একটা সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের দৃপ্ত পদচারণা থাকলেও, বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান খুবই কম। গত এক শতাধিক বছরে মাত্র ৩ জন মুসলিম বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন- দুজন রসায়নে, একজন পদার্থ বিজ্ঞানে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মুসলিম ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে রোর বাংলায় একটি প্রবন্ধ আছে। এর বাইরে আর মাত্র পাঁচ মুসলিম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যাদের তিনজন বিজ্ঞানে এবং বাকি দুজন সাহিত্যে। তাদেরকে নিয়েই এই লেখা।
মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, পদার্থবিজ্ঞান (১৯৭৯)
প্রফেসর আব্দুস সালাম ছিলেন পাকিস্তানের একজন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ। তার জন্ম ১৯২৬ সালে, পাকিস্তানের পাঞ্জাবে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি অসাধারণ মেধাবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৪ বছর বয়সেই তিনি রেকর্ড নাম্বার পেয়ে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৪ সালে লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজ ইউনিভার্সিটিতে গণিতে স্নাতক অধ্যয়নকালেই তিনি রামানুজনের গাণিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করেন। তিনি গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানে ডাবল অনার্স সহ বিএ পাশ করেন, পরবর্তীতে গণিতে মাস্টার্স করেন এবং ক্যামব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
আব্দুস সালাম দীর্ঘদিন পাকিস্তান এবং ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬০-৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তান সরকারের বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টা। সে সময় তিনি শুধু তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানই না, বরং পুরো পাকিস্তানের বিজ্ঞান গবেষণার অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন (PAEC) এর তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান শাখা, মহাকাশ এবং উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণা সংস্থা (SUPARCO) সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তি গবেষণায় তার ব্যাপক অবদান ছিল, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়।
প্রফেসর আব্দুস সালাম তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কিছু মৌলিক গবেষণা করেন। তার গবেষণার মধ্যে ছিল ইলেক্ট্রোউইক ইউনিফিকেশন থিওরি, যার মাধ্যমে তিনি চারটি মৌলিক বলের মধ্যে দুটিকে একীভূত করেন। এই গবেষণার জন্য তাকে এবং আরো দুজন গবেষককে ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। আব্দুস সালাম ছিলেন প্রথম মুসলমান, যিনি বিজ্ঞানের কোনো শাখায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি একইসাথে এখন পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাওয়া একমাত্র মুসলিম বিজ্ঞানী, যদিও তিনি যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুসারী, সেই আহমদিয়াদেরকে পাকিস্তান সহ বিশ্বের অনেক দেশই মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
নাজিব মাহফুজ, সাহিত্য (১৯৮৮)
নাজিব মাহফুজ একজন মিসরীয় ঔপন্যাসিক। তার জন্ম ১৯১২ সালে, মিসরের কায়রোতে। ছোটকাল থেকেই তিনি আরবি ক্লাসিক্যাল সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদ পড়তেন। তিনি রাশিয়ান সাহিত্যকর্মের খুব ভক্ত ছিলেন। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৩৪ সালে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন সরকারী চাকরিজীবী।
নাজিব মাহফুজ মিসরের আল-আহরাম পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তার অধিকাংশ উপন্যাসই বই হিসেবে বের হওয়ার আগে পত্রিকাটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো। তিনি ৩৪টি উপন্যাস এবং ৩৫০টি ছোটগল্প রচনা করেন। চলচ্চিত্র জগতেও তার দৃপ্ত বিচরণ ছিল। তিনি প্রচুর চলচ্চিত্রের এবং কিছু নাটকের চিত্রনাট্য রচনা করেন। তার উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনেও অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
নাজিব মাহফুজের একেবারে প্রথমদিকের কিছু উপন্যাস ইতিহাস নির্ভর হলেও পরবর্তী জীবনে তিনি বিস্তৃত বিষয়ের উপর লেখালেখি করেছেন। তার লেখার বিষয়বস্তু এবং মতামতের কারণে বিভিন্ন সময় মিসর এবং অন্যান্য আরব দেশে তার বই নিষিদ্ধও হয়েছিল। তিনি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে পরিচিত আরবি সাহিত্যিক। ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এটি ছিল আরবি সাহিত্যের জন্য প্রথম এবং একমাত্র নোবেল পুরস্কার।
আহমেদ জেওয়েইল, রসায়ন (১৯৯৯)
আহমেদ জেওয়েইল একজন মিসরীয় আমেরিকান রসায়নবিদ, যিনি রসায়নের একটি বিশেষ শাখা ফেমটোকেমিস্ট্রির জনক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জেওইয়েলের জন্ম ১৯৪৬ সালে, মিসরের শার্কিয়াতে। আলেক্সান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া থেকে ১৯৭৪ সালে পিএইডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি ফ্যাকাল্টি অফ ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ঐ ইউভার্সিটির রসায়ন বিভাগের প্রথম লিনাস পলিং প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান।
আহমেদ জেওইয়েলের গবেষণাকর্ম ফেমটোকেমিস্ট্রি নামে রসায়নের এক নতুন শাখার সূচনা করে। যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হওয়ার পর অতি ক্ষুদ্র সময়ে তাদের পর্যবেক্ষণের যে পদ্ধতি, তাকেই ফেমটোকেমিস্ট্রি বলে। এই ক্ষুদ্র সময়ের একক ফেমটো সেকেন্ড থেকেই এর নামকরণ করা হয়েছে। ১ ফেমটো সেকেন্ড হচ্ছে ১ সেকেন্ডের ১ কোয়াড্রিলিয়ন (১০০০ ট্রিলিয়ন) ভাগের ১ ভাগ। জেওইয়েল বিশেষ ধরনের লেজারের মাধ্যমে বিক্রিয়া শুরু হওয়ার মাত্র ১০ সেকেন্ড পরে অণু-পরমাণুর গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন, যা ফেমটোসেকেন্ড স্পেক্ট্রোস্কোপি নামে পরিচিত।
আহমেদ জেওয়েইল মিসরের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ, আলবার্ট আইনস্টাইন ওয়ার্ল্ড অ্যাওয়ার্ড সহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন। ফেমটোকেমিস্ট্রিতে গবেষণার জন্য জেওয়েইল ১৯৯৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এটি ছিল কোনো আরব এবং কোনো মিসরীর বিজ্ঞানের কোনো শাখায় প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ। ২০১৬ সালে, ৭০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ওরহান পামুক, সাহিত্য (২০০৬)
ওরহান পামুকের পুরো নাম ফেরিত ওরহান পামুক। তার জন্ম ১৯৫২ সালে, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। ইস্তাম্বুলের রবার্ট কলেজে অধ্যয়ন করার পর পামুক ইস্তাম্বুল টেকনিকাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন স্থাপত্যবিদ্যা পড়াশোনার জন্য। কিন্তু তিন বছর পর, ১৯৭৪ সালে স্থাপত্যবিদ্যা ছেড়ে তিনি পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে মনোনিবেশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতা স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।
ওরহান পামুকের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। তবে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান ত১৯৮৫ সালে প্রকাশিত তার তৃতীয় উপন্যাস দ্য হোয়াইট ক্যাসেলের মাধ্যমে। তার উপন্যাসগুলোর অনেকগুলো আত্মজীবনী ঘরানার, এবং সেগুলোতে তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সংস্কৃতির সাথে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্ব প্রভাবিত সংস্কৃতির মধ্যকার জটিল সম্পর্ক উঠে আসে।
ওরহান পামুকের উপন্যাসগুলো তুরস্কের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই। তার লেখা উপন্যাসগুলো এ পর্যন্ত ৬৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ১ কোটি ত্রিশ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। সাহিত্যে তার অবদানের জন্য ২০০৬ সালে তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি তুরস্কের প্রথম নোবেল বিজয়ী।
আজিজ সানজার, রসায়ন (২০১৫)
আজিজ সানজার একজন তুর্কি-আমেরিকান জীব-রসায়নবিদ এবং আণবিক জীববিজ্ঞানী। সানচারের জন্ম ১৯৪৬ সালে তুরস্কের মারদিন প্রদেশের স্যাভুর শহরের এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার বাবা-মা ছিলেন আরবি ভাষাভাষী, যদিও তিনি এবং তার পরিবার তুর্কি ভাষাতেই কথা বলেন। ছাত্রজীবন থেকেই সানজার ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার ইচ্ছে ছিল রসায়ান নিয়ে পড়াশোনা করার, কিন্তু তার সহপাঠীদের অধিকাংশই ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তিনিও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মেডিসিনে ভর্তি হন।
সানজার ১৯৬৯ সালে ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টর অফ মেডিসিন সম্পন্ন করেন। কয়েক বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭৩ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস থেকে মলিকিউলার বায়োলজিতে পিএইচডি অর্জন করেন। পিএইচডি অর্জনের পর তিনি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এ সময়ই তিনি Nucleotide Excision Repair এর উপর গবেষণা শুরু করেন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আমাদের দেহকোষের বিভিন্ন প্রোটিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোষের ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএগুলোকে মেরামত করে ফেলে।
সানজারের ডিএনএ মেরামত সংক্রান্ত আবিষ্কারটি ছিল জীবরসায়নবিদ্যার একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এ বিষয়ে গবেষণার জন্য ২০১৫ সালে তাকে এবং একজন সুইডিশ ও একজন মার্কিন বিজ্ঞানীকে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সাহিত্যিক ওরহান পামুকের পর তিনি নোবেল বিজয়ী দ্বিতীয় তুর্কি নাগরিক। ২০১৬ সালের ১৯ মে, তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা কামাল আতাতুর্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর ৯৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে সানজার তার নোবেল পুরস্কারের মেডেলটি এবং সার্টিফিকেটটি কামাল আতাতুর্কের সমাধি সংলগ্ন জাদুঘরে দান করে দেন।