“দিদি, বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব এখনও বেঁচে আছেন।”
মৃত্যু কতটা সহজ হলে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে একজন সদ্য প্রাণ হারানো ব্যক্তির স্ত্রী আরেকজনকে এমনভাবে তাঁর জীবনসাথীর চিরবিদায়ের কথা বলতে পারেন? আরেকজন বেঁচে আছেন। কতটা সাহসী হলে এই সংবাদ স্বাভাবিকভাবে বলতে পারেন সেই স্ত্রী?
প্রশ্নগুলো আমাদের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে। প্রশ্নগুলো আমাদের চিত্তে ধারণ করে রাখার মতো। আমাদের সত্তার সাথে মিশে একাকার হয়ে থাকার কথা এ প্রশ্নগুলো। এমনকি এর উত্তর মিশে থাকার কথা আমাদের সদা বহমান জীবনধারার সাথে
কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান সেই ইতিহাসের গল্পগুলো কেন যেন এতটা চিত্তে আঘাত করার মতো জানানো হয়নি। কেন যেন আমাদের জানা গল্পগুলো হয়ে উঠেছে একঘেয়েমিতে পূর্ণ। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে বাস্তবের ভুল উপস্থাপন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের চিত্র কেমন ছিলো? কেমন ছিলেন আমাদের সমাজ বিনির্মাণের কারিগর প্রজ্ঞাবান সেসব ব্যক্তিত্ব। অথবা কেমন ছিলেন সাধারণ মানুষ আর সাধারণভাবে চলতে থাকা এক সমাজ।
সেসব গল্পের বাস্তব চিত্র, চিত্তে আঘাত করার মতো করে না চাইতেই জলধারা বয়ে যাওয়ার মতো করে তুলে ধরেছে ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসটি। এই উপন্যাস আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছে উপরের প্রশ্নগুলো। কিছু ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসা করেছে আরও নানা প্রশ্ন, যা সরাসরি জড়িয়ে আছে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বের সাথে, আমাদের সত্ত্বার সাথে এবং সদা আনন্দ করতে চাওয়া চিত্তের সাথে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই বছর পর ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’। অস্ত্রের ঝলকানি, পাকিস্তানীদের খাবার রোটি আর ফুর্তির জন্য বেছে নেয়া আমাদের দেশের নারী- এ তিন উপাদানকে নিয়ে লেখক সাজিয়েছেন পুরো উপন্যাস। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হলেও মূল কাহিনী তিনি যেভাবে লিখেছিলেন, সেভাবেই থাকে। ফলে উঠে আসে আসল ইতিহাস।
বাংলাদেশের ইতিহাসের মহান সময় ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ আর এপ্রিলের প্রথমদিকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতম ঘটনাবলি এ উপন্যাসের মূল প্রেক্ষাপট। তবে কখনও কখনও লেখক তুলে ধরেছেন আমাদের বাঙালিদের চিরায়ত বিশ্বাসের মালাকে। অসাম্প্রদায়িকতার সুতোয় বোনা এ দেশের আসল সত্যকে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর লেখায়।
তিনি শহীদ আনোয়ার পাশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিষয়ের একজন অধ্যাপক। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যখন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়, তখন ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান পাশা।
সেদিন ঘটে যাওয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ভয়াল রাতের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ তাঁর চিত্তে আঘাত হানে ৷ চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একেকটি ঘটনা অন্যকে জানাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর মনে স্বপ্ন ছিলো, আমাদের দেশ একদিন স্বাধীন হবে। তখন পরের প্রজন্ম জানবে, তারা যে স্বাধীনভাবে চলাচল করছে তার প্রেক্ষাপট কী।
১৯৭১ সালের জুন মাসে শেষ করেন বাঙ্গালি জাতির শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ণ এবং তা থেকে মুক্ত ও যুদ্ধজয়ের প্রেরণার গল্প। কিন্তু হায়! কে জানতো তাঁর শেষ করা এ গল্প যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে, ততদিনে তিনি এ ধরার কাছে হয়ে যাবেন প্রয়াত। মহান এ সৃষ্টি যখন মানুষের হাতে হাতে, তখন তাঁর উপস্থিতির জন্য হাহাকার করবে বইয়ের প্রতিটি পাতা।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য আরও অনেক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সাথে তিনিও হারিয়ে যান চিরতরে। বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হয়ে যান তিনিও। ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাসে উল্লিখিত সেই ইতিহাসের একজন উপাদান হয়ে আক্ষেপ সৃষ্টি করেন স্বাধীনচেতা মানুষের মনে।
তিনি রাজনীতি করতেন না। ছিলেন মানবতার পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতার ঘোরতর বিরোধী। ১৯৬৪ সালে পাবনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধলে প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন আনোয়ার পাশা। ৩০ হিন্দু ছাত্রকে বাঁচান সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থেকে।
কী আছে ‘রাইফেল, রোটি, আওরাতে’?
“বাংলাদেশে নামল ভোর”
এক নতুন ভোর দিয়ে শুরু হয় উপন্যাস। এ ভোর অন্য ভোর। সচরাচরের মতো না। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চের ভোর। ইতিহাসের ভয়াবহ নারকীয়তার দু’রাত পরের এক ভোর। দু’রাত নয়, যেন পার হয়ে গেছে দুই যুগ। কিন্তু দু’রাত আগের সেই কালরাতে মৃত্যু যেমন সহজ হয়ে গিয়েছিলো, দুই যুগ পরে এসে সকালটাতেও মৃত্যু তখনও সহজ হয়েছিলো সুদীপ্তের কাছে।
উপন্যাসের মূল চরিত্র সুদীপ্ত। বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতায় মোড়ানো নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। যেখানে শিক্ষক হবার জন্য তাকে বদলাতে হয়েছে নিজের নাম। ‘হিন্দুয়ানী নাম’ বলে তাকে অপদস্থ হতে হয়েছে ইন্টারভিউতে। তবে শুধু হিন্দুদের প্রতিই পাক বাহিনীর ঘৃণা ছিলো এমন বললে ভুল বলা হবে। এই বইয়ে দেখানো হয় নরপিশাচদের অন্যতম অবজ্ঞার বস্তু ছিলো আমাদের ‘বাংলা ভাষা’ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
এই দুই সত্তাকে বিনাশ করতে তারা এর সাথে যুক্ত করে ‘হিন্দুয়ানী’ ট্যাগ। তবে তারা জানতো না, মানুষকে মারা যায়, কিন্তু তাদের সত্তা অমর হয়ে থাকে। তাদের বিশ্বাসকে কখনও মারা যায় না। যে বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন কলিযুগের দেবতা হিসেবে উপন্যাসে উল্লেখ করা ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। মসজিদে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মদিনের আয়োজনে উপস্থিত থেকে তিনি অসাম্প্রদায়িকতার বিরল এক নজির গড়েন। তাকে দেহত্যাগে বাধ্য করা হলেও তাঁর এ ধারাকে তো বিনাশ করতে পারেনি সেই পিশাচের দল!
“তোমরা দেশকে বাঁচাবে আর আমি তোমাদের বাঁচাব না?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রাণের চেয়েও কাছের একজন মানুষ মধুদা, যার ক্যান্টিনে ছাত্রছাত্রীরা ফ্রি খেতে পারতো, যিনি এখানকার সবার নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অপরাধ কী ছিলো? মানুষকে ভালোবাসা? তাঁর অপরাধ ছিলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলা মানুষদের অন্যতম প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠা। কারণ ইয়াহিয়ার বর্বর সেনারা ভালো মানুষদেরই মারতে জানে।
তবে তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি তাদেরই চাটুকারিতা করা ব্যক্তিরাও। তখনকার সময়ে যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন, তারাও রেহাই পাননি। গিরগিটির মতো রঙ বদলে নতুন মোড়কে আবির্ভাব হওয়া মালেক সাহেবের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় কোরআন শরীফের সামনে। ঘর থেকে তুলে নেয়া হয় তার স্ত্রী এবং মেয়েদের। মৃত্যুর আগে স্রষ্টার প্রতি বলা শেষ বাক্যটিও পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি তাকে। তাহলে মুসলিম জাতীয়তার কথা বলে যুদ্ধ করার পর তাদের কেন এ প্রতারণা? শুধু বাংলাকে বিনাশ করতে।
আবার এসব ঘটনা নিজের সাথে ঘটার পরেও তারা তাদের এ চাটুকারিতা বন্ধ করেনি। তা জানা যায় মালেক সাহেবের ভাই খালেক সাহেবের কথা শুনে। তিনি অবলীলায় বর্ণনা করেন তার ভাইয়ের মৃত্যুর কথা। তার ভাতিজীদের ফেরত দেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রশংসা করেন পাক বাহিনীর। অন্ধ এক গোঁড়ামিতে থাকা মানুষদের চিত্র আঁকার ক্ষেত্রে চমৎকার এক সত্য নিয়ে আসেন আনোয়ার পাশা।
মৃত্যু এত নিকটে এসে চলে যাওয়ার ভয়াবহতা দেখান কয়েকটি ঘটনায়। বাস থেকে মানুষদের বেছে নেয়ার পর যারা বেঁচে যান তাদের মনের অবস্থা তখন কেমন ছিলো? কিংবা বারবার ভাগ্যের কারণে মৃত্যুর কাছে গিয়ে ফিরে আসা যুবকেরই বা মনের অবস্থা কেমন ছিলো? সেসব উপলব্ধি করা যায় এসব ঘটনায়।
আমাদের অনেকেই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আবদুল্লাহ মনসুরের নাম জানি না। জানি না পাক স্বৈরাচারদের অত্যাচার এবং বঞ্চনার চিত্র আঁকা আমন নামের মানুষটি তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। একসাথে থাকা দুই ভাইয়ের একজন মারা গেলে আরেকজন যখন ভাবেন বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেবেন তখন তাঁর মনের অবস্থা জানি না আমরা।
এ উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ব্যাপার অবশ্য লক্ষণীয়। এখানে লেখক মোটাদাগে কয়েকবার বলার চেষ্টা করেন, তখনকার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যখন আলাপ আলোচনা নিয়ে মত্ত, শুধুমাত্র প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ নিয়ে বসে আলাপ করছেন, তিনি কী করবেন তার পানে চেয়ে বসে আছেন, হাত গুঁটিয়ে বসে থেকে বলার মতো কোনো প্রতিবাদের চিহ্ন নেই। তখন সাধারণ মানুষের মনে জেঁকে বসেছে প্রতিশোধের নেশা। কেননা বঙ্গবন্ধু নিজেই ৭ মার্চ শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এ বঙ্গবন্ধুতেই আমরা খুঁজে পাবো আমাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। তাই বলা হয়েছে,
“শেখ মুজিবুর রহমান- শুধুই একটি নাম তো নয়, তা যে বাঙ্গালির আত্মমর্যাদার প্রতীক। এবং আনন্দময় জীবনেরও।”
তিনি আরও দেখিয়েছেন আমাদের ভাষাকে বিনাশ করার পরিকল্পনা করেছিলো আমাদের বাংলার অনেকেই। তারা বুদ্ধি দিয়ে শাসকদের বুঝিয়েছিলো কীভাবে এ ভাষা চিরতরে নিশ্চিহ্ন করা যায়। কিন্তু তাদের সে পরিকল্পনা কাজে আসেনি আমাদের ঐক্যের কারণে।
আবার আনোয়ার পাশা তাঁর গল্পের এক চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন যে, কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে এক হয়ে চললেও তারা পরে তাঁর বিরুদ্ধে চলে যাবেন, যা মুক্তিযুদ্ধের পর কতটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে তা অবশ্য তর্কের বিষয়।
বাইরে যখন গুলির শব্দ হচ্ছে সেসময়ে এসে আনোয়ার পাশা লিখলেন,
“নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কতো দূরে। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।”
লেখকের এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির তখনকার কামনা ও প্রত্যাশারই অভিব্যক্তি এটি। সফলতার বার্তা দিয়ে শেষ করেন উপন্যাস। ঠিকই নয় মাস টানা যুদ্ধের পর পূর্ব দিগন্তে রক্ত লাল সূর্য উঠেছিল । কিন্তু সেই সূর্য দেখার জন্য ছিলেন না স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন দেখানো মানুষটি।