“কঠিন না হলে, সবার দ্বারাই এ কাজ সম্ভব হতো। কঠোরতাই এ কাজের মহত্ব।”
উপরের কথাটি যার মুখ থেকে নিঃসৃত, এ পৃথিবীর অবিনশ্বর ব্যক্তির তালিকায় নাম লেখানোর কঠিন যুদ্ধে টিকে যাওয়া কয়েকজন বিজয়ীর মধ্যে তিনি একজন। বলতে গেলে, মহত্ব তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে নাকি তিনি মহত্বকে নিজ প্রচেষ্টায় ছুঁয়েছেন, সে ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে না ভুগে উপায় নেই।
মানুষটা দেখতে বড্ড সাদামাটা। আপনি যদি তার সাথে আগে পরিচিত না হয়ে হঠাৎ করে তার কোনো ছবি দেখেন তাকে কোনো উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বা কোনো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ভেবে নেওয়া একদম স্বাভাবিক ব্যাপার। তার চেহারা, পোশাক, চালচলন ও কথাবার্তায় যতটা না বিখ্যাত ব্যক্তির ভাবমূর্তি প্রতিফলিত হয় তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি আমেরিকান শিক্ষিত ও মার্জিত সিনিয়র সিটিজেনের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে।
শুধু বর্তমানেই নয় কিন্তু, সেই শুরু থেকেই তিনি এমন ছিলেন। একই জগতে কাজ করা একই প্রজন্মের অন্যান্য ব্যক্তিরা হালফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের বাহ্যিক বেশভূষা ও স্টাইল নিয়ে সচেতন থাকলেও সেসব নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না তার। বাকিদের মতো চলাফেরাতেও নিজের তারকাসুলভ আচরণ প্রকাশ করতে তাকে দেখা যায়নি। ব্যস্ত কোনো শহুরে রাস্তার ফুটপাত ধরে তিনি হেঁটে গেলেও সাধারণ কোনো জনতা থেকে তাকে আলাদাভাবে চেনার কোনো উপায় ছিল না। আর এমন মধ্যবিত্ত গোছের নিপাট ভদ্রলোকের বেশ ধরেই একের পর এক আকাশের তারা নিজের হাতের মুঠোয় এনে বন্দি করে চলছিলেন তিনি, নীরবে!
বলছিলাম রুপালি পর্দার এমন এক নক্ষত্রের কথা, সত্যিকারের সিনেপ্রেমী হয়ে থাকলে যার সাথে পরিচিত না হয়ে, আপনি পারবেনই না! কখনো যুদ্ধ ময়দানে প্রাণপণ লড়াইয়ে অংশ নেওয়া সেনা, কখনো চাঁদের দেশে অভিযান চালানো মহাকাশচারী, কখনো আইনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কখনো পাইলট, কখনো গ্যাংস্টার, কখনো জাহাজের ক্যাপ্টেন ইত্যাদি এমন অনেক চরিত্রে তার সরব উপস্থিতি সিনেমার পর্দায় গত চার দশক ধরে দেখা গেছে। তার অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমা যেমন নন্দিত হয়েছে, তেমনি তার বেশিরভাগ চরিত্রই দর্শকের মনে অমলিন হরফে স্থান করে নিয়েছে। টম হ্যাঙ্কস নামে সর্বজনীন পরিচিত এ মহা তারকার গল্প নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এ আয়োজন।
অগোছালো ছেলেবেলা
ক্যালিফোর্নিয়ার কনকর্ড শহরের হাসপাতালের কর্মী জ্যানেট মেরিলিন ও রাঁধুনি অ্যামোস মিফোর্ড হ্যাঙ্কসের সংসারে তৃতীয় সন্তান হিসেবে আগমন ঘটে টম হ্যাঙ্কসের। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিল থমাস জেফরি হ্যাঙ্কস। তার মায়ের পূর্বপুরুষেররা ছিলেন পর্তুগীজ আর বংশগতভাবে তার বাবা ছিলেন ইংরেজ। তার বয়স যখন মাত্র চার, তখন তার মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। তাদের চার সন্তানের মধ্যে প্রথম তিন জনের দেখাশোনার ভার নেন বাবা অ্যামোস আর একদম ছোট সন্তান জিম মায়ের সাথেই থেকে যায়। সেই থেকে বাবার ছায়ায় মানুষ হতে থাকেন টম। তার বয়স দশ না পেরানোর আগেই দশটা ভিন্ন ভিন্ন বাসায় থাকার অভিজ্ঞতা হয় তার৷
তার স্কুল জীবন তেমন একটা ভালো কাটেনি। স্কুলের ছাত্র থেকে শুরু করে শিক্ষক কেউই তাকে পছন্দ করত না। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির হ্যাঙ্কস নিজের বানানো জগত নিয়েই খুশি থাকতেন। তবে স্কুল জীবনে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে হয়নি তাকে। কারণ ছোটকাল থেকেই তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল।
১৯৬৫ সালে তার বাবা পুনরায় বিয়ে করেন। সান ফ্রান্সিসকোর আদিবাসী ফ্রান্সেস ওয়ং নামের সে মহিলার পূর্বপুরুষেরর ছিলেন চাইনিজ। তখন থেকে বাবার দ্বিতীয় সংসারে আরও দুজন সৎ ভাই বোনের সাথে বেড়ে উঠতে লাগলেন হ্যাঙ্কস।
থিয়েটারের সাথে
ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডের স্কাই লাইন হাই স্কুলে পড়াকালীন টম হ্যাঙ্কসের অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি তার বিশেষ ভালো লাগা কাজ করত বলে হাই স্কুলের নাটকগুলোতে অংশ নিতে শুরু করেন।
হাই স্কুল জীবনের পাট চুকিয়ে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ক্যালিফোর্নিয়ার হেওয়ার্ড চাবোট কলেজে থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা করতে ভর্তি হন। দুই বছর পর সেখান থেকে বদলি হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। ১৯৮৬ সালে নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“যে ছেলে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে শোরগোল করতে চায়, তার জন্য অ্যাক্টিং ক্লাস থেকে সেরা জায়গা আর একটাও নেই।”
সে সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, সে সময়ে তিনি একা একা থিয়েটারে নাটক দেখতে যেতে পছন্দ করতেন। সাথে কোনো প্রমিলাকে না নিয়েই ড্রাইভ করে চলে যেতেন কোনো থিয়েটারে। তারপর একটা টিকেট কেটে চুপচাপ বসে পড়তেন নাটক উপভোগ করতে। এরপর ধীরে ধীরে ডুবে যেতেন নাটকের ভেতর। এভাবেই তিনি নিজ উদ্যোগে অল্প অল্প করে অভিনয় দক্ষতা রপ্ত করছিলেন।
থিয়েটার নিয়ে পড়াকালীন ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে গ্রেট লেক থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি। তখন ফেস্টিভ্যালের প্রধান ভিনসেন্ট ডোওলিংয়ের সাথে দেখা হয় তার। তার পরামর্শে ফেস্টিভ্যালে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেন তিনি। সে ইন্টার্নশিপের মেয়াদ তিন বছর স্থায়ী হওয়ার ফলে সেখান থেকেই থিয়েটার প্রোডাকশনের নাড়িনক্ষত্র জানা হয়ে যায় তার। লাইটিং, সেট ডিজাইন, স্টেজ ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ে ভালোই প্রশিক্ষণ লাভ করেন তিনি। তবে এর বদলে তাকে কলেজের ডিগ্রির আশা ছাড়তে হয়েছিল। তবে ১৯৭৮ সালে থিয়েটারে শেকসপিয়ারের ‘দ্য টু জেন্টলম্যান অব ভেরোনা’ নাটকে প্রোটিয়াস চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ক্লিভল্যান্ড ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড জেতার মধ্যদিয়ে কলেজ ছেড়ে হাতেকলমের শিক্ষাকে বেছে নেওয়ার সঠিক মূল্যায়ন পান তিনি।
বড় পর্দার সাথে
১৯৭৯ সালে নিউইয়র্কে পাড়ি জমালে সেখানেই তিনি প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হি নোস ইউ আর অ্যালোন’ নামে স্ল্যাশার ফিল্মের (হরর জনরার অন্তর্ভুক্ত একটি সাব-জনরা হলো স্ল্যাশার) মাধ্যমে সিনেমায় অভিষেক ঘটে তার৷ এরপর ১৯৮২ সালের ‘মেজেস অ্যান্ড মনস্টার’ নামের টেলিভিশন ড্রামা ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ মিলে তার।
সে বছরই এবিসি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের ‘বোসম বাডিস’ এ প্রধান চরিত্রে নেওয়া হয় তাকে। সিটকম জনরার এ সিরিজ দর্শক সমাজে তেমন সাড়া না ফেললেও, ক্রিটিকরা ভালোই রেটিং দিয়েছিলেন সিরিজটিকে। টম সিরিজটিতে মেয়েদের বেশ ধরে অভিনয় করেছিলেন। রোলিং স্টোনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিরিজের কো-প্রডিউসর ল্যান প্রেইসার টম সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,
“তাকে দেখে আমি ভাবছিলাম, টেলিভিশন জগতের দুর্ভাগ্য, তাকে আর বেশিদিন পাবে না। দু বছরের মধ্যেই সে মুভি স্টার হয়ে যাবে।”
১৯৮২ সালে ‘হ্যাপি ডেজ’ সিটকমে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স হিসেবে ‘বোসল বাডিস’ সিরিজ থেকে টমকে আনা হয়। আর তখনই ভাগ্যের চাকা মোড় নেয় তার৷ ‘হ্যাপি ডেজ’ এর সে এপিসোড সিনেমা নির্মাতা রন হোওয়ার্ডের চোখে পড়লে তিনি নিজের পরবর্তী মুভির জন্য টমকে নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেভাবেই টম ১৯৮৪ সালের সিনেমা ‘স্প্ল্যাশ’ এ মূল নায়কের চরিত্র পেয়ে যান৷ রোমান্টিক কমেডি ঘরানার এ সিনেমার প্লট এক মৎসকন্যার একজন সাধারণ মানবের প্রেমে পড়ার গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছিল। যদিওবা প্রথমে রন তাকে সিনেমার একটি পার্শ্ব চরিত্রে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। একই বছর ‘ব্যাচেলর পার্টি’ নামের আরেকটা সেক্স কমেডি জনরার সিনেমাতেও দেখা যায় তাকে।
১৯৮৬ সালে টম অভিনীত আরও দুটো কমেডি জনরার সিনেমা মুক্তি পায়। তার মধ্যে ‘নাথিং ইন কমন’ সিনেমাটি একজন বাবা ও তার ছেলের মধ্যেকার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। আর অন্যটি হলো ‘দ্য মানি পিট’ যেটার প্লট একজন লোক ও তার শখের বাড়ির গল্প নিয়ে নির্মিত হয়।
এভাবে ছোটখাটো সাফল্যের মধ্যদিয়ে টমের ক্যারিয়ার এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনো তেমন বড় ধরনের কাজ তার হাতে এসে ধরা দেয়নি৷ ১৯৮৮ সালে ‘বিগ’ সিনেমার মধ্যদিয়ে স্পটলাইটে আসেন টম। ওই সিনেমাতে তার অভিনয় তাকে বক্স অফিস সাফল্য তো এনে দিয়েছিলই, সেই সাথে প্রথমবারের মতো অস্কারে সেরা অভিনেতা বিভাগে মনোনয়নও। সে বছর ‘পাঞ্চলাইন’ নামে তার আরও একটি সিনেমাও রিলিজ পায়।
রূপালি পর্দার সাথে
এরপরের চার-পাঁচটা বছর ছিল তার ক্যারিয়ারের উথান-পতন। ‘দ্য বার্বস’, ‘জই ভার্সেস দ্য ভলকানো’, ‘দ্য বোন ফায়ার অব দ্য ভ্যানিটিস’ ইত্যাদি সিনেমাগুলোতে এ সময়ে কাজ করেছিলেন তিনি। এগুলোর সবকটার কমেডি জনরার সাথে অন্য যেকোনো জনরার মিশ্রণে নির্মিত সিনেমা ছিল। মোটকথা, তখনো টম কমেডি জনরা থেকে বের হয়ে অন্য কোনো ঘরানাতে নিজের প্রতিভা তুলে ধরার মতো সুযোগই পাননি। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘টার্নার অ্যান্ড হুচ’ সিনেমাটিই সে সময়ে একমাত্র ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করে।
টম হ্যাঙ্কসের ক্যারিয়ারের বাঁক ঘুরে যায় ১৯৯৩ সালে। সে বছর প্রথমে ‘স্লিপলেস ইন সিয়াটল’ ও পরে ‘ফিলাডেলফিয়া’তে অভিনয়ের মাধ্যমে তার সিনে ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়৷ ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেও এ কথা স্বীকার করে বলেন যে,
“আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সিনেমা নির্মাণের কৌশলের পাশাপাশি তার কাজেও পরিবর্তন এসেছিল। নিজেকে আবিস্কার করার দিন ততদিনে পেরিয়ে গিয়েছিল।”
‘স্লিপলেস ইন সিয়াটেল’ তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য দর্শক তাকে তার প্রজন্মের অন্যতম সেরা রোমান্টিক অভিনেতার খেতাব দেয়। ‘ফিলাডেলফিয়া’ সিনেমায় একজন এইডস আক্রান্ত সমকামী লোকের চরিত্রে অভিনয় করেন টম। সে যুগে এমন একটা বিতর্কিত চরিত্রে অভিনয় করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। এ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তাকে ৩৫ পাউন্ড ওজন কমানোর পাশাপাশি মাথার চুলও ফেলে দিতে হয়েছিল৷ তার এ একনিষ্ঠতা বৃথা যায়নি কিন্তু। এ সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য প্রথমবারের মতো অস্কার হাতে উঠেছিল তার। পিপল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা ‘ফিলাডেলফিয়া’ মুভির রিভিউতে লিয়া রোজেন বলেন,
“ফিলাডেলফিয়া সিনেমার সাফল্যের সব কৃতিত্ব টম হ্যাঙ্কসের যিনি নাকি মাথায় রেখেছিলেন তিনি কোনো সাধুর চরিত্রে অভিনয় করছেন না। এমন বিস্ময়কর, মর্মস্পর্শী ও অতি সূক্ষ্ম পারফরম্যান্সের জন্য অস্কারের যোগ্য দাবিদার তিনি।”
সবে তো টম হ্যাঙ্কসের দিন শুরু। সামনে আরও বিশাল সাফল্য হাতছানি দিয়ে ডাকছিল৷ ১৯৯৪ সালে ‘ফরেস্ট গাম্প’ সিনেমাতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এ সিনেমা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আজও সর্বকালের সেরা সিনেমাগুলোর তালিকায় চোখ বোলালে সিনেমাটির নাম চোখে পড়ে। এ সিনেমা সম্পর্কে হ্যাঙ্কস একবার বলেছিলেন যে,
“যখন আমি পান্ডুলিপি পড়ি, আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, এটা ওই মুভিগুলোর মধ্যে একটা হতে যাচ্ছে যা কিনা মানুষের মনে আশা জাগাবে ও নিজের জীবনের অবস্থান সম্পর্কে ভাবাবে। ছোটকালে এমন অনেক মুভি থেকে শত সহস্রবার আমি আশা খুঁজে পেয়েছি, এমনকি এখনো পাই।”
ফরেস্ট গাম্পের জন্য সে বছর দ্বিতীয় বারের মতো সেরা অভিনেতার ক্যাটাগরিতে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন তিনি। ইতিহাসের দ্বিতীয় অভিনেতা (প্রথমজন ছিলেন স্পেনসার ট্রেসি) হিসেবে এমন পর পর দু বছর টানা অস্কার জেতার রেকর্ড গড়েন তিনি।
এর পরের বছর রন হোওয়ার্ডের ‘অ্যাপোলো থার্টিন’ সিনেমায় মহাকাশচারী জিম লাভেলের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সিনেমাটি সমালোচকদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা তো লাভ করেই, এছাড়া সে বছর অস্কারে ৯টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে দুটো জিতেও নেয়। ওই একই বছর ডিজনি পিক্সারের ‘টয় স্টোরি’ অ্যানিমেটেড ফিল্মে শেরিফ উডির চরিত্রে কণ্ঠ দেন তিনি।
সিনেজগতের তিনি নাকি সিনেজগতটাই তার?
মাঝখানের তিন বছর পরিচালক রূপে নিজের নতুন পরিচয় আত্মপ্রকাশে ব্যস্ত সময় কাটান তিনি। ১৯৯৮ সালে ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ নামের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমাতে ক্যাপ্টেন জন এইচ. মিলার চরিত্রে অভিনয় করে আরও একবার সিনে জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। সিনেমাটি চারিদিকে তুমুল সাড়া ফেলেছিল। আর ফেলবেই বা না কেন? সিনেমার পরিচালক যে ছিলেন স্টিভেল স্পিলবার্গ৷ সে বছরও টম অস্কারে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান। স্পিলবার্গ এ সিনেমার জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতে নেওয়ার পাশাপাশি এ সিনেমাকে সর্বকালের সেরা যুদ্ধভিত্তিক প্লটের সিনেমার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ বছরের শেষের দিকে ‘স্লিপলেস ইন সিয়াটেল’ এর সহ অভিনেত্রী মেগ রায়ানের সাথে পুনরায় জুটি বেঁধে ‘ইউ হ্যাভ গট আ মেইল’ নামে আরও একটি সুন্দর গল্পের রোমান্টিক সিনেমাতে কাজ করেন তিনি।
এর পরের বছর স্টিভেন কিং এর নোবেল ‘গ্রিন মাইল’ অবলম্বনে নির্মিত একই নামের সিনেমায় অভিনয় করেন। সিনে দুনিয়ায় এ সিনেমাটি আরও একটি মাস্টারপিস বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। সে বছর টয় স্টোরি পার্ট টুতেও কণ্ঠ দেন তিনি।
২০০০ সালে ‘কাস্ট আউয়ে’ সিনেমায় এক নির্জন দ্বীপে আটকা পড়ে একাকী কয়েক বছর সংগ্রাম করে টিকে গেছে এমন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেন তিনি। এ সিনেমার জন্য গোল্ডেন গ্লোব জয়ের পাশাপাশি পঞ্চমবারের মতো অস্কারের জন্য নমিনেশন পান।
২০০২ সালে ‘রোড টু পার্ডিশন’ নামক আমেরিকান ক্রাইম জনরার ফিল্মে হিটম্যানের চরিত্রে দেখা যায় তাকে। একই বছর স্পিলবার্গের সাথে আরও একটা সিনেমাতে কাজ করার সুযোগ হয় তার। ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ নামের এ সিনেমাতে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর সাথে জুটি বাঁধেন তিনি। চোর-পুলিশ খেলা নিয়ে গড়ে উঠা এ সিনেমা পুলিশের চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাকে।
২০০৪ সালে কয়েন ব্রাদার্সের ‘দ্য লেডিকিলার’ সিনেমাতে গ্যাংস্টার চরিত্রে পর্দার সামনে আসেন তিনি। টমের সে চরিত্রটা আসলেই মনে রাখার মতো ছিল। অনেকদিন পর এমন ভিন্নধর্মী রূপে দেখা গিয়েছিল তাকে৷ সে বছর স্পিলবার্গের মুভিতে তৃতীয়বারের মতো উপস্থিত হোন তিনি। ‘দ্য টার্মিনাল’ নামক এ সিনেমার গল্পটা এতটা হৃদয়স্পর্শী ছিল যে এটি টমকে দর্শকদের মনে আরও পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে দেয়। থ্রি ডি কম্পিউটার অ্যানিমেটেড অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম ‘দ্য পোলার এক্সপ্রেস’-এ ট্রেনচালকের চরিত্রেও একই বছর কাজ করেন তিনি।
ইউএসএ উইকেন্ড পত্রিকা এক সাক্ষাৎকারে নিজের সিনেমা বাছাইয়ের ব্যাপারে বলতে গিয়ে টম বলেন,
“১৯৯২ সালের পর থেকে সিনেমাকে শুধু সিনেমা হিসেবেই বিবেচনা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। সিনেমাটির ভেতর এমন কোনো কিছু আছে লুকিয়ে আছে কিনা যা সিনেমাটিতে অভিনয়ের জন্য আমার অনুভূতি বা ইচ্ছাকে প্রবলভাবে নাড়া দেবে সে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি আমি।”
২০০৬ সালে ড্যান ব্রাউনের বেস্ট সেলিং বই ‘দি দ্য ভিঞ্চি কোড’ অবলম্বনে বানানো সিনেমায় প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডনের চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমাটি বক্স অফিসে ভালোই সাড়া ফেলে। এর পরের বছর ‘চার্লি উইলসন’স ওয়ার’ মুভিতে ডেমোক্রেটিক টেক্সাস কংগ্রেসম্যান চার্লস উইলসনের ভূমিকার দেখা যায় তাকে। সিনেমাটির জন্য তিনি গোল্ডেন গ্লোবের নমিনেশনও পান। ২০০৮ সালে নিজের ছেলে কলিন হ্যাঙ্কসের সাথে ‘দ্য গ্রেট বাক হোওয়ার্ড’ সিনেমায় কলিনের বাবার চরিত্রেই অভিনয় করেন।
তার পরের বছর ড্যান ব্রাউনের ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডিমন’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাতে আবারও রবার্ট ল্যাংডন হিসেবেই অবতারণ ঘটে তার। ২০১০ সালে টয় স্টোরির পার্ট থ্রি রিলিজ পেলে সেটাতেও হ্যাঙ্কস অংশ নিয়েছিলেন। এর পরের বছর ‘ল্যারি ক্রাউন’ নামে একটা রোমান্টিক কমেডি মুভি পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেন তিনি। এ মুভিতে জুলিয়া রবার্টস ছিলেন তার বিপরীতে। সে বছর ‘দ্য এক্সট্রিমলি লাউড অ্যান্ড ইনক্রেডিবলি ক্লোজ’ নামের ড্রামা জনরার মুভিতেও দেখা যায় তাকে। তবে ওই বছর তার অভিনীত ‘ক্লাউড অ্যাটলাস’ সিনেমাটি সবথেকে বেশি আলোচিত হয়।
২০১৩ সালে টম অভিনীত দুটো সিনেমা মুক্তি পায়৷ তার মধ্যে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’ সিনেমাতে জলদস্যুদের দ্বারা হাইজ্যাক হয়ে যাওয়া একটি জাহাজের নির্ভীক ক্যাপ্টেনের চরিত্রে দেখা যায় তাকে। আর অন্য সিনেমাটি হলো, “সেভিং মি. ব্যাংক্স’। এ সিনেমায় ওয়াল্ট ডিজনির ভূমিকায় পর্দার সামনে আসেন তিনি। ক্যাপ্টেন ফিলিপ চরিত্রের জন্য সেবার তিনি আরও একবারের মতন গোল্ডেন গ্লোবের নমিনেশন পাওয়ার কৃতিত্ব লাভ করেন।
টম অভিনীত ‘ব্রিজ অব স্পাইস’ ২০১৫ সালে রিলিজ পায়। স্পিলবার্গের নির্মিত হিস্টোরিক্যাল ড্রামা জনরার এ সিনেমাতে একজন ইন্সুরেন্স লয়ারের চরিত্রে দেখা যায় তাকে। সিনেমাটিকে সে বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা হিসেবে গণ্য করা হয়। এর পরের বছর তিনটি সিনেমাতে দেখা যায় তাকে। তার মধ্যে ক্লিন্ট ইস্টউডের পরিচালিত বায়োলজিক্যাল ড্রামা জনরার ‘সালি’ সিনেমাতে একজন দুর্ধর্ষ পাইলটের চরিত্রে দেখা যায় তাকে।
চেলসি সালেনবার্গার নামের একজন পাইলট কীভাবে নিজের জীবন ও ক্যারিয়ারের ঝুঁকি নিয়ে ২০০৯ সালে শত শত বিমান আরোহীর জীবন বাঁচান, সে গল্পই তুলে ধরা হয়েছিল এ সিনেমাতে। সে বছর ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’ অবলম্বনে বানানো মুভিতে আবারও প্রফেসর ল্যাংডন রূপে হাজির হোন তিনি।
২০১৭ সানে সাই ফাই মুভি ‘সার্কেল’ এ এমা ওয়াটসনের সাথে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়া সে বছর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ঘিরে একটি সত্য ঘটনার উপর নির্মিত সিনেমা ‘দ্য পোস্ট’ এ মেরিল স্ট্রিপের সহ অভিনেতা হিসেবে দেখা যায় তাকে। স্পিলবার্গের পরিচালিত এ সিনেমা সে বছরে অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল।
২০১৮ তে টমকে বড় পর্দায় না দেখা গেলেও এর পরের বছর টয় স্টোরি পার্ট ফোরে উডির কণ্ঠের পাশাপাশি ‘আ বিউটিফুল ডে ইন দ্য নেইবারহুড’ মুভিতে বিখ্যাত আমেরিকান টিভি ব্যক্তিত্ব ফ্রেড রজার্সের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দর্শকদের সামনে ফের হাজির হোন তিনি। ফ্রেড রজার্সের চরিত্রটিকে অনন্যভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে এ বছর প্রথমবারের মতো সেরা পার্শ্ব অভিনেতার শাখাতে মনোনীত হয়েছিলেন তিনি।
সামনেই তাকে অ্যারন স্নাইডারের ‘গ্রেহাউন্ড’ নামক যুদ্ধভিত্তিক সিনেমাতে দেখা যাবে৷ তাছাড়া এ বছরের প্রায় শেষের দিকে ইউনিভার্সাল পিকচারের সাই-ফাই ড্রামা ফিল্ম ‘বিআইওএস’ এ পৃথিবী গ্রহে টিকে থাকা শেষ মানব রূপে আবির্ভূত হবেন তিনি। আর বছরের একদম শেষে পল গ্রিনগ্রাসের ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ সিনেমাতে আমেরিকান প্রয়াত গায়ক ও অভিনেতা এলভিস প্রেসলির ম্যানেজার হিসেবে দেখা মিলবে তার।
এসব ছাড়াও আগামী বছরের জন্যও বেশ কিছু প্রজেক্টে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চলেছেন তিনি।
সিনেজগতের অন্যান্য রাজ্যে বিচরণ
সিনেমাতে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা ও ধারাভাষ্যকার হিসেবেও বেশ কিছু কাজ করেছেন টম৷ ‘কাস্ট আউয়ে’, ‘মাই বিগ ফ্যাট গ্রিক ওয়েডিং’, ‘চার্লি উইনসন্স ওয়ার’, ‘মাম্মা মিয়া’ সহ আরও অনেক সিনেমার প্রযোজক ছিলেন তিনি। অন্যদিকে, ‘দ্য থিং ইউ ডু’ ও ‘ল্যারি ক্রাউন’ সিনেমা দুটোতে পরিচালকের ভূমিকাতে দেখা গেছে তাকে।
টেলিভিশন জগতেও তার অবদান কিন্তু কম নয়। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যেমন বেশ কিছু টিভি শোতে অভিনয় করেন তিনি, তেমনি পরে এসে বেশ কিছু টিভি শোতে পরিচালক অথবা প্রযোজক হিসেবে কাজ করে গেছেন। ‘দ্য লাভ বোট’, ‘বোসল বাডিস’, ‘মেইজেস অ্যান্ড মনস্টার’, ‘ট্যাক্সি’, ‘হ্যাপি ডেজ’, ‘ফ্যামিলি টাইস’, ‘টেলস ফ্রম দ্য ক্রিপ্ট’ ইত্যাদি টিভি শোতে অভিনয় অভিনেতা হিসেবে ছিলেন তিনি।
১৯৯৩ সালের সিটকম ‘আ লিগ অব দেয়ার ওন’ ও অ্যান্থোলজি ‘ফলেন অ্যাঞ্জেলস’ সিরিজ দুটোতে পরিচালকের দায়িত্বে থেকেছেন টম। ১৯৯৮ সালের ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ নামের এইচবিও’র ডকুমেন্টারি ড্রামা মিনি সিরিজে একই সাথে অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে কৃতিত্ব দেখান তিনি। টেলিভিশন দুনিয়ার সবথেকে জনপ্রিয় দুটো যুদ্ধভিত্তিক সিরিজ ‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ ও ‘দ্য প্যাসিফিক’ এ প্রযোজকদের একজন ছিলেন তিনি। এমনকি ‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ সিরিজে পরিচালনাও করেন। আর ‘দ্য প্যাসিফিক’ সিরিজে ধারাভাষ্যকারের কাজ। এছাড়া আরও অসংখ্য প্রজেক্টে নানাভাবে জড়িত আছেন টম।
সিনে দুনিয়ার ভালোবাসার প্রতিদান
টম হ্যাঙ্কসের অর্জনের গল্প বলতে শুরু করলে শেষ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে পাঁচবার সেরা অভিনেতার ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়ে দুইবার পুরস্কার জিতে নেন তিনি। আর একবার সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন তো আছেই। গোল্ডেন গ্লোবে নয়বার সেরা অভিনেতার শাখাতে মনোনয়নের পাশাপাশি রয়েছে চারবার গ্লোব হাতে তুলে নেওয়ার সৌভাগ্য।
মেরিল স্ট্রিপ পর তিনিই গোল্ডেন গ্লোবে এতবার মনোনয়ন ও সর্বোচ্চ পুরস্কার অর্জনের খ্যাতি লাভ করেছেন। বাফটাতে পাঁচবার সেরা অভিনেতার জন্য মনোনীত হলেও এ অ্যাওয়ার্ডটা আজো অধরা রয়ে গেছে তার। তবে এমিতে নানা টিভি শোর জন্য নানা ক্যাটাগরিতে মোট বারো বার মনোনয়ন বাফটার অভাব পুষিয়ে দিয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়৷ ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ যেমন ১৯৯৮ সালে সেরা লিমিটেড সিরিজ হিসেবে এমি জিতে নেয়।
‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ ও ‘দ্য প্যাসিফিক’ও সেই পথ অনুসরণ করে যথাক্রমে ২০০২ ও ২০১০ সালে সেরা লিমিটেড সিরিজ ক্যাটাগরিতে এমি লুফে নেয়৷ ‘ব্যান্ড অব ব্রাদার্স’ এর জন্য সেরা পরিচালকের শাখাতেও এমি জয় করেন নেন টম। স্ক্রিন অ্যাক্টরস গ্রিল্ড অ্যাওয়ার্ডে দুটো পুরস্কারসহ আটটি নমিনেশন পাওয়ার গৌরব আছে তার।
এগুলো ছাড়াও আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট, আমেরিকান কমেডি অ্যাওয়ার্ড, অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকাডেমি অব সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস, শিকাগো ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাসোসিয়েশন, ডেট্রয়েট ফিল্ম ক্রিটিকস সোসাইটি, লন্ডন ফিল্ম ক্রিটিকস সার্কেল, এমপায়ার ম্যাগাজিন, পিপলস চয়েজ অ্যাওয়ার্ড সহ আরও বহু অ্যাওয়ার্ড তার বাসার শোকেসে শোভা বর্ধিত করছে।
গোল্ডেন গ্লোবের আজীবন সম্মাননা তো আছেই, এছাড়া আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকেও আজীবন সম্মাননা পুরস্কারের সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে তাকে।
এখানেই কি তবে শেষ? এগুলো তো শুধু গেল সিনে জগতে তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাফল্যের প্রতিফলন।
সিনে দুনিয়ার বাইরেও ভালোবাসার কমতি নেই
রূপালি পর্দা ব্যতীতও টম হ্যাঙ্কসের জীবনে কর্মকাণ্ড ও অর্জন কিন্তু নেহাৎ কম নয়। ‘ন্যাশনাল স্পেস সোসাইটি’ নামক আমেরিকান আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব গর্ভনরের একজন সদস্য তিনি। ছোটবেলায় নভোচারী হবার স্বপ্ন দেখতেন বলে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন না করতে পারলেও মহাকাশ বিষয়ক নানা সিনেমা ও টিভি শোতে কাজ করে গেছেন তিনি। ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ টিভি শোতে যেমন মহাকাশচারীদের চাঁদে পাঠানোর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি আবার অ্যাপেলো থার্টিনে নিজেই মহাকাশচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। এমন আরও মহাকাশ সংশ্লিষ্ট নানাবিধ কাজের জন্য ২০০৬ সালে স্পেস ফাউন্ডেশন থেকে তাকে ‘ডগলাস এস. মরো পাবলিক আউটরিচ অ্যাওয়ার্ড’এ ভূষিত করা হয়। এর আগে ১৯৯৬ সালে ‘অ্যাপেলো থার্টিন’ মুভিতে অসাধারণ অভিনয়কে মর্যাদা দিতে ‘১২৮১৮ টম হ্যাঙ্কস’ নামে একটা উপগ্রহের নামকরণ করা হয়েছিল।
‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ সিনেমায় যোদ্ধার চরিত্রে সাবলীল অভিনয়ের জন্য ২০০৬ সালে তাকে ‘ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি র্যাঞ্জার্স’ এর সম্মানিত সদস্য রূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনিই প্রথম অভিনেতা যে কিনা এমন সম্মান নিজের করে নিয়েছেন।
২০১৪ সালে আমেরিকান সংস্কৃতিতে বেশ কয়েক যুগ ধরে শিল্পী হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্য ‘কেনেডি সেন্টার অনার্স’ মেডেল লাভ করেন।
২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অভ ফ্রিডম’ জেতার মাধ্যমে নিজেকে একজন সুযোগ্য ও আর্দশ আমেরিকান সিটিজেন রূপে প্রমাণ করেন টম। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হাত থেকে এ মেডেল নিজের গলায় বরণ করেন তিনি।
বলাবাহুল্য টম হ্যাঙ্কস রাজনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে বেশ তৎপর ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটের সময় বারাক ওবামাকে বেশ জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন তিনি। নিজের মাই স্পেস অ্যাকাউন্টে ওবামাকে নিয়ে একটা প্রচারণামূলক ভিডিওর পাশাপাশি ওবামা ফর আমেরিকা দ্বারা নির্মিত ‘দ্য রোড উই হ্যাভ ট্রাভেলড’ ডকুমেন্টারিতে ধারাভাষ্যও দেন টম। ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় তিনি হিলারি ক্লিনটনের সমর্থনকারী ছিলেন।
সমকামী বিয়ের পক্ষে জোরদার আওয়াজ উঠাতেও তিনি পিছপা হোননি। ২০০৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে সমকামী বিয়ের বিরুদ্ধে ‘প্রোপোজিশন এইট’ একটি আইন প্রণনয় করা হলে এর প্রতিবাদে ক্যাম্পেইনের আয়োজন করেন টমসহ আরও অনেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে রুপালি পর্দায় এতটা সূক্ষ্মভাবে পরিবেশন করার জন্য ২০১৬ সালে ‘ফ্রেঞ্চ লিজিওন অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে সম্মান জানানো হয় তাকে। এটাকে ফ্রান্সের মিলিটারি ও সিভিল মেরিটের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
ব্যক্তিগত জীবনে ম্যানুয়াল টাইপ রাইটার সংগ্রহের নেশা বহুদিন ধরেই ছিল টমের। তিনি যে শুধু নানা ধরনের অ্যান্টিক সব টাইপ রাইটার সংগ্রহই করেন তাই নয়, সেগুলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারও করে থাকেন। ২০১৪ সালের অগাস্টে ‘হ্যানক্স রাইটার’ নামে আইওএস চালিত অ্যাপও চালু করেন যাতে আইফোন ব্যবহারকারীরা টাইপ রাইটারে লেখার স্বাদ নিতে পারে। সে বছরেই তিনি টাইপ রাইটারের সংগ্রহ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ছোটগল্পের সংকলন বই বের করার ঘোষনা দেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ‘আনকমন টাইপ’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়।
সিনে ভুবনের ভালোবাসার মানুষটার নিজের মনের মানুষ
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের দিকে তাকালে হলিউডের অন্যতম সুখী মানব যে টম হ্যাঙ্কস তা নিয়ে কারোরই সন্দেহ পোষণের অবকাশ নেই। একজন আদর্শ অভিনেতা ও মানুষের পাশাপাশি তিনি একজন আর্দশ স্বামী ও একজন আর্দশ পিতাও বটে৷
১৯৭৮ সালে আমেরিকান অভিনেত্রী সামান্থা লেয়াসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন টম। তখন সবে তার বয়স ২১। সামান্থার সাথে প্রায় দশ বছরের মতো সংসার করেছিলেন তিনি৷ সামান্থা ও তার, কলিন হ্যাঙ্কস ও এলিজাবেথ হ্যাঙ্কস দুজন সন্তান আছে। ১৯৮৭ সালে সামান্থা ও টমের বিচ্ছেদ ঘটে।
মূলত, সামান্থার সাথে বিচ্ছেদের পূর্বেই অভিনেত্রী রিটা উইলসনের সাথে একসাথে কাজ করতে গিয়ে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন টম। ১৯৮১ সালে টিভি কমেডি ‘বোসম বাডিস’ এ তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে৷ এরপর আবার ১৯৮৫ সালে ‘ভলান্টিয়ার্স’ সিনেমার সেটা পুনরায় মিলিত হোন তারা।
টমের মতে,
“বয়স ত্রিশ অতিক্রম করার পূর্বে বিয়ে করাটাই উচিত না।”
সামান্থার হাত ছেড়ে রিটার হাত ধরলেও সে হাত আজ অবধি একবারের জন্যও ছাড়েননি টম৷ ১৯৮৮ সালে রিটার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে একসাথে কাটিয়ে দিয়েছেন তিন দশকেরও বেশি সময়। সিনে দুনিয়ায় রিটা ও টমের মতো এমন সফল ও সুখী জুটি খুব কমই নজির হয়। তাদের অন্তরে পরস্পরের প্রতি প্রেম কতটা চিরতুরণ ও খাঁটি, তা যেকোনো অনুষ্ঠানে তাদের একসাথে দেখলেই এক পলক দেখেই তা আঁচ করে ফেলতে পারবেন যে কেউ।
রিটা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে একবার টম বলেছিলেন,
“এ মানুষটা আমাকে রুগ্ন অবস্থায় ভালোবেসেছে, স্থুল অবস্থায় ভালোবেসেছে, টাক মাথায় ভালোবেসেছে, চুলো মাথায় ভালোবেসেছে। যে মানুষটাকে আমি চিনি, সে আমায় ভালোবাসে৷ তাই, আমি ভাগ্যবান লোক।”
রিটা ও টমের সংসারে চেস্টার হ্যাঙ্কস ও ট্রুম্যান থিওডোর নামে তাদের দুই পুত্রসন্তান রয়েছে। কলিন, এলিজাবেথ, চেস্টার ও ট্রুম্যান এ চার সন্তানের পিতা হিসেবে নিজেকে সবসময় গর্বিত বলে দাবি করেন টম।
রিটাকে জীবনসঙ্গিনী বানানোতে টমের জীবনে যে শুধু মানসিকভাবে পরিপূর্ণতা এসেছিলেন তা নয়। রিটাকে তিনি আত্মিকভাবে আপন করে নেওয়ার পাশাপাশি তার ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতিতেও নিজের করে নিয়েছিলেন। রিটা হলেন একজন গ্রিক ও বুলগেরিয়ান বংশোদ্ভূত। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানও গ্রিক অর্থোডক্স চার্চে গ্রিক রীতিতে সম্পন্ন হয়৷ বিয়ের পর থেকে টম নিয়মিত গ্রিক চার্চে যাওয়া শুরু করেন।
এ বছর গোল্ডেন গ্লোবের আসরে স্ত্রীসহ, চার সন্তানকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। গ্লোব তার হাতে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার হিসেবে সেসিল বি ডিমাইল অ্যাওয়ার্ড তুলে দিলে, মঞ্চেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন টম।
পুরস্কার হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়েই স্ত্রী ও সন্তানদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন,
“এভাবে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে এখানে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।”
আমেরিকার পিতার জন্ম
আজ প্রায় ৪৫ বছর ধরে স্বনামে চলে আসা আমেরিকান লেট নাইট লাইভ টিভি শো ‘স্যাটারডে নাইট লাইভ’ ( এসএনএল) এর নাম তো কমবেশি সবারই শুনে থাকার কথা। এনবিসির এ শো’টিতে নানা ধরনের বিনোদনধর্মী মাধ্যমকে একই প্ল্যাটফর্মে সাজিয়ে দর্শকদের সামনে মেলে ধরা হয়। এসএনএল এর মঞ্চে এখন পর্যন্ত নয়বার উপস্থাপক হিসেবে হাজির হওয়া টমকে দিয়ে এ অনুষ্ঠানের বিশেষ একটি ক্লাবের সূচনা হয়েছিল।
১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো এসএনএল মঞ্চে পা রাখার প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় অনুষ্ঠানে পঞ্চমবারের মতো আমন্ত্রিত হন তিনি। এরপর থেকে এসএনএল এর আয়োজন কতৃপক্ষ পাঁচ বার বা তার বেশি যে শিল্পীরা এ অনুষ্ঠানের মঞ্চে পা রেখেছেন, তাদেরকে ফাইভ টাইমার্স ক্লাবের অন্তর্গত সদস্য বলে বিশেষ সম্মান দেওয়ার প্রচলন শুরু করে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকান মেন’স ম্যাগাজিন ‘এস্কোয়ার’ তাকে ‘আমেরিকা’স ড্যাড’ খেতাবে ভূষিত করার পর অক্টোবরে এসএনএল এর মঞ্চে নবমবারের মতো উপস্থিত হোন তিনি। আর সে সময়ে পুরো আমেরিকা জুড়ে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে একটা উদ্বেগ বিরাজমান ছিল। কিন্তু এসএনএল এর সে পর্বের স্বাগত ভাষনে টমের এমন হাস্যরসাত্মক কিন্তু প্রশান্তিমূলক বাণী শুনে যেন আমেরিকান নাগরিকদের মনে যেন নতুন করে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল।
টমের সেদিনের কথাগুলো এমন ছিল,
“সাম্প্রতিককালে একটা ম্যাগাজিন আমাকে ‘আমেরিকা’স ড্যাড’ বলে আখ্যায়িত করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে আবেদনময়ী পুরুষ বললে বেশি খুশি হতাম, তবে এটাও চলবে।”
শুধু এটুকুই নয়৷ তারপর তিনি নিজের গায়ের স্যুট খুলে একটা সাদামাটা ঘরোয়া সোয়েটার পরে বাবার মতো হাবভাব নিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। নিজের দেশকে সন্তানসুলভ ভেবে নিয়ে এরপর তিনি যে কথাগুলো বললেন শুধু যেকোনো আমেরিকান নাগরিকই নয়, যেকোনো জাতিই তা শুনে নিজের দেশ নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে বাধ্য।
টম বলতে শুরু করেন যে,
“হে বন্ধু! আমার সাবালক জাতি। কী খবর তোমার, বৎস? সময়টা কঠিন যাচ্ছে, না? জানি আমি। তোমার উপর দিয়ে অনেককিছু যাচ্ছে৷ ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি উদ্বিগ্ন, ভীত ও অনিশ্চিত বুঝতে পারছি। তাহলে শোনো, কিচ্ছু হবে না তোমার।
মনে আছে, তুমি যখন সেই হতাশার মধ্যদিয়ে দিন পার করছিলে? এটা তো কিছুই না। তুমি বেড়ে উঠছো, আর বয়সের এ ধাপটাই এমন জটিলতায় জর্জরিত।”
আমেরিকা সম্পর্কে আরও কিছু বাস্তব তথ্য তিনি এমনভাবে পরিবেশন করেছিলেন যে হাসিতে মেতে উঠার পাশাপাশি নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে আমেরিকানরা৷
আর এভাবেই, সিনে জগতের দেবদূততুল্য এ মানুষটা আমেরিকার পিতা ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
টম হ্যাঙ্কস হলিউড সাম্রাজ্যের রাজসভার কোন পদের অধিকারী, তা নিয়ে হিসাবকিতাব কষতে যাচ্ছি না৷ শুধু একজন ভক্ত হিসেবে তিনি যেন আরও কয়েক দশক ধরে হলিউড সাম্রাজ্যকে নিজের বিশালতা দিয়ে মাথা উঁচু করে তুলে ধরতে পারেন এ কামনাই করি।