২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র থেকে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। গবেষণা পত্রটির শিরোনাম ছিল- “Has financial development made the world riskier?”। গবেষণাটির মূল বিষয় ছিল অর্থনৈতিক উদ্দীপনা (Incentives) নিয়ে। এতে উল্লেখ করা হয়, অর্থনৈতিক যেকোনো উদ্দীপক বাজারে প্রচুর পরিমাণে অর্থ তৈরি করতে পারে এবং এই অর্থটি আসে বাজারের একটি নির্দিষ্ট স্বল্পকালীন লভ্যাংশ থেকে। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের উদ্দীপক ব্যাংকারদের তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশী বেশী ঝুঁকি নিতে উৎসাহিত করে। কিন্তু এ ধরনের ঝুঁকি নেয়ার ফলে তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, যার ফলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। ২০০৮ সালে যখন সমগ্র বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার শিকার হয়, তখন এই গবেষণার কথা সবার স্মরণে আসে, যা ২০০৫ সালে আইএমএফ এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর রঘুরাম রাজন প্রকাশ করেছিলেন। রাজন খুব স্পষ্ট করে ব্যাংকারদের উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন যে, কম ঝুঁকি নিয়ে বেশী লাভ হতে পারে এমন কিছু না ভেবে বেশী ঝুঁকি নিয়ে বেশী লাভ করার দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত [১]।
ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২৩ তম গভর্নর রঘুরাম রাজন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়িত্ব নেন এবং ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। মাত্র তিন বছরেই তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে থেকেই রাজন মন্দা নিয়ে তার ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে সবার দৃষ্টিগোচরে এসেছিলেন।
১৯৬৩ সালে ভারতের মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত ভূপালের এক তামিল পরিবারে জন্ম নেন রাজন। স্কুল জীবন অতিবাহিত হয়েছিল ভারতের নামকরা দিল্লী পাবলিক স্কুলে। এরপর ভারতের বিখ্যাত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি, দিল্লীতে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে অলরাউন্ড ছাত্র হিসেবে ডিরেক্টরস গোল্ড মেডেল পান। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ করে রাজন আইআইএম, এলাহবাদ থেকে ব্যবসায়িক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সেখান থেকে তিনি এমআইটি-র বিখ্যাত স্লোন স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে পিএইচডি করতে চলে যান। তার পিএইচডি থিসিস ছিল “Essays on Banking”। ২০১২-তে আরেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকেও তিনি সম্মানীয় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। রঘুরাম রাজন বর্তমানে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অব বিজনেস এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
রাজন জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করেন ২০০৫ সালে, যখন তিনি International Monetary Fund (IMF)-এ প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০০৫ সালে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় কনফারেন্স “Annual Jackson hole Economic Policy Symposium” অনুষ্ঠিত হয়। দুনিয়ার সব বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ এবং সেন্ট্রাল ব্যাংকাররা এই কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। তাদের সামনে রাজন তার ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখিত পেপারটি উপস্থাপন করেন। সেই সময় এ ধরণের ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে রাজনকে অনেক সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। এর জের ধরে সেই কনফারেন্সেই আরেক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামারস রাজনের এমন ধারণাকে ভ্রান্ত বলে উড়িয়ে দেন এবং তাকে ‘লাডাইট’ আখ্যা দেন। লরেন্স বলেন, রাজনের এমন চিন্তা পলিসিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
২০১২ সালে রাজন ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এবং তার পরপরই Reserve Bank of India (RBI)-এর গভর্নর নিযুক্ত হন। রাজন যখন এই দায়িত্ব নেন, তখন ভারতের অর্থনীতি অনেকটা পড়তির দিকে। ভারতীয় রুপীর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছিল। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতির হারও ছিল অনেক বেশী।
তিন বছরের মেয়াদে তিনি রুপীর মূল্য কমে যাওয়া কিছুটা সামলাতে পেরেছিলেন। এছাড়া রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। খাদ্য, ক্রেতার ক্রয় এবং পাইকারি মূল্যের উপর মুদ্রাস্ফীতির হার তার দায়িত্ব নেয়ার এক বছরের মাথায় প্রায় ১% করে কমে যায় এবং GDP’র হার ৪.৭% থেকে ৫.৭% বেড়ে যায়।
তিন বছর পর গভর্নর হিসেবে পদত্যাগ করার পর বিভিন্ন সূত্র থেকে এমন খবর পাওয়া যায় যে, মোদি সরকার রাজনকে এই পদে আর রাখতে চায়নি। সে কারণেই তার পদত্যাগ। কারণ রাজন মিডিয়ার কাছে গভর্নর থাকা অবস্থায় বড় বড় সব ঋণখেলাপিদের নাম প্রকাশ করার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছিলেন। যদিও বিভিন্ন ভাষণে বা মিটিংয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সবসময় রাজনের প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছে। গভর্নর থাকাকালীন সময়ে এক সভার ভাষণে রাজনকে উদ্দেশ্য করে মোদী বলেন, “রঘুরাম প্রত্যেক দুই সপ্তাহ পর পর আমার কাছে আসেন। আসার সময় তিনি সাথে করে তিনটি কিংবা চারটি স্লাইড নিয়ে আসেন। আমি এত পড়ালেখা জানি না। কিন্তু রঘুরাম এত সুন্দর করে আমাকে সব বুঝিয়ে দেন যে সেসব আমার মস্তিষ্কের ভিতরে গেঁথে যায়। আমার মনে হয় তিনি কোনো এক সময় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কারও পেয়ে থাকবেন।” এমনকি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে রঘুরাম রাজনকে যখন এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি স্বীকার করেন যে, নরেন্দ্র মোদীর সাথে তার সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল। গভর্নর থাকাকালীন সময়ে তাদের নিয়মিত দেখা হতো। নরেন্দ্র মোদী আরও বলেন, RBI এবং ভারত সরকারের চিন্তার মধ্যে খুব বেশি অমিল নেই। যদিও পরবর্তীতে দেখা যায় কথাটি খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ইদানিং রঘুরাম রাজন দুটি কারণে আবারও শিরোনামে এসেছেন। প্রথমত, তার বই “I do what I Do” এর কারণে। বইটিতে গভর্নর থাকাকালীন সময়ে তার অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়াতে দেয়া তার সাক্ষাৎকারগুলোর সঙ্কলন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এই বইটিতে একজন গভর্নর হিসেবে রাজনৈতিক এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করার সময় কী কী সমস্যার ভিতর দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা এবং অভিমত পাওয়া যায়। এছাড়া বইটিতে RBI এর স্বায়ত্তশাসিত হবার প্রসঙ্গে পরোক্ষভাবে তার সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, মুদ্রাহিতকরণ (Demonetization) নিয়ে তার বক্তব্য ছিল সবার অজানা। RBI থেকে তিনি চলে যাবার পরপরই ভারতে মুদ্রাহিতকরণ ঘটে। নিজের পূর্বের কর্মসংস্থায় ফিরে যাবার পর দীর্ঘ এক বছর এই সম্পর্কে একটা কথাও বলেননি তিনি। এই সময়ে তিনি তার তিন বছরের অভিজ্ঞতাগুলোকে বই আকারে সাজাতে থাকেন এবং প্রকাশ করার জন্য আবারও মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হন। বইটি প্রকাশের পরই জানা যায় যে, রাজন সরকারকে মুদ্রাহিতকরণ করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছিলেন এবং নিজেও এর ফলাফল নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। তিনি সরকারকে প্রথমদিকে মৌখিকভাবে মুদ্রাহিতকরণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। এমনকি RBI থেকে লিখিতভাবে একটি রিপোর্টও সরকারকে দেয়া হয়েছিল যেখানে কালো টাকা জব্দ করার জন্য মুদ্রাহিতকরণ বাদে অন্যান্য উপায়ের কথা উল্লেখ ছিল যেগুলো সেসময় কেউ গ্রাহ্য করেনি। যা-ই হোক, শঙ্কাটা যে অমূলক ছিল না তা পরবর্তীতে মুদ্রাহিতকরণের পর ভারতের GDP হার অবনমিত হওয়া লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৮ সালেও ভারতে আরও একবার মুদ্রাহিতকরণ (Demonetization) করা হয়েছিল এবং তখনও RBI এর মধ্যস্ততায় সেটি করা হয়নি। তাই RBI এর স্বায়ত্তশাসিত হবার প্রসঙ্গে রাজনের বক্তব্যে এর সমর্থনের গন্ধ পাওয়াটাই স্বাভাবিক [২]।
মুদ্রাহিতকরণের ভালো এবং খারাপ – দুই দিক নিয়েই রঘুরাম রাজন আলোচনা করেছেন। রাজনের মতে, এখন যদি ব্যাঙ্কের ডিপোজিটের অর্থ খতিয়ে দেখা হয় এবং কোথা থেকে এত টাকা এসেছে তার অনুসন্ধান করা হয় তাহলে খুব সহজেই অপরাধীদের ধরা যাবে এবং ট্যাক্স উশুল করা যাবে। আবার মুদ্রাহিতকরণের জন্য যদি ট্যাক্স দেয়ার পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে যে এই প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য বয়ে নিয়ে আসবে। অপরদিকে, প্রাথমিকভাবে GDP হার কমে যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে সেটার সাথে মুদ্রাহিতকরণের সরাসরি যোগাযোগ আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে বের করার কথাও রাজন বলেছেন। তার মতে হয়তো মুদ্রাহিতকরণের প্রভাব এখানে আংশিকভাবে হলেও, অবশ্যই আছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি পুরো একটি দেশের অর্থনীতির উপর কতটুকু বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে সেটা অনুসন্ধান না করে কোনো সঠিক উপসংহারে আসা যাবে না।
গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার পর রঘুরাম রাজনকে অনেকে RBI এর জেমস বন্ড বলেছিলেন। কারণ সেই সময় ভারতের অর্থনীতির যে সংকটকাল চলছিল, এমন সময় রঘুরাম রাজনের মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারক দায়িত্ব নেয়ার পর সাধারণ মানুষের আশা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল। তিন বছরের মেয়াদে রাজন সেইসব মানুষদের প্রত্যাশা ভালোই পূরণ করতে পেরেছেন। যদিও, এই বিষয়ে মতের অমিল আছে।
গভর্নর পদে তার মেয়াদকাল নবায়ন না করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল সেটা সময় বলে দিবে। কিন্তু দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করা এবং কালো টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য তার কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ছিল প্রশংসাযোগ্য। তাছাড়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বর্তমান তরুণদের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রতি এবং পলিসিগত কার্যকলাপের প্রতি এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করা ছিল সত্যি অনুপ্রেরণাময়।
তথ্যসূত্র
[১] Rajan, R. (2017). Fault Lines: How Hidden Fractures still Threaten the World Economy, Princeton University Press.
[২] Rajan, R. (2017). I Do What I Do, Harper Collins, India.
ফিচার ইমেজ- newsmobile