![](https://archive.roar.media/wp-content/uploads/2023/02/Feature-Image-New-copy-15.jpg)
সানসেট বুলেভার্ড (১৯৫০), সিনেমা পারাদিসো (১৯৮৮), ক্লোজ-আপ (১৯৯০), মুলহল্যান্ড ড্রাইভ (২০০১) বা হালের ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন হলিউড (২০১৯)। সিনেমা নিজে চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছে বারংবার। এবার ব্যাবিলন (২০২২)-এর মাধ্যমে সিনেমা এবং হলিউডের স্বর্ণালি যুগকে ট্রিবিউট দিলেন অস্কারজয়ী পরিচালক ডেমিয়েন শ্যাজেল।
ব্যাবিলনের শুরুতে শ্যাজেল আমাদেরকে নিয়ে যান নির্বাক হলিউডের অন্তিমকালে। ক্রমান্বয়ে আমরা দেখতে পাই সিনেমায় শব্দের আগমনসহ আরো নানা খুঁটিনাটি বিষয়। গল্পের চরিত্রদের সাথে সাথে বড় হতে থাকে হলিউড এবং সিনেমা। হলিউডের প্রতি নিজের এই এপিক ট্রিবিউটের গল্প ফাঁদতে তিনি বাস্তব ইতিহাস এবং মানুষজনের জীবন থেকে নির্যাস নিয়েছেন। সাথে যোগ করেছেন স্বীয় কল্পনা। এসবের সাথে যোগ হওয়া নানা হলিউডি শ্রুতি, আখ্যান এবং অতিকথন মিলে গল্পটি লাভ করেছে বর্ণিল রূপ। ১৮৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটির উপস্থাপনাকে মহিমান্বিত করতে প্রচেষ্টার কোনো কমতি দেখা যায়নি তার মাঝে।
সিনেমার বিবর্তনের পাশাপাশি ব্যাবিলনের গল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দু এখানকার ৬টি চরিত্র। এসকল চরিত্রের উত্থান-পতনের পাশাপাশি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে হলিউড। চরিত্রগুলো হলো যথাক্রমে ম্যানুয়েল ‘ম্যানি’ তোরেস (ডিয়েগো ক্যালভা), নেলি লেরয় (মার্গো রবি), জ্যাক কনরাড (ব্র্যাড পিট), এলিনর সেইন্ট জন (জিন স্মার্ট), সিডনি পালমার (জোভান আদেপো) এবং লেডি ফে ঝু (লি জুন লি)। কয়েকটি বাদে এখানকার সবগুলো চরিত্রই গড়ে উঠেছে তৎকালে হলিউডে কাজ করা মানুষজন এবং তাদের পরিণতির সংমিশ্রণে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/02/image2-1024x682.jpg)
প্রথম দৃশ্যে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্যালিফোর্নিয়ার জনশূন্য একটি রাস্তা। সময় ১৯২৬ সাল। ম্যানি অপেক্ষা করে আছে একজন ট্রাক ড্রাইভারের আগমনের। সে তাকে সাহায্য করবে একটি অতিকায় হাতিকে বহন করে নিয়ে যেতে। হাতিটি একটি পার্টির অন্যতম আকর্ষণ। পার্টির আয়োজক কিনোস্কোপ স্টুডিওর এক্সিকিউটিভ ডন ওয়ালাচ। হাতিটিকে পার্টির ভেন্যুতে নিয়ে আসতে গিয়ে বেশ বেগ পোহাতে হয় ম্যানিকে। এসব বিপত্তি কাটানোর জন্য কিছু ব্যক্তিকে ওয়ালাচের পার্টিতে ঢুকতে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় তাকে।
অবশেষে সকল বিপত্তির অবসান ঘটিয়ে হাতি নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হয় ম্যানি। সকলের আকাঙ্ক্ষিত এই পার্টিকে আমরা তুলনা করতে পারি প্রাচীন গ্রিসের ধনবানদের উদ্দাম ‘বাকানালিয়া’ উৎসবের সাথে। মদ, যৌনতা, মাদক, ফেটিশিজম, সঙ্গীত- কোনোকিছুরই অভাব নেই সেখানে। ম্যানির পাশাপাশি বাকি চরিত্রদেরও দেখা মিলবে এখানে।
সিডনি পালমার ট্রাম্পেট বাজাচ্ছেন তার ব্যান্ডের সাথে। ফুসরতের সময় তর্কে মাতছেন ব্যান্ডের আরেক সদস্যের সাথে। সবসময়ের মতো চিত্তাকর্ষক লেডি ফে মঞ্চে আসেন। চটুল এক গান পরিবেশনার মাধ্যমে সকলের মনও জিতে নেন। বিনোদন সাংবাদিক এলিনরও আছেন। সবাই তার কাছ থেকে অবস্থান করতে চায় নিরাপদ দূরত্বে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/02/image4-1-1024x687.jpg)
খানিকটা দেরি করে পার্টিতে আসেন জ্যাক কনরাড। নির্বাক চলচ্চিত্রের অন্যতম খ্যাতিমান এ তারকার বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। বরাবরের মতো পার্টিতেও স্ত্রী বিষয়ক ঝামেলা তার সঙ্গী। এরকম ঝামেলায় তাকে আমরা পড়তে দেখব বার বার। তারপর জোর করে পার্টিতে ঢুকতে গিয়ে ম্যানির সাথে পরিচয় হবে নেলির। তাদের মাঝে নৈকট্য আসতে দেখতে পাবো আমরা। কথায় কথায় উভয়ে একে অপরকে জানাবে নিজেদের অতীতের কথা, স্বপ্ন-আশার কথা। এসব কথা যখন চলছে তখনও তারা জানে না যে, রাত পোহালেই বাস্তব রূপ পাবে উভয়ের স্বপ্ন। নেলি পাবে তার বহুল আকাঙ্ক্ষিত ব্রেক। ম্যানি কাজ পাবে সিনেমার সেটে, যেখানে কাজ করতে চাচ্ছিল সে বহুদিন ধরে। কিন্তু সুযোগ মিলছিল না। কথোপকথনের একপর্যায়ে ম্যানি বলে ওঠে,
I just love watching films, you know?
শ্যাজেলসহ সকল সিনেমাপ্রেমীর হৃদয়ের কথা যেন প্রতিধ্বনিত হয় ম্যানির মুখে।
তার পরদিন এসব ক্যারেক্টারের সাথে আমরা চলে যাই হলিউডের সিনেমার সেটে। যেখানে স্বপ্নেরা মূর্ত হয়, মিথ এবং ইতিহাস হাতে হাত ধরে চলে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কীভাবে নির্বাক জমানায় সিনেমার শ্যুটিং হতো। কত ধরনের ঝামেলা প্রকট হতো। কীভাবেই বা এসব সমস্যার সমাধান করা হতো।
এরপরের গল্প উত্থানের। ক্যালেন্ডারে আসে ১৯২৭ সাল। ক্যামেরার সামনে নেলি, জ্যাক; আর তাদের আশপাশে ম্যানিসহ অন্যান্যরা তর তর করে বাইতে থাকে সাফল্যের সিঁড়ি। লাভের গুড় খেতে এগিয়ে পিঁপড়ারাও। এ বছরই শব্দ সংযুক্ত হয় সিনেমায়। জ্যাক ম্যানিকে পাঠায় এসব ‘টকিজ’-এর ভবিষ্যত কেমন হবে সে ব্যাপারে জেনে রিপোর্ট করতে। ম্যানি বলে ভবিষ্যৎ টকিজেরই হবে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/02/image1-1-1024x682.jpg)
এভাবে ক্রমান্বয়ে আমরা দেখতে থাকি ১৯২৮, ১৯৩০ এবং ১৯৩২ সাল। নির্বাক সিনেমার সূর্য অস্ত গিয়ে সবাক সিনেমার সূর্য উদিত হয়। এই রুপান্তরের ফলে সিনেমার নির্মাণশৈলী এবং কলাকুশলীদের কাজে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তা-ও দেখানো হয়। উত্থানের পর স্বভাবতই আসে পতন। গল্পের পরিচিত চরিত্রগুলোকে আমরা নানা ঘাত-প্রতিঘাত পোহাতে দেখি। কেউ কাছের বন্ধুর আচরণে অপমানিত বোধ করে। কেউ বা বদভ্যাসের ফাঁদে পড়ে জীবনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। বুদ্ধিমানরা বুঝতে পারে তাদের সময় ফুরিয়েছে। তবে সকলেই আবার স্বরূপে ফেরার চেষ্টা অন্তত একবার হলেও করে। জ্যাক-এলিনর এবং জ্যাক-লেডি ফে-র মধ্যে দুটি কথোপকথন দেখানো হয়। এগুলো আমাদেরকে সিনেমা এবং ভাঙা-গড়ার শাশ্বত নিয়মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শেষের সিকোয়েন্সে আমরা চলে আসি ১৯৫২ সালে। পরিচিত একটি চরিত্র আবারও ফিরে আসে হলিউডে। হলে বসে সে দেখে ‘সিংগিং ইন দ্য রেইন’। স্মৃতিপটে এসে ভীড় করে পুরনো স্মৃতিরা। মনে পড়ে আগের বন্ধুদের। এদিকে পর্দায় শ্যাজেল স্থান-কালের গন্ডি ভেদ করে দেখাতে থাকেন চলচ্চিত্রের রুপান্তর। যেখানে স্থান পায় ‘সিংগিং ইন দ্য রেইন’ থেকে শুরু করে ‘দ্য টার্মিনেটর’ (১৯৮৪) এবং ‘অ্যাভাটার’ (২০০৯)। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে জাস্টিন হুরউইটজের কম্পোজ করা ‘ভুডু মামা’। সিনেম্যাটোগ্রাফার লিনাস স্যান্ডগ্রেন ক্যামেরাকে হলের সারি ধরে নিচের দিকে নামাতে থাকেন। আমরা দেখতে পাই সেখানে বসে আছে নানা বয়সের, নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন। এটি আমাদেরকে সিনেমা শিল্পের সর্বব্যাপীতার কথা মনে করিয়ে দেয়। শ্যাজেলের ট্রিবিউটকে মহিমান্বিত রূপ দিতে সিনেম্যাটোগ্রাফি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের অবদান অনস্বীকার্য।
ব্যাবিলন-এ ডেমিয়েন শ্যাজেল পুরনো হলিউডের প্রতি প্রেমভাব দেখিয়েছেন। বর্ণনা করেছেন তার বর্ণিল রোশনাই, উল্কীয় উত্থান-পতনের গাঁথা। তবে ইন্ডাস্ট্রির কদর্য দিকটির কথা তিনি ভোলেননি। এদিক থেকে সিনেমাটিকে একটি স্যোশাল কমেন্ট্রিও বলা চলে।
![](https://roar.media/wp-content/uploads/2023/02/image10-1024x420.jpg)
আমরা দেখতে পাই সহায়-সম্বলহীন মানুষদের ত্যাগ। সবকিছু ছেড়ে তারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসে হলিউডের আলোকজ্জ্বল দুনিয়ায়। তারপর এমন বিষাক্ত পরিবেশে তারা পড়ে যে, ভুলে যেতে চায় নিজেদের জন্মপরিচয়। এই পরিবেশে মানুষ বাধ্য হয় নিজের বন্ধুকে ছোট করতে। আছে বর্ণবাদ, অপরকে ছোট করে দেখা প্রবণতা। আছে শারীরিক এবং মানসিক নিগ্রহ। ক্যারিয়ার বাঁচাতে অসহায়দের এলিটদের কাছে ধর্না দিতে হয়। নিজেদেরকে তাদের ছাঁচে ফেলতে হয়, সহজাত আচরণকে দমিয়ে রাখতে হয়। তবুও তাদের মন পাওয়া যায় না। ফলে হানা দেয় বিষণ্নতা। ফুল হয়ে ফোটার আগে ঝরে পড়ে কুঁড়ি।
সিনেমাটির ঐতিহাসিক শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সকল আর্টকে পলিটিক্যালি কারেক্ট হতেই বা হবে কেন? এটি ইন্ডাস্ট্রি সংক্রান্ত মিথ আর গালগল্পে ভরা শ্যাজেলের কল্পিত হলিউড। ব্যাবিলন একটি এক্সপেরিয়েন্স। এই এক্সপেরিয়েন্স নিতে আপনিও বসে যেতে পারেন সুদীর্ঘ ট্রিবিউটটি দেখতে। পরিচিতদের ক্যামিও যে অনুভূতিকে করবে আরো মধুর।