ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থাবলি

ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানার অন্যতম সঠিক উৎস হচ্ছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানই নয়, ইতিহাসের কঙ্কালসার কাঠামোতে একটু একটু করে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থও। ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও পাওয়া যায় এমন গ্রন্থাবলির উদাহরণ। আজকের এ লেখায় আলাপ হবে সেগুলো নিয়েই।

অষ্টাধ্যয়ী

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ বা ৫ম শতকে রচিত অষ্টাধ্যয়ী মূলত সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ, যা রচনা করেন বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ পাণিনি। এতে তিনি সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং বাক্য গঠনের প্রায় ৪,০০০ সূত্র অন্তর্ভুক্ত করেন। এর বাইরে কথ্য ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ গ্রন্থে। নাম অনুযায়ী গ্রন্থটি আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত, যার প্রতিটি আবার চারটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে।

পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বার্চ গাছের ছালে লিখিত পাণ্ডুলিপি।
পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বার্চ গাছের ছালে লিখিত পাণ্ডুলিপি; Image Source: Research Gate

অর্থশাস্ত্র

নাম শুনে মনে হতে পারে, এটি বোধহয় ধনসম্পদ সম্পর্কিত কোনো গ্রন্থ। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে রচিত এ গ্রন্থটি মূলত রাজনৈতিক গ্রন্থ। বলা হয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি চর্চার আকরগ্রন্থ এই অর্থশাস্ত্র। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী চাণক্য তথা কৌটিল্য এটি রচনা করেন। ধারণা করা হয়, গ্রন্থটি মূলত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন পরিচালনার দিকনির্দেশিকা হিসেবে রচিত।

অর্থশাস্ত্র
অর্থশাস্ত্র; Image Source: Ancient-Origins

গ্রন্থটি ১৫টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত, যার একেকটিকে বলা হয় অধিকরণ। প্রতিটি অধিকরণ আবার কিছু অধ্যায়ে বিভক্ত। পুরো গ্রন্থে এরকম ১৫০টি অধ্যায় রয়েছে। রয়েছে ১৮০টি সেকশন বা আলোচনার বিষয়। ৬,০০০-এর মতো শ্লোক রয়েছে এ গ্রন্থে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, মন্ত্রী নির্বাচন, যুদ্ধ পরিচালনা, কর ব্যবস্থাপনা এবং তা সঠিকভাবে বিতরণ, বাহ্যিক হুমকি বা অভ্যন্তরীণ কোন্দল মোকাবেলা প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে এতে। শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

অর্থশাস্ত্রে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, বাংলা সম্পর্কে বিধৃত তথ্যের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ এটি।

১৯০৫ সালে ভারতের মহীশূর রাজ্য থেকে অধ্যাপক ড. শ্যামাশাস্ত্রী গ্রন্থটি উদ্ধার করে ১৯০৯ সালে ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ নামে প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯১৫ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় এবং তারপরই জনবিধৃত হয়। অর্থশাস্ত্রকে ‘দ্য সায়েন্স অভ পলিটিক্স’, ‘দ্য সায়েন্স অভ পলিটিক্যাল ইকোনমি’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার বিখ্যাত গ্রন্থ প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এবং নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’-এর সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে অর্থশাস্ত্রকে এবং চাণক্যকে বলা হয় ভারতবর্ষের ম্যাকিয়াভেলি।

মুদ্রারাক্ষস

সংস্কৃত শব্দ ‘মুদ্রারাক্ষস’, যার অর্থ হলো ‘রাক্ষস এবং তার সীলকৃত আংটি’। বিশাখদত্ত রচিত এ গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটক। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দীতে গুপ্তযুগে রচনা করা হয়। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থান।

বলা চলে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের রাজনৈতিক নীতিকেই এতে নাটকে রূপ দেওয়া হয়েছে, যেখানে মূল চরিত্র হল কৌটিল্য। চন্দ্রগুপ্তের উত্থান, নন্দ বংশ ধ্বংস, মৌর্য যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ নাটকের মাধ্যমে পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে ঢুণ্ডীরাজ নাটকের টীকাভাষ্য রচনা করেন।

রঘুবংশ কাব্য

মহাকবি কালিদাসের দুটি মহাকাব্যের একটি রঘুবংশ। ৫ম শতকে; বাংলা সাহিত্য রচনার স্বর্ণযুগ বলে খ্যাত গুপ্ত শাসনামলে রচিত এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু রামায়ণ থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে রাম এবং তার বংশধর রঘুর চরিত্র রচিত হয়েছে।

রঘুবংশ কাব্যের একটি পাণ্ডুলিপি পৃষ্ঠার অনুলিপি।
রঘুবংশ কাব্যের একটি পাণ্ডুলিপি পৃষ্ঠার অনুলিপি; Image Source: Wikimedia Commons

ধারণা করা হয়, এই রঘু হলো সমুদ্রগুপ্ত। আর রঘুর যে দুঃসাহসী বর্ণনা দেওয়া হয়, তা মূলত সমুদ্রগুপ্তের জীবনাবলম্বনে। তবে এ নিয়ে বেশ মতানৈক্যও রয়েছে।

রামচরিতম

বাংলার দীর্ঘস্থায়ী পাল শাসনামলের সর্বশেষ সম্রাট মদনপালের রাজত্বকালে দ্বাদশ শতাব্দীতে রামচরিতম রচনা করা হয়। এ গ্রন্থের রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। রামচরিতমে ২১৫, মতান্তরে ২২০টি শ্লোক রয়েছে। তবে কাব্যটি প্রায় দুর্বোধ্য। তাছাড়া কাব্যটি দ্ব্যর্থবোধক। অর্থাৎ, প্রতিটি শ্লোকের দুই রকমের অর্থ রয়েছে। একটি হলো বহুল পরিচিত রামায়ণের কাহিনী, আরেকটি সমসাময়িক ঘটনাবলী। এ সমসাময়িক ঘটনাবলীর অর্থই খুব সহজে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

তবে কাব্যটির এক পাণ্ডুলিপিতে প্রথম দু’ভাগের ব্যাখা পাওয়া যায়। সন্ধ্যাকর নন্দীর বাবা ছিলের রাজপরিবারের উচ্চপদস্থ কর্মী। তাই রাজপরিবারের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য এ গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। তাছাড়া পাল যুগের বিশেষ কিছু ঘটনা, যেমন- কৈবর্ত বিদ্রোহ, দিব্যের শাসন প্রতিষ্ঠা, রামপালের শাসন পুনরুদ্ধার প্রভৃতি বিধৃত হয়েছে এ গ্রন্থে, যার একমাত্র উৎস রামচরিতমই। ১৮৯৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে এ গ্রন্থটি উদ্ধার করেন।

হর্ষচরিত

পুষ্যভূতি রাজবংশের শ্রেষ্ঠ শাসক শ্রীহর্ষবর্ধনের জীবনী নিয়ে লেখা হয় এ গ্রন্থটি। রচনা করেন তারই সভাকবি বাণভট্ট। ধারণা করা হয়, গ্রন্থটি ৭ম শতাব্দীর প্রথমার্ধে লিখিত।

হর্ষচরিত
হর্ষচরিত; Image Source: India Old days

সংস্কৃতে লেখা এটিই প্রথম জীবনীগ্রন্থ। বইয়ে আটটি অধ্যায় রয়েছে, যার প্রথম তিন অধ্যায়ে নিজের সম্পর্কে লিখেছেন বাণভট্ট। গ্রন্থে গ্রামীণ ভারত প্রকৃতির বর্ণনা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মেলে প্রজাদের পেশা ও দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা। মোটকথা, হর্ষবর্ধনের সময়ের সমাজ, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায় এ গ্রন্থ থেকে।

আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প

আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প বৌদ্ধ গ্রন্থ। খ্রিস্টীয় ৯ম-১০ম শতকে শশাঙ্কের আমলে রচনা করা হয় গ্রন্থটি। এর রচয়িতার নাম জানা যায়নি। গ্রন্থটি সংস্কৃতে রচিত এবং সমগ্র উত্তর ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এতে; তবে এ লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি নিতান্তই ভিন্ন। গ্রন্থকার সব নামের আদ্যাক্ষর ব্যবহার করেছেন, কিন্তু পুরো নাম কোথাও উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক তথ্যই অজানা রয়ে গেছে। তবে ৭ম-৯ম শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের কিছু তথ্য এ গ্রন্থে পাওয়া যায়।

রাজতরঙ্গিনী

‘রাজতরঙ্গিনী’ শব্দটির সংস্কৃত অর্থ হলো ‘রাজাদের নদী’। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এ উপাখ্যান রচনা করেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ কলহন। ধারণা করা হয়, কলহনের পিতা রাজা হর্ষের মন্ত্রী ছিলেন। রাজতরঙ্গিনীকে বলা হয় প্রাচীন কাশ্মীরের সমাজ-ইতিহাসের দলিল। যদিও কলহন নিজেকে ঐতিহাসিক নয়, বরং কবি হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। কাব্য রচনার প্রেরণা থেকেই তিনি এ গ্রন্থে কাশ্মীরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী কালানুক্রমে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থে প্রাচীনকাল থেকে লেখকের সময় পর্যন্ত প্রায় দুই সহস্রাব্দ সময়ের ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত এ গ্রন্থকে আদি-মধ্যযুগের সবচেয়ে স্বীকৃত ইতিহাসমূলক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৭,৮২৬টি শ্লোকে সমৃদ্ধ এ গ্রন্থে আটটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে কাশ্মীরের রাজাদের কল্পিত গল্প বা লোকশ্রুতিগুলোকে মহাকাব্যিক রূপকথার মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী পাঁচ অধ্যায়ে প্রতাপাদিত্য, গোনন্দ, মাতৃগুপ্তের রাজ্য, কার্কোট ও উৎপল রাজবংশের ইতিহাস লিখিত হয়েছে। শেষ দুটি অধ্যায়ে প্রথম ও দ্বিতীয় লোহার রাজবংশের কাহিনী, হর্ষবর্ধনের মৃত্যু এবং কাশ্মীরের রাজা জয়সিংহের অধীনে চলে আসার ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন। ধারণা করা হয়, রাজতরঙ্গিনী ১১৪৮-৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত হয় এবং রাজা জয়সিংহের সময় লেখা শেষ হয়।

Related Articles

Exit mobile version