
‘স্পাই স্টোরিজ’ বইটি সাজানো হয়েছে এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য ছয়টি বাস্তব গল্প দিয়ে। এসপিওনাজ (Espionage), এই স্প্যানিশ শব্দটির ঠিকঠাক ইংরেজি অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় স্পাইয়িং (Spying); অর্থাৎ গুপ্তচরবৃত্তি। ‘স্পাই’ শব্দটা উচ্চারণ করতেই আমাদের কল্পনার ইলাস্ট্রেশনে, জেমস বন্ড কিংবা সিনেমার কোনো দুর্ধর্ষ স্পাই হিরোর অবয়ব ফুটে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, বাস্তবিক স্পাইদের জীবন, সিনেমাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। স্পাই স্টোরিজ বইটিতে রয়েছে এমনই ছয়জন স্পাইয়ের জীবন গল্প, যা সত্যিই সিনেমার থেকেও বেশি অ্যাডভেঞ্চার আর থ্রিলারে ভরপুর।
বইটির লেখক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা, পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হলেও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা অসাধারণ। তিনি ফেসবুক, রোর বাংলা ও তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে নিয়মিত বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে লিখালেখি করেন। স্পাই স্টোরিজ বইটি পড়তে বসলে নিঃসন্দেহে যেকোনো পাঠক, লেখকের গল্প বলার ধরনে আলাদা একরকমের স্বাদ পাবেন, যা অ্যাডভেঞ্চারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে। সেই সাথে বেশ ভালো ধারণা মিলবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে।
তাহলে জেনে নেওয়া যাক ‘স্পাই স্টোরিজ’ বই এর ৬টি গল্প সম্পর্কে। অবশ্যই, গল্পের রিভিউয়ে কোনো স্পয়লার থাকছে না।
১. অ্যাডলফ তোলকাচভ: বিলিয়ন ডলার স্পাই

অ্যাডলফ তোলকাচভের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার বেশ কিছু বছর আগে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছেন। ১৯৪১ সালে নিজের মাতৃভূমিকে জার্মান বিমান হামলায় বিধ্বস্ত হতে দেখেছেন। কারণ, তৎকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাডার প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না। সেই থেকেই ঠিক করেছিলেন, দেশের জন্য কিছু করবেন। পড়াশোনা শেষে সে সুযোগটাও এসে যায়। তার পড়াশোনার একটা বিশেষ অংশ জুড়ে ছিল রাডার প্রযুক্তি। তাই তিনি যোগদান করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাডার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে। যথেষ্ট মেধাবী হওয়ায় অল্প সময়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন রাডার বিভাগের শীর্ষ পদে।
বিয়ে করেছিলেন ২২ বছর বয়সী নাতাশা নামের এক সহকর্মীকে। নাতাশা বাল্যকালে বাবা-মা’কে হারিয়ে ভীষণ হতাশায় সোভিয়েত বিরোধী হয়ে উঠেছিল, কারণ সবকিছুর মূলে ছিল সোভিয়েত সরকার। নাতাশার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় তোলকাচভ। মূলত স্ত্রীর কষ্টের ভাগ নিতেই, সেও হয়ে ওঠে সোভিয়েত বিরোধী। ভাবতে থাকে, কীভাবে নিজের দেশের ক্ষতি করা যায়। ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পড়ে গুপ্তচরবৃত্তির সাথে, হয়ে ওঠে আমেরিকার সিক্রেট এজেন্ট। এরপরই তোলকাচভের স্পাই জীবনে শুরু হয় যত নাটকীয়তার।
২. ব্রায়ান রিগ্যান: যে স্পাই বানান করতে জানত না

ওয়াশিংটন ডিসির এফবিআইর ফিল্ড অফিস কিছু বেনামি চিঠি হাতে পায়, যেগুলো বিশেষ সাইফার কোডে লেখা, উদ্দেশ্য লিবিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান। চিঠিতে কেউ একজন দাবি করেছেন, তিনি সিআইএ’র একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এবং তিনি লিবিয়াকে এমন কিছু তথ্য দিতে চান, যেগুলো আমেরিকা গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে লিবিয়া থেকে সংগ্রহ করেছেন। লিবিয়া এ ব্যাপারে আগ্রহী হলে যেন চিঠিতে দেয়া ই-মেইল অ্যাড্রেসে যোগাযোগ করে।
এই কেসটি সমাধান করার দায়িত্ব পড়ে এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট স্টিভেন কারের উপর। স্টিভেন কেসটা হাতে নিয়ে একরকম হতভম্ব হয়ে যায়, কারণ চিঠির সাথে কিছু স্পর্শকাতর তথ্যও পাঠানো হয়েছিল, যেগুলো আমেরিকার স্পাই ড্রোনগুলো দিয়ে সংগ্রহ করা।
চিঠিতে দেওয়া ই-মেইল অ্যাড্রেসের সূত্র ধরেই প্রাথমিক অনুসন্ধান চলতে থাকে। তবে ই-মেইলের চেয়ে চিঠির আরো একটি সূত্র বেশ কাজে লেগেছিল, সেটি হলো, চিঠিতে প্রচুর বানান ভুল। যে সাইফার কোডে চিঠি লিখতে পারে, সে নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃত বানান ভুল করার মতো ব্যক্তি নয়! এটি মূলত একপ্রকার ব্যাধি, যা ডিসলেক্সিয়া নামে পরিচিত। এই ব্যাধিতে আক্রান্তরা অক্ষর চিনতে ভুল করে প্রায়।
আমেরিকার সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগে, স্পাই স্যাটেলাইটের দায়িত্বে থাকা এমনই একজন ডিসলেক্সিক প্যাট্রিক রিগ্যান। সন্দেহটা তার উপরেই পড়ে। তবে ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত মানুষগুলো সাধারণত সহজ-সরল হয়ে থাকে। রিগ্যানও তেমনই একজন, সে কী করে দেশের বিরুদ্ধে এমন কাজ করতে পারে?
৩. এজেন্ট স্টর্ম: যে স্পাই আওলাকিকে ধরিয়ে দিয়েছিল

মর্টেন স্টর্ম; ডেনমার্কের একটি বিচ্ছিন্ন পরিবারে বেড়ে উঠা অশৃঙ্খল, রোমাঞ্চপ্রেমী এক তরুণ। ২১ বছর বয়সে হঠাৎই ধর্মান্তরিত মুসলিম হয়ে, উগ্রপন্থী বন্ধুদের সহায়তায় আল-কায়েদায় যোগ দেয়। পরিচয় হয় আল-কায়েদার প্রভাবশালী নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির সাথে। স্টর্মের সাথে আওলাকির পরিচয় হয় ইয়েমেনে। আওলাকি স্টর্মকে পছন্দ করতেন, তার জিহাদি চেতনার জন্য, বিশ্বাসও করতেন ভীষণ।
আমেরিকার ভয়ে আওলাকি আত্মগোপন করে আছেন। তবে স্টর্ম এখন ডেনমার্কে থাকলেও তার সাথে যোগাযোগ হয় নিয়মিত। আওলাকি নিঃসঙ্গতা দূর করতে তৃতীয় বিয়ে করতে চান; কারণ, তার আগের দুই স্ত্রী এখন তার সাথে নেই। স্টর্ম ডেনমার্ক থেকে আমিনা নামের এক রূপসী তরুণীকে আওলাকির বিয়ের জন্য পাঠায়। সাথে আমিনাকে একটি লাগেজ উপহার দেয় এবং সেখানেই প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে। মানে, সেই লাগেজে একটি ট্র্যাকিং ডিভাইস জুড়ে দেয়, যেন আমেরিকা আওলাকিকে খুঁজে বের করতে পারে। স্টর্ম আওলাকির আস্থাভাজন হয়েও এমন বিশ্বাসঘাতকতা করার কারণ, সে ইয়েমেন থেকে ফিরেই আমেরিকার গুপ্তচর হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎই ধর্মান্তরিত হওয়া স্টর্ম কেন এমন কাজ করল? কেন সে আওলাকির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সিআইএ-তে যোগ দিল? সিআইএ কি সেই ট্র্যাকিং ডিভাইস কাজে লাগিয়ে ধরতে পারবে আওলাকিকে?
৪. শুলা কোহেন: বৈরুতে ইসরায়েলি মাতাহারি

সময়টা ১৯৪৭, তৎকালের সুইজারল্যান্ডখ্যাত বৈরুতে একটি ক্রিসমাস পার্টিতে উপস্থিত দেশের গণ্যমান্য সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তারা। শুলা কোহেন; অত্যন্ত রূপসী ও মার্জিত আচরণের এই ইহুদী স্কুল শিক্ষিকাও সেখানে আমন্ত্রিত। একটি টেবিলে বসেছেন লেবানিজ আর্মির দুই চিফ স্টাফসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। তারা সেখানে আলোচনা করছিলেন, ফিলিস্তিনের একটি ইহুদী বসতিতে আক্রমণ করার। কিন্তু কেউই খেয়াল করেননি, পাশের টেবিল থেকে শুলা কোহেন আড়ি পেতে শুনছিলেন তাদের সব কথা।
এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনেই শুলা কোহেন অস্থির হয়ে ওঠেন, কীভাবে খবরটা ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছাবেন, তা ভেবে। অবশেষে তিনি একটি চিঠির মাধ্যমে খবরটি পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং নাম লেখান ইসরায়েলের গুপ্তচরের খাতায়, তখনো অবশ্য মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরপর একের পর এক মিশন সফল হয় শুলা কোহেনের। অতিমাত্রায় রূপসী ও মার্জিত আচরণের হওয়ায় খুব সহজেই উঁচু পদের কর্মকর্তাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে সহজেই তথ্য হাতিয়ে নিতেন। মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের সাথেও কাজ করতে থাকেন। তিনি মোসাদের কাছে মুক্তার মতোই মূল্যবান হয়ে ওঠেন, তাই তাকে ডাকা হতো ‘এজেন্ট পার্ল’ নামে। এমন চৌকসতা কি কাজে লেগেছিল শেষ পর্যন্ত, নাকি প্রেমের ফাঁদে ফাঁসাতে যেয়ে তিনিও কারো প্রেমে পড়ে গেছিলেন সত্যি সত্যি? নাটকীয়তার আরো অনেক বাকি।
৫. আশরাফ মরোয়ান: মোসাদের মিশরীয় এঞ্জেল

১৯৭৩ সাল; আরব ইসরায়েলের ৪র্থ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। মিশর ও সিরিয়া, ইসরায়েল সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে কিন্তু ইসরায়েল এখনো এই আক্রমণের ব্যাপারে কিছুই জানে না। মিশর আসলে এই এডভান্টেজ কাজে লাগিয়ে অতর্কিত হামলা করতে চায় যেনো ইসরায়েল যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়তে না পারে।
লন্ডনের একটা সেইফ হাউজে মোসাদের প্রধান পরিচালক জাবি অপেক্ষা করছেন, ইসরায়েলের মিশরীয় এজেন্ট এঞ্জেল এর জন্য। কিছুক্ষণ পরেই এঞ্জেল আসলো, জাবি কুশল বিনিময় করতে যাবেন কিন্তু এঞ্জেল বললেন তিনি এই মুহুর্তে জরুরী একটি তথ্য দিতে চান। তথ্যটি হলো, মিশর আর ১৫ ঘন্টার মধ্যে ইসরায়েল আক্রমণ করতে যাচ্ছে। এঞ্জেলের কথা অবিশ্বাস করার সুযোগ নেই, এর আগেও তার দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই একটি হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল ৪০০ ইসরায়েলি নাগরিক। তাছাড়া এঞ্জেল মিশরের প্রেসিডেন্ট হাউজে কর্মরত, তার কাছেও ভুল খবর আসতে পারে না। কে এই এঞ্জেল! যে মিশরের প্রেসিডেন্টের অত্যন্ত কাছের ব্যক্তি হয়েও দিনের পর দিন এভাবে তথ্য পাচার করে যাচ্ছেন? তার উদ্দেশ্য কি শুধুই অর্থ, নাকি ক্ষমতাও!
৬. আনা মন্টেজ: যে স্পাই কিউবাকে ভালোবেসেছিল

স্কট কারমাইকেল কম্পিউটার স্ক্রিনে নামগুলো দেখে বিশ্বাস করতে পারছেন না। স্ক্রিনে থাকা নামগুলোর সবাই মার্কিন প্রতিরক্ষা বিষয়ক গোয়েন্দা সংস্থার (DIA) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এদের মধ্যে কেউ একজন কিউবার কাছে আমেরিকার তথ্য পাচার করে দিচ্ছে। স্কট কারমাইকেলের দায়িত্ব হলো গোয়েন্দাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করা। লিস্টে থাকা অনেকেই উনার পরিচিত। তবে যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য, আনা মন্টেজ যার এমন এমন কাজ করার কথা নয়।
আনা মন্টেজের বেড়ে উঠা মিলিটারী পরিবারে, সে উচ্চাভিলাষী নয়। কাজের প্রতি ভীষণ দায়িত্ববান বলেই অল্প সময়েই ডিআইএর উচ্চপর্যায়ে আসতে পেরেছেন, পুরষ্কৃতও হয়েছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু আনার উপরেই সন্দেহটা সবচেয়ে বেশি। সন্দেহ বলতে একরকম নিশ্চিত, শুধু প্রমাণ পাওয়া গেলেই গ্রেফতার করা যাবে। তবে আবাক করা ব্যাপার হলো আনা কিউবার হয়ে কাজ করার জন্য কোন অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধা নেয়নি। তদন্তে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি, কোনো দায়িত্বেও সে অবহেলা করেনি। তবে কেন সে আমেরিকার বিরুদ্ধে গিয়ে এসপিওনাজ জগতে প্রবেশ করলো! সে কি ধরা পরে যাবে?
এসপিওনাজ জগৎ অর্থাৎ গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে যাদের ধারণা একেবারেই কম, তারা এই বইটি না পড়লে বুঝতেই পারবেন না যে, বাস্তবিক এসপিওনাজ জগতের থ্রিলার-এডভেঞ্চার সিনেমা বা কল্পকাহিনীর থেকেও কত বেশি লোমহর্ষক। বইটিতে আরো জানা যাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়, যেগুলো সম্পর্কে না জানা অবধি সত্যিই অবিশ্বাস্যই মনে হবে।
“স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন এখান থেকে: https://roar.cm/spy-stories