এ বছর প্রখ্যাত ইহুদী বংশোদ্ভূত সাংবাদিক লেজলি হেইজেলটনের লেখা ‘দ্য ফার্স্ট মুসলিম’-এর অনুমোদিত বাংলা রূপান্তর ‘দ্য প্রফেট’ প্রকাশিত হয়েছে। বইটির ভাষান্তর করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ। ভাষার দিকটি সম্পাদনা করেছেন মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক এবং ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন তথ্য সম্পাদনা করেছেন মুশফিকুর রহমান মিনার।
বইটি ঠিক প্রথাগত সিরাত গ্রন্থ নয়। ‘সিরাত’ শব্দটির অর্থ পথ, এর দ্বারা জীবনীও বোঝানো হয়। সিরাতুন্নাবী, মানে রাসুল (সা)-এর জীবনী। সাধারণত ‘সিরাত’ বলতে রাসুল (সা)-এর জীবনীকেই সাধারণভাবে বোঝানো হয়। সিরাত গ্রন্থে সাধারণভাবে শুধু কুরআন ও হাদিস থেকে রাসুল (সা)-এর জীবনী তুলে আনার চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি, তুলে ধরা হয় এ থেকে মুসলিমদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়গুলো।
এ বইতে লেখক মানুষ মুহাম্মদ (সা)-কে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, তার মনোজগৎ কীভাবে গড়ে উঠেছে, তাঁকে নিয়ে যে বর্ণনাগুলো আছে, এগুলো প্রায় দেড় হাজার বছর পরের একজন ভিন্নধর্মী, আধুনিক মানুষের কাছে বর্তমান সময়ের, আধুনিক বিভিন্ন জ্ঞান, বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যের তুলনায় কীরকম মনে হওয়ার কথা— এ ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করেছেন লেজলি। বিভিন্ন বর্ণনাকে তিনি নির্মোহভাবে কাটাছেঁড়া করেছেন।
পিতা-মাতা হারা এক এতিম বালকের কাছে কঠিন মরু কেমন ছিল? কী আচরণ পেয়েছেন তিনি মক্কার ব্যবসা ও বংশগৌরবপ্রধান মানুষগুলোর কাছে? এগুলো তার মনে কী প্রভাব ফেলেছিল? কেমন ছিল মানুষ হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবনের প্রতিটি পর্ব?
আব্দুল মুত্তালিব মুহাম্মদকে (সা) অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাহলে হালিমা যখন তাঁকে আনতে গেলেন, তাঁর সঙ্গের অন্য কেউ কেন রাসুল (সা)-কে আগেই নিয়ে গেলেন না? পিতৃহীন এই শিশুটিকে কেন হালিমাই নিলেন সবার শেষে? আব্দুল মুত্তালিবের পর আবু তালিব ছিলেন রাসুল (সা)-এর অভিভাবক। তাহলে, মুহাম্মদ (সা) যখন আবু তালিবের মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলেন, কেন তিনি মানা করে দিলেন? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো তুলেছেন লেজলি। দেখিয়েছেন, কীভাবে রাসুলকে (সা) এতিম হিসেবে, পিতাহীন এক শিশু হিসেবে একে একে সব অর্জন করে নিতে হয়েছে।
তিনি দেখিয়েছেন, শিশুকালে মরুতে মেষ চরাতে গিয়ে তিনি কী শিখেছেন, ভবিষ্যতে এসব শিক্ষা কীভাবে তাঁর কাজে লেগেছে। দেখিয়েছেন, ব্যবসাপ্রধান মক্কার সে সময়ের বাস্তবতায় কতটা কঠিন ছিল অনাথ এক বালকের বেড়ে ওঠা। আলোচনা করেছেন, যুদ্ধের সময় বা শাস্তি দেওয়ার সময় কেন প্রয়োজনে কঠিন হয়ে উঠেছিলেন মুহাম্মদ (সা)। বহুবিবাহের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোও তিনি তুলে এনেছেন নির্মোহভাবে, বুঝতে চেষ্টা করেছেন।
বিভিন্ন জায়গায় লেখক বর্ণনার বাইরে গিয়ে রাসুল (সা)-এর মানসিক অবস্থাও বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রথম যখন ওহী পেলেন, তাঁর মনের কী অবস্থা হয়েছিল? প্রচণ্ড কষ্ট হতো তাঁর। প্রথমবার তো মনে হয়েছিল, তিনি বুঝি পাগলই হয়ে গেছেন। এই ব্যাপারগুলো এসেছে হাদিসেই। লেজলি বুঝতে চেষ্টা করেছেন, কতটা কষ্ট হয়েছিল তাঁর। অনুভব করতে চেষ্টা করেছেন, কেমন লেগেছিল তাঁর মক্কা ছেড়ে যেতে। নিজের জন্মভূমি, শেকড় ফেলে যাওয়ার কষ্ট কেমন? কেমন লেগেছিল তাঁর, যখন মক্কা বিজয়ের সময়ে ফিরে এসেছিলেন নিজভূমে?
ব্লার্বে (প্রচ্ছদের পেছনের অংশে) লেখা ‘ভিন্ন আঙ্গিকের এক জীবনী’। কথাটা বলা হয় অনেকক্ষেত্রেই, কিন্তু সত্যি হয় না বেশিরভাগ সময়েই। এই বইয়ের জন্য সেটা সত্যি। তবে ভিন্ন ধরনের হলেও, এটি সিরাত। তাই, মূল ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলাদা করে বলার বিশেষ কিছু নেই। এখানে একটা জিনিস বলে রাখা ভালো, অনুবাদক নিজেও কথাটা বইতে বলে দিয়েছেন। আগে কোনো সিরাত পড়েননি, এমন পাঠকদের জন্য এই বইটি পড়ার আগে অন্য কোনো সিরাত পড়ে নিলে ভালো হবে। প্রথম সিরাত হিসেবে পড়ার জন্য এটি ঠিক উপযোগী নয়।
মূল বই
প্রশ্ন হলো, লেজলি কতটা নির্মোহভাবে তুলে আনতে পেরেছেন এখানে ইসলামের নবীকে? উত্তর, বেশ ভালোভাবে। ইহুদী বংশোদ্ভূত এই মানুষটি কোথাও রাসুল (সা)-কে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেননি। সে সময়ের সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে নবী (সা)-এর জীবনের প্রতিটি পর্বকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন, জানাতে চেয়েছেন মূলত পশ্চিমা বিশ্বের মানুষকে। রাসুল (সা)-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যুদ্ধ ও শাস্তির ব্যাপারে তাঁর ভাবনা ও এর পেছনের কারণ, তাঁর বিচক্ষণতা সবই তিনি তুলে এনেছেন।
এ বইটি লেখার জন্য তিনি মূলত কুরআন শরিফ, ইবনে ইসহাক ও তাবারির লেখা সিরাতকে অনুসরণ করেছেন। বলে রাখা প্রয়োজন, সিরাতে ইবনে ইসহাক, মানে ইবনে ইসহাকের লেখা সিরতা-ই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সিরাত গ্রন্থ। এর সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত রূপের নাম সিরাতে ইবনে হিশাম, এটি বহুল পঠিত ও অন্যতম নির্ভরযোগ্য সিরাত গ্রন্থ বলে বিবেচিত।
তবে, লেখক বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু তথ্যে ভুল করেছেন। অনুবাদক এই ভুলগুলো যথাসম্ভব ঠিক করে দিয়েছেন, জুড়ে দিয়েছেন টীকা। টীকাগুলোর দরকার ছিল।
অনুবাদ
অনুবাদ নিঃসন্দেহে দারুণ। তবে, আরও ভালো কি হতে পারত? হয়তো। ভালোর আসলে কোনো শেষ নেই। কিন্তু যে চলমান, গতিশীল ভাষায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ বইটিকে বাংলায় হাজির করেছেন, তা পড়তে গিয়ে থামা দুষ্কর। যে পাঠকেরা তার মৌলিক লেখা পড়েছেন, তারা ব্যাপারটা ভালো বুঝতে পারবেন। বই পড়ার সময় মনে হবে না, অনুবাদ পড়ছেন।
অনুবাদকের দেওয়া টীকাগুলো শুধু লেখকের তথ্যগত ভুল শুধরেই দেয়নি, বিভিন্ন জায়গায় ঘটনার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাও দিয়েছে। এ ধরনের একটি বইতে এ রকম টীকা সংযোজন দরকার ছিল। অনুবাদকের পরিশ্রম সম্পর্কেও এখান থেকে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রশ্ন আসে। এক, অনুবাদ ভালো হয়েছে সত্যি, কিন্তু এটা কি লেখকের টোনকে ধরে রাখতে পেরেছে? দুই, অনুবাদক কি প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন করেছেন? দুটো প্রশ্নের উত্তরেই বলতে হয়, মূল বইটি পড়া না থাকলে এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। তবে পাঠক হিসেবে এটুকু বলা যায়, অনুবাদটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অনুমোদিত। এটি লেখকের টোনকে কতটা ধরে রাখতে পেরেছে, তা বলতে হলে আলাদা ভাবে মূল বইটি গভীরভাবে পঠন জরুরি। তবে লেখকের নির্মোহ বিশ্লেষণকে তুলে এনেছে বেশ ভালোভাবেই। তাছাড়া, অনুবাদ পড়ে রাসুল (সা)-এর জীবনকে, তাঁর মানুষ সত্ত্বাটিকে অনুভব করা যায়। পড়তে পড়তে কারো চোখ ভিজে ওঠে, রোমাঞ্চ অনুভব হয়, থমকে যেতে হয় ঘটনার ঘনঘটায়। এজন্য অনুবাদক নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাবেন।
সমালোচনা
প্রথমত, লেখকের কথা বললে, লেখকের তথ্যগত অনেক ভুলই অনুবাদক ঠিক করে দিয়েছেন টীকায়। তবু কিছু জিনিস রয়ে গেছে। এগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ভুল বলা চলে না হয়তো, তবে এই জায়গাগুলোতে আরেকটু যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। যেমন, ১১৪ পৃষ্ঠায় লেখক মক্কার লোকদের অবস্থা বোঝাতে বলছেন, “পূর্বপুরুষদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা প্রায় পূজনীয় স্তরে চলে গিয়েছিল- তবে না, তারা উপাস্য ছিল না। সবচেয়ে ক্ষমতাবানদের কবর হয়ে যেত মাজার, আজকের দিনেও প্রথিতযশা র্যাবাই, সেইন্ট আর ইমামদের কবরের ক্ষেত্রেও আমরা একই ঘটনা ঘটতে দেখি। অর্থাৎ, এ ব্যাপারটা ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম তিন ধর্মেই বিদ্যমান।” এখানে টীকা দেওয়া দরকার ছিল সাবধানতার জন্য, ইসলাম ধর্মে মাজার পূজা নেই, এটা ইসলাম সমর্থন করে না।
এছাড়া, সম্পাদনায় বেশ কিছু ভুল রয়ে গেছে। পাশাপাশি অনুচ্ছেদে একই ব্যক্তিকে কোথাও ‘তার’, কোথাও ‘তাঁর’ বলা হয়েছে, একইবাক্যে ‘তিনি’ ও ‘তার’ চলে এসেছে ইত্যাদি। পাশাপাশি, বেশ কিছু বানান ভুল আছে। এটা বিভিন্ন বানানরীতির সমস্যা নয়। এককথায়, সম্পাদনায় আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন ছিল।
রচয়িতাদের সম্পর্কে
লেখক লেজলি হেইজেলটন ইহুদী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান নাগরিক। সাইকোলজি বিষয়ে অনার্স করেছেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, মাস্টার্স করেছেন জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন জেরুজালেমে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, হারপার্স ইত্যাদি থেকে। ২০১১ সালে তিনি সাহিত্যে ‘জিনিয়াস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। এই বইটি লিখেছেন মূলত পশ্চিমাদেরকে রাসুল (সা)-এর ব্যাপারে জানাতে। এছাড়াও ‘আফটার দ্য প্রফেট’, ‘মেরি’, ‘জেজেবেল’ ইত্যাদি তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
অনুবাদক আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎকৌশলে অনার্স করেছেন ও আইবিএ থেকে এমবিএ করেছেন। রোর বাংলার মাধ্যমে তার লেখালেখি শুরু। ইতিহাস, কিংবদন্তি ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব তার পছন্দের বিষয়। ইহুদী জাতির ইতিহাস, অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে ও সিক্রেট মিশনস : মোসাদ স্টোরিজ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য বই।
সবমিলিয়ে এই হলো ‘দ্য প্রফেট’। লেজলির এই বইটি পড়ে জীবনীগ্রন্থ পড়ছেন বলে মনেই হবে না। যারা সিরাতে আগ্রহী, ফিরে যেতে চান দেড় হাজার বছর আগের সেই সময়ে এবং বুঝতে চান রাসুল (সা)-এর জীবনের প্রতিটা পর্ব ও সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, অনুভব করতে চান মুহাম্মাদ (সা)-এর ব্যক্তিগত অনুভূতির মুহূর্তগুলোকে, এই বইটি তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।