প্রতিটি মানুষের জীবনেই মনে হয় একটা গোপন ভালোবাসার গল্প থাকে। যেটা সে কাউকে বলে না। কিংবা তার গল্পটা শোনার মতো তেমন আগ্রহী শ্রোতা পায় না।
একুশজন লেখকের একুশটি ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে সংকলিত ‘আমি পাইনি ছুঁতে তোমায়’। যেখানে নক্ষত্রের সময়শূন্যতা বিশ্বব্যাপী সংক্রামক হয়ে ওঠে, ধ্রুপদী অহেতুক আঁধার পুষে রাখে। কে জানে, রাক্ষসপুরী হয়তো তানভীরকেও হাতছানি দিয়ে ডাকে? উল্টোপিঠে অভিমানের পাল্লা ভারী করতে করতে মেঘ জমায় ফারিহা আর বর্ণ। সূর্যাস্তের পর বৃষ্টি নামে খুব জোরে। তখন একূল-ওকূল ভেসে যায়। ঘর-সংসারের পাট চুকে যায়। আর কেউ স্রেফ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মরুভূমি কিংবা বৃষ্টির গল্প শুনতে থাকে।
একুশটি গল্প নিয়ে আলোচনা করা বেশ সময়সাপেক্ষ একটি কাজ। পাঠকের সুবিধার্থে উল্লেখযোগ্য কিছু গল্প সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো এই লেখায়।
প্রিয় অনিরুদ্ধ
অনেক বছর পর অনিরুদ্ধ একটি চিঠির সন্ধান পায়। ‘প্রিয়’ সম্বোধন করে লেখা চিঠি। কিন্তু কে লিখেছে এই চিঠি? কেন লিখেছে?
‘প্রিয়’ সম্বোধন করে কাউকে চিঠি লিখেছেন কোনোদিন? এখন তো চিঠি লেখার চল উঠেই যাচ্ছে! তবে একসময় যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল এই চিঠি। টুকটাক খোঁজখবর নেয়ার পাশাপাশি ছিল পত্রমিতা বানানোর সুযোগ। চিঠির আদান-প্রদানে পত্রমিতা বানানোর সুন্দর অথচ করুণ এক গল্প ‘প্রিয় অনিরুদ্ধ’।
পরম্পরা
গল্পকথক বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে বাহনের অপেক্ষা করছিলেন। অনেকক্ষণ পর ইজিবাইকের দেখা মেলে। ঘটনার আকস্মিকতায় ড্রাইভার শোনান এক বিস্ময়কর কাহিনি। গতিময় পরম্পরার কাহিনি।
পরম্পরা শব্দটি শোনার সাথে সাথেই একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার কথা মাথায় আসে। যে প্রক্রিয়া হঠাৎ করে থেমে যায় না। চলমান থাকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। গতিময়তা অটুট থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। ‘পরম্পরা’ গল্পে মূলত পিতা-পুত্রের ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটতে দেখা যায়।
সূর্যাস্তের পথে তিনজন নারী
সূর্যাস্তের পথে হেঁটে চলেছে তিনজন— রুশ্মিলা, জয়িতা আর রিনিতা। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে এই তিন নারী? ফিরে আসার মতো জায়গা কি তাদের আছে?
সূর্য অস্ত গেলে পাখিরা নীড়ে ফিরে আসে। শুধু কি পাখি? সবাই নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরে আসে এ সময়। তবে সূর্যাস্তের নরম আলোয় কেউ কেউ পথ হারিয়ে ফেলে। ফিরে আসার মতো জায়গা কি আর সবার কপালে জোটে? নারীজীবনের অদ্ভুত এক সত্যের উন্মোচন ঘটেছে এই গল্পে।
বিলবোর্ড
বাসস্ট্যান্ডের বিলবোর্ডের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আকিব। সেই বিলবোর্ড আবার ভাড়া নিতে চায় লীনা। সেখানে টাঙিয়ে রাখতে চায় নিজের ছবি!
এই গল্পে দুটি ভিন্ন প্রান্তের মানুষ মুখোমুখি হয় এক বিলবোর্ডকে কেন্দ্র করে। সামান্য প্রচেষ্টা কীভাবে যোজন যোজন দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারে, সেটা ‘বিলবোর্ড’ গল্পের মুখ্য বিষয়।
রাক্ষসপুরী
সুফিয়া একজন স্পেশাল চাইল্ড। রাক্ষুসে চিন্তাধারার আক্রমণ সাধারণ মানুষ ফিরিয়ে দিতে পারে, প্রতিবাদ করতে পারে। কিন্তু সুফিয়ার মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা মানবমনের জটিলতা সম্পর্কে অজ্ঞ। শুভ চেতনার আড়ালে থাকা কদর্য মনস্তত্ত্ব তারা ধরতে পারে না। সাজানো বাগান যখন রাক্ষসপুরীতে পরিণত হয়, তখন কীভাবে প্রতিবাদ করবে তারা?
‘রাক্ষসপুরী’ গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে সমাজের সাম্প্রতিক এক অবক্ষয়। ভাষা, বিস্তৃতি, প্লট, বর্ণনাশৈলী, চরিত্রায়ণ— সবটাই উপভোগ্য। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার কাহিনিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বাকিটা আঁধার পুষেছে মেঘের দল
সাড়ে পাঁচ মাস পর বাড়ি ফিরেছে তুষার। ততদিনে বাড়ির নিচতলাটা ভাড়া নিয়েছে বর্ণ নামের এক মেয়ে। অদ্ভুত স্বভাবের এই মেয়েটি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। সবকিছুতে কেমন যেন নিস্পৃহ থাকে। কিন্তু কেন? বর্ণ কেন মেঘের মতো আঁধার জমিয়ে রাখে?
মেঘের দল আঁধার জমায়। জমিয়ে জমিয়ে পাহাড় বানিয়ে ফেলে। সেই পাহাড় আবার ধরণীতলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে। আর এই গল্পে উঠে এসেছে মানবমনের লুক্কায়িত আঁধার, একাকিত্বের বিচিত্র রূপ।
মরুভূমি কিংবা বৃষ্টির গল্প
একদিন হাতিরঝিলে হাঁটতে গিয়ে শান্তা আপার সাথে পরিচয় হয়ে গেল দিপার। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। রোজকার গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে একদিন বেরিয়ে এলো শান্তা আপার জীবনের অদ্ভুত এক গল্প। গল্পটা মরুভূমির মতো রুক্ষ কিংবা বৃষ্টির মতো শীতল।
গল্পের প্লট ভারি চেনা। লেখকের বর্ণনার গুণে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। চমৎকার কিছু উক্তির প্রয়োগ পাঠকের বেশ পছন্দ হবে।
তাকে বলে দিয়ো
একদিকে তানভীর-ফারিহা দম্পতির সংসারে দেখা দিয়েছে অভাব। অন্যদিকে ফারিহার স্বভাবে রাজ্যের উদাসীনতা। মাঝখানে সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে তানভীর। এখন উপায় হচ্ছে ভালো একটা কাজের জন্য চেষ্টা করা। সেই চেষ্টা করতে গিয়েই এক রাতে বাড়ি ফিরতে দেরি করে ফেলল তানভীর। তারপর?
তারপর ভাতের হোটেলে তানভীরের আগমন, সেখানে মঈনুলের অদ্ভুত আচরণ— প্রত্যেকটি ঘটনার বুনন একটি রহস্যময় গল্পের অবতারণা ঘটায়। সমাপ্তিটা অপ্রত্যাশিত হলেও পাঠকের বেশ ভালো লাগবে।
সময়শূন্যতা
নক্ষত্রের কাছে সময় চেয়েছিল ধ্রুপদী। ভাগ্যে জোটেনি। দু’দণ্ড সময়ের যে ভীষণ শূন্যতা! দিন যায়, দিন আসে। সময়ের সাথে সাথে জীবনের আয়ু ফুরিয়ে আসে।
সময়ের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে আবর্তিত হয়েছে গল্পের পুরো কাহিনি। টুপ করে শেষ হয়ে যাওয়া এই গল্পের পাঠকভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হবে।
আমি পাইনি ছুঁতে তোমায় সংকলনে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলোতে বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে ব্যর্থতা কিংবা অপূর্ণতার কথা। কেউ কেউ ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের ইচ্ছেগুলো প্রকাশ করতে গিয়ে। মনগড়া যে স্বপ্নগুলো প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার রসদ যোগায়, সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি অনেকেই। এই সব অপ্রাপ্তির গল্প পড়তে গিয়ে পাঠক খুঁজে পাবে মানবজীবনের চিরায়ত স্বরূপ। চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ছাপিয়ে যেখানে ধ্বনিত হয় ভাগ্যের নির্ধারিত গন্তব্যের গল্প।
…
বই: আমি পাইনি ছুঁতে তোমায়
ধরন: গল্প সংকলন
প্রকাশনী: হিজিবিজি প্রকাশনা
মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা