দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র একরাশ ধুলা এসে জর্জ অরওয়েলের মাথার উপর পড়লো। কিন্তু তিনি বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না। বছরের পর বছর ধরে ফেলে রাখা এই কুটিরের প্রতিটি প্রাঙ্গণে মানুষের অনুপস্থিতির প্রমাণস্বরূপ রাশি রাশি ধুলা জমে স্তুপ হয়ে আছে। বন্ধুর দুরাবস্থা দেখে দ্রুত সাহায্যে এগিয়ে আসলেন ডেভিড অ্যাস্টর। নিজের রুমাল দিয়ে অরওয়েলের মাথা পরিষ্কার করে দিলেন। জর্জ অরওয়েল ধুলার আক্রমণে কেশে উঠলেন। কিছুক্ষণ অনবরত কাশির কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তিনি।
বছর ধরে পিছু লেগে থাকা যক্ষ্মার সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকা শুকনো মানুষটি ক্ষণে ক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও একদম হাল ছেড়ে দিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবে বিশ্রাম নেওয়ার পর সাংবাদিক বন্ধু অ্যাস্টরের সাহায্যে পুরো ঘর সাফ করে ফেললেন। তারপর বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে চামড়ার ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজ-কলম এবং শখের টাইপ রাইটার বের করে চলে গেলেন কুটিরের দক্ষিণের বারান্দায়।
পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমাকাশে অলসভাবে হেলে পড়া সূর্যের নরম আলো কুটিরের বারান্দায় ছড়িয়ে পড়ছিলো। চারদিকে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। শুধু দূর থেকে ভেসে আসা নাম না জানা পাখির মিষ্টি কিচিরমিচির এক অসম্ভব সুন্দর পরিবেশের জন্ম দিয়েছে। অরওয়েল তার পকেটে রাখা রুমাল বের করে সেটা দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। এরকম পরিবেশই তিনি চেয়েছিলেন। এখানে তাকে বিরক্ত করার কেউ নেই। নতুন একটি বই লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জর্জ অরওয়েল। টাইপ রাইটারের বর্ণমালাগুলো অলস ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ দশটি আঙুলের ঝড়ো আক্রমণে তা ধাতব ধ্বনিতে জেগে উঠলো। পরিষ্কার সাদা কাগজের উপর কালো কালির হরফে ফুটে উঠতে থাকলো এক কালজয়ী উপন্যাস। মুহূর্তের মধ্যে দু’পাতা লিখে ফেললেন। নতুন পৃষ্ঠায় অরওয়েল পুনরায় লেখা শুরু করলেন,
“War is peace
Freedom is slavery
Ignorance is strength”
“যুদ্ধই শান্তি, মুক্তি মানে দাসত্ব, অজ্ঞতাই বল”- চোখের সামনে ভেসে ওঠা এক সংগ্রামী অধ্যায়কে কাল্পনিক উপন্যাসের সুচারু বুননে গড়ে তুলতে লাগলেন তিনি। ১৯৪৬ সালের এক সুন্দর বিকেলে এভাবেই জর্জ অরওয়েল তার বন্ধু ডেভিড আস্তরের স্কটল্যাণ্ডের কুটিরে এক নতুন যুগ বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব হাতে নেন। ‘থট পুলিশ’, ‘বিগ ব্রাদার’, ‘ডাবল থিঙ্ক’-এর মতো বহু নতুন ধারণার জন্ম নেয় জর্জ অরওয়েলের কাল্পনিক যুগে। আর সেই অন্ধকার ভীতিকর যুগকে সাহিত্যিকগণ নাম দেন ‘অরওয়েলিয় যুগ’ হিসেবে। এই অসামান্য কীর্তির কারিগর হিসেবে সাহিত্য জগতে অমর হয়ে আছেন জর্জ অরওয়েল।
জর্জ অরওয়েল
“একাকী অসহায় শিশুর মতো আমিও গল্প বানাতাম। ধীরে ধীরে তা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কাল্পনিক বন্ধুদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলতাম। আমি মনে করি, আমার সাহিত্যের শুরুতে মিশে আছে সবার থেকে আলাদা হয়ে একা বাস করা এক শিশুর মিশ্র অনুভূতি।”
জর্জ অরওয়েল তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে নিজেকে এভাবেই তুলে ধরেছিলেন। অনেকের কাছে তিনি ছিলেন বিস্ময় বালক। চার বছর বয়সে যখন সবাই পাড়ার রাস্তায় অন্যান্য ছোকড়াদের সাথে মার্বেল খেলছিলো, ঠিক তখন জর্জ অরওয়েল তার প্রথম কবিতা লিখে ফেলেন। যেন লেখালেখির জন্যই তার জন্ম। ১৯০৩ সালের ২৫ জুন ভারতবর্ষের মতিহারি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার নাম রাখা হয় এরিক আর্থার ব্লেয়ার। পাঠকদের নিকট তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও বিশ্ব রাজনীতির প্রাঙ্গনে তার প্রচুর নামডাক ছিল। সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং সাম্যবাদী সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন তিনি।
জন্মের পর সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে এক বছর বয়সে ইংল্যাণ্ডে ফেরত পাঠানো হয় শিশু ব্লেয়ারকে। কিন্তু পিতা ভারতবর্ষে থেকে যান। তাই শৈশব থেকেই পিতা ও সন্তানের মাঝে সামান্য ব্যবধান সৃষ্টি হয়। আর ব্লেয়ার বড় হতে থাকেন একজন অসুস্থ শিশু হিসেবে। ব্রঙ্কাইটিস এবং ফ্লু-এর কবলে পড়ে প্রায়ই তার স্কুল কামাই দিতে হতো। এগার বছর বয়সে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি লেখালেখির প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। কিন্তু সুশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইটন স্কুলে ভর্তি হলে কবিতা লেখার আগ্রহে ভাঁটা পড়ে যায়।
স্কুলজীবন শেষে ১৯২২ সালে তিনি ভারতবর্ষে পাড়ি জমান। সেখানে পুলিশের চাকরি নেন তিনি। মাত্র ৫ বছরেই ক্লান্ত হয়ে ইংল্যাণ্ড ফিরে আসেন তিনি এবং লেখালেখিতে মন দেন। দুর্ভাগ্যবশত এখানেও তিনি ব্যর্থ হন। তাই পুনরায় সামরিক জীবনে ফিরে যান। স্পেনে গৃহযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৩৮ সালে প্রাণঘাতী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন তিনি। জীবনের বাকি সময় এই রোগের সাথে যুদ্ধ করে কাটান তিনি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একজন মুখপাত্র হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু যার জন্মই হয়েছিলো লেখালেখির জন্য, তার কি যুদ্ধক্ষেত্রে মন টেকে? বেশ তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে নিয়ে ১৯৪৩ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন,
“আমার নিজের সময় আর সরকারের অর্থ, দুটোই বিনা হিসেবে নষ্ট করছিলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছিলাম না। ব্রিটিশদের রাজনৈতিক চালগুলো সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু না।”
এবার যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নতুন করে কলম তুলে নেন তিনি। নতুন কিছু শুরু করতে চাই নতুন কিছু উদ্দীপনা। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি তার নতুন নাম ব্যবহার করা শুরু করেন,‘জর্জ অরওয়েল’। এই যাত্রায় দাপটের সাথে সাহিত্য জগতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেন অরওয়েল। একের পর এক পাঠক সমাদৃত উপন্যাস, গল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত প্রহসন উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হন জর্জ অরওয়েল। ডিস্টোপিয়া কিংবা অন্ধকার সমাজের বার্তাকে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করতে পটু অরওয়েল এখানেই থেমে গেলেন না। ১৯৪৬ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন আরো একটি উপন্যাস রচনার। অরওয়েলের ‘ম্যাগনাম অপাস’ হিসেবে পরিচিত এই নতুন উপন্যাসটির নাম ছিল ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’।
নাইন্টিন এইটি ফোর
“এপ্রিল ৪, ১৯৮৪”। ভাঙা অক্ষরে নতুন ডায়েরির পাতায় তারিখ লেখলেন ‘আউটার পার্টি’র সদস্য উইন্সটন স্মিথ। সত্য মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড বিভাগে কর্মরত উইন্সটনের জীবন অত্যন্ত সাদামাটা। কর্মক্ষেত্রে সরকারি নথিপত্র সংশোধন এবং পুনর্লিখনের কাজ তদারকি করতে করতে দিন কেটে যায় তার। এভাবে দিনের পর দিন ইতিহাসকে নিজের হাতে ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন। কিন্তু সবকিছুই সর্বক্ষমতার অধিকারী ‘বিগ ব্রাদার’দের নির্দেশে করছেন। কাজে ফাঁকি দেয়ারও কোনো উপায়। কারণ এক প্রমাণ আকারের টেলি পর্দা সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখছে। অফিস, বাসা-বাড়ি, ক্যাফেটেরিয়া, পথঘাট সর্বত্র নজর রাখছে সেই পর্দা। তাদের নজরদারি থেকে কারো রেহাই নেই। কেউ যেন ব্যাপারটি ভুলে না যায়, এজন্য সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়- ‘Big Brother is watching you’।
বিগ ব্রাদার তোমার উপর নজর রাখছেন, তাই সাবধান! পুরো পৃথিবী তখন তিন ভাগে বিভক্ত। ওশেনিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং ইউরেশিয়া নামক তিনটি সাম্রাজ্য একে অপরের সাথে বছরের পর বছর ধরে এক অমীমাংসিত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ওশেনিয়ার সর্বক্ষমতার অধিকারী বিগ ব্রাদাররা জনগণকে মুক্ত চিন্তা এবং বুদ্ধিবিকাশ থেকে বিরত রেখে এক পঙ্গু মানব সমাজের জন্ম দিয়েছে। এমনকি মুক্তচিন্তা করাও ছিল মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো গুরু অপরাধ। শহর জুড়ে টহল দিচ্ছে Thought Police বা চিন্তা দমনকারী পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ। এমন অন্ধকার অভিশপ্ত সমাজে টিকে থাকতে হলে চিন্তা-যুক্তি বাদ দিয়ে অন্ধের মতো বিগ ব্রাদারদের নির্দেশ মান্য করার কোনো বিকল্প নেই। হয়তো উইন্সটনও তাই চেয়েছিলেন।
কিন্তু তার এই আশা পূরণ হলো না। ধীরে ধীরে বিষিয়ে যেতে থাকে তার মন। এভাবে আর কয়দিন বেঁচে থাকা যায়? বিগ ব্রাদারদের এই স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন তিনি। তখন তিনি ডায়েরি লেখা শুরু করেন। বিগ ব্রাদারদের টেলি পর্দার নজর থেকে ডায়েরিকে আড়াল করে রাখতেন তিনি। ধরা পড়লে যে রক্ষা নেই! এভাবে শুরু হয় এক নতুন উইন্সটনের জীবন।
নতুন জীবনের শুরুতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কল্প মন্ত্রণালয়ের জুলিয়া নামক এক নারীর সাথে প্রণয় হয় তার। বদ্ধ সমাজ ব্যবস্থায় জুলিয়া যেন সামান্য অবকাশের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছিলো তার জীবনে। জুলিয়াও তার মতো বিদ্রোহী ছিল। ধীরে ধীরে উইন্সটন আরো গভীর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তারপর থেকে ঘটতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর সব ঘটনা। উপন্যাসের প্রতিটি পাতা পাঠকদের উদ্বিগ্ন করে রাখে। সবার মনে একই প্রশ্ন– “উইন্সটনরা পারবেন তো? পতন ঘটাতে পারবেন এই বিগ ব্রাদারদের?”
দুই যোগ দুই সমান পাঁচ
উইন্সটন স্মিথের স্মৃতি থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরাশক্তি রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলো ইউরোপে একে অপরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বইয়ের সময়কাল অনুযায়ী সেটা ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ঘটে। যুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের ফলে যুক্তরাজ্যের বড় শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। বিভিন্ন সংকটের মুখে ব্রিটেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইংরেজ সমাজতান্ত্রিক পার্টি (সংক্ষেপে Ingsoc) ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আমেরিকান দেশগুলোর সাথে মিলে গড়ে উঠে ওশেনিয়া নামক শক্তিশালী রাষ্ট্র। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপের দখল নিয়ে গড়ে তোলে ইউরেশিয়া। আর তৃতীয় পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় পূর্ব এশিয়া। এই তিন মহারাষ্ট্র অন্যান্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো দখল করার নিমিত্তে একে অপরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যে যুদ্ধের কোনো ফলাফল ছিল না।
এই যখন বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা, তখন দেশগুলোর অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে এক অসম সমাজ ব্যবস্থা। ওশেনিয়ার জনগণ তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন; দলের অভ্যন্তরীণ সদস্যবৃন্দ (Inner Party), কর্মজীবী সমাজ (Outer Party) এবং সবশেষে শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী (Prole)। সেই সমাজে ইনার পার্টির সদস্যগণ ছিলেন শতকরা দুই ভাগ। আউটার পার্টির ১৩% এর বিপরীতে প্রায় ৮৫% মানুষের শ্রমজীবী সমাজ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ক্ষমতাসীন দল ৪টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনগণকে কুক্ষিগত করে রাখতো। এমনকি বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসও বদলে ফেলতে পিছপা হয়নি তারা। হাস্যকর হলেও সত্য যে, তারা হেলিকপ্টার, বিমান এবং ট্রেনসহ বিভিন্ন যুগান্তকারী আবিষ্কারের পেছনে বিগ ব্রাদারদের ভূমিকা আছে বলে দাবি করতো। ওশেনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে লাগানো হয় বিগ ব্রাদারদের ঘৃণ্য মূলনীতি– ‘War is peace, Freedom is slavery, Ignorance is strength’।এমনকি ‘দুই যোগ দুই সমান পাঁচ’ এমন উদ্ভট মিথ্যাকে মেনে নিতে বাধ্য করা হতো এর সাধারণ জনগণকে। এমনকি সাধারণ ভাষার বদলে ‘নিউ স্পিক‘ নামক সংক্ষেপিত ভাষার প্রচলন করা হয়। এর মাধ্যমে উঠে আসে ‘ডাবল থিঙ্ক’-এর মতো কালজয়ী কিছু শব্দ।
অনুপ্রেরণায় তিক্ত অভিজ্ঞতা
১৯৩৮ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন জর্জ অরওয়েল। কিন্তু তৎকালীন সমাজে যক্ষ্মার উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। তাই সাধারণ বিশ্রাম এবং উন্নতমানের আহারের মাধ্যমে অরওয়েলকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করার হয়। বেশ কয়েক মাস হাসপাতালের বিছানায় বন্দী জীবন কাটানোর পর মুক্তি মেলে অরওয়েলের। কিন্তু যক্ষ্মা তখনও তার পিছু ছাড়েনি। এর প্রায় ৮ বছর পর প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রাণবিয়োগে মুষড়ে পড়েন তিনি।
জীবনের এই প্রান্তে এসে এসব তিক্ত অনুভূতিকে পুঁজি করে তিনি পুনরায় কলম হাতে তুলে নেন। শহর ছেড়ে পাড়ি জমান স্কটিশ এক দ্বীপের কুটিরে। নাইন্টিন এইটি ফোরের প্রথম খসড়া তৈরির সময় তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ঘন ঘন জ্বর, ওজন হ্রাস এবং অনিদ্রার ফলে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তাকে পুনরায় হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে কলাপ্স থেরাপি (Collapse Therapy) নামক বিশেষ পদ্ধতিতে তার চিকিৎসা করা হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই থেরাপি প্রয়োগকালীন যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতাকে তিনি তার উপন্যাসে স্থান দেন জেলখানার নির্মম অত্যাচার রূপে। উপন্যাসে উইন্সটনের শীর্ণ দেহের বর্ণনার সাথে জর্জ অরওয়েলের অসুস্থ দৈহিক গড়নের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। সেন্ট এলিজাবেথ মেডিক্যাল সেন্টারের জন রস জানান,
“অরওয়েল নিজে থেকেই তার বন্ধুদের জানিয়েছিলেন, হয়তো তিনি অসুস্থ না থাকলে হয়তো উপন্যাসটি এত বিষণ্ণ হতো না। তার মতে, পুরো কাজটি ছিল বিরক্তিকর এবং হতাশাপূর্ণ! কিন্তু আমার মতে, তার অসুস্থতা যেন তার মধ্য থেকে সেরাটা বের করে এনেছে।”
বাজিমাত ১৯৮৪
১৯৪৯ সালের ৮ জুন প্রকাশিত হয় জর্জ অরওয়েলের সর্বশেষ এবং অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’। ভিক্টর গোলাঞ্জের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি প্রথম বর্ষেই বাজিমাত করে ফেলে। কয়েক লাখ কপি বিক্রি হওয়ার মাধ্যমে তা আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। শুধু যুক্তরাজ্যেই বিক্রি হয় প্রায় ৫০ হাজার কপি। যুক্তরাষ্ট্রে বইটি ‘বুক অব দ্য মান্থ ক্লাব’ হিসেবে নির্বাচিত হয়। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময় পুরো বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধ নামক এক অভিনব রাজনৈতিক যুদ্ধে মেতে উঠেছিলো।
বিশ্লেষকগণের মতে, বইটি বিশ্ব রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের চিন্তাধারায় ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। পুঁজিবাদ এবং সাম্যবাদের মধ্যবর্তী নৈতিক দ্বন্দ্ব চলাকালীন যুগে উপন্যাসটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই উপন্যাসে বর্ণিত ১৯৮৪ সাল যেন এক অদূর ভবিষ্যতের আগাম সতর্কবাণী। এর ব্যাপ্তি ১৯৮৪ ছাড়িয়ে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পাঠকসমাজে দারুণ জনপ্রিয়তা পাওয়ায় উপন্যাসটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। উপন্যাসের কাহিনী অনুকরণ করে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। আর রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রচলিত হয় টোটালিটারিয়ান (Totalitarian ) কিংবা সর্বগ্রাসী সরকার ব্যবস্থার মতো নতুন শব্দ। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন উপন্যাস সম্পর্কে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে।
“কীভাবে উইন্সটন এবং জুলিয়া বিদ্রোহ করলেন, প্রেমে পড়লেন এবং এর খেসারত দিলেন- এসব কিছুর সমন্বয়ে জর্জ অরওয়েল তার সবচেয়ে সেরা কল্পকাহিনীকে তুলে ধরেছেন। অ্যানিমেল ফার্ম এ অরওয়েল সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে প্রহসন করেছেন, কিন্তু নাইন্টিন এইটি ফোর-এ অরওয়েল প্রতিটি হাসির পেছনে প্রকাশ করেছেন প্রচণ্ড হতাশাকে। হয়তো তা ৩৫ বছর পরের বীভৎস পৃথিবীর প্রতি।”
২৫ জানুয়ারি ২০১৭ সালে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বইয়ের বাজারে রে ব্রাডবারির ‘ফারেনহাইট ৪৫১‘, আল্ডোস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ এবং মার্গারেট এটওডের ‘দ্য হ্যাণ্ডমেইডস টেল’ বিক্রির তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাঠকদের চাহিদার প্রথম পছন্দে উঠে আসে জর্জ অরওয়েলের ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’ এর নাম। অনলাইন বিক্রয় কেন্দ্র ‘অ্যামাজন এর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায়ও উঠে আসে এর নাম।
অবাক করা ব্যাপার হলো প্রথম প্রকাশের প্রায় ৭০ বছর পর অরওয়েলিয়ানের নাইন্টিন এইটি ফোর যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই উপলক্ষ্যে পেঙ্গুইন প্রকাশনী এই বইয়ের নতুন ৭৫ হাজার কপি পুনর্মুদ্রণের সিদ্ধান্ত নেয়। তাহলে কি অরওয়েলিয়ান ১৯৮৪ সাল থেকে আমাদের মাঝে চলে এসেছেন? নাকি ইতোমধ্যে তা বিশ্ব রাজনীতিতে ভর করছে অভিশপ্ত আত্মার মতো? এর উত্তর জানতে হলে একবার হলেও এই বইয়ের মাঝে ডুব দিয়ে আসা আবশ্যক।
ফিচার ইমেজ: Revolutionary mind