”যে টিউশনিটা আছে সেটাও ছেড়ে দাও, তারপর আমার গরীব বর সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে আর আমার কোনো অনুশোচনা থাকবে না”। আরও বেশি কাছে পাওয়ার অবদারে, অভিমানী স্বামীর রাগ ভাঙাতে বলা সংলাপটি মুহূর্তেই দর্শকদের হৃদয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক মুহূর্ত হিসাবে জায়গা করে নেয়। আর সবচেয়ে নজর কাড়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সী হরিণী চোখের অভিনেত্রী অপর্ণার সুনিপুণ অভিনয়।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ সিনেমাটিতে অভিনয়ের হাতেখড়ি হয় অপর্ণা-অপুর চরিত্রায়নে শর্মিলা ঠাকুর ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। ১৯৫৯ সালে এই সিনেমার মধ্য দিয়েই রুপালী পর্দায় জায়গা করে নেন রুপে-গুণে তেজস্বিনী শর্মিলা ঠাকুর। অল্প সময়ের মাঝেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (ভারত), ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট পুরস্কার সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করে নেয় সিনেমাটি। এরপর তার সুনিপুণ অভিনয় দক্ষতায় আরো অনেক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়ে ‘অপুর সংসার’ এর অপর্ণা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
১৯৪৬ সালের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার হায়েদ্রাবাদে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বংশধর গীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইরা ঠাকুর (বড়ুয়া) এর সংসারে জন্মগ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর। গীতিন্দ্রনাথ ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধর এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়। মা ইরা ঠাকুর ছিলেন আসামের বিখ্যাত লেখক জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়ার কন্যা। আবার শর্মিলা ঠাকুরের মায়ের পরিবারের দিক থেকেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। ইরা ঠাকুরের মা লতিকা বড়ুয়া ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই দ্বীজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনী।
শর্মিলা ঠাকুরের আরও দুটি বোন ছিল; ঐন্দ্রিলা ও রমিলা। শর্মিলার পূর্বে ঐন্দ্রিলা প্রথম শিশুশিল্পী হিসাবে অভিনয় জগতে আসেন। ১৯৫৭ সালে তপন সিনহার ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমার মুখ্য চরিত্র মিনি হিসাবে দেখা যায় তাকে।
শর্মিলার বাল্যকাল কাটে আসানসোলে। সেখানে তিনি ‘St. John’s Diocesan Girls’ Higher Secondary School‘ ও ‘Loreto Convent‘ নামক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৩ বছর বয়সেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মে তার। পরের বছরেই প্রথম সিনেমার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। তবে অভিনয় জগতে প্রবেশের ফলে সেই সময় লেখাপড়ায় অনেক ব্যঘাত ঘটে। ফলশ্রুতিতে পড়াশুনায় আর মনোনিবেশ করতে পারেননি এবং আশাতীতভাবে পরীক্ষায় কম নম্বর পেতে থাকেন।
একদিকে অভিনয়ের সাফল্য, অন্যদিকে পড়াশোনায় মনোনিবেশ- একইসাথে তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। জীবনের এই চরম মুহূর্তে তার বাবার সহযোগিতা ও পরামর্শে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে অভিনয়েই পুরোপুরিভাবে মগ্ন হয়ে যান। সামাজিক নিয়মের বেড়িবাঁধ ভেঙে পরিবারের সহায়তায় অভিনয়ে আসার সেদিনের সেই সিদ্ধান্তেই বাংলা চলচ্চিত্র তার অন্যতম নক্ষত্রটি পেয়েছিল।
প্রথম ছবিতেই বিপুল প্রশংসিত অভিনেত্রী পরবর্তী বছরেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন ‘দেবী’ সিনেমায়। ১৯৬০ সালে মুক্তি প্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ সিনেমাটিও বিপুল হারে সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত তিনটি ছবি ‘শেষ অঙ্ক’, ‘নির্জন সৈকতে’ ও ‘ছায়া সূর্য’। ‘শেষ অঙ্ক’ সিনেমায় তিনি উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ পান এবং বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায় সিনেমাটি।
১৯৬৪ সালে পরিচালক শক্তি সামন্তর ‘কাশ্মির কি কলি’ সিনেমার মধ্য দিয়ে হিন্দি সিনেমায় পদচারণা শুরু হয় শর্মিলা ঠাকুরের। অনবদ্য সৌন্দর্য আর অভিনয়ের তীক্ষ্ণতায় অচিরেই খ্যাতির শীর্ষে চলে যান তিনি। সেই সময় রুপালী পর্দায় শর্মিলা ঠাকুর মানেই যেন ব্যবসাসফল সিনেমার জন্ম। একের পর এক মুক্তি পায় ‘ওয়াক্ত’, ‘অনুপমা’, দেবর’, ‘শাওয়ান কি ঘাটা’ নামে বাণিজ্যিক সফল সিনেমা।
১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমায় উত্তম কুমারের বিপরীতে ভিন্নভাবে দেখা যায় তাকে। সাংবাদিকের চরিত্রায়নে আবারও তার অসাধারণ অভিনয় শৈলীর প্রমাণ দেন। প্রতিবার পর্দায় তাকে ভিন্নভাবে খুঁজে পাওয়া যেত। ১৯৬৭ সালে শক্তি সামন্তের ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ সিনেমায় তার বিকিনি পরে পর্দায় আবির্ভাব রীতিমত আলোড়ন ফেলে দেয় সারা দেশে। রক্ষণশীল মানুষ তার তীব্র নিন্দা করলেও লাস্য ভঙ্গিমায় তার অভিনয় বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। সেই বছরেই ‘ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিনে’র প্রচ্ছদেও এই বেশে তাকে দেখা যায়।
১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তার ব্যবসাসফল ছবিগুলো ‘আমনে সামনে’, ‘মেরে হামদাম মেরে দোস্ত’, ‘হামসায়া’, ‘সত্যকাম’, ‘তালাশ’। তবে পূর্বের খ্যাতির রেকর্ড ভাঙে ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আরাধনা’ সিনেমাটি। সিনেমার কাহিনী অবলম্বনে তৎকালীন সময়ে বিয়ের পূর্বে অন্তঃসত্ত্বা হওয়া শর্মিলার জীবনের প্রতি পদক্ষেপে বাঁধার সম্মুখীন হওয়া বিশেষভাবে নাড়া দেয় দর্শকদের। একইসাথে স্বামী ও ছেলের ভূমিকায় রাজেশ খান্নার অভিনয় ও রাজেশ-শর্মিলা জুটিও নজর কাড়ে সবার।
বহু তরুণের স্বপ্নের নায়িকা শর্মিলা ক্যারিয়ারের মধ্যগগনেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন পতৌদি নবাব বংশের বংশধর, ভারতের ক্রিকেট অধিনায়ক মনসুর আলি পতৌদির সাথে। ১৯৬৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন দুজন। ভিন্ন ধর্মালম্বী হওয়ায় অনেক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন তখন। বিয়ের পূর্বে শর্মিলা ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার নতুন নাম হয় বেগম আয়েশা সুলতানা। নিন্দুকের অনেক সমালোচনা নিষ্ফল করে সুখী দম্পতির দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন তারা। পতৌদি পরিবারের আদর্শ বধূ হিসাবেও শর্মিলার বেশ প্রশংসা শোনা যায়। শর্মিলা-মনসুর দম্পতির তিন সন্তান। সাইফ আলি খান ও সোহা আলি খান বলিউডে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাবা আলি খান জুয়েলারি ডিজাইনার।
বিয়ের পরও একটুও পসার কমেনি তার। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ১৯৭১ সালে ‘সীমাবদ্ধ’। সিনেমা দুটিতেই তিনি মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন এবং সফলতা পান। হিন্দিতে তার উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘সফর’, ‘অমর প্রেম’, ‘রাজারানি’, ‘দাগ’, ‘আ গালে লাগ যা’, ‘দাস্তান’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। ১৯৭৫ সালে সঞ্জীব কুমারের বিপরীতে ‘মওসাম’ সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জোরে ভারতের ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ অর্জন করেন।
১৯৭৭ সালে উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ সিনেমা দুটিই দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় শর্মিলা-শশী কাপুর জুটি উপহার দেন ছবি ‘গেহরি চোট‘ (বাংলা নাম ‘দূরদেশ’)। বাংলাদেশের বিভিন্ন সিনেমা হলেও ছবিটি মুক্তি পায় এবং বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তৎকালীন রঞ্জিত মল্লিক, রাজেশ খান্না, দিলিপ কুমার, শশী কাপুর, অমিতাভ বচ্চন সহ চলচ্চিত্র জগতের বহু বিখ্যাত অভিনেতার বিপরীতে দেখা গেছে তাকে।
‘মন’, ‘ধাড়কান’, ‘আবার অরণ্যে’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ২০০৩ সালে ‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করেন এবং দীর্ঘদিন ভারতীয় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বর্তমানে তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
জীবনের বিভিন্ন সুর, তাল, ছন্দে ৪২ বছরের সফল বিবাহিত জীবন কাটিয়ে ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন মনসুর আলি পতৌদি। ফুসফুসের সংক্রমণ দরুন দিল্লীর একটি হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসারত ছিলেন তিনি। তিনি মরণোত্তর চক্ষু দান করেন ‘ভেনু আই ইনস্টিটিউটকে’। শর্মিলা ঠাকুরের কাছে আজও তিনি তার পথপ্রদর্শক। নবাব পতৌদির মৃত্যুর পর স্বামীর দেখানো পথে তিনি তার স্মৃতি রক্ষার্থে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেছেন।
চিরযৌবনা শর্মিলা ঠাকুর তার সৌন্দর্য, প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের মাধুর্য দিয়ে আজও বলিউডের অন্যতম সেরা তারকা হিসাবে সম্মানিত। তার সুমিষ্ট হাসি আর হরিণী নয়নের চাহনী আজও তাকে আকর্ষণীয় করে তোলে সকলের কাছে। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম উজ্জ্বল এই নক্ষত্র আরও হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকবেন সকল ভক্তের হৃদয়ের রানী হিসাবে।
ফিচার ইমেজ- Zee News, Zimbio, Pinterest