দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাঁকবদলকারী অন্যতম প্রধান ঘটনা। এর ফলাফল হিসেবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে নতুন দুই পরাশক্তি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন; যাদের মধ্যে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগপর্যন্ত চলে ‘কোল্ড ওয়ার’, বাংলায় যাকে আমরা বলি ‘স্নায়ুযুদ্ধ’। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে টিকে থাকার লড়াই এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণস্বরূপ শুরু হয় আর্মস রেইস এবং স্পেস রেইস।
এই প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বিজয়ী হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। তারপর পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর প্রথম স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক ১’ (Sputnik-1) উৎক্ষেপণ করে, মহাশূন্যে কোনো প্রাণী হিসাবে কুকুর প্রেরণ করে, চাঁদে ‘লুনা ২ (Luna-2)’ নামক স্পেসক্রাফট প্রেরণ করে, এরপর সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগিয়ে মহাশূন্যে প্রথম মানবও প্রেরণ করে।
এত সব প্রথমের পেছনে মূল কারিগর ছিলেন সের্গেই করোলেভ, যাকে তার মৃত্যুর আগে পৃথিবীবাসী ‘চীফ ডিজাইনার’ নামে জানত। তিনি আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
জন্ম ও শৈশব
পুরো নাম সের্গেই পাভলোভিচ করোলেভ। জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৭ সালের ১২ জানুয়ারি বর্তমান ইউক্রেনের ঝিতোমিরে। তার বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর তার মা নতুন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে করোলেভের সৎবাবার সাথে মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হয়নি।
শিক্ষাজীবন
করোলেভের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ওডেসা বিল্ডিং ট্রেড স্কুল থেকে ছুতোরের কাজ শেখার মাধ্যমে। তার অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতি ভালোবাসা শুরু হয় যখন তিনি ১৯১৩ সালে একটি এয়ারশোতে যান। এরপর তিনি গ্লাইডার বানানোর কাজ শুরু করেন, এবং মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার প্রথম গ্লাইডার তৈরি করেন। এর এক দশক পর তিনি ‘সোসাইটি অব এভিয়েশন অ্যান্ড এরিয়্যাল নেভিগেশন অব ইউক্রেন অ্যান্ড দ্য ক্রিমিয়া’-তে যোগ দেন। সেখানে তিনি কে-৫ (K-5) নামের আরেকটি গ্লাইডার ডিজাইন করেন।
এরপর তিনি কিয়েভ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর শিক্ষালাভ করেন। সেখান থেকে তিনি রাশিয়ার এমআইটি-খ্যাত বাউমান মস্কো স্টেট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে আরেক বিখ্যাত সোভিয়েত বিমান প্রকৌশলী আন্দ্রেই টুপোলেভের অধীনে বিমান প্রকৌশল বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন; যদিও পরে তার মনোযোগ রকেট প্রোপালশনের দিকে সরে যায়, যেটি সেসময় শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বিষয় ছিল।
টুপোলেভ তার তরুণ ছাত্র সম্পর্কে বলেছিলেন,
“এমন একজন মানুষ যার নিজের কাজ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে রয়েছে সীমাহীন একনিষ্ঠতা।”
১৯৩১ সালে ফ্রেডরিখ সান্ডারের (Fredrich Tsander) সাথে রকেটবিদ্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণার জন্য করোলেভ প্রতিষ্ঠা করেন ‘গীর্ড’ (Gruppa Izucheniya Reaktivnogo Dvizheniya – GIRD; রাশিয়ান সংস্থাটির নাম ইংরেজি করলে দাঁড়ায় Group For The Study Of Reactive Motion), যে প্রতিষ্ঠানে কাজের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ‘তরল জ্বালানি চালিত’ রকেট আবিষ্কার করেন। ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে রকেট বিদ্যা নিয়ে কাজ করা দুটি প্রতিষ্ঠান ‘গীর্ড’ এবং ‘জিডিএল’ (GDL: Gas Dynamics Laboratory)-কে একত্রিত করে সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে আরএনআইআই (RNII: Reaktivnyy Nauchno-Issledovatel’skiy Institut, রাশিয়ান সংস্থাটির ইংরেজি নাম Ractive Scientific Research Institute) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
করোলেভ নতুন গঠিত আরএনআইআই-তে অ্যারোস্পেস স্ট্রাকচার নিয়ে এবং তার সহকর্মী ভ্যালেনটিন গ্লুশকো (Valentin Glushko) রকেট প্রোপালশন সিস্টেম নিয়ে কাজ করতেন।
গুলাগ জীবন
১৯৩৬ সালে স্ট্যালিন তার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে শুরু করেন ‘নির্মম শুদ্ধি অভিযান’, যেটি ‘গ্রেট টেরর’ নামেও পরিচিত। ১৯৩৮ সালের ২৩ মার্চ এই অভিযানের অধীনে ভ্যালেন্টিন গ্লুশকোকে আটক করা হয়। গ্লুশকো তার উপর অভিযোগের ভার কমাতে করোলেভের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেন। ফলশ্রুতিতে করোলেভকে আটক করা হয় এবং আরএনআইআই-তে রকেট প্রোগ্রামের রিসার্চ ধীর করে দেওয়ার মাধ্যমে নাজি জার্মানির রকেট প্রোগ্রাম এগিয়ে দেওয়ার অভিযোগে তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। স্টালিনের গুলাগ ক্যাম্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ‘কলিমা সোনার খনিতে’ তার কারাজীবন শুরু। কারাভোগের সময় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে এবং স্কার্ভি রোগে ভুগে তিনি তার সবক’টি দাঁত হারান, তার হার্ট এবং চিবুক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পুনর্বিচারে তার শাস্তি কমিয়ে ১০ বছর থেকে ৮ বছর করা হয়, এবং তার একসময়কার শিক্ষক, আন্দ্রেই টুপোলেভ – যিনি নিজেও রাজবন্দী, তার অনুরোধে করোলেভকে সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কারাগারে অবস্থিত গোপন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ল্যাবরেটরিতে গবেষণার সুযোগ দেওয়া হয়।
জীবনের মোড় বদলে দেওয়া ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে সোভিয়েত রেড আর্মি নাজি জার্মানির V-2 রকেটের কিছু যন্ত্রাংশ জব্দ করে এবং তারা এই যন্ত্রাংশগুলোকে তাদের নিজস্ব মিসাইল সিস্টেমের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চাইল। যন্ত্রাংশগুলো মূল্যায়ন করার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হিসেবে ডাক পড়ল কারাগারে থাকা সের্গেই করোলেভের, যে ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এবং ১৯৪৫ সালে তাকে রেড আর্মির একজন কর্নেল হিসেবে নিয়োগ দিয়ে জার্মানিতে পাঠানো হলো।
পৃথিবীর প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম তৈরির গল্প
করোলেভ নাৎসিদের ভি-২ রকেটের জব্দকৃত যন্ত্রাংশগুলো মূল্যায়ন করে বুঝতে পারলেন , ভি-২ রকেটের গাইডেন্স সিস্টেম, টার্বো-পাম্প এবং ইঞ্জিন অনেক উচ্চমানের পরিশীলিত।
যদিও ভি-২ রকেটের ডিজাইনার আরেক বিখ্যাত নাজি রকেটবিজ্ঞানী ভন ব্রাউন (Wernher Von Braun)। তার টিমকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত ভি-২ রকেটসহ সিআইএ (CIA) অপারেশন পেপার ক্লিপ (Operation Paperclip)-এর মাধ্যমে আমেরিকায় নিয়ে যায়, যা আমেরিকাকে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে রাখে। কিন্তু তা সের্গেই করোলেভের ভি-২ রকেটের রেপ্লিকা R1 তৈরিতে একটুও বাধার সৃষ্টি করাতে পারেনি।
নতুন প্রতিষ্ঠিত NII-88 রিসার্চ সেন্টারে তারা R1 মিসাইলসহ R1 এর আরো অনেক সংস্করণ তৈরি করেন।
১৯৫৩ সালে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সামরিক নেতৃত্বের সাথে বসে করোলেভ সিদ্ধান্ত নেন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম তৈরির, যার নাম দেন R-7 বা সেমিওর্কা (রাশিয়ান ভাষায় ৭) এবং যার রেঞ্জ হবে ৭,০০০ কিলোমিটার। অনেক ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ১৯৫৭ সালের ২১ আগস্ট পৃথিবীর প্রথম আইসিবিএম লঞ্চ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেটি বর্তমান কাজাখস্তানের বাইকনুর কসমোড্রম থেকে যাত্রা শুরু করে ৭,০০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রাশিয়ায় কামচাটকা পেনিনসুলায় গিয়ে যাত্রা শেষ করে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছে,
প্রতিপক্ষ আমেরিকা পরিপূর্ণ ভি-২ রকেট এবং তার ডিজাইনারকে নিয়েও আইসিবিএম তৈরির ক্ষেত্রে তার কাছে ১৫ মাসের ব্যবধানে পরাজিত হয়।
স্পুটনিক স্যাটেলাইট থেকে ভস্টক ম্যানপ্রোভ
পৃথিবীকে ঘিরে স্যাটেলাইট আবর্তনের শুরুটা হয়েছিল সের্গেই করোলেভের হাত ধরে। আইসিবিএম-এর সম্ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে করোলেভ ১৯৫৩ সালের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় একটি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের প্রস্তাব করেন, যেটি পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তন করবে এবং পৃথিবীতে বার্তা প্রেরণ করবে।
যদিও কেন্দ্রীয় কমিটি প্রথমে উৎসাহ বোধ করেনি, কিন্তু করোলেভ প্রতিপক্ষ আমেরিকার স্পেস প্রোগ্রামের ব্যাপক উন্নতি হয়ে যাচ্ছে মর্মে কেন্দ্রীয় কমিটিকে রাজি করাতে সক্ষম হন।
করোলেভের টিমের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর R-7 রকেটে করে পৃথিবী থেকে ৫৭৭ কিলোমিটার উচ্চতায় ৮৩.৬ কেজি ওজনের মানব ইতিহাসের প্রথম স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করা হয়, যার বিপ-বিপ সিগন্যাল পৃথিবীকে নাড়া দিয়ে যায়।
অবশেষে ২১ দিন যাবত তার ট্রান্সমিটারের ব্যাটারির চার্জ শেষ হওয়ার আগে সেটি পৃথিবীতে সিগন্যাল পাঠাতে থাকে, যেটি পৃথিবীর মানুষ রেডিওর মাধ্যমে শুনতে পায়। ১৯৫৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে পুড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহটি ১,৪৪০ বার আবর্তন সম্পন্ন করে।
স্পুটনিক-১ এর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সোভিয়েত প্রিমিয়ার নিকিতা ক্রুশ্চেভ ‘অক্টোবর বিপ্লবের’ ৪০ তম বার্ষিকী উদযাপনকে স্মরণীয় করে রাখতে স্পুটনিক-২ উৎক্ষেপণের অনুমতি দেন যেটি প্রথম কোনো প্রাণীকে মহাশূন্যে নিয়ে যাবে। করোলেভ এবং তার টিমের একান্ত প্রচেষ্টায় স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের এক মাসের মাথায় ১৯৫৭ সালের ৩রা নভেম্বর কুকুর লাইকাসহ স্পুটনিক-২ উৎক্ষেপণ করা হয়। যদিও অত্যাধিক তাপের কারণে লাইকার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে।
প্রথম মানব ইউরি গ্যাগারিনকে মহাশূন্যে প্রেরণ
যদিও লাইকার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়, তবুও এই ধারণা শক্তপোক্ত হয় যে মহাশূন্যে মানুষকেও প্রেরণ করা সম্ভব। তখন করোলেভ মনুষ্যবাহী মহাশূন্য অভিযানে পূর্ণ মনোযোগ দেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা ছিল মিশন শেষে নভোচারীদের আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার কাজ। এই সমস্যা সমাধানে করোলেভ ‘ভস্টক’ প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ শুরু করেন যার সাফল্য তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখে। তিনি এই প্রোগ্রামের ডিজাইনার হিসেবে নিয়োগ দেন কনস্টান্টিন ফিয়কোতিস্তভকে (Konstantin Feokotistov)। ১৯৬০ সালে ভস্টক প্রোগ্রামের প্রথম প্রোটোটাইপ অরবিটে প্রেরণ করা হয়, কিন্তু তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশে ব্যর্থ হয়।
দুই মাস পর ‘চাইকা’ (Chaika) এবং ‘লিশিচকা’ (Lishichka) নামের দুটি কুকুরকে ভস্টকে করে মহাশূন্যতা পাঠানো হয়। কিন্তু মিশন ব্যর্থ হয়, এবং তারা এক বিস্ফোরণে মারা যায়। এর এক মাসেরও কম সময়ে নতুন দুটি কুকুর ‘বেলকা’ (Belka) এবং ‘স্ট্রেলকা’ (Strelka) পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম কোনো প্রাণী হিসেবে জীবিত অবস্থায় মহাশূন্য থেকে ফেরত আসে।
এবার মানুষ যাওয়ার পালা।
এর সাত মাস পর ১২ এপ্রিল ১৯৬১ সালে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর পাইলট ইউরি গ্যাগারিন বর্তমান কাজাখস্তানের বাইকোনুর কসমোড্রমে ‘ভস্টক’ ক্যাপসুলে ইতিহাস রচনা করার জন্য বসে আছেন। করোলেভ মিশন কন্ট্রোল রুমে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা বেজে ঠিক ৬ মিনিটের মাথায় করোলেভ R-7 রকেটের ইঞ্জিন চালু করেন, এবং R-7 আস্তে আস্তে উপরে উঠতে শুরু করে। গ্যাগারিন রাশিয়ান ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন, “Poyekhali (Let’s go!)“, যেটি পরবর্তীতে লোকমুখে বিখ্যাত শব্দ হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়। অরবিটে পৌঁছানোর পর ইতিহাসের প্রথম কোনো মানবসন্তান মহাশূন্যে পৌঁছানোর উল্লাসে মিশন কন্ট্রোলের সবাই চিৎকার করে উঠলেন।
মহাশূন্যে গ্যাগারিনের অভিব্যক্তি ছিল,
“আমি পৃথিবীকে দেখতে পারছি… অসাধারণ দেখাচ্ছে!”
১০৮ মিনিট মহাশূন্যে থাকাকালে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করার পর নিরাপদে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসেন তিনি, যা তাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তো বটেই, গোটা পৃথিবীতেই রূপকথার চরিত্র বানিয়ে দেয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার স্বার্থে খুব জটিল গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করত। তাই করোলেভের মৃত্যুর আগপর্যন্ত পৃথিবীবাসী জানতে পারেনি ইউরি গ্যাগারিনের গল্পের পেছনে মূল কারিগর সম্পর্কে।
নাসাও সেসময় একই রকম একটি স্পেস প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছিল, কিন্তু গ্যাগারিন মহাশূন্যে যাওয়া পর্যন্ত তারা একটা শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে সতের মিনিটের টেস্ট ফ্লাইটের বেশি যেতে পারেনি। করোলেভ নাসাকে খুব সহজেই পরাজিত করলেন।
ঐ সময়কার আমেরিকার এক সংবাদপত্রের ব্যঙ্গচিত্র ছিল অনেকটা এরকম, একটি শিম্পাঞ্জি আরেকটি শিম্পাঞ্জিকে বলছে, “আমরা রাশিয়ানদের থেকে সামান্য পিছিয়ে এবং আমেরিকানদের থেকে সামান্য এগিয়ে।”
তো গ্যাগারিনের মহাশূন্য জয় আমেরিকানদের জন্য বিরাট পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভস্টক প্রোগ্রামের ইতি টানা হয় ১৬ জুন ১৯৬৩ সালে প্রথম কোনো নারী হিসেবে ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভাকে মহাশূন্যে পাঠানোর মাধ্যমে।
ভস্খোদ প্রোগ্রাম
ভসখোদ প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি তিনজনের একটি দলকে মহাশূন্যে পাঠান। এরপর যখন জানতে পারেন আমেরিকা স্পেসওয়াক করার জন্য তোড়জোড় শুরু করছে, তখন তিনি দ্রুত ভস্খোদ-২-কে একটু মডিফাই করে অ্যালেক্সি লিওনভকে ১৯৬৫ সালের ১৮ মার্চ প্রথম মানব হিসেবে স্পেসওয়াক করান। তিনি প্রায় ছয় মিনিট মহাশূন্যে হাঁটেন এবং আমেরিকাকে এখানেও পরাজয়ের স্বাদ দেন।
চাঁদের পানে যাত্রা
গ্যাগারিনের মহাশূন্যজয় ছিল আমেরিকানদের কাছে অপমানজনক পরাজয়। আমেরিকান প্রশাসন নড়েচড়ে বসে, প্রেসিডেন্ট জেএফ কেনেডি ১৫ মে ১৯৬১ সালে, ষাটের দশকের শেষে চাঁদে মানুষ পাঠানোর চ্যালেঞ্জ করেন। করোলেভের আমেরিকাকে মুন মিশনে পরাজিত করার নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। এজন্য তিনি বিশালাকার ‘N-1’ রকেট এবং ‘সয়ুজ’ স্পেসক্রাফট তৈরির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু N-1 রকেটের ইঞ্জিন নিয়ে তিনি তার পুরনো সহকর্মী ভ্যালেন্টিন গ্লুশকোর সাথে কিছুতেই একমত হতে পারছিলেন না। তাকে পাশ কাটানোর জন্য করোলেভ নিকোলাই কুজনেৎসভের শরণাপন্ন হন। কিন্তু কুজনেৎসভের প্রস্তাবিত ইঞ্জিন ছিল খুব ছোট, যেখানে বিশালাকার N-1 রকেটের জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি থ্রাস্ট। এসব ঝামেলায় N-1 রকেট প্রোগ্রাম অনুমোদন পেতে পেতে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়, যদিও ওই সময়ের মধ্যে ‘আমেরিকান লুনার প্রোগ্রাম’ মার্কিনীদের জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত হয়।
যদিও ইতোমধ্যে সের্গেই করোলেভ ১৯৫৯-৬৬ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো লুনার মিশন সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে লুনা-টু প্রোব ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ সালে পৃথিবীর প্রথম কোনো নভোযান হিসেবে চাঁদে পৌঁছায়, যদিও সেটি ক্রাশ ল্যান্ড করে। ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে লুনা-৩ প্রোব প্রথম চাঁদের দূরবর্তী অংশের ছবি তুলতে সক্ষম হয়।
জীবনাবসান
স্ট্যালিনের গুলাগে থাকাকালীন করোলেভকে অমানুষিক নির্যাতন ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যার ফলশ্রুতিতে তিনি হার্ট এবং চিবুকের জটিল সমস্যায় ভুগতেন। এ সবকিছু তার জীবনাবসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। N-1 রকেট প্রোগ্রাম চলাকালে ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে ৫ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে কোলন সার্জারি করার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ১৪ জানুয়ারি এই প্রতিভাবান ‘চীফ ডিজাইনার’ মৃত্যুবরণ করেন।