স্কুলে যেতে কার ভালো লাগে? এমন প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চয়ই খুব বেশি মানুষ হাত তুলবে না। স্কুল নিয়ে আমাদের অনেকেরই নানান বিভীষিকা আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে টিচারের গুরুগম্ভীর কথা শোনা কোনো মজার কাজ নয়। তার উপর আছে কোচিং, পরীক্ষা আর নাম্বারের পেছনে ছোটাছুটি। নিরানন্দ এই শিক্ষাপদ্ধতি একটা শিশুর কাছে কেন আনন্দময় লাগবে? নীরস এই পদ্ধতি কী নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে কত সোনালি শৈশব!
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের হতাশা নতুন না। কিন্তু আমরা কি আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাদের উপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি দিতে পারছি? চেষ্টা হয়তো চলছে। তবে কাজ কতটুকু হচ্ছে?
১৯৮১ সালে জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব তেৎসুকো কুরোয়ানাগির স্মৃতিকথা হিসেবে একটি বই প্রকাশ হয়। যেখানে তিনি নিজের ছেলেবেলার স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। প্রকাশের পরপরই বইটি জাপানে ব্যাপক সাড়া ফেলে, বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় নাম লেখায়। অনেক ভাষায় বইটা অনূদিতও হয়েছে। বাংলায় অনূদিত বইটার নাম “তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি”।
তোত্তোচান সবেমাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে, অথচ এরই মধ্যে স্কুল থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে। তার দোষ ছিল অমনোযোগিতা। শিক্ষিকা যখন পড়াতো সে তখন নিত্যনতুন খেলা খেলতো, পড়া ফেলে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, বাজনাবাদকদের কাছে গান শুনতে চাইতো, পাখিদের সাথে গল্প করতো। পড়া বাদ দিয়ে এসব করলে শিক্ষিকা কেন সহ্য করবে? তাই তাকে বহিষ্কার করা হয় স্কুল থেকে।
দুষ্টু মিষ্টি মেয়ে তোত্তোচান, হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দেয় তার ছোট্ট মাথায়। ছোট্ট তোত্তোচান বড় হয়ে কখনো টিকেট চেকার হতে চায়। কখনো চায় গুপ্তচর হতে। আবার কখনো সে হতে চায় বাজনাবাদক! স্কুল থেকে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। আর থাকবেই বা কেন! সে তো জানেই না তাকে আগের স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে। মনে চাপ পড়তে পারে এই আশঙ্কায় তার মা তাকে বলেননি কথাটা। অথচ এখনকার দিনে ক্লাস-টেস্টের একটা পরীক্ষায় দুই নাম্বার কম পেলে আমাদের অভিভাবকেরা মনে করেন, তাদের বাচ্চার জীবনটাই বুঝি ধ্বংস হয়ে গেলো!
তোত্তোচানের নতুন স্কুলটা ভারী অদ্ভুত। নাম তার “তোমোয়ে গাকুয়েন বিদ্যালয়”। সোশাকু কোবাইয়াশি এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং হেডমাস্টার। তার স্কুলটা ইট-পাথরের দালানে নয়, খোলা আকাশের নিচেও নয়। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, এই স্কুল রেলগাড়ির কামরার মধ্যে! হ্যাঁ, একদম সত্যিকারের রেলগাড়ির মধ্যে! এমন মজার স্কুল কার না পছন্দ হয়ে থাকতে পারে! তাই তো যে তোত্তোচানকে অমনোযোগিতার জন্য স্কুল থেকে তাড়িতে দেয়া হয়েছিল, সেই তোত্তোচানও স্কুলে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকতো।
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা শিশু বাস করে। কালের পরিক্রমায় সেটা আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলি। কিন্তু মিস্টার কোবাইয়াশি সেটা যত্ন করে আগলে রেখেছিলেন নিজের মধ্যে। শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক জগতের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়নি কখনো। তাই পেরেছিলেন এমন গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে তোমোয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে। যেখানে “সমুদ্দুরের কিছু আর পাহাড় থেকে কিছু” দিয়ে টিফিন করা হতো। সবচেয়ে খারাপ, পুরনো কাপড় পড়ে আসতে বলা হতো যেন বাচ্চাগুলো কাদা মেখে, লাফালাফি করে খেলতে পারে। ক্লাসে ছিল না নির্দিষ্ট কোনো বিষয় পড়ার বাধ্যবাধকতা। ফলে দেখা যেতো, একজন হয়তো ছবি আঁকছে, আর অন্যজন পাশে বসে পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে!
মিস্টার কোবাইয়াশি বাচ্চাদের পড়ালেখার মধ্যেই তার স্কুলের সব কাজ সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি তাদের নিয়ে পিকনিক করেছেন, ক্যাম্পিং করেছেন, স্পোর্টসের দিন অদ্ভুত সব খেলার আয়োজন করেছিলেন যেন শারীরিক ত্রুটির জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে না পেরে হীনম্মন্যতায় না ভোগে। পুরস্কার হিসেবে রেখেছিলেন বিভিন্ন সবজি যাতে বাচ্চারা গর্ব করে বাসায় গিয়ে বলতে পারে, “আমার নিজের রোজগার!”
কল্পনার এই স্কুল বাস্তবে করা সম্ভব হয়েছিলো একজন মানুষের জন্য। তিনি সোশাকু কোবাইয়াশি, তোমোয়ে স্কুলের স্বপ্নদ্রষ্টা। অসাধারণ এই শিক্ষাবিদ খুব ভালো করে বুঝতে পারতেন শিশুদের। তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এতটুকু ছাড় দেননি কখনো। আনন্দ এবং স্বাধীনতার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা দিয়েছেন তোমোয়ে স্কুলের সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের।
“তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি” বইতে তেৎসুকো কুরোয়ানাগি ছোট বড় মিলিয়ে অনেকগুলো গল্প বলেছেন। গল্পগুলো সহজ ভঙ্গিতে একটা দুরন্ত বাচ্চার সুরে বলা। যেন সামনে বসে তোত্তোচান নিজেই গল্পগুলো শোনাচ্ছে আমাদের।
বইটি বাচ্চাদের জন্য। তবে যেকোনো পাঠক এই বই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করবে। বইটি একবার হলেও সবার পড়ে দেখা উচিত। বিশেষ করে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের আর যাদের শিক্ষা নিয়ে কৌতূহল আছে তাদের। তোত্তোচান আর তার স্কুলের গল্পগুলো পাঠককে হাসাবে, কাঁদাবে আর শিক্ষাপদ্ধতি ও শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।
এবার আসি অনুবাদের কথায়। আক্ষরিক অনুবাদের একটা চল আমাদের অনুবাদ সাহিত্যে খুব লক্ষ্য করা যায়। এতে করে আর কিছু হোক বা না হোক বইয়ের ভাষা হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য এবং রসহীন। তবে এই বইটির ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ আনা যায় না। ডরোথি ব্রিটন কর্তৃক অনূদিত “তোত্তোচান: দ্য লিটল গার্ল অ্যাট দ্য উইন্ডো” বই থেকে অনুবাদ করেছেন চৈতী রহমান। আক্ষরিক অনুবাদ তিনি করেননি। বরং ভীষণ যত্ন নিয়ে শব্দচয়ন করেছেন এবং বাক্যগুলো সাজিয়েছেন কবিতার মতো করে। ফলে অনুবাদ হয়েছে চমৎকার আর প্রাণবন্ত। ছোট্ট তোত্তোচানকে বিদেশি হিসেবে নয়, আমাদের পরিচিত এক বাচ্চা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন পাঠকদের মাঝে।
কী সুন্দর আর অসাধারণ সব গল্পে ঠাসা জীবন ছিল তোত্তোচান বাচ্চাটার! পড়ার মাঝে বইটি আপনাকে নিয়ে যাবে আপনার মধুর শৈশবে, স্কুলের দিনগুলোতে। আর তোমোয়ে স্কুলের জন্য থেকে যাবে একরাশ দীর্ঘশ্বাস।