১
আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ফুটবলের ইতিহাসে এযাবৎ কালের সেরা কোচ কে, তাহলে আপনার মাথায় কার নাম আসবে? কারো মনে মরিনহো, কারো মনে পেপ গার্দিওলা, কেউ আবার রাইনাস মিশেলের কথা ভাববে, কেউ হয়তো আবার সিমিওনি। এসব নাম বাদেও আরো অনেক গ্রেট কোচ আছেন, যাদের নাম লিখতে গেলেও এই লেখার আকার অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই এসব কিছু বাদ দিয়ে সরাসরি মূল কথায় চলে আসা যাক।
সর্বকালের সেরা বিবেচনায় প্রথম যে বিষয়টা জরুরী, তা হচ্ছে সেই খেলোয়াড় অথবা কোচটিকে তার খেলা থেকে অবসর নিতে হবে। ক্যারিয়ারের মাঝপথে কখনোই বিবেচনা করা উচিত না তিনি সর্বসেরা কিনা। কারণ তখন যুক্তির চেয়ে আবেগটা অনেক বেশি কাজ করে। তবুও মানুষ বিবেচনা করে। সর্বকালের সেরা কোচ নিয়ে এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনই হয়েছে, সেটা ২০১৩ সালে, ওয়ার্ল্ড সকার পত্রিকার অধীনে। সেই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৭৩ জন এক্সপার্ট। প্রত্যেকে পাঁচ জন করে ম্যানেজারকে গ্রেট হিসেবে বাছাই করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
সেই নির্বাচনে ৪৯ জনের ভোট পেয়ে আলেক্স ফার্গুসন প্রথম হয়েছিলেন, দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাইনাস মিশেল পেয়েছিলেন ৪৬ জনের ভোট। এই ভোটিংকে আসলে কতটা গুরুত্ব দেওয়া যায়? তাছাড়া অনেকের মতেই সর্বকালের সেরা কোচ হচ্ছেন রাইনাস মিশেল। সেটা শুধু ভোটের ফলাফলের কারণে নয়, উনি সেই সময়ে নতুন এক যুগের সূচনা করেছিলেন। অবশ্য এই নির্বাচনে মিশেল আর ফার্গির ব্যবধান মাত্র ৩ ভোটের। যা-ই হোক, এক নম্বর হোক আর না হোক, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত যত কোচ এসেছেন, তাদের মাঝে ফার্গুসন উপরের দিকেই থাকবেন।
এই নির্বাচনকে বাদ দিয়ে আরেকটু আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা যাক। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যানেজারদের জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড ধরা হয় ‘The League Managers Association Awards’ কে। এই পুরস্কারে ভোট দিতে পারেন সহকর্মী পেশাদার পরিচালকরা। পুরষ্কারটি সর্বোচ্চ চারবার জিতেছেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।
এছাড়া ‘Premier League Manager of the Season’ পুরস্কার তিনি জিতেছেন সর্বোচ্চ ১১ বার। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আর্সেন ওয়েঙ্গার এবং মরিহো জিতেছেন ৩ বার করে। একমাত্র কোচ হিসেবেও টানা তিনবার এই পুরস্কার জিতেছেন ফার্গি। এছাড়াও ‘Premier League Manager of the Month’ পুরস্কার জিতেছেন তিনি সর্বোচ্চ ২৭ বার, যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আর্সেন ওয়েঙ্গার জিতেছেন ১৫ বার।
যে কোনো জায়গায় প্রথম হওয়াটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গ্রেটরা বেশিরভাগ সময় দ্বিতীয় স্থানের সাথে নিজের ব্যবধানটা বাড়িয়ে নেন; যে বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ফার্গি অনন্য। তবে তার এই সফলতা এতটা সহজে আসেনি। এই পথেও অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল, শোনা যাক সেই গল্পের কিছু অংশ।
২
খেলোয়াড় ফার্গুসন
ফার্গুসন মাত্র ১৬ বছর বয়সে অপেশাদার ক্লাব কুইনস পার্কের হয়ে খেলা শুরু করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলে ৩১ ম্যাচে মাত্র ২০টি গোল করেন তিনি। দলে পর্যাপ্ত সুযোগ মিলছিলো না দেখে ১৯৬০ সালে চলে যান সেন্ট জন্সটনে। এখানেও একই ঘটনা। নিয়মিত গোল করে যাওয়ার পরও সুযোগ মিলছিলো না প্রথম একাদশে। ফার্গুসনকে সেন্ট জন্সটনের কোচ কানাডায় বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নতুন কোনো স্ট্রাইকার আনতে ব্যর্থ হওয়ায় একরকম বাধ্য হয়েই রেঞ্জার্সের বিপক্ষে মাঠে নামাতে হয় ফার্গুসনকে। সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে সব অবহেলার জবাব দেন ফার্গি। এই ম্যাচের পরেই স্কটিশ ক্লাব Dunfermline Athletic F.C. তাকে সাইন করায়। ১৯৬৪ সালে এই ক্লাবে জয়েন করার পর পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তার।
১৯৬৪ সালে Dunfermline স্কটিশ লিগে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, স্কটিশ লিগ জেতার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো Dunfermline Athletic, কিন্তু মাত্র ১ পয়েন্টের ব্যাবধানে লিগ হারাতে হয় তাদেরকে। স্কটিশ কাপ ফাইনালেও খেলেছিল তারা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেল্টিকের কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায়। লিগে জনস্টোনের বিরুদ্ধে খারাপ পারফর্মেন্সের কারণে ফার্গুসনকে ফাইনালের স্কোয়াড থেকে বাদ দেয়া হয়। সেই সিজনে Dunfermline লিগ হারে এক পয়েন্টের ব্যবধানে। তবে সেই সিজনে ফার্গির পারফরমেন্স ছিলো চোখ ধাঁধানো। ৩১ গোল করে তিনি ছিলেন লিগের টপ স্কোরার। এরপর তিনি ৬৫,০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে রেঞ্জার্সে যোগ দেন, যা কিনা দুটি স্কটিশ ক্লাবের মধ্যে ট্রান্সফারের রেকর্ড হিসেবে এখনো পর্যন্ত টিকে আছে। রেঞ্জার্সে দুই সিজন খেলে ৪১টি ম্যাচে ২৫ গোল করেন তিনি। কিন্তু রেঞ্জার্সে তার অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। ১৯৬৯ সালের স্কটিশ কাপের ফাইনালে হারের জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। এই সময় ইংলিশ ক্লাব Nottingham Forest ফার্গুসনকে সাইন করাতে চায়, কিন্তু তার স্ত্রী ইংল্যান্ডে যেতে অনিচ্ছুক থাকায় তিনি Falkirk এ যোগদান করেন। তিনি সেখানে খেলোয়াড়-কোচ হিসেবে পদোন্নতি পান,কিন্তু যখন জন প্রেন্টিস ম্যানেজার হন, তিনি ফার্গুসনকে কোচিংয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন। ফার্গুসন Ayr ইউনাইটেড যোগ দেন এবং ১৯৭৪ সালে সেখানে তার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শেষ করেন।
৩
কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু
১৯৭৪ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ফার্গি পেয়ে যান স্টার্লিংশায়ারের কোচিংয়ের দায়িত্ব। পার্ট টাইম জব হিসেবে কাজটি করার জন্য ফার্গি সাপ্তাহিক বেতন পেতেন ৪০ ইউরো করে। সেই বছরই একই লিগের অন্য আরেকটি ক্লাব সেন্ট মার্টিন ফার্গিকে প্রস্তাব দেয় তাদের ক্লাবের কোচ হবার জন্য। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলা এই ক্লাব ফার্গির কারিশমায় ১৯৭৭ সালে প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে এর পরেও মহিলা অ্যাসিস্ট্যান্টের সাথে বাজে ব্যবহার আর খেলোয়াড়দের সাথে খারাপ সম্পর্কের কারণ দেখিয়ে ফার্গিকে বরখাস্ত করা হয়। ক্যারিয়ারে এই একবারই ফার্গি বরখাস্ত হয়েছিলেন।
সেন্ট মার্টিনের পর ফার্গি দায়িত্ব পেলেন স্কটিশ জায়ান্ট আবার্ডিনের। প্রথম সিজনে লিগে চতুর্থ হয়ে শেষ করলো আবার্ডিন এবং স্কটিশ কাপের সেমিতেই থেমে গেলো তাদের যাত্রা। এরপরের সিজন ১৯৭৯-৮০তে তুলনামূলক ভালো খেলে স্কটিশ লিগ কাপের ফাইনাল অব্দি গেলেও, শেষ পর্যন্ত ট্রফিলেস হিসেবে এই সিজনটাও অতিবাহিত করতে হলো আবার্ডিনের। তারপরের সিজন থেকেই সবাই দেখলো এক ভিন্ন আবার্ডিনকে। যেখানে গত ১৫ বছর যাবৎ সেল্টিক এবং রেঞ্জার্স ছাড়া কেউ ট্রফি জিততে পারছিলো না, সেখানে ১৯৫৫ এর পর প্রথম স্কটিশ লিগ জিতে নিলো ফার্গির আবার্ডিন। ফার্গি সে লিগ জেতার পর বলেছিলেন-
“That was the achievement which united us. I finally had the players believing in me.”
আবার্ডিনকে নিয়ে ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো স্কটিশ কাপ জয় করেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।
এ সময় আর্সেনাল, টটেনহাম ইত্যাদি ক্লাব থেকে প্রস্তাব আসার পরেও ফার্গি সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। তবে ফার্গুসন সবাইকে অবাক করে দেন ইউরোপে সফলতা পেয়ে। আগেরবার স্কটিশ কাপ জেতার পর ১৯৮২-৮৩ সিজনে উইনার্স কাপ খেলার সুযোগ পায় আবার্ডিন। বায়ার্ন মিউনিখ আর টটেনহামকে হারিয়ে ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা পায় রিয়াল মাদ্রিদকে। রিয়াল মাদ্রিদকেও হারিয়ে দেওয়ার পর ফার্গি পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান সুপার কাপ এবং স্কটিশ লিগ কাপও জিতে যান। এ অবস্থায় লিভারপুলের প্রস্তাব পেয়েও সেটা ফিরিয়ে দেন ফার্গি।
আবার্ডিনে ফার্গির শেষ সিজনটা বাজে কাটে। এই সিজনে আবার্ডিন লিগে চতুর্থ হয়। এই সিজন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবার্ডিনের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন ফার্গি। অবশ্য এর মাঝে কিছুদিন নিজ দেশ স্কটল্যান্ডের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব চলাকালীন স্কটল্যান্ডের কোচ জক স্টেইন মারা গেলে তিনি স্কটল্যান্ডের দায়িত্ব নেন। কিন্তু যখন স্কটিশরা বাছাই পর্ব উৎরাতে ব্যর্থ হয়, তখন তিনি এই ক্ষণস্থায়ী দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
৪
ইংলিশ লিগে প্রবেশ
১৯৮৬ সালেই ফার্গুসনের কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটা আসে। রন অ্যাটকিনসন সবেমাত্র ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দায়িত্ব ছেড়েছেন তখন। লিগে দল ২১ নম্বর পজিশনে ধুঁকছে। অনেক ইউনাইটেড ফ্যান রেলিগেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছেন। তখনই ইউনাইটেড ম্যানেজমেন্ট থেকে ঘোষণা করা হলো নতুন কোচ নিয়োগের কথা। ধীরে ধীরে সংবাদ সম্মেলনে আসলেন নতুন কোচ। এসেই ঘোষণা দিলেন,
“Hello everybody, I’m just trying to say I’m appointed the manager of Manchester United. I hope the coming years will bring excitement to this club which the fans never expect and imagine.”
তা এই ধরনের কথা তো নতুন কেউ আসলে সবসময়ই বলে। কিন্তু সমর্থকদের তাতে বিশ্বাস কতটুকু ছিল, সেটাই হলো প্রশ্ন। এমনকি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজমেন্টেরই বা কতটুকু আস্থা ছিল, তা তর্কের বিষয়।
ফার্গুসন যখন দায়িত্ব নেন, তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ভালোই টালমাটাল অবস্থায় ছিল। দল লিগের পজিশনে ছিল ২১ নম্বরে (শেষের দিক থেকে ২য়), এটি মূল সমস্যা ছিল না। মূল সমস্যা ছিল, দলের অন্যতম খেলোয়াড় ব্রায়ান রবসন এবং নর্ম্যান হোয়াইটসাইড ছিলেন মাদকাসক্ত এবং জীবন নিয়ে চরমভাবে হতাশ। এবারো ফার্গি বরাবরের মতো শৃঙ্খলার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিলেন। কিন্তু সিজন শেষ করেন ১১ নম্বরে থেকে।
দ্বিতীয় সিজনে লিগে লিভারপুলের চেয়ে ৯ পয়েন্ট পিছিয়ে দ্বিতীয় হয়ে চমক দেখালেও পরের সিজনে আবার ১১ তম হয় ম্যানইউ। ১৯৮৯-৯০ সিজনে ফার্গি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে অবস্থায় পড়েন। মৌসুম শেষে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে ১-০ গোলে FA Cup ফাইনাল জিতে সে যাত্রায় টিকে যান তিনি।
৪
সাফল্যের শুরু
১৯৯২-৯৩ সিজনে ফার্গুসন ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ড এরিক ক্যান্টোনাকে কিনে আনেন। এই বছরেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ২৬ বছর পর প্রথম প্রিমিয়ার লিগ টাইটেল জেতে। এরপর একপর্যায়ে ১৯৯৬-৯৭ সিজনে লিগ জিতে পাঁচ বছরের মাঝে চার বার লিগ জেতার কীর্তি গড়েন তিনি।
১৯৯৮-৯৯ সিজনে ফার্গি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা সাফল্যটা পান। এই সিজনে প্রিমিয়ার লিগ, এফ.এ. কাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পায় ট্রেবল। ট্রেবল জেতার পর ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয়ের কাছ থেকে নাইটহুড উপাধি পান অ্যালেক্স ফার্গুসন। এর ফলে তার নামের আগে যুক্ত হয় সম্মানসূচক ‘স্যার’ উপাধি। এরপর থেকেই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন নামেই ডাকা হয় তাকে।
স্যার অ্যালেক্সের অধীনে ১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত টানা লিগ জিতে হ্যাটট্রিক লিগ শিরোপা জেতার রেকর্ড গড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। কিন্তু ২০০২ এর পর অনেক সিনিয়র খেলোয়াড়ের অবসর এবং দল ছাড়ার কারণে দলকে আবার ঢেলে সাজাতে হয় তার।
এই জায়গাটিতেই ফার্গি তার বিশেষত্বের আরেকটা নমুনা দেখান। গ্রেটদের একটি গুণ হচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে নিজেকে ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া। নতুন প্রজন্মের সাথেও ফার্গি দারুণভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। ২০০২ থেকে ২০০৬ এর মধ্যে দলে নিয়ে আসেন তরুণ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, রুড ভ্যান নিস্টলরয়, রিও ফার্ডিনান্ড, ওয়েইন রুনি, ভিডিচ, এডউইন ভ্যান ডার সার, মাইকেল ক্যারিক, পার্ক জি সুং, প্যাট্রিস এভরাদের। এদের নিয়ে দারুণভাবেই সফল হয়েছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। ২০০৬-০৭ সিজনে এই বাহিনী নিয়ে জিতেন নবম লিগ টাইটেল ।
৫
২০০৭-০৮ সিজনে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন এবং অল্পের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ট্রেবল জেতা মিস করেন। ২০০৮-০৯ প্রিমিয়ার লিগ টাইটেল জেতার মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রিমিয়ার লিগ জেতার হ্যাটট্রিক করেন। ইউনাইটেডের হয়ে এটি ছিলো তার ১১তম লিগ টাইটেল। এই লিগ টাইটেল জেতার মাধ্যমে লিভারপুলের ১৮টি লিগকে স্পর্শ করে ফেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
২০০৮-০৯ সিজন শেষে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বলেছিলেন, অবসর নেওয়ার আগে অন্তত আরেকবার প্রিমিয়ার লিগ জিততে চান তিনি। কারণ, আরেকটি প্রিমিয়ার লিগ জিতলেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলকে টপকে ১৯টি লিগের মালিক হবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফার্গির সে আশা ঠিক তখনই পূরণ না হলেও, পূরণ হয়েছিলো এক সিজন বাদে। ২০০৯-১০ সিজন চলাকালীন ডিসেম্বরে স্যার ম্যাট বাসবিকে পেছনে ফেলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে সবচেয়ে দীর্ঘদিন সার্ভিস দেওয়া ম্যানেজার বনে যান স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। সেবার লিগ জিতে তার স্বপ্ন পূরণ করে ফার্গি। লিভারপুলকে টপকে প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে সফল দল বনে যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ২০১২-১৩ সিজনে ফার্গুসন তার ২০ তম লিগ টাইটেল জিতে অবসর নেন।
৬
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে সবাই ডাকতো ‘দ্য বস’ বলে। ব্যবহারের দিক থেকে খেলোয়াড়দের কাছে হাইস্কুলের হেডমাস্টারদের মতোই ছিলেন তিনি। কখনো ছেলেদের শাসন করছেন, আবার পরক্ষণেই হয়তো বুকে টেনে নিচ্ছেন।
২৬ বছরের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্যারিয়ারে দলকে এনে দিয়েছেন ৩৮টি ট্রফি যা আর যেকোনো ম্যানেজারের চেয়ে বেশি। পুরো কোচিং ক্যারিয়ারে জিতেছেন ৪৯টি ট্রফি। দীর্ঘ ম্যানইউ ক্যারিয়ারে মাত্র তিনটি ম্যাচ মিস করেছিলেন, ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন চৌদ্দশোরও বেশি বার। সবসময় চুইংগাম চিবোতে চিবোতে সেটাকে ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিলেন। তার ইনজুরির সময়ে অনেকবার তার দল জিতে যাওয়ায়, এক পর্যায়ে সেই সময়টাকে বলা হয়েছিল ‘ফার্গি টাইম’।
স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একমাত্র ম্যানেজার, যার ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে তার জীবদ্দশাতেই। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ‘Sir Alex Fergusn Stand’ নামে একটি স্ট্যান্ডও রয়েছে।
তার আরেকটা গুণ ছিল দূরদর্শিতা। ক্যারিয়ারে কখনোই বড় বড় খেলোয়াড় কেনার পেছনে টাকা ব্যয় করার পক্ষপাতি ছিলেন না, জোর দিতেন টিম ক্যামিস্ট্রিতে। তার তৈরি করা খেলোয়াড়রাই পরবর্তীতে অন্যান্য বড় দলে আলো জ্বালিয়েছেন।
৭
পরিশিষ্ট
খেলোয়াড় হোক অথবা কোচ, আপনি তখনই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবেন, যখন আপনার অনুপস্থিতিতে দল আপনাকে মিস করবে। কোচ হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জন্য ফার্গুসন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন? ১৯৯২-৯৩ সালের পর থেকে ম্যানইউ ১৩ বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, ৫ বার লিগ রানার্স-আপ আর তিনবার ৩য় হয়। তিনি ইংলিশ ফুটবল লিগের মধ্যে একমাত্র ম্যানেজার, যার পরপর ২০ মৌসুমে শীর্ষ তিনে অবস্থান করে লিগ শেষ করার সুযোগ হয়েছে। একজন কোচ হিসেবে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতেছেন ১৩ বার, যা পরবর্তী সবচেয়ে সফল ম্যানেজারের দ্বিগুণেরও বেশি। তিনি ইংলিশ লীগের প্রথম কোচ হিসেবে পর পর তিনটি লিগ শিরোপা জিতেন এবং এই কাজ তিনি দু’বার করতে সক্ষম হন।
অথচ লিগ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করার পর একই দল নিয়ে পরের সিজনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড হয় ৭ম, তার পরের দুই সিজনে যথাক্রমে ৪র্থ আর ৫ম। অনেক নামীদামী খেলোয়াড় কিনে কিংবা বড় বড় কোচ পাল্টিয়েও সফলতা পাচ্ছিল না ইউনাইটেড। এই তথ্য থেকে আপনি স্যার আলেক্স ফার্গুসনের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন।
এই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে কি কোনো অতৃপ্তি নেই? অতৃপ্তি আছে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না, কারণ, সেটা একান্তই ফার্গির ব্যক্তিগত উপলব্ধি; তবে কিছুটা অপূর্ণতা অবশ্যই আছে। সেটা হচ্ছে, কখনোই কোনো জাতীয় দলকে নিয়ে ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বিশ্বকাপে যাওয়া হয়নি তার। কেন যেন জাতীয় দলের কোচ হওয়ার প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তবুও এই অপূর্ণতা তার গ্রেটনেসের পথে বাধা হয়ে থাকেনি। কে জানে, এই বয়সেও হয়তো কখনো তার মনে হতে পারে যে একটা দলকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করানো দরকার। বিভিন্ন পেশাতেই অবসর ভেঙে ফিরে এসে ভালো করার রেকর্ড তো অনেকেরই আছে। হয়তো ফার্গির মনেও কখনো ইচ্ছে হবে, একটি জাতীয় দলকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানানোর!
ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া ফুটবলপ্রেমীদের আর কোনো গতি আপাতত নেই।