আমেরিকান সিনেমা প্রথমবার বদলেছিল কিংবা বলা চলে, নতুন আঙ্গিকে জন্ম হয়েছিল অরসন ওয়েলসের ‘সিটিজেন কেইন’ (১৯৪১) দিয়ে। পূর্বের সবক’টি প্রথা ভেঙে, এই সিনেমা নতুন করে লিখেছিল ফিল্মমেকিংয়ের সংজ্ঞা। এবং বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয়বার বদলেছে কিংবা পরিণত হয়েছে আর্থার পেনের এই ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ দিয়ে। বনি আর ক্লাইড, তারা তো ভালোবাসায় সিক্ত উষ্ণ দু’টি প্রাণ; যারা টগবগে যৌবনকে নিংড়ে নিয়েছিল উদ্দাম জীবন-যাপন, হিংস্রতা আর উচ্ছলতায়। প্রথম যখন দু’জন পরস্পরের চোখে চোখ রেখেছিল, তখনই তো ওই ব্যাপারটি ঘটে গেছে। ওই যে বলে না, “ইউ গট মি অ্যাট হ্যালো।”
অথচ বনি তখন নিজের ঘরটায় নগ্ন অবস্থায় অস্থির সময় পার করছিল। বিরক্তিকর প্রতিটি মুহূর্ত। সিনেমার ওপেনিং ক্রেডিটের শেষে ডিসলভ ব্যবহারের মাধ্যমে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে বনি পার্কার চরিত্র রূপদানকারী ফে ডানওয়ের মোহনীয় ঠোঁট দু’টি। আয়নায় তাকিয়ে দেখছিল নিজেকে। তারপর সটান শুয়ে পড়ে নিজের বিছানাটায়। এপাশ-ওপাশ করছিল বিছানায়। সময় যেন কাটছেই না। আবার উঠে গিয়ে দাঁড়াল ঘরের জানালাটায়। চোখটা এদিক-ওদিক বুলিয়ে ঘরের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় আনতেই চোখে পড়ে ওই যুবকটিকে।
তার মায়ের গাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছিল। লকটা খুলে গাড়িটা নিয়ে সটকে পড়ার সুযোগ খুঁজছিল। বনি হাঁক ছাড়ল এবং তখনই দু’জনের দৃষ্টি দু’জনের উপর স্থির হয়েছিল প্রথমবারের মতো। নিজেদের অজান্তেই ঠোঁটের কিনারায় হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বনি যেন তখনই বুঝতে পেরেছিল, এই যুবকই তার একঘেয়ে জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যাবার চাবি। আর ক্লাইডও যেন বুঝতে পেরেছিল, এই সেই মেয়ে, অবচেতনে যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল সে। জীবনটাকে উদ্যমী করতে তাদের একে অপরকে দরকার। তাইতো দু’জন পুরোপুরি আগন্তুক হয়েও অবলীলায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল, বলছিল নিজেদের সম্পর্কে।
বনি, হোটেলের ওয়েট্রেস। রোমাঞ্চকর কিছুই নেই তার জীবনে। প্রতি রাতে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হওয়ার মাঝেও অনুভব করে না রোমাঞ্চ। অন্যদিকে ক্লাইড ব্যারো স্টেট প্রিজন থেকে ছাড়া পেয়েছে সদ্যই। দু’ বছর জেল খেটেছে সশস্ত্র ডাকাতির জন্য। বনি তো ‘ফাঁকা বুলি’ বলে ক্লাইডের সে কথা বাতাসে উড়িয়ে দেয়। বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, ক্লাইড যখন কোটের আড়ালে লুকানো কোমরে গোঁজা পিস্তলটা বের করে দেখায়। ক্লাইডকে ভয় পাওয়ার বদলে উল্টো এক রুদ্ধশ্বাস, উন্মত্ত জীবনের হাতছানি দেখতে পায় বনি। আরো আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে ক্লাইডকে। মজে যায় তার কথায়। ক্লাইড সঙ্গী করে নিতে চায় বনিকে। বনির’ও না-রাজি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সেখান থেকেই শুরু দু’জনের উন্মত্ত পথচলার। বন্দুক এবং ভালোবাসা। ক্লাইড চায়, মানুষ তাদের চিনুক, জানুক। পত্রিকায় নাম আসুক। ক্লাইড বন্দুক চালাতে পারদর্শী আর বনি পত্রিকায় ছবি আসার জন্য লাস্যময়ী পোজ দিতে। নিজেদের মহার্ঘ করে তুলে কবিতাও লিখতে পারে বনি। এভাবেই তারা পরিপূর্ণ করে নিজেদের।
তারা তো বাস্তব জীবনেরই দম্পতি (অবিবাহিত)। কুখ্যাত বনি এন্ড ক্লাইড এবং তাদের ব্যারো গ্যাং। গ্রেট ডিপ্রেশনের সেই ৩০ দশকের প্রথমার্ধে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল গোটা আমেরিকায়। ব্যাংক ডাকাতির জন্য ত্রাস ছড়িয়েছিল টেক্সাসের দিকে। ৯ জন পুলিশ অফিসার আর ৪ জন সাধারণ নাগরিকের খুনের দায় আছে তাদের উপর। এই উন্মত্ত জীবনের রোমাঞ্চই তাদের পরিচালিত করেছে। তাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু খুনগুলোর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য কী? খুন করার পেছনে তাদের মনস্তত্ত্ব কীভাবে কাজ করছিল? আদৌ কি খুন করার ইচ্ছা কিংবা কোনোরূপ বাসনা তাদের ছিল?
না। এই সিনেমা তেমনটা বলে না। এই সিনেমা বলে, বনি আর ক্লাইড খুন করতে কিংবা খুনি হতে চায়নি। তারা শুধু রোমাঞ্চকর জীবনের স্বাদ চেয়েছিল। গ্রেট ডিপ্রেশনের বিষণ্ণতা তাদের গ্রাস করছিল। নির্জীবতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল তাদের। সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে তারা ডাকাতিকে বেছে নিয়েছিল। টাকার লোভ নয়, নিজের মতো করে বাঁচার লোভই তাদের ব্যাংক ডাকাতির দিকে ধাবিত করেছে। আইনের শৃঙ্খল ভাঙার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদের এ পথে নিয়েছে। ‘যে মুহূর্তটায় বাস করছি, সে মুহূর্তটা নিজের করে নেওয়া’র তাড়নাই তাদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। এবং মাত্রাছাড়া উন্মত্ততা কীভাবে স্বীয় ধ্বংসমুখিতার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, তা-ই আবার ব্যাখ্যা করে এই সিনেমা।
বনি অ্যান্ড ক্লাইড সিনেমাটা নির্মাণের পেছনের গল্প এবং মুক্তি পরবর্তী ঘটনা নিয়েও একটা গোটা সিনেমা নির্মাণ করা যাবে। চিত্রনাট্য লেখার সময় থেকে শুরু করে ওয়ারেন বেটির প্রযোজনা করার সিদ্ধান্ত তারপর পরিচালকের দ্বারে দ্বারে চিত্রনাট্য নিয়ে যাওয়া; চিত্রনাট্যে হিংস্রতার পরিমাণ দেখে অনেকেই পরিচালনা থেকে পিছিয়ে যান, আর্থার পেনের ‘না’ করে দেওয়া এবং পরবর্তীকালে আবার পরিচালনায় ফেরা। এসব তো শ্যুটিংয়ের আগের চিত্র। শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর এবার নতুন যুদ্ধ, ডিস্ট্রিবিউটর খোঁজা। সেখানেও ভোগান্তি কম নয়। সিনেমার অরিজিনাল কাট ডিস্ট্রিবিউট করতে ওয়ার্নার ব্রোস একবাক্যে না করে দিলেন। তারপর আবার নতুন কাট। থিয়েটারে মুক্তি দিতে গিয়ে বারবার থিয়েটার মালিকদের ধর্না দেওয়া। স্বল্প পরিসরে মুক্তি। এর উপর ভায়োলেন্সের জন্য সমালোচকদের কড়া সমালোচনা ছুরির ফলার মতো বিঁধেছিল। কিন্তু অল্প কিছু সময়েই চিত্রটা বদলে গেল। কারণ এ সিনেমা আকৃষ্ট করেছিল আমেরিকার তখনকার নতুন প্রজন্মকে।
৬০ দশক তখন, ষাটের শেষভাগ তা-ও। আমেরিকান সমাজ আর সংস্কৃতিতে ‘কাউন্টার কালচার’ বিশাল পরিবর্তন এনেছে। এই সিনেমা কাউন্টার কালচারের সাথে সম্পৃক্ত না হয়েও, হয়ে গেল কাউন্টার কালচারের প্রতিনিধি। কারণ এতে ছিল প্রথা ভাঙার সুর, যার উপর ভিত্তি করেই তো গোটা কাউন্টার কালচার। এখানে যৌবনের উদ্দীপনা আছে, উষ্ণ রক্তের জোয়ারকে আরো উন্মাতাল করার মতো শক্তি আছে। নতুন প্রজন্মের কারণে এবার বড় পরিসরে আলোচিত হলো ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’। সমালোচকদের ক্ষুরধার বক্তব্য নমনীয় হলো। ব্যবসায়িকভাবে বিশাল সাফল্য পেল। অনেক সমালোচক ভবিষ্যদ্বাণী করল, এ সিনেমাই মডার্ন আমেরিকান সিনেমার পথপ্রদর্শক হতে যাচ্ছে এবং ক্ষণকালেই তেমনটা হয়েছে।
ভায়োলেন্স, নগ্নতা, ভিন্ন বর্ণের মাঝে প্রেম এবং আরো বিবিধ বিষয় তখন আমেরিকান সিনেমায় সরাসরি প্রদর্শন করা যেত না। কারণ হলিউড তখন নিয়ন্ত্রিত হতো ‘হেইস কোড’ দ্বারা। তবে এ সিনেমা সেই কোডের ধার ধারেনি। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ফোয়ারা যেন এই সিনেমা। কোনোরকম রাখঢাক করতে যায়নি। ৭০ দশকে আমেরিকান সিনেমা যে নতুন তরঙ্গের মধ্য দিয়ে যাবে, তা যেন পূর্ব নির্ধারণ করেছে ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’। স্টুডিও সিস্টেম যে অচিরেই ধসে পড়তে যাচ্ছে, তার ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শোনা গেছে এই সিনেমায়। সবদিক থেকে ‘র’ হয়ে উঠেছে এই সিনেমা। বলেছে, আমেরিকান সিনেমার প্রাপ্তবয়স্ক হবার সময় এসে গেছে। ফরাসি সিনেমায়ও বিপ্লব ঘটে গেছে। এবার হলিউডের পালা। অস্তিত্বহীনতার ভীতি, কমেডি এবং মনস্তাত্ত্বিক আবেগকে সহাবস্থানে রাখার মাধ্যমে ফরাসি নব্য তরঙ্গের সিনেমাগুলোর ঝাঁঝটাকে ধরেছে যেন এই সিনেমা। সেসবের সাথে একটা জাঁকজমক আবহ তৈরি করে ওই সময়কার আমেরিকান আর ফরাসি সিনেমাকে সমান্তরালে চালিয়ে নেওয়ার একটা আপাত চেষ্টা আর্থার পেনের পরিচালনায় লক্ষ করা যায়।
বাস্তব জীবনের বনি এবং ক্লাইড সোশিওপ্যাথিক চরিত্র। সিনেমা তাদের সেভাবেই রূপায়ন করেছে। তবে চতুরতার সাথে তাদের প্রাণবন্তও করে তুলেছে। দুই সোশিওপ্যাথিক প্রেমিক-প্রেমিকার জার্নি; ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ সিনেমার এ ধারায় পরবর্তী সময়ে আরো অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। সবচেয়ে কাছাকাছি টানা যায় অলিভার স্টোনের সাইকেডেলিক সিনেমা ‘ন্যাচারাল বর্ন কিলার্স’ (১৯৯৪)-কে। ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’-এর মতো এ সিনেমাও মুক্তিকালে অতিরিক্ত ‘ভায়োলেন্ট’ হওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছে। তর্ক-বিতর্ক আজো জারি রয়েছে, যার উপর ভর দিয়ে ‘কাল্ট ফলোয়িং’ দাঁড় করিয়েছে সিনেমাটি। স্টোনের এ সিনেমা বেশ ভালোভাবে অনুসরণ করেছে ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’কে।
চরিত্রায়নে; মিডিয়া এ ধরনের চরিত্রগুলোকে কীভাবে বাড়িয়ে-চড়িয়ে মহিমান্বিত করে তোলে, সেই বিষয়টিতে; ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’-এর ধমনীতে বেড়ে উঠেছে এই সিনেমা। ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’-এও দেখা যায়, ভায়োলেন্সকে সরলীকরণ করতে গণমাধ্যম কীভাবে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। বনি এবং ক্লাইডকেও জনসাধারণের কাছে ‘হিরো’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে মিডিয়া। হিংসা-দ্বেষ, বিভ্রান্তি তৈরিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে মিডিয়া। এবং সে দিকটাকে বিদ্রূপাত্মক আকারে উপস্থাপন করেছে ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ সিনেমা।
এ সিনেমার সত্যাসত্য, অর্থাৎ ঐতিহাসিক নির্ভুলতা নিয়ে বেশ ঝোড়ো বিতর্ক রয়েছে। তবে সে সত্যাসত্যের জের ধরে এই সিনেমাকে তাচ্ছিল্য কিংবা কটাক্ষ করার চেষ্টা হবে খুবই অযৌক্তিক এবং খেলো। কারণ সিনেমাটি কখনোই সত্যাসত্যের দিক থেকে নির্ভুল হতে চায়নি বা ডকুমেন্টারির ভাব জাগাতে চায়নি। পুরোদস্তুর সিনেমা হয়ে উঠতে চেয়েছে। এ সিনেমা তো বনি এবং ক্লাইডের উন্মাদনা নিয়ে, রোমাঞ্চের উদ্দেশ্যে ছোটা নিয়ে, তাহলে ওই সত্যাসত্যের দিকটি আসছেই বা কীভাবে? রোমাঞ্চ অনুভবের প্রাণপণ সে চেষ্টা লক্ষ করা গেছে ওয়ারেন বেটি এবং ফে ডানওয়ের অভিনয়ে। উচ্ছলতা যেন তাদের দু’জনের চোখ ঠিকরে পড়ছিল। দু’টি চরিত্রে আজো প্রাণবন্ত তাদের অভিনয়। তবে শুধু এই কেন্দ্রীয় দু’জনই নিখুঁত অভিনয়শৈলী উপহার দেননি, দিয়েছেন মাইকেল জে. পোলার্ড এবং ক্লাইডের ভাইয়ের চরিত্র রূপদানকারী জিন হ্যাকম্যানও।
‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ শৈল্পিকভাবেও অত্যন্ত প্রভাবশালী সিনেমা। যৌবনচাঞ্চল্যের সাথে ‘ডিপ্রেশন এরা’র একটা নিগূঢ় বিষণ্ণতা পরিলক্ষিত হয় সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমে। সফট ফোকাস ব্যবহার করে এক তন্দ্রালু আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। খ্যাতনামা সিনেমাটোগ্রাফার বার্নেট গাফির হালকা সবুজ আর সোনালির প্যালেটে ধুলোয় মোড়া রুক্ষ শহর, তৃণশ্যামল রাস্তাঘাটের ল্যান্ডস্কেপ এবং ব্যাকগ্রাউন্ডে জ্যাজ প্রধান সঙ্গীত সংযোজন সেই আবহটাকে আরো চড়িয়ে দেয়। একটা নৈসর্গিক অনুভূতি জাগে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ; বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে, ফসলের মাঝে বনিকে ক্লাইডের খুঁজে বেড়ানোর সেই দৃশ্যে। অথচ এমন স্বর্গীয় অনুভূতি জাগাতে, এমন ইমেজারি সৃষ্টিতে কোনো ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসের দরকার হয়নি। বিশাল সেট তৈরি করতে হয়নি। বুদ্ধিদীপ্ততা দিয়েই এমন ‘চমৎকার’ ফিল্মমেকিংয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। আলাদা করে উল্লেখ্য হওয়ার দাবি রাখে ডিড অ্যালেনের হঠকারী সম্পাদনা!
হলিউডি ‘কন্টিনিউটি’ নির্ভর সম্পাদনার ধারাতেই এগিয়েছে তবে নতুনত্বের সন্ধান দিয়েছে। গল্পটায় যে গতিময়তা এবং একটা তাড়া ছিল, সম্পাদনা সে ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে এগিয়েছে। ফাস্ট কাটের ব্যবহার করা হয়েছে। ডাকাতি এবং কমেডি দৃশ্যগুলোতে জাম্প কাট বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলত, একটা আলাদা ছন্দ ওই দৃশ্যগুলোতে যোগ হয়েছে, যা সিনেমায় আরো রসবোধ যুক্ত করেছে। এবং সে কারণেই এই সিনেমা একইসাথে অভিঘাতী এবং রসপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে এ সিনেমা হিংস্র বেশি, নাকি মজাদার বেশি, সে নিয়ে বেশ দ্বন্দ্ব চালু আছে। কিন্তু ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ আসলে পুরোপুরি কোনোভাগেই যেতে চায়নি। বলা যায়, ভায়োলেন্সের সাথে উইট মিশিয়েছে কিংবা উইটের সাথে ভায়োলেন্স। এই দুটো জিনিসের দ্বান্দ্বিক প্রকৃতিকে পাশাপাশি রেখেই মূল সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছে সিনেমাটি। যুগান্তকারী সম্পাদনার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত এ সিনেমার ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য, যা অগ্রবর্তী আমেরিকান সিনেমাগুলোর পরিবর্তনের রূপরেখা হিসেবে কাজ করেছে।
ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে হিংস্রতার অনবদ্য রূপায়ন ফিল্মমেকিংয়ে সাহসিকতা এবং স্বাধীনতার এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছিল। রাস্তার পাশে বনি আর ক্লাইডের গাড়ি দাঁড় করানো তখন। পাশেই ঝোপঝাড়। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা কাজ করছিল সে মুহূর্তে। সেটিংটা একেবারে ফকফকা দিনের আলোয় হওয়াতেই মূলত সেই অস্বস্তিটা কাজ করছিল। নীরবতা ভেঙে দূর থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখা গেল। মাথার উপর অশুভ সংকেত জানিয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল। পাশের ঝোপঝাড়টা নড়েচড়ে উঠল। ক্লাইড খুব দ্রুত বনির দিকে তাকাল। ক্ষণিকের দৃষ্টিবিনিময়েই দুজন বুঝতে পারল, তাদের কয়েক সেকেন্ড পরের নিয়তি সম্পর্কে।
ক্রস কাটের ব্যবহার করে স্ক্রিনে একবার ক্লাইডের বনির দিকে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য, আরেকবার বনির তিক্ততায় ভরা মুখের অভিব্যক্তির ক্লোজআপ, আরেকবার ঝোপের নড়াচড়া; তিনটাই যুগপৎ চলছিল। তারপর অতর্কিত আক্রমণ! ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের এই মুহূর্তটায় স্লো মোশন ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা আর মন্তাজে সেটা বোঝাই যায় না। পানির মতো বুলেট ধেয়ে আসছে তাদের দিকে, তাদের শরীরগুলো এমনভাবে নড়ে উঠছে বারবার, যেন মৃত্যুর উল্লাসে যোগ দিয়েছে এবং তারপর…। সেটিং এবং সম্পাদনায় গোটা দৃশ্যটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে, মৃত্যুর অভিমুখে দাঁড়িয়ে থাকার প্রত্যেকটা মুহূর্ত অনুভব করা যায় রীতিমতো।
এই একটি একক দৃশ্যের হিংস্রতা হলিউডের হেইস কোডের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল।
“শিল্পে থাকবে না কোনো শৃঙ্খল। থাকতে পারে না কোনো শৃঙ্খল;”
এই কথাটিই যেন হুংকার ছেড়ে বলেছিল। সে হুংকারের তেজ আজো কমেনি এতটুকুও।