ডার্ক উইজার্ড শব্দটা শুনলেই চলে আসে লর্ড ভলডেমর্ট বা গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের নাম। কিন্তু কে ছিল জাদু জগতে এই ডার্ক ম্যাজিকের পথিকৃৎ? এই প্রশ্ন হয়তো অনেক পটারহেডের অনুসন্ধিৎসু মনে উঁকি দিয়েছে। জে. কে. রোলিংয়ের সৃষ্ট উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের ইতিহাসে প্রথম সন্ধান পাওয়া ডার্ক উইজার্ড বা কালো জাদুকর হলেন ‘হারপো দ্য ফাউল’। সর্বাধিক প্রাচীন জাদুকরদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার সম্বন্ধে খুব অল্প তথ্যই জানা গেছে। তিনি কখন এই পৃথিবীতে হেঁটে বেরিয়ে কালো যাদুর চর্চা করে গেছেন, সে সম্পর্কে উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। জাদু মন্ত্রণালয়ও তার ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করেনি। এইচপি লেক্সিকনের তথ্যানুযায়ী, তিনি ছিলেন ক্লাসিক্যাল পিরিয়ডের (যা শুরু হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর পূর্বে) সামসময়িক একজন জাদুকর।
তখন প্রাচীন যুগ চলছে। আজকের জাদু জগতে বিদ্যমান শান-শওকতের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না সেসময়। না ছিল কোনো জাদু মন্ত্রণালয় বা জাদু বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব। জাদুকরেরা তাদের সন্তানদের তখন ঘরে বসেই জাদু শিক্ষা দিতেন। কারণ জাদু নিয়ন্ত্রণ করা জানলে, তা মাঝেমধ্যে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াত। জাদুর ছড়িটা পর্যন্ত বানাতে হতো নিজেদের। সেই যুগে জাদুকর সমাজ আর জাদু না জানা সাধারণ মানুষের (মাগল) সমাজ কোনো মোটা দাগে বিভক্ত ছিল না, তারা একই সাথে বসবাস করত। কিন্তু কাল পরিক্রমণের সাথে সাথে একসময় মাগলেরা জাদুকরদের উপর দলবেঁধে অত্যাচার শুরু করে। ফলে, কোণঠাসা হয়ে পড়ে জাদুকর সমাজ। নিজেদের জাদুকরী ক্ষমতা নিজেদের মধ্যেই দাফন করে দিতে থাকে তারা।
জাদুকরের সন্তানেরা রূপ নেয় অবস্কিউরিয়ালে, যাতে কোনো মাগল তাদের মারতে আসলে তারা মুহূর্তেই পালিয়ে যেতে পারে। ধারণা করা হয়, মাগল কর্তৃক জাদুকর নিধনের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়েই প্রাচীন গ্রিসের এক জাদুকর পরিবারে জন্ম নেয় হারপো দ্য ফাউল। স্বজাতির উপর অত্যাচারের এই নির্মম দৃশ্য বালক হারপোর কোমল মনে গভীর দাগ কেটে যায়।
হারপো দ্য ফাউল ডার্ক ম্যাজিক চর্চার দিকে কেন ঝুঁকেছিলেন, সে বিষয়টা এখনো অজানা। কিন্তু জন্মগতই তিনি ছিলেন একজন পারসলমাউথ অর্থাৎ তিনি সাপের ভাষায় কথা বলতে পারতেন, এবং সে ভাষা পুরোপুরি বুঝতেন। এক্ষেত্রে তার অধিক মিল লক্ষ্য করা যায় সালাজার স্লিদারিন এবং লর্ড ভলডেমর্টের সাথে। জাদু জগতে পারসলমাউথ এমন এক ক্ষমতা, যা বংশপরম্পরায় বাহিত হয়। সে হিসেবে, অনেকে সালাজার স্লিদারিনকে হারপো দ্য ফাউলের উত্তরসূরি বলে মনে করেন। পারসলটাংয়ের ক্ষমতা গন্ট পরিবারের সবার মধ্যেও নিহিত ছিল। এছাড়াও, ডার্ক ম্যাজিকের প্রতি স্লিদারিনের প্রবল আগ্রহ সেই সম্ভাবনার পালে জোর হাওয়া প্রদান করে। হারপো দ্য ফাউলের সাথে সালাজার স্লিদারিনের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সে ব্যাপারে জে. কে. রোলিং এখনো কিছু বলেননি।
জাদু জগতে সর্বপ্রথম সফলভাবে হরক্রাক্স তৈরিতে সফল হয়েছিলেন হারপো দ্য ফাউল। হরক্রাক্স হলো জাদু ক্ষমতাসম্পন্ন বস্তু, ডার্ক ম্যাজিক বা কালো জাদুর একটি উপকরণ যা অমরত্ব লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। একে রূপকথায় বর্ণিত প্রাণ ভোমরার সাথে তুলনা করা যায়। হারপোর আগেও হয়তো হরক্রাক্স বানানোর নিয়ম জাদুকরদের জানা ছিল, কিন্তু কেউ সফল হতে পারেনি। সঠিক নিয়ম প্রয়োগের মাধ্যমে হরক্রাক্স তৈরিতে সফল হবার দরুন হারপো দ্য ফাউলকেই প্রথম সফল হরক্রাক্স নির্মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এজন্য তিনি ডার্ক ম্যাজিক নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন, পুরো জীবনটাই তিনি ব্যয় করেছেন ডার্ক ম্যাজিক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পেছনে। জীবদ্দশায় তিনি বহু ডার্ক কার্স তৈরি করে রেখে গেছেন।
হরক্রাক্সের বৈশিষ্ট্যটা আবার মিলে যায় লর্ড ভলডেমর্টের সাথে, যে তার আত্মাকে ছয়টা হরক্রাক্সে বিভক্ত করেছিল। কিন্তু হারপো অমর হবার উদ্দেশ্যে তার আত্মাকে পুরে রেখেছিল শুধু একটা হরক্রাক্সেই। অর্থাৎ তিনি হরক্রাক্স তৈরি করেছিলেন মাত্র একটা। তিনি ঠিক কোন জিনিসটাকে হরক্রাক্সে রূপান্তরিত করেছিলেন, বা সেটা ঠিক কোথায় লুকানো ছিল সে বিষয়ে কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। জনশ্রুতি আছে, তিনি এই হরক্রাক্স বানানোর জন্য এক মাগলকে হত্যা করেছিলেন। এভাবেই কালো জাদু, হিংস্রতা আর নিজ দক্ষতার সংমিশ্রণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অমর। যার ফলে তার দেহ পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেলেও তিনি ভবঘুরে আত্মা নিয়ে চষে বেড়াতে পারবেন এই পৃথিবীতে।
হারপো দ্য ফাউল সম্পর্কে একটু অংশ উঠে এসেছে হ্যারি পটার সিরিজের প্রিকুয়েল ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়ার টু ফাইন্ড দেম’ বইয়ে। সেখানে হাফলপাফের উইজার্ড নিউট স্ক্যামান্ডার বলেছিল,
“জাদু জগতের ইতিহাসে প্রথম ব্যাসিলিস্ক ব্রিডিংয়ের নজির পাওয়া যায় ‘হারপো দ্য ফাউল’ এর কাছে। তিনি ছিলেন একজন গ্রিক ডার্ক উইজার্ড এবং পারসলমাউথ (সর্প-ভাষা জানা লোক)। প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, একটি মুরগির ডিমকে ব্যাঙের নিচে তা দিলে সেটা ফুটে অতি দানবীয় ক্ষমতা সম্পন্ন এক রাক্ষুসে সাপের জন্ম হয়।”
তার সৃষ্টি করা ব্যাসিলিস্ককে তিনি পারসলটাংয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। বলতে গেলে, হারপোর কাছে ব্যাসিলিস্ক ছিল এক পোষা প্রাণীর মতো। ধারণা করা হয়, একেকটা ব্রিডিং করা ব্যাসিলিস্ক প্রায় ৯০০ বছরের মতো বেঁচে থাকতে পারত। যদি স্লিদারিন হারপো দ্য ফাউলের আত্মীয় হয়ে থাকেন, তবে চেম্বার অভ সিক্রেটস থাকা ওই ব্যাসিলিস্ক আসল মালিক হতে পারেন হারপো নিজেই। তবে এর স্বপক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ নেই।
হারপো শব্দটা জে. কে. রোলিং নিয়েছেন প্রাচীন গ্রিক শব্দ, ‘হারপেটন’, যার অর্থ হলো সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। বর্তমানে উভচর আর সরীসৃপ নিয়ে গবেষণাকে বলা হয় ‘হারপেটোলজি’। তেমনিভাবে ব্যাসিলিস্ক হলো এক প্রকার বৃহৎ সাপ যা সরীসৃপ উপপর্বের অন্তর্ভুক্ত।
হারপো দ্য ফাউল স্বাভাবিকভাবেই মারা গিয়েছেন, নাকি তার হরক্রাক্স ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল তা এখনো জানা যায়নি। যদি হরক্রাক্স ধ্বংস না করা হয়ে থাকে, তবে তিনি এখনো জাদু জগতে বেঁচে আছেন। তবে তার অবস্থা হবে খুবই শোচনীয়; যা প্রফেসর হোরেস স্লাগহর্ন টম রিডলকে হরক্রাক্সের ব্যাপার বলার সময়েই বর্ণনা করে গেছেন।
মজার ব্যাপার হলো, হারপো এমন এক জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার দাঁত দিয়ে হরক্রাক্স ধ্বংস করা যায়। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অভ সিক্রেটস’ বইয়ে হ্যারি ব্যাসিলিস্ক দিয়ে টম রিডলের একটি হরক্রাক্স ধ্বংস করেছিল। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে হরক্রাক্সের সৃষ্টি ও ধ্বংস; দুটোই হারপোর আবিষ্কার।
জাদু জগতে উল্লেখিত প্রাচীন গ্রিসের কয়েকজন জাদুকরঃ
- আন্দ্রোস দ্য ইনভিসিবল – তিনি দৈত্যাকৃতির প্যাট্রোনাস তৈরি করতে পারতেন।
- ক্যালচাস – একজন জাদুকর, যিনি তার বন্ধু ‘মপসাস’ এর সঙ্গে জাদু ক্ষমতা নিয়ে টেক্কা দিয়ে হেরে গিয়েছিলেন।
- সার্সি – একজন প্রসিদ্ধ মহিলা জাদুকর যিনি নাবিকদের শুকরে পরিণত করায় দক্ষ ছিলেন।
- ফ্যালকো অ্যাসেলন – সর্বপ্রথম অ্যানিম্যাগাস।
- মপসাস – ক্যালচাসের বন্ধু, দক্ষ জাদুকর।
- গ্রিক ম্যান – যে রুবিয়াস হ্যাগরিডের কাছে তিন মাথাওয়ালা কুকুর বিক্রি করেছিল।
হ্যারি পটারের জাদু জগতে হারপো দ্য ফাউল এক অবিস্মরণীয় নাম হলেও, তার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের পাঁড় ভক্ত ছাড়া হারপো দ্য ফাউলকে চিনে বা তার নাম শুনেছে, এমন মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। হারপো দ্য ফাউলের হরক্রাক্স কোথায় আছে, কীভাবে আছে তা কেউ জানে না। যদি তার হরক্রাক্স অক্ষত অবস্থায় থেকে থাকে, তবে জাদু জগতে এখনো তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। হয়তো তিনি রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়ান গন্ট পরিবারের পরিত্যক্ত বাড়িতে বা হতাশার গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলেন হগওয়ার্টস স্কুল অব উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রির ঘুটঘুটে অন্ধকার কোনো কুঠুরিতে।