যন্ত্রনির্ভর কোনো কালে পৃথিবীর বুকে মানুষের হারিয়ে যাওয়া মমতা আর ভালোবাসার চিহ্ন ফিরিয়ে আনতে সংগ্রাম করছে একজন তরুণ-তরুণী। কোথাও আবার পৃথিবী থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশে ঘটে যাচ্ছে লঙ্কাকাণ্ড। এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ছুটে বেড়াচ্ছে জীবন। তৈরি হচ্ছে কত গল্প; প্রযুক্তির, সভ্যতার আর মানবপ্রেমের। খুব চেনা ধাঁচের এই গল্পগুলোর দেখা মেলে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর পাতায়। বাংলাদেশে যার তুমুল জনপ্রিয়তা এসেছে একজন গল্পকারের হাত ধরে, তাঁর নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই লেখকের লেখনীর সাবলীলতায় জটিল সব কথাবার্তাও সহজবোধ্য হয়ে যায় পাঠকের কাছে। প্রকৌশল বিদ্যার মানুষ হয়ে এই লেখক বিজ্ঞানকে পৌঁছে দেয়ার সাধনা করে চলেছেন লাখো পাঠকের কাছে।
কেমন হতে পারে আগামীর বিশ্ব যদি একইসাথে তাতে রাজত্ব করে মানুষ আর রোবটের দল? সভ্যতা কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে যখন মানবদেহে মিশবে যন্ত্রের অংশ? বিবর্তন কি প্রকৃতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে নাকি তাতেও আসবে মানুষের দখল? এরকম কত প্রশ্ন মনে উঁকি দেয় অবচেতনভাবেই বইগুলো পড়তে গিয়ে! বিজ্ঞানের খটমটে শব্দের দলও দিব্যি হেসেখেলে ঘুরতে থাকে মাথার ভেতর। তাঁর অসংখ্য বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মাঝে একটি গল্পের মূল চরিত্র নিয়েই এখানে গল্প হবে। এমন এক চরিত্র, যে সম্পূর্ণভাবে যন্ত্র নয়, নয় মানবীও। অসম্পূর্ণ জীবন তার। প্রচন্ড প্রতাপের অধিকারী হয়েও শেষ অবধি যার কোনো পরিচয় থাকতে নেই। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তার প্রতি পৃথিবীর নেই কোনো দায়। সে এক অতিমানবী, যার অতিমানবীয় জীবনের মাঝে মিশে আছে সাধারণ মানুষ হয়ে বাঁচার প্রবল ইচ্ছা!
একজন অতিমানবী
ষোল বিটের কোড দিয়ে হিসেব রাখা হয় তার। কোনো এক গোপন প্রজেক্টের ফলস্বরূপ জন্ম মেয়েটির। মেয়ে, অথবা কেবলই একটি যন্ত্র যাকে নারীর অবয়ব দেয়া হয়েছে! সে অপূর্ব রূপবতী একজন তরুণী। আধা মানবী, আধা যন্ত্রের অদ্ভুত মিশেল। অনাথাআশ্রমে বড় হওয়া কিরির নিঃসঙ্গ জীবনে ঝড় হয়ে আসা স্নেহময়ী একজন নারী এই আধা জৈবিক প্রাণী। সে একজন অতিমানবী!
অসামাজিক স্বভাবের কিরির জীবন এক ছকে বাঁধা পড়ে দিব্যি কেটে যাচ্ছিলো। একলা মানুষ সে, বন্ধু বলতে আছে শুধু কোম। কোমের দৃঢ় বিশ্বাস, কিরির জন্ম গবেষণাগারে ক্লোন হিসেবে। এই বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক করে তাদের অবসরটুকু খানিক উত্তেজনায় কাটে! এমনই এক তর্কের অবসরে কিরির জীবনে ঘটে যায় একটি ঘটনা, কিংবা অঘটন, যা তার নিরুত্তাপ জীবনে উত্তাপের বার্তা নিয়ে আসে। পানশালায় ঘটে যাওয়া সেই মারপিটের ঘটনার রেশ কিরিকে পৌঁছে দেয় প্রতিরক্ষা দফতরের সাথে চুক্তিবদ্ধ এক জীবনে, যে জীবনে অপেক্ষা করে আছে সেই রহস্যময়ী নারী, সেই অতিমানবী।
প্রতিরক্ষা দফতরের লোকজন কিরিকে তৈরি করে শত্রুর মুখোমুখি হতে। কিরির শিকার এমনই হিংস্র এক প্রাণী অথবা যন্ত্র, যে কিরিকে সামান্যতম সুযোগও দেবে না নিজেকে রক্ষা করার! একটি অপরাধী সংস্থার তৈরি এই আধা জৈবিক প্রাণীর আছে অমানুষিক নিষ্ঠুরতা। তার বুকের ভেতর রয়েছে নিউক্লিয়ার সেল, তাতে মানুষের জন্য বিচিত্র ঘৃণা পুষে রাখা। এই ভয়াবহ শত্রুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভবনা প্রায় শূন্যের কাছে, তা জেনেই কিরি অগ্রসর হয় মিশন নিয়ে। সে যে বাধ্য প্রতিরক্ষা দফতরের কাছে। জীবনের শেষ বাজি না খেলে হার মেনে নেয়াটা যে মানা যায় না! কিরি তখনো জানে না, অদৃষ্টের লিখন খুব ভিন্ন কিছু। ভয়াবহ শত্রু বলে যাকে হত্যা করতে যাচ্ছে, সে ভালোবাসার প্রতিরূপ হয়ে ধরা দিতে অপেক্ষায় আছে!
কিরির সাথে মেয়েটির দেখা হয় মাটির অনেক নিচে তামার আকরিকে বোঝাই এক পরিত্যক্ত খনিতে। মেয়েটিকে হত্যা করার দায়িত্বে থাকা কিরি তাকে সামনে পেয়ে থমকে যেতে বাধ্য হয়। সে যে নিতান্তই একজন নারী! অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী এক নারী, যার যান্ত্রিক চোখের গভীরে মায়া লুকোনো, এমন কাউকে হত্যা করার সাহস কিরির থাকতে নেই। কিরি সংজ্ঞা হারায়, তাকে পরম মমতায় আগলে রাখতে একজন তখন সেখানে রয়েছে। সেই মেয়েটি, আধা জৈবিক একটি প্রাণ, সে একজন জনমদুঃখী অতিমানবী! কিরি পরবর্তীতে তার মিষ্টি একটি নাম দেয়, সে পরিচিত হয় নিজের আলাদা কোনো নাম নিয়ে, সে লাইনা!
লাইনার জন্ম কোনো অপরাধী সংস্থায় নয়, প্রতিরক্ষা দফতরেরই এক গোপন প্রজেক্টে। প্রজেক্ট অতিমানবীতে তার মত আরো বিশ-পঁচিশজন শিশু তৈরি করা হয়। তারা একজন অন্যজনের অবিকল প্রতিরূপ। সবাই মিলে তারা এক সত্তা। একজন মানুষেরই তারা অনেকগুলো ভাগ। গ্রুটাস নামের যন্ত্রমানবের বিকৃত পরীক্ষার ফলস্বরূপ লাইনার বাকি সত্তার অনেকেই প্রাণ হারায় ভয়াবহভাবে। কেউ কেউ মস্তিষ্কে বসানো ট্রাকিওশানের প্রভাবে বাধ্য হয় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে। তাদের একজন যখন মারা যায়, বাকি সবাই স্বাদ পায় সেই মৃত্যুর। কোনো সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারবে না কতটা ভয়াবহ সেই অনুভূতি! একটি প্রাণী বারবার মৃত্য যন্ত্রণা ভোগ করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে! তাদের মাঝে সুখের অনুভূতিও কিছু ক্ষেত্রে এতটা প্রবল হয় যে তা বেদনার সৃষ্টি করে। অনুভূতির এসব তীব্রতায় অতিমানবীরা গুমরে মরে থেকে থেকেই। তারা অসহনীয় এই জীবনের ভার আর বয়ে নিতে পারে না। পালিয়ে যায় গবেষণাগার থেকে।
আর শুরু হয় তাদের হত্যা করতে প্রতিরক্ষা দফতরের মিশন। কিরি যখন দেখা পায় লাইনার, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নয়জন অতিমানবী তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর। তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছে জীবন থেকে। কিন্তু লাইনার জীবনে যে কিরি ক্ষণিকের অতিথি হয়ে যায়নি। গল্প তখনো কিছুটা বাকি। ভীষণ নিঃসঙ্গ লাইনার মানবী মন কিরির ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যেতে পারে না। কিরির একলা জীবনও অতিমানবী লাইনার উপস্থিতিতে নতুন প্রাণ পায়। তারা আঁকড়ে ধরতে চায় এক অপরকে। শুরু হয় নতুন গল্প, সে গল্প লাইনার জন্য কিরির যুদ্ধের।
কিরি পৌঁছায় গ্রুটাসের কাছে। নয়জন অতিমানবীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে কিরি। গ্রুটাসকে বাধ্য করতে জাল বিছিয়ে রেখেছে সে। অতিমানবীদের দেহকোষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি গ্রুটাসকে বাধ্য করে কিরির প্রস্তাব মেনে নিতে। কিরি ফিরে চলে সেই পরিত্যক্ত খনিতে, সেখানে অপেক্ষায় রেখে এসেছে তার লাইনাকে। লাইনা সহ বাকি অতিমানবীদের সাথে নিয়ে ফিরতে হবে গ্রুটাসের গবেষণাগারে। অতিমানবীরা পরিবর্তিত দেহ নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন পাবে এখানেই। কিরির ফেরার দেরি লাইনাকে নিয়ে যায় মরণের দোরগোড়ায়, নিজের অতিমানবিকতার সুযোগে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় নিজেকে। কিরি ফিরে এসে মৃতপ্রায় লাইনাকে জাপটে ধরে যখন পাগলের মত চিৎকার করছে, লাইনা ক্ষীণস্বরে উচ্চারণ করে, “আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না”। এই অভিমান কোনো যন্ত্রের বুকে হয় না, হতে পারে না। এই অভিমান এক সাধারণ মানবীর হৃদয় নিংড়ানো আবেগের প্রকাশ। লাইনাও যে এক সাধারণ মানবী হতে চেয়েছিলো!
কিরির আকুলতায় সাড়া দিয়ে সেবার ফিরে আসে লাইনা। কিরি নয়জন অতিমানবীকে একত্রিত করে গ্রুটাসের আস্তানায় হাজির হয়। কিন্তু তার এতদিনের পরিশ্রম, পরিকল্পনার সমস্তটা ভেস্তে যায় গ্রুটাসের কৌশলের কাছে! গ্রুটাস আবার নিয়ন্ত্রণ নেয় এই ধ্বংসাত্মক খেলার। অতিমানবীরা একযোগে পা বাড়ায় স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে! শেষবারের মত কিরি যখন ব্যাকুল হয়ে লাইনাকে ডাকছে, ক্যাপসুলে ঘুমন্ত নয়জন অতিমানবীর মাঝ থেকে সাড়া দেয় লাইনা। তখন যে বড় দেরি হয়ে গেছে, আর ফেরার উপায় নেই। তবু শেষ একটিবার লাইনা তার ভালোবাসার মানুষটিকে ধরা দেয়। সে আসে কিরির স্মৃতি থেকে নিজেকে মুছে দিয়ে যেতে! কিরিকে সে বলে যায়, “আমরা অতিমানবী। কিন্তু এই পৃথিবী, পৃথিবীর সভ্যতা অতিমানবীর জন্য তৈরি হয়নি। আমরা এখানে অনাহুত।” কিরি লাইনাকে যেতে দিতে চায় না, প্রবল ভালোবাসায় তাকে আগলে রাখতে চায় নিজের কাছে। এত যুদ্ধ, এত আয়োজন বৃথা করে লাইনা কীভাবে চলে যাবে তাকে একা ফেলে! কিন্তু লাইনাদের বাঁচতে নেই। আর সে সত্যিটা অতিমানবীরা মেনে নিয়েছে। চলে যাচ্ছে তারা। নয়জনের মাঝে লাইনাকে আলাদা করেছিলো কিরির ভালোবাসা, সে ভালোবাসার দাম লাইনা চুকিয়ে যায় ঠিক।
শেষবেলায় লাইনার আয়ত কালো অপূর্ব দু’টি চোখে পানি চিকচিক করে। কিরি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার গোটা পৃথিবী দুমড়ে-মুচড়ে যায়, লাইনা তাকে ভুলিয়ে দিতে থাকে তাদের সব স্মৃতি, তাদের ভালোবাসা! এক বিশাল বেলাভূমিতে একলা পড়ে থাকে কিরি, আর দূরের ঐ দিগন্তে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় লাইনা। এক জনমদুঃখী অতিমানবী!