকুমারী দাশ ছন্দে ছন্দে কথা বলতেন। রান্নাঘরে মশলা কুটতে কুটতে লিখেছিলেন ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি। ছোট ছেলে অশোকানন্দের স্কুলের বার্ষিক কবিতা আবৃত্তির জন্য কবিতাটি লিখেছিলেন।

“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে..”।

জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ; Image Source : Pinterest
জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ; Image Source: Pinterest

জীবনানন্দের মধ্যেই হয়তো সেই ছেলেকে খুঁজেছিলেন কুসুমকুমারী দাশ। জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দরা ছিলেন সাত ভাই। জীবনানন্দেরা দুই ভাই, এক বোন। ছোট ভাই অশোকানন্দ নয় বছরের ছোট, আর ছোট বোন সুচরিতা দাশ ষোল বছরের। সব মিলিয়ে একান্নবর্তী সংসার। কবির শৈশবের স্মৃতিগুলো ছিল মধুর। লাজুক স্বভাবী, নিভৃতচারী, অল্পভাষী জীবনানন্দকে সবাই পছন্দ করত। পারিবারিক এক উষ্ণ আবহে তার শৈশব কেটেছে।

জীবনানন্দের বরিশালের বাড়ি; Image Source : thedailystar.net
জীবনানন্দের বরিশালের বাড়ি; Image Source : thedailystar.net

শৈশবে প্রকৃতি তাকে যে সৌন্দর্যরূপের প্রতিবেশ দিয়েছে, সেটাই তার পরের কবিত্বের জীবনের সহায়ক ছিল- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ছিল ‘ঝরা পালক’। এটি যখন ছাপা হয়, তখন কবির বয়স আটাশ। তিন বছর পর তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ে করেন রোহিণী কুমার গুপ্তের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। তাদের দুটি সন্তান হয়েছিল- মেয়ে মঞ্জুশ্রী, ছেলে সমরানন্দ। জীবনানন্দের বৈবাহিক জীবন সুখের ছিল না। বিয়ের পরও অনেকদিন তাকে বেকার বসে থাকতে হয়েছে। অনেকবার আত্মহননের কথাও ভেবেছেন। তারপর কী মনে করে যেন ফিরে এসেছেন। খুশি থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। সমরানন্দের সাথে খেতে বসলেই ছেলের পাতের ডিম নিয়ে কাড়াকাড়ি, স্ত্রী লাবণ্যের সাথে খুনসুটি- এসব তার সুখী থাকার চেষ্টাকেই নির্দেশ করে।

জীবনে সবকিছু খুব সহজভাবে নিতে পারতেন বলেই জীবনানন্দের ছিল আলাদা স্বকীয় এক জগত। শুধুই লিখেছেন। সেই লেখা ছাপাখানায় পাঠিয়ে অর্থ উপার্জনের সাবলীল পন্থাকে তিনি খুব সহজভাবে নিতে পারেননি।

তরুণ জীবনানন্দ; Image Source : wikiwand
তরুণ জীবনানন্দ; Image Source : wikiwand

কাউকে দেখানোর জন্য নয়, তিনি লিখতেন নিজের জন্য। লিখে ট্রাঙ্ক ভর্তি করে রেখে দিতেন। সারা জীবনে তার প্রকাশিত রচনার সংখ্যা বড়জোর তিনশোর মতো হবে। এখন যা পাওয়া যায়, সেগুলো তার মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা। একবার ট্রেনে করে ফেরার পথে কবির ট্রাঙ্ক চুরি হয়ে যায়। ট্রাঙ্কের সাথে সাথে হারিয়ে যায় লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো। এগুলোর কয়েকটি পরে উদ্ধার করা গেলেও সব যায়নি। সেদিন পৃথিবীবাসী বঞ্চিত হয়েছিল অপ্রকাশিত সেই লেখাগুলো থেকে।

একবার কবি সপরিবারে দিল্লী বেড়াতে যান। ছোট ভাই অশোকানন্দের বাড়িতে। অশোকানন্দের ঘরে তখন তার সাত বছরের সন্তান অমিতানন্দ। একদিন তারা সবাই মিলে দিল্লী ঘুরতে বের হলেন। ঘুরতে ঘুরতে অমিতানন্দ বড়দিদি মঞ্জুশ্রীর হাতের বালা হারিয়ে ফেলে। এতে জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দেবী ও অশোকানন্দের স্ত্রী নলিনী দেবী ছোট্ট অমিতানন্দকে বকাঝকা করেন। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই কবির। তিনি আপন মনে আত্মভোলা হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছেন সবকিছু। সেদিন নলিনী দেবী জীবনানন্দের একটি ছবি তুলে দেন। সেই ছবিই এখন বই-পত্তর, পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়।

দিল্লীর রাজঘাটে সপরিবারে জীবনানন্দ দাশ, (বা দিক থেকে) স্ত্রী লাবণ্য দেবী, মেয়ে মঞ্জুশ্রী, ভাইপো অমিতানন্দ ও ছেলে সমরানন্দ; Image Source : billwa90.blogspot.net
দিল্লীর রাজঘাটে সপরিবারে জীবনানন্দ দাশ, (বাঁ দিক থেকে) স্ত্রী লাবণ্য দেবী, মেয়ে মঞ্জুশ্রী, ভাইপো অমিতানন্দ ও ছেলে সমরানন্দ; Image Source: billwa90.blogspot.net

জীবনানন্দ ও তার লেখা সেসময় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন সজনীকান্ত দাশ। সজনীকান্ত তাঁর শনিবারের চিঠি-তে জীবনানন্দের লেখার ব্যঙ্গাত্মক ও কড়া সমালোচনা করতেন। সমালোচনা করে সজনীকান্ত লিখেছিলেন ‘গণ্ডারমারী কবিতা’। একবার লিখেছিলেন,

“জীবনানন্দের লেখা নির্জন পেঁচার মতো প্রাণ যদি অলৌকিক না হয় তবে সীতার পাতাল প্রবেশও অলৌকিক নয়”।

এত্তসব সমালোচনার শরকে উপেক্ষা করে জীবনানন্দ মুচকি হেসে বলেছিলেন,

“সজনীকান্তবাবু তো আমার ভালোই প্রচার করছেন”।

জীবনানন্দের প্রিয় শহর ছিল কলকাতা। কলকাতার আবহে তিনি ছিলেন মোহাচ্ছন্ন। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের চাকরি ছাড়ার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। বাগেরহাটের কলেজে চাকরিরত অবস্থায়ও ছুটি পেলেই কলকাতায় চলে যেতেন। কলকাতায় কবি কখনও মেসে ছিলেন, কখনও ছিলেন অশোকানন্দের বাড়িতে; আর একটু দীর্ঘ সময় ছিলেন ল্যান্সডাউনের এক ভাড়াবাড়িতে। এই কলকাতাতেই কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

যেদিন ট্রামের দুর্ঘটনাটি ঘটে, তার আগের দিন রেডিও-তে আবৃত্তি করেছিলেন ‘মহাজিজ্ঞাসা’ কবিতাটি। দুর্ঘটনার দিন সকালেও বন্ধুদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। প্রতিদিনের মতো সেদিন বিকেলেও হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। দুই থোকা ডাবও কিনেছিলেন। দু’হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন, এমন সময় ঘাতক ট্রামটি কবির উপর চড়ে বসে। গুরুতর আঘাত পান তিনি। কণ্ঠ, উরু ও পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়।

তার চিৎকার শুনে পাশের চায়ের দোকানদার চুনিলাল ও অন্যরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। ড. ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেক কবি-সাহিত্যিক তার প্রাণ বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেন। সজনীকান্ত দাশ তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়কে অনুরোধ করেন কবিকে দেখার জন্য। বিধান রায় সে অনুরোধ রেখেছিলেন। যমে-মানুষে আটদিনের লড়াই চলে। তারপর সব স্থির হয়ে যায়। জীবনানন্দ তার প্রিয় বাংলা, কলকাতাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ উক্তিটি ছিল,

“ধূসর পাণ্ডুলিপির রং সারাটা আকাশ জুড়ে”।

[জীবনান্দ দাশের বই কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে। ক্লিক করুন এখানে। ]

This is a bangla article. This is about poet Jibananda Das.

Featured Image: banglanews24.com

References:
Books-
মানুষ জীবনানন্দ, লাবণ্য দাশ, ভাষাচিত্র প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ, ২০১৫
Websites –
1. https://banglarkobita.com/book/famous/91
2. https://m.dailyinqilab.com/article/5448/%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B6
3. https://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-write-up-on-jibanananda-das-1.864473
4. https://m.prothomalo.com/nagorik-sangbad/article/1620608/জীবনানন্দ-দাশ-চেনা–অচেনার-গণ্ডি-পেরিয়ে
5. https://www.thedailystar.net/news-detail-159367
6. https://www.newworldencyclopedia.org/entry/Jibanananda_Das
7. http://www.newagebd.net/article/53798/jibananandas-64th-death-anniversary-today

 

 

Related Articles