অনুপ্রেরণায় ‘হাল না ছেড়ে দেওয়া’ অপরাহ উইনফ্রে এবং নিক ভুজিসিক

এতো ভালো করে প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষার ফলাফল খারাপ আসা, শুরু করা ব্যবসাটির প্রথমেই লোকসান হওয়া, প্রচুর খাটাখাটির পরেও প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়া, বারবার চেষ্টা করেও সফল না হতে পারা মানুষগুলো একসময় হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। কখনো নিজের দারিদ্র্য, সীমাবদ্ধতা, শারীরিক ত্রুটি, যোগ্যতা কিংবা সামর্থ্যের কাছে হেরে গিয়ে মাথা পেতে নেয় বাস্তবতা হিসেবে। নিজেকে বারবার জানায়, “তুমি যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ছুটছ তার যোগ্য তুমি নও”। এক সময় পুরোপুরি কুঁকড়ে যায়। কেউ বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে হাল ছেড়ে দেয়। কেউ আবার বেছে নেয় আত্মহননের পথ।

এদের মধ্য থেকেই আবার কেউ কেউ নতুন উদ্যমে জেগে উঠে। “কখনো হাল ছেড়ো না। চেষ্টা করে যাও। সফলতা আসবেই।” এর মতো জাগরণী বাক্যগুলোতে বিশ্বাস এনে আবার চেষ্টায় লেগে যায় এবং একটা সময় ঠিকই তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়, জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়, হয়ে উঠে বিখ্যাতদের একজন। এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা বারবার হেরে গিয়েও আবার চেষ্টা করেছে। হাল না ছেড়ে দিয়ে নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করে গিয়েছে এবং সফলতার শীর্ষে নিজের অবস্থানটাকে নিশ্চিত করেছে।

আজ এমনই দুজন ‘হাল না ছেড়ে দেওয়া’ বিখ্যাতদের অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প বলব আপনাদের।

গণমাধ্যম সম্রাজ্ঞী অপরাহ উইনফ্রে

যখন বয়স মাত্র নয়, তখন প্রথম ধর্ষণের শিকার হয় কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটি। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় এবং জন্মের দুই সপ্তাহের মধ্যেই তাকে হারায়। কিশোরী অবিবাহিত মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া মেয়েটি বেড়ে উঠে মিসিসিপির উত্তরের শহর মিলওয়াকিতে দারিদ্র্য এবং অবহেলার মধ্যে, বেড়ে উঠে অপবাদ, নিন্দা, দেহের রঙ, চেহারাসহ ইত্যাদির ব্যাপারে খারাপ সমালোচনা শুনে। হাই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণকালীন এবং বাবার সাথে থাকার সময়ে টেনেসির একটি স্থানীয় রেডিওতে সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায় সে। মাত্র  উনিশ বছর বয়সে সান্ধ্যকালীন সংবাদ পাঠিকা হিসেবে এবং পরবর্তীতে নিজের যোগ্যতা দিয়ে সেখানেই একটি শো পরিচালনার সুযোগ পায় মেয়েটি।

অপরাহ উইনফ্রে, ১৯৭৮ সালে তোলা ছবি।

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নিজের যোগ্যতা এবং একাগ্রতা দিয়ে, পিছনে ঘটে যাওয়া দুঃসময়ের কথা ভুলে কলেজ থেকে শিক্ষা বৃত্তি পেয়ে অনার্স শেষ করে। দারিদ্র্য, অবহেলা, নিজের চেহারা এবং গায়ের রঙ নিয়ে তীব্র নিন্দার শিকার হওয়া মেয়েটি হয়ে উঠে একাধারে অভিনেত্রী, লেখক, পরিচালক এবং একজন গণমাধ্যম সম্রাজ্ঞী। বর্তমানে যার নিজের নামেই রয়েছে বিখ্যাত টক শো ‘দ্য অপরাহ উইনফ্রে শো’।

কুইন অফ অল মিডিয়া’ খ্যাত অপরাহ উইনফ্রেকে বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার অর্জনের থলিতে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পক্ষ থেকে পাওয়া ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ এবং  ডিউক ও হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রীসহ অসংখ্য নামীদামী সম্মাননা।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে ‘প্রেসিডেন্টশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ পরিয়ে দিচ্ছেন।

তিনি বলেছেন,We can’t become what we need to be by remembering what we are। তার মতে, আমরা যদি আমাদের অতীত মনে রেখে বসে থাকি, আমাদের কী আছে, না আছে সেই ভাবনায় তলিয়ে থেকে যা করা উচিত তা থেকে দূরে থাকি, তাহলে কখনোই আমরা আমাদের যা হওয়া উচিত তা হতে পারবো না।

জীবন সংগ্রামে হাল ছেড়ে না দেওয়া এই নারী জখমকে জ্ঞানে পরিণত করার কথা  বলেছেন। তিনি বলেছেন নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে, বারবার চেষ্টা করে যেতে, সব ধরনের মতবিরোধ, অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে সেখান থেকে শিখতে। যদি বারবার চেষ্টা করেও যা চাচ্ছেন তা অর্জন করতে না পারেন, তাহলে চেষ্টা করার ঐ রাস্তাটা পরিবর্তনের কথাও তিনি বলেছেন।

তিনি নিজের যা আছে সে জিনিসটার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন, Be thankful what you have; you will end up having more. If you concentrate what you have, you will never, ever have enough। সফল হওয়ার ব্যাপারেও তার বক্তব্য স্পষ্ট। তার মতে, “আপনি যদি অর্থপূর্ণ কাজগুলো করে যান, সফলতা প্রাকৃতিকভাবেই আপনার কাছে ধরা দিবে।

শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ নিক ভুজিসিকের সম্পূর্ণ পৃথিবী

মেলবোর্নের একটি হসপিটালে শারীরিক ত্রুটিপূর্ণ নিকোলাসের জন্ম স্বাভাবিক নিয়মে হলেও শারীরিকভাবে সামর্থ্য, শক্তিশালীদের এই পৃথিবীতে তার আগমনটা ছিল অপ্রত্যাশিত। জন্মের পরপরেই নিজের মা-ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। নার্সকে বলেছিলেন, হাত-পা হীন বাচ্চাটিকে যেন তার সামনে না আনা হয়। যদিও পরবর্তীতে তার চার্চ ভক্ত বাবা-মা তাকে স্রষ্টার লীলাখেলা মনে করে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু স্বাভাবিক পৃথিবী তো আর এই অস্বাভাবিক ঘটনাকে মেনে নিতে পারে না। আর ভুক্তভোগী নিকোলাসই বা কেন এসব মেনে নিবে? যেখানে তার সমবয়সী ছেলেরা পায়ে ভর দিয়ে দৌঁড়চ্ছে, ফুটবল খেলছে, কাঠের ব্যাট ধরে ক্রিকেট খেলছে, উৎসবের দিনে নাচছে, ছুটছে, ছুটির দিনে সমুদ্রতীরে পিকনিকে গিয়ে সাঁতার কাটছে, সেখানে কেনই বা সে সুবোধ বালক হয়ে বাড়ি বসে থাকবে? কেনই বা নিজের অসম্পূর্ণ দেহটাকে নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে? তাই মাত্র দশ বছর বয়সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ছেলেটি। ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু চেষ্টাটা ব্যর্থ হওয়ার কারণেই আজ পুরো পৃথিবীর এমন অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যেতে পারছেন ৩১ বছর বয়সী সফল এই মানুষটি। নিজের অক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জয় করে নিয়েছেন কোটি কোটি মানুষের মন। হয়ে উঠেছে সকলের প্রিয় নিক ভুজিসিক।

স্কুলে অধ্যয়নরত ছোট নিকোলাস

বুঝ হওয়ার পরপরই নিজের অক্ষমতাকে সক্ষমতায় পরিণত করার চেষ্টাটা চালিয়ে যান তিনি। বাবা-মায়ের সহযোগিতায় যা আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পরেন নিজেকে তৈরির লড়াইয়ে। যখন সতেরো বছর বয়স, তখন একদিন মা ভুরিসলাভ ভুজিসিক নিকের মতোই একজন শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষের ব্যাপারে লেখা একটি আর্টিকেল এনে দেন। সেসময় থেকে চার্চের প্রেয়ার গ্রুপের সদস্যদের সামনে অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প বলা শুরু করেন তিনি। বিকলাঙ্গ হয়েও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার পন্থাগুলো খুঁজে মানুষকে বলার একটা ঝোঁক সেখান থেকেই শুরু।

ভরাট অডিটোরিয়ামে বক্তব্যরত নিক ভুজিসিক

মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ার লুগানের গ্রিফথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন নিক। সেখান থেকে অ্যাকাউন্টিং এবং ফাইনান্সিয়াল প্লানিংয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। মাত্র উনিশ বছর বয়স থেকে নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য দিতে থাকেন নিক। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন থেকে লস এঞ্জেলসে চলে যান তিনি। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন বিকলাঙ্গদের নিয়ে কাজ করে যাওয়া অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘Life Without Limbs’ এবং মোটিভেশনাল স্পিকিং কোম্পানি ‘Attitude Is Altitude’।

স্কাইড্রাইভিংরত নিক

অত্যন্ত বিরল Phocomelia ব্যাধিতে আক্রান্ত নিক বর্তমানে দুই সন্তানের বাবা, সাতান্নটি দেশ ভ্রমণ করে চারশো মিলিয়ন মানুষকে স্বশরীরে থেকে অনুপ্রেরণা দানকারী একমাত্র গর্বিত বক্তা। তার ‘লাইফ উইদাউট লিমিটস’, ‘লাভ উইদাউট লিমিটস’, ‘স্ট্যান্ড স্ট্রং’, ‘লিমিটলেস’ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার ‘আনস্টপ্যাবল’ নামক বইগুলো পৃথিবীব্যাপী প্রায় ত্রিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

বড় ছেলে এবং স্ত্রীর সাথে নিক

জীবনের ব্যাপারে তার ধারণা খুবই সাধারণ। স্রষ্টায় বিশ্বাসী এই মানুষটি তার এই অস্বাভাবিক শারীরিক অসংলগ্নতার জন্য কখনোই স্রষ্টাকে দোষারোপ করেন না। এ বিষয়ে কত স্বাভাবিক ভাবেই না বলেন, God won’t allow anything to happen in your life if it’s not for your good। তিনি যা আছে তা নিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে এগিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী। সবার মতো তিনিও থেমে না থেকে, বারবার হেরে যাওয়ার পরেও আবার চেষ্টা করে যাওয়ায় বিশ্বাসী। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, If I fail, I try again, and again and again. If YOU fail, are you going to try again? The human spirit can handle much worse than we realize. It matters HOW you are going to FINISH. Are you going to finish strong?

তথ্যসূত্র

১) motivationgrid.com/famous-people-who-never-give-up/

২) en.wikipedia.org/wiki/Oprah_Winfrey

৩) en.wikipedia.org/wiki/Nick_Vujicic

৪) nickvujicic.com/

Related Articles

Exit mobile version