বিজ্ঞান কবে থেকে শুরু হয়েছে তা জানা সম্ভবত এই যুগের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাই ঠিক কোন ব্যক্তি বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন প্রথম সেটাও এক অজানা রহস্যই বটে। ইতিহাস ঘেঁটেও এর সঠিক হদিস বের করা কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞান ছিলো, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
বিজ্ঞানের সঠিক সূত্রপাত আমরা না জানলেও যিনি পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁকে কি আমরা চিনি? পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে যিনি স্বীকৃত হয়ে আছেন, তিনি বিজ্ঞানী থেলিস। বিজ্ঞানী থেলিস ছিলেন গ্রীসের সপ্তর্ষি অর্থাৎ সাতজন বিখ্যাত জ্ঞানী মানুষের মধ্যে একজন।
বিজ্ঞানী হিসেবে যদিও তাঁর গবেষণার খুব কম অংশই এখন পাওয়া যায়, কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করে এবং প্রাচীন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বক্তব্য অনুসারে তিনি বিজ্ঞান ও দর্শনে রেখেছেন নিজের প্রভাব।
চলুন জানা যাক তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে।
জন্ম ও পরিচিতি
ইতিহাসবিদগণের মতামত অনুসারে থেলিস জন্ম নিয়েছিলেন সক্রেটিস-পূর্ব সময়ে। জন্মস্থান মিলেটাস নামক অঞ্চলে যা ছিলো এশিয়া মাইনর অঞ্চলের একটি অংশ, বর্তমানে তুরস্কের বালাতা অঞ্চলে। জন্মসাল হিসেবে পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৬২০ থেকে ৬২৫ সালের মধ্যে (অনেকের মতে সেটা খ্রিস্টপূর্ব ৬২৪ সাল)। আবার কতিপয় ইতিহাসবিদের মতে তাঁর পিতামাতা ছিলেন প্রাচীন ফিনিশিয়া কলোনির অধিবাসী। পরে তাঁরা মিলেটাস অঞ্চলে চলে আসেন। কাজেই তাঁর জন্মসাল ও জন্মস্থান- উভয় নিয়েই মতান্তর আছে যথেষ্ট। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্টের মতে তিনি ছিলেন খাঁটি মিলেশিয়ান নাগরিক। সেজন্য তাঁর নামের শেষে যোগ করা হয়েছে মিলেটাস শব্দটি, অর্থাৎ ‘থেলিস অফ মিলেটাস’।
বিজ্ঞানে তাঁর অবদান
আগেই বলা হয়েছে, সেকালে গ্রীসের সাতজন বিশিষ্ট জ্ঞানী মানুষের মধ্যে থেলিস ছিলেন অন্যতম। তিনি নিজের প্রতিভার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছেন তৎকালীন দর্শন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। তাঁকে যেমন বিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেই সাথে গ্রীসের প্রথম দার্শনিক ও গণিতবিদ হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়। তিনিই প্রথম সরলরৈখিক জ্যামিতির ভিত্তি স্থাপন করে গণিতে অ্যাবস্ট্র্যাক্ট জিওমেট্রির সূত্রপাত ঘটান।
থেলিসের গবেষণার লিখিত কোনো অনুলিপি-প্রতিলিপি নেই। কাজেই ইতিহাসবিদদের কাছে এটি মতামতের বেশ পার্থক্য তৈরি করে যে, আসলেই তিনি কী করেছিলেন? সেইসাথে তাঁর গবেষণা কাজের যথেষ্ট মূল্যায়ন করাও কিছুটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস এর মতে থেলিস ছিলেন এজিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত আয়োনিয়ান শহরসমূহের একজন কূটনীতিবিদ। আবার কবি ও পণ্ডিত ক্যালিম্যাকাস স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য গ্রন্থবদ্ধ করার সময় উল্লেখ করেন যে, থেলিস কোনো একসময় জাহাজের নাবিকদের ঋক্ষমণ্ডলের পরিবর্তে শিশুমার নক্ষত্র (লঘু সপ্তর্ষিমণ্ডল) অনুসরণ করে জাহাজ পরিচালনা করার পরামর্শ দেন।
ধারণা করা হয়, থেলিস শিক্ষার্জনের জন্য মিশরে যান। সেখানে তিনি মিশরীয় পুরোহিতদের কাছে গণিতের জ্ঞান লাভ করেন এবং সেই জ্ঞান নিয়ে পরে ফিরে আসেন গ্রীসে। জ্যামিতির ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞান ছিলো উল্লেখযোগ্য। মিশরে অর্জিত জ্যামিতির জ্ঞান ব্যবহার করে, ত্রিভূজের অনুপাত সূত্রের সাহায্যে (অর্থাৎ ত্রিকোণমিতির সাহায্যে) তিনি মিশরের পিরামিডের উচ্চতা মেপে দেখান। সেই সাথে সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে দূরে অবস্থিত কোনো জাহাজেত দূরত্বও হিসেব করেন। এটা গ্রীকদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো।
অর্থাৎ উচ্চতা ও দূরত্ব পরিমাপের পদ্ধতি সম্পর্কে থেলিস জানতেন। এর ফলে তাঁকে বলা হয়ে থাকে প্রথম সত্যিকারের গণিতবিদ। উচ্চতা পরিমাপের ক্ষেত্রে তিনি ত্রিভুজের আনুপাতিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন যা এখন ‘থেলিস উপপাদ্য’ হিসেবে পরিচিত। যদিও এসব তথ্যের সঠিক কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। কাজেই অনেকটা অপ্রমাণিতই থেকে যায় থেলিসের অবদান।
যখন তিনি মিশরে ছিলেন তখন মিশরীয়দের ভূমি জরিপের কাজ শিখেছিলেন তিনি। ফেরাউনদের জায়গা পরিমাপ করতে তাঁদের অনুগতরা লাঠি ও দড়ির সাহায্য নিতেন। নীল নদের প্লাবনের পর নিজেদের জায়গার সীমানা নিরূপণের দরকার হয়ে পড়তো প্রায় প্রতি বছর। কাজেই সঠিক পরিমাপের অন্যথা করার সুযোগ ছিলো না। ধারণা করা হয়, তিনি গ্রীসে ফিরে এসে এই পদ্ধতি বর্ণনা করলে গ্রীক গণিতবিদেরা বিন্দু, সরলরেখা ও বৃত্তচাপের সাহায্যে একে গাণিতিকভাবে প্রতিপাদন করেন, যাকে ‘রোপ অ্যান্ড স্টেক’ পদ্ধতি নাম দেয়া হয়। মূলত ভূমির পরিমাপ সংক্রান্ত এই জ্ঞান থেকে জ্যামিতি বা জিওমেট্রি নামের ব্যবহার শুরু করেন গ্রীকরা। ‘Geo’ অর্থ পৃথিবী বা ভূমি সংক্রান্ত এবং ‘Metry’ অর্থ পরিমাপ।
জ্যামিতির পাঁচটি বিশেষ উপপাদ্য আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় থেলিসকে। উপপাদ্যগুলো ছিলো এমন,
১) বৃত্তকে এর ব্যাস বরাবর সমান দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়।
২) সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের সমান বাহুদ্বয়ের বিপরীত কোণদ্বয় সমান।
৩) একটি সরলরেখাকে আরেকটি সরল রেখা ছেদ করলে বিপ্রতীপ কোণ সমান হয়।
৪) অর্ধবৃত্তের ভেতরে অঙ্কিত কোণ সমকোণ হয় এবং
৫) ত্রিভুজের একটি বাহু এবং এই বাহুতে অবস্থিত দুটি কোণ দেয়া হলেই ত্রিভুজটি পাওয়া সম্ভব।
এখানেও তাঁর কৃতিত্ব নিয়ে মতভেদ আছে। কারণ সেকালে মানুষের পাণ্ডিত্যের আড়ালে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যেতো। যেমন কোনো আবিষ্কারের জনক না পাওয়া গেলে জ্ঞানীদের মধ্যে থেকে খুঁজে নেয়া হতো যে কে এটা করতে পারে।
কবি ও দার্শনিক জেনোফেনের দাবি অনুসারে আরো জানা যায়, থেলিস সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সেসময়ে। এই ভবিষ্যদ্বাণীর কারণেই থেমে যায় লিডিয়ার রাজা এলিয়েটস এবং মিডিয়ার রাজা সায়াক্সারসের মধ্যকার যুদ্ধ। এই সূর্যগ্রহণ ঘটেছিলো ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মে মাসের ২৮ তারিখে। তবে আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেসময়ে সূর্যগ্রহণ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান কারো থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। হতে পারে থেলিসের করা ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো নিতান্তই কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়ায় এবং এর ফলে এক বিশাল যুদ্ধের অবসান ঘটায় সবাই তাঁকে একজন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে মেনে নেন।
দর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান
তৎকালীন গ্রীসের জনগণ তাঁকে দর্শনের জনক হিসেবে দাবি করতেন। বার্ট্রান্ড রাসেল এক উক্তিতে বলেছেন যে পশ্চিমা দর্শনের শুরুই হয়েছে থেলিস থেকে। আবার বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর ‘মেটাফিজিক্স’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, থেলিসই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বলেন পৃথিবী পানির উপর ভেসে থাকে এবং পৃথিবী ও এর প্রতিটি উপাদানের ভিত্তি কেবলই পানি, অর্থাৎ ‘একক বস্তু অনুসিদ্ধান্ত’ ধারণা আসে থেলিসের থেকে। আর পানির উপর ভেসে থাকার কারণেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। যদিও দু’টি ধারণাই এখন ভুল প্রমাণিত।
এরিস্টটল আরো বলেন, থেলিস মনে করতেন বিশ্বের সবকিছুতেই দেবতাদের অস্ত্বিত্ব আছে এবং চুম্বকের চুম্বকত্বের পেছনে আছে আত্মাদের কারসাজি। আত্মাদের উপস্থিতির কারণেই চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে। এর সাহায্যে তিনি আত্মার অস্ত্বিত্ব প্রমাণ করেন। চুম্বকের গতিবিধির সাহায্যে তিনি বোঝান, আত্মাদের চলাচলের সক্ষমতা আছে।
দর্শনে তাঁর অবদান কিছুটা পৌরাণিক গল্প আর বাস্তবতার মধ্যে যোগসাধনের মতো হলেও তিনি প্রথম ব্যাখ্যাভিত্তিক ধারণার সূচনা ঘটান। তাঁর পূর্বের দার্শনিকেরা এদিক থেকে ছিলো অনেক পিছিয়ে। কিন্তু থেলিস গতানুগতিক পদ্ধতিতে না এগিয়ে হাইপোথিসিস বা প্রকল্প অনুসারে প্রতিটি বিষয় ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করতেন এবং বেশ কয়েকটি প্রকল্পের পরই তিনি পেয়ে যেতেন মূলনীতি। অনেকটা আধুনিক বিজ্ঞানীদের অনুসরণ করা ধাপসমূহের মতোই।
থেলিস মিলেটাস শহরে আয়োনিয়ান স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে দর্শনের শিক্ষা দেয়া হতো। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অ্যানাক্সিম্যান্ডার এবং অ্যানাক্সিমেনস। জ্যামিতির বিপ্লবপুরুষ পীথাগোরাস ছিলেন অ্যানাক্সিম্যান্ডারের শিষ্য। থেলিসের উপদেশেই তিনি মিশরে যান জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে। থেলিসের সময়ে মিলেটাস ছিলো এশিয়া মাইনরের বিশেষ একটি জায়গা, যেখানে পণ্ডিত ও দার্শনিকদের বসবাস ছিলো। সেসময়ে মিলেটাসেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো বেশ কয়েকটি স্কুলের যেখানে বিজ্ঞান, দর্শন, স্থাপত্য, ভূগোল ও গণিতের শিক্ষা দেয়া হতো। মিলেটাসকে বলা হত জ্ঞানীদের ভূস্বর্গ।
এটি খুবই সম্ভব যে থেলিসকে সেসব কাজের জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয় যা তাঁর না-ও হতে পারে। তাঁকে কৃতিত্ব দেয়া হয় তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্যামিতির জ্ঞানের কারণে। জাহাজ চালনার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদানের কথা জানা যায়। অনেকে বিশ্বাস করেন, জাহাজ চালনার ক্ষেত্রে নক্ষত্রের অবস্থান ব্যবহার করা সম্পর্কে তিনি একটি বইও লেখেন। কিন্তু এতকিছুর পরও থেকে যায় অনেক ‘কিন্তু’। না পাওয়া যায় তাঁর কোনো কাজের লিখিতরূপ, না পাওয়া যায় কোনো বই। শুধু পরবর্তী দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের লেখা বইয়েই পাওয়া যায় তাঁর এবং তাঁর কাজের সম্পর্কে কিছু তথ্য।
দিওজেনেস ল্যার্শাস নামক একজন লেখকের ‘দার্শনিকদের জীবন’ নামক গ্রন্থে থেলিসের দু’টি চিঠি আর কয়েকটি শ্লোক (ছোট পদ্য) পাওয়া যায়। কেবল এরিস্টটলের বইগুলোতেই থেলিসের সম্পর্কে জানা যায় সর্বাধিক। আর এসব কারণেই তাঁকে পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানীর মর্যাদা দেয়া হয়। কারণ তাঁর আগে আর কারো কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না যারা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা কিংবা দর্শন নিয়ে ভেবেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
তাঁর মৃত্যুর সঠিক সময় জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৭ থেকে ৫৪৬ সালের মধ্যে থেলিস মৃত্যুবরণ করেন। রোমের ক্যাপিটোলিন জাদুঘরে তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি রাখা আছে। কিন্তু থেলিস যে এমনই ছিলেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না।