দেখতে দেখতে চোখের পলকে দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেলো। এক বছর আগের ঠিক এরকম একটি দিনেই মৃত্যু হয়েছিলো বিখ্যাত ‘টাইফয়েড মেরি’র। অথচ মনে হচ্ছে এই সেদিন মেরির মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন তিনি।
এই ‘তিনি’ হচ্ছেন জর্জ সপার। টাইফয়েড মেরির মতো বিস্ময়কর এক মানবীর সন্ধান লাভের মাধ্যমে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন বিজ্ঞানীমহলে। এই আবিষ্কার তাকে এনে দিয়েছে অসামান্য খ্যাতি আর সম্মাননা। অথচ কেন জানি আজকের সন্ধ্যায় সবকিছুই অনর্থক মনে হচ্ছে। তিনি কি কোনো ভুল করলেন?
এই দ্বিধা থেকেই যেন তিনি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। দরকারি কাগজে ঠাসা ড্রয়ার হাতরে খুঁজে বের করলেন ব্যক্তিগত নথিপত্র। অনেকদিন ধরে পরিত্যক্ত থাকায় সেটার একপাশ উইপোকার অত্যাচারে মরে গেছে। বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে কলম হাতে নিলেন। শখের সোনালি ফ্রেমের চশমাখানা চোখে দিয়ে সাদা কাগজে লেখা শুরু করলেন,
“৩২ বছর আগে আমি প্রথম মেরিকে দেখি। হিসাব করলে সালটা দাঁড়াবে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে। তখন তার বয়স ছিল ৪২ বছর। দেখলে মনে হয় সে সবসময় রেগে আছে। যেকোনো মুহূর্তে তেড়েফুঁড়ে আসবে আমার দিকে। প্রায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির মতো লম্বা মেরির গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার ছিল”।
এতোটুকু লেখার পর থামলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে মেরির কথা মনে করার চেষ্টা করলেন। এরপর ফের লেখা শুরু করলেন,
“মেরি শারীরিক দিক থেকে বেশ শক্ত সামর্থ্যবান। এটা স্রেফ কথার কথা না। আমার তো মনে হতো ওকে যদি একবার খেলার মাঠে নামিয়ে দেয়া যায়, খুব সহজেই বাজিমাত করে ফেলবে। সে নিজেও এব্যাপারে বেশ গর্ববোধ করতো। তবে ওর ভালোবাসার জায়গাটুকু রান্নাঘরের চার দেয়ালে সন্তুষ্ট ছিল। তাই তেমন আফসোস ছিল না। ওর আরেকটা চমৎকার গুণ ছিলো। ও বেশ গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারতো। সামান্য কয়েক পাতা পড়লে মনেই হবে না এটা কোনো বাবুর্চির হাতে লেখা।”
এতটুকু লিখেই হাঁপিয়ে উঠলেন সপার। নিজের উপর রাগ লাগতে লাগলো। চোখের চশমাখানা খুলে হাতে নিয়ে ডানদিকের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অদূর আঁধারের মধ্যে হঠাৎ করে মেরির অবয়ব ভেসে উঠলো। মাংস কাটার বড় ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চোখ মুখ রাগে অগ্নিশর্মা। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুরি ঘুরিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠলো সে, “আর এক পা সামনে আসলে খুন করে ফেলবো। তোমরা কেউ সামনে আসবে না। আমার গায়ে কোনো রোগ নেই। আমি অভিশপ্ত না! খবরদার বলছি!”
উপরের উল্লিখিত ঘটনাটুকু জর্জ সপারের ব্যক্তিগত নথিপত্র থেকে উদ্ধার করা। ‘টাইফয়েড মেরি’ নামে পরিচিত এক নারীর সন্ধান লাভের মাধ্যমে তিনি সবার নজরে চলে আসেন। আসলে কে ছিলেন এই টাইফয়েড মেরি? কেনই বা তার নামের সাথে জুড়ে দেয়া হলো টাইফয়েডের মতো একটি রোগের নাম? এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সাজানো আমাদের আজকের লেখাটি।
টাইফয়েড মেরি
‘টাইফয়েড মেরি’র আসল নাম মেরি মেলোন। তিনি ১৮৬৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর উত্তর আয়ারল্যান্ডের কুকসটাউন নামক এক দরিদ্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আশৈশব দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন মেরি। দু’বেলা পেট পুরে খাওয়ার সন্ধানে কাজে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু তার ভাগ্য সহায় হলো না। এ দ্বার থেকে ও’ দ্বার ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত হার মানলেন তিনি।
তিনি বুঝতে পারলেন, আয়ারল্যান্ডে আটকে থাকলে তাকে না খেয়ে মরতে হবে। তাই সুযোগ বুঝে ১৮৮৩ সালে সপরিবারে পাড়ি জমান স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বের বুকে নতুন পরাশক্তি হিসেবে জেগে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র তখন হাজারো অভিবাসীর আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলো। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নিউইয়র্কের ব্যস্ত বন্দর দেখে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন মেরি মেলোন।
হাজারো কর্মজীবী মানুষের মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তার চোখের সামনে হাতছানি দিতে থাকে নতুন ভবিষ্যত।
নিউইয়র্কের নতুন জীবনে বেশ সহজেই খাপ খাইয়ে নেন তিনি। খুব দ্রুত রান্না করাও আয়ত্ত করে নেন। এছাড়াও টুকটাক ঘরের কাজ শিখে নেন। তৎকালীন অভিবাসী নারীদের অনেকেই শহরের বড় বড় বাসায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন। মেরি সে পথেই পা বাড়ালেন। কিন্তু মেরি মানুষ হিসেবে বেশ জেদি ছিলেন। ফলে যা হবার তা-ই হলো। প্রায়ই মালিকের সাথে ঝগড়া লেগে যেত তার।
কয়েক বছরের মাথায় তিনি চাকরিচ্যুত হতেন। এরপর ফের নতুন কর্মস্থলে চাকরি নিতেন। সেখানেও কয়েক বছরের বেশি টিকতেন না। তবে মেরি রান্না করতে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। তাই হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি বিচলিত হতেন না।
এককথায়, আর বাকি দশজন মানুষের মতোই মেরির জীবন কেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু মেরির জীবনের কালো অধ্যায়ের সূচনা হয় এর বেশ কিছুদিন পরেই।
মেরি মেলোনের ‘টাইফয়েড মেরি’ হয়ে উঠা
টাইফয়েড জ্বর বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ রোগ। Salmonella typhi নামক এক ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হচ্ছে, এই রোগ মারাত্মক ছোঁয়াচে। তাহলে মেরি মেলোনের সাথে এই টাইফয়েডের সম্পর্ক কোথায়? তার কি টাইফয়েড হয়েছিলো?
মেরি মেলোনের দেহ টাইফয়েড রোগের জীবাণু ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। কিন্তু ঠিক কখন এবং কীভাবে এই ব্যাকটেরিয়া তার দেহে প্রবেশ করেছিলো সে সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেরি মেলোন টাইফয়েড জীবাণু বহন করলেও তার দেহে টাইফয়েডের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। ফলে তিনি টাইফয়েডের একজন সক্রিয় বাহক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
মূলত মেরির দেহের অসাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণেই তার দেহে টাইফয়েডের প্রভাবমুক্ত ছিল। মেরি মেলোন খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষের মাঝে টাইফয়েড জীবাণু ছড়াতে থাকেন। মেরি মেলোন নিজেও জানতেন না তার এই বৈশিষ্ট্যের কথা। নিউইয়র্কে সেবার টাইফয়েড মহামারী আকারে দেখা দেয়। সবার অগোচরে প্রায় ৫১ জন মানুষের দেহে টাইফয়েড ছড়িয়ে দেন মেরি! সেই ৫১ জনের দ্বারা আরো হাজার হাজার মানুষ টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
এদের মাঝে তিনজনের মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া যায়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ জন লোক টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন, যাদের বাসায় মেরি মেলোন স্বল্প সময়ের জন্য হলেও গৃহপরিচারিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সাধারণ গৃহপরিচারিকা মেরি মেলোন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন গুপ্তঘাতক ‘টাইফয়েড মেরি’! অন্যান্য দুর্ধর্ষ ঘাতকের ন্যায় ছুরি বন্দুকের ব্যবহার তিনি করেন না। তার প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠে ‘টাইফয়েড জীবাণু’।
জর্জ সপারের অভিযান
নিউইয়র্কের ঘরে ঘরে টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়ে। বাদ পড়েনি প্রভাবশালী পরিবারগুলোও। কিন্তু এতদিন সবাই টাইফয়েডকে গরিবের রোগ হিসেবে জানতো। ধনী পরিবারে টাইফয়েডের বিস্তারে অভিজাত শ্রেণীর কপাল কুঁচকে গেলো। এবার বুঝি আর রক্ষা নেই!
১৯০৬ সালের কথা। ধনকুবের চার্লস ওয়ারেনের ওয়েস্টার বে’র বড় বাড়ির ভাড়াটেদের ১১ জনের মধ্যে ৬ জনই টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ওয়ারেন এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাড়ির সদস্যদের অসুস্থতার বাইরেও তার চিন্তার আরো কারণ ছিল। এই ঘটনার পর আর কখনো এই বাড়ি ভাড়া নিতে কেউ রাজি হবে কি না তা নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। তিনি জর্জ সপার নামক এক শৌখিন গবেষককে ডেকে পাঠান।
জর্জ সপার পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও তিনি টাইফয়েড মহামারী নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি বাড়ির বিভিন্ন পানির উৎসের নমুনা নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোথাও টাইফয়েডের জীবাণু খুঁজে পেলেন না। সপার হিসাব মিলাতে পারছিলেন না। অসহায় সপার একটা সময় প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তখন তার মেরির সাথে পরিচয় হয়। সপার লক্ষ্য করলেন, বাড়ির অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হলেও মেরি দিব্যি সুস্থই আছেন। কৌতূহলবশত তিনি মেরির ইতিহাস ঘাঁটা শুরু করেন। মেরি মেলোন গত সাত বছরে প্রায় ছয় বাড়িতে কর্মরত ছিলেন এবং প্রতিটি বাড়ির সদস্যরাই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলো। কিন্তু মেরি কখনও অসুস্থ হননি।
সপার এবং তার দলের সদস্যরা আরো কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে মেরিই এই মহামারীর মূল হোতা। কিন্তু মেরি এই ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে পারলেন না। সপার মেরিকে অনুরোধ করলেন যেন তাকে পরীক্ষা করার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু মেরি ভয় পেয়ে গেলেন। মেরির অপারগতা এবং একগুঁয়েমির কারণে অবস্থা বেগতিক হয়ে যায়। নিউইয়র্ক আদালত তাকে আটক করার নির্দেশ প্রদান করে। শেষপর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় কয়েক দফা ধ্বস্তাধ্বস্তির পর মেরিকে বন্দি করা হয়।
ততদিনে নিউইয়র্কের কাকপক্ষী পর্যন্ত মেরির ব্যাপারে জেনে গেছে। এদিক ওদিক নানা রটনায় বাতাস ভারি হয়ে যায়। সবার আলোচনায় শুধু ‘টাইফয়েড মেরি’।
আমিও মানুষ!
টাইফয়েড মেরিকে গ্রেপ্তার করে নর্থ ব্রাদার নামক একটি দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। মেরি এই অমানবিক সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। সেখানে তার একমাত্র সঙ্গী ছিল একটি কুকুর। দিনলিপির পাতায় শুধু একটি বাক্যই লেখতেন তিনি, “আমি কেন এখানে? একটি কুকুর ছাড়া আর কেউ নেই কেন আমার সাথে?”
বন্দি অবস্থায় মেরি তার আইনজীবীর মাধ্যমে বিভিন্ন আইনী কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেন। নিউইয়র্কের একটি বেসরকারি গবেষণায় মেরির সাথে টাইফয়েডের সরাসরি সম্পৃক্ততা ভুল প্রমাণিত হয়। এই প্রতিবেদনকে পুঁজি করে মেরি আপিল করেন। কিন্তু নিউইয়র্কের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই প্রতিবেদন বাতিল করে দেয়। আপিলের পরেও তাকে মুক্তি দেয়া হয়নি। সবাই যেন হঠাৎ করে ভুলে গেলো যে মেরিও একজন মানুষ!
১৯১১ সালে নতুন কমিশনার নিয়োগ লাভ করার পরে ব্যাপারটি নতুন করে উত্থাপন করা হয়। তিনি মেরির মানবিক দিক বিবেচনা করে মুক্তি দেয়ার পক্ষে ভোট দেন। কিন্তু তাকে একটি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। মেরি আর কখনোই রান্নাঘরে কাজ করতে পারবেন না। মেনে নেন মেরি। নতুন করে নিউইয়র্কের মাটিতে পা রেখে বুকভরে শ্বাস নিলেন মুক্ত মেরি।
ম্যানহ্যাটনের মেরি ব্রাউন
এরপরের ঘটনা ১৯১৫ সালের দিকে ঘটে। ম্যানহ্যাটনের একটি হাসপাতালে প্রায় ২৫ জন কর্মী টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে ২ জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নতুন করে টাইফয়েড মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। গবেষকদল বিভিন্ন সূক্ষ্ম পরীক্ষার পর নিশ্চিত হলেন, এই রোগের জন্য দায়ী হতে পারে হাসপাতালের বাবুর্চি। কে সেই বাবুর্চি?
রেকর্ড বুক ঘেঁটে নাম পাওয়া গেলো ‘মেরি ব্রাউন’। নাম শুনেই খটকা লাগলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। তারা মেরি ব্রাউনের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। মেরিকে দেখার পর কমিশনার যেন আকাশ থেকে পড়েন। কারণ মেরি ব্রাউনই সেই ‘টাইফয়েড মেরি’!
তিনি বুঝতে পারেন যে, মেরি নিজেও একজন মানুষ। তাকে তার ভালোবাসার কাজ থেকে আলাদা করে রাখা সম্ভব না। তিনি হতাশ হয়ে পুনরায় মেরিকে আটকের নির্দেশ দেন। তাকে পুনরায় নির্বাসনে প্রেরণ করা হয়। আর কখনো মেরি মুক্ত হননি।
মুদ্রার ওপিঠ
মেরি তার জীবদ্দশায় কখনও নিজেকে টাইফয়েডের বাহক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করতেন তার মাঝে অন্য কোনো মারাত্মক অভিশাপ বিদ্যমান আছে। এজন্য তিনি বেশ কয়েকবার নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করেন।
একদিক থেকে বিবেচনা করলে মেরি একজন ভয়ংকর টাইফয়েড বাহক। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠ বলছে তিনি একজন সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। তিনি তার জীবনে কখনো টাইফয়েড রোগে ভোগেননি। এমনকি স্বল্পমাত্রায় কোনোরূপ লক্ষণও প্রকাশ পায়নি।
একটা সময় প্রশ্ন উঠেছিলো যে, “মেরি কি কখনো স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন?” তিনি ইচ্ছা করলেই পারতেন। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যেন খাবার রান্না করার সময় এবং পরিবেশনকালে ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, তিনি সে নির্দেশ মানতেন না।
আরেকটি প্রশ্ন উঠেছিলো যে, “খাবার রান্না করার তাপমাত্রায় টাইফয়েড জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে না। তাহলে কীভাবে মেরি খাবারের মাধ্যমে টাইফয়েড জীবাণু ছড়াতেন?” এই রহস্যের সমাধান করেন জর্জ সপার। তার মতে, মেরি আইসক্রিম তৈরি করতে ভালোবাসতেন। প্রিয় আইসক্রিমের মাধ্যমেই তিনি টাইফয়েড ছড়াতেন।
নিঃসঙ্গতার ছাব্বিশ বছর
ম্যানহ্যাটনে গ্রেপ্তার হবার পর তাকে পুনরায় নর্থ ব্রাদারে নির্বাসিত করা হয়, যেখানে তিনি পূর্বে প্রায় তিন বছর নির্বাসিত ছিলেন। দেখতে দেখতে তিন বছর চলে গেলো। তার মুক্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা দিলো না। মেরি প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন। এরপর অপেক্ষা করাও যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। প্রতিটা মুহূর্ত তাকে কষ্ট দিতে লাগলো। তিনি অপেক্ষা করা বন্ধ করে দিলেন। নির্বাসনকেই আপন করে নিলেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি রান্না করার অনুমতি পান। কিন্তু সেটা শুধু নিজের জন্য।
মেরির মতো জীবাণু বাহক হয়তো লাখে একজন। হয়তো আমাদের মাঝেই কেউ কেউ এরকম বাহক হিসেবে বেঁচে আছেন। কিন্তু সবার উপরে মানুষ সত্য। তাদেরও বেঁচে থাকতে ইচ্ছা হয়। হয়তো বর্তমান যুগের ন্যায় উন্নত প্রযুক্তির অভাবই মেরির মানবেতর জীবনের জন্য দায়ী। জর্জ সপার জীবনের শেষদিকে অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই মেরিকে খলনায়ক হিসেবে আবির্ভূত করেছে। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় দফায় ২৩ বছরের দীর্ঘ একাকিত্ব শেষে ১৯৩৮ সালের ১১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন মেরি মেলোন ওরফে টাইফয়েড মেরি। মৃত্যুর মাঝে যেন মুক্তি খুঁজে পেলেন মেরি। মাত্র নয়জন বন্ধুর সমাবেশে শেষকৃত্যের আয়োজন করা হয়। তার নিঃসঙ্গ জীবন যেন এর মাধ্যমে বেশ করূণভাবে প্রতিফলিত হলো শেষবারের মতো।