কোলকাতার রাস্তায় ঘটে চলছে একের পর এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। টানা আট মাস ধরে একই ধাঁচে খুন হলেও পুলিশ কোনো কূল খুজে পায়নি কেস সমাধান করার। মিডিয়ায় হত্যাগুলো নিয়ে নানা কথার প্রেক্ষিতে ভয়ে আছে কোলকাতার সাধারণ মানুষও। অথচ এই কেস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অভিজিৎ পাকরাশির মতো মেধাবী পুলিশ অফিসার। যারা থ্রিলার সিনেমা পছন্দ করেন তারা হয়তো বুঝে গেছেন সিনেমার গল্পটি কোন দিকে এগোচ্ছে। বাংলা সিনেমায় আধুনিককালে এক নতুন ধারা নিয়ে আসা সৃজিত মুখার্জীর দ্বিতীয় সিনেমা বাইশে শ্রাবণ। অটোগ্রাফ সিনেমা দিয়ে শুরুতেই বাজিমাত করা সৃজিত বাইশে শ্রাবণেও কুড়িয়েছেন দর্শক এবং সমালোচকদের প্রশংসা।
মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলারমূলক ভিন্ন মাত্রার সিনেমা বাইশে শ্রাবণ। এটি নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় গল্পের ভিত্তির কথা। শুরুতেই জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার লাইন দিয়ে শুরু হয় যে গল্প।
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
এই কবিতার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে চলে সিনেমার দৃশ্য। অভিজিতের চরিত্রে অভিনয় করা পরমব্রতের সাথে একসময় যুক্ত হন প্রবীর রায় চৌধুরী নামের চাকরীচ্যুত কিন্তু সিরিয়াল কিলিং কেস বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন পুলিশ অফিসার। প্রবীর রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন গুণী অভিনেতা প্রসেনজিৎ। সৃজিত তার প্রথম সিনেমার মতো এখানেও বেশ সফলভাবেই প্রসেনজিৎের সাথে গড়ে তোলেন বেশ আকর্ষণীয় প্রবীর রায়ের চরিত্রটি। পর্দায় প্রবীর রায়ের গাম্ভীর্যপূর্ণ আগমন এবং তারপর পুরো সিনেমাজুড়ে প্রসেনজিৎের প্রভাব দর্শকের মন জয় করবে বলাই বাহুল্য। পরমব্রতও পিছিয়ে ছিলেন না। যদিও গল্পের প্রয়োজনে প্রবীর রায়ের সামনে কিছুটা ম্লানই মনে হবে অভিজিতের চরিত্রটি। কিন্তু দুজনের মধ্যে অসাধারণ রসায়ন তাদের কাজকে আরও শক্তিশালী করেছে শেষ পর্যন্ত।
একসময়ের তুখোড় পুলিশ অফিসার প্রবীর রায় যিনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তার মেধার পরিচয় রেখেছিলেন, একসময় বাদ পড়ে যান পুলিশ বাহিনী থেকে। নিজের রগচটা দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য তার এই পরিণতি হলেও তার টান ছিল দেশের জন্য কাজ করার আর অপরাধীদের সমূলে ধ্বংস করার। তাই নিজের অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির জোরে অভিজিতের সাথে দ্রুতই জট খুলতে থাকেন পুরো ঘটনার।
একসময় কবিতার সাথেই মিল খুজে পাওয়া যায় এই খুনগুলোর। কারণ প্রতিটা খুনের সাথেই পাওয়া যায় একটা করে চিরকুট আর সেসবে লেখা ছিল কোনো কবিতার কিছু লাইন। পরিচালক এখানে বেশ দারুণভাবেই কবিতার লাইনের সাথে খুনগুলোর সংযোগ ঘটিয়েছেন বলা যায়। তবে এই কবিতার লাইনগুলোর সাথে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালের হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টের সামঞ্জস্য আনাটা হয়তো অনেকের কাছে অতিরিক্ত মনে হবে। প্রকৃতপক্ষে, গৌতম ঘোষের হাংরি মুভমেন্ট চরিত্রটির সাথে এই সাহিত্য আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই, যেটি মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চ্যাটার্জি, সমীর রায়চৌধুরী এবং দেবী রায় দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল।
নিবারণ চক্রবর্তী একটি নকল চরিত্র, এবং হাংরি মুভমেন্ট কখনোই তার মতো বিভ্রান্ত কারোর কথা প্রকাশ করবে না যিনি কিনা নিজের কবিতা ছাপানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা তাদের কাজগুলিকে বুলেটিন হিসাবে প্রকাশ করেছিলেন, যেগুলি তারা কলকাতার কফি শপ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংবাদপত্রের বিভিন্ন বিভাগে বিনামূল্যে বিতরণ করেছিলেন। কলকাতা বইমেলায় অগ্নিসংযোগের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং মলয় রায় চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি মামলার বিষয় ছিল, যা আইপিসির ১২০(বি) এবং ২৯২ ধারার অধীনে আনা হয়েছিল। নিম্ন আদালত মলয় রায়চৌধুরীকে এক মাসের কারাদণ্ড দিলেও কলকাতা হাইকোর্ট তাকে অব্যাহতি দেয়। তবে এই হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তীর চরিত্রে গৌতম ঘোষের পাগলাটে অভিনয় আর তার উচ্চারিত কবিতাগুলো দর্শককে মুগ্ধ করবে নিঃসন্দেহে।
অভিনয়ের দিক দিয়ে মুখ্য চরিত্রে থাকা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, রাইমা সেন, আবীর চট্টোপাধ্যায় কিংবা গৌতম ঘোষ সবাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তবে অমৃতা মুখার্জীর চরিত্রে রাইমা সেনের চরিত্রটি আরও ভালো কাজ দর্শককে উপহার দিতে পারতো। আবীর বেশ গুণী অভিনেতা হলেও তার সূর্য চরিত্রটি সিনেমায় তাকে পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলার সুযোগ দেয়নি। পুরো গল্পে আবীরকে শুধু ত্রিভুজ প্রেমের জন্যই আনা হয়েছে বলে মনে হবে। যদিও মূল গল্পের জট খুলতে তার অবদান আছে, তবে নগণ্য পরিমাণে।
পুরো গল্পে ভিন্ন স্বাদ আনতেই সৃজিত ত্রিভুজ প্রেমের অবতারণা করেছেন। তারপরও এখানেও ভালবাসার মানুষের ভুলগুলো বুঝতে শেখা আর নিজেদের মধ্যে বোঝাপারা ঠিক রাখার ব্যাপারটা তুলে ধরা হয়েছে।
“জীবনে ভাত-ডাল আর বিরিয়ানির তফাৎটা বুঝতে শেখো। প্রথমটা necessity আর পরেরটা luxury।”
কাছের মানুষকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই কথাটা বলেছিলেন প্রবীর রায়। এই জায়গায় পাকরাশি আর প্রবীর রায়ের মধ্যে শিষ্য আর গুরুর সুন্দর দিকটি ফুটে উঠে যখন নিজের প্রেমিকাকে হারিয়ে পাকরাশি বেশ ভেঙে পড়ে।
সৃজিত অশ্লীল ভাষার ব্যবহার সিনেমায় একটু বেশিই করেছেন বলা যায় এখানে। থ্রিলারধর্মী সিনেমায় আবীরের সাথে রাইমার প্রেমদৃশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। অনেকের কাছে এটা বাহুল্য, আবার অনেকে এটাকে অতি সাধারণ সিনেমার অংশ হিসেবেই নিতে পারেন।
সিনেমাটির একটি বড় সফলতার ক্ষেত্র এর গানগুলো। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত এর প্রতিটা গানই সাধারণ মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়ে এসেছে। একবার বল (অনুপম রায়), যে কটা দিন (দ্বৈত, সপ্তর্ষী মুখোপাধ্যায়, শ্রেয়া ঘোষাল), গভীরে যাও (পুরুষ, রূপঙ্কর বাগচী), মাটি খুঁড়ে (রাঘব চট্টোপাধ্যায়), এই শ্রাবণ (রূপম ইসলাম), যে কটা দিন (পুরুষ অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়) প্রতিটা গানই ভীষণই সুন্দর, যা মন ছুয়ে যাবে।
সৃজিতের মূল সাফল্য দর্শককে সিনেমার শেষ পর্যন্ত একটা থ্রিলিংয়ের মধ্যে রাখতে পারা। শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস প্রযোজিত চলচ্চিত্রটি ২০১১ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। বাইশে শ্রাবণ সব মিলিয়ে ৪১টি পুরস্কার পেয়েছে। এটি জি বাংলা গৌরবে ১৩টির মধ্যে ৯টি মনোনয়ন পেয়েছে। চলচ্চিত্রটি সিঙ্গাপুরের দর্পণ চলচ্চিত্র উৎসব এবং কলকাতার অ্যালায়েন্স ফ্র্যাঞ্চাইজ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল এবং ২০১২ সালের লন্ডন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ফাইনালিস্ট ছিল। টানা ১০৫ দিনে, ছবিটি বছরের সেরা চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে।