মারিয়াম একজন আত্মবিশ্বাসী ২১ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, যে কিনা পোশাক ছিড়ে যাবার ফলে বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা পোশাক পরে গ্র্যাজুয়েশন পার্টিতে যায়। ডিস্কোতে অপরিচিত সুদর্শন এক যুবকের সাথে চোখের ভাষায় কথার আদান-প্রদান চলতে থাকে। অতঃপর তারা পরিচিত হয়ে ডিস্কো থেকে একসাথে বেরিয়ে সৈকতের তীরে একান্ত সময় কাটাতে মনস্থির করে। অনেকটা সাদামাটা গৎবাঁধা রোমান্টিক গল্প মনে হচ্ছে কি? অন্তত, প্রথম অধ্যায়ের এটুকু ন্যারেটিভ পর্যন্ত তা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখান থেকে আচমকা গল্পের গতিপথ বদলে যায়। পার্টির উৎফুল্ল আমেজ আর লাউড ব্যাকগ্রাউন্ডের রেশ থাকতেই অমানিশার ঘোর অন্ধকার আর নীরবতা ভর করে ফ্রেমে!
স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা একরাতে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে চলে গেল। ভিক্টিম চুপ থাকবেন নাকি অপরাধের বিষয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করবেন- সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আলামত নষ্টের আগেই। চিন্তাভাবনা করে মেয়েটি ন্যায়বিচার পাবার আশায় মামলা করতে উদ্যত হয়। এদিকে, পুলিশের দ্বারা ধর্ষণের অভিযোগ শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফরেনসিক টেস্টের ব্যাপারে সহযোগিতা করে না। আবার থানায় গিয়ে দেখা গেল- এই বক্তব্য কাউকে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। পুলিশ আইন লঙ্ঘনকারী পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নিতে নারাজ। এমতাবস্থায় থানা প্রাঙ্গণে পুলিশের একটি গাড়ি উপস্থিত হতেই মেয়েটি চিনে ফেলে, এবং ভেতর থেকে তার হারানো পার্স ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। উপস্থিত পুলিশদের সামনেই সবকিছু হচ্ছে। কিন্তু তারপরও তারা মামলা গ্রহণে অনাপত্তির কথা বলে। উপরন্তু, জনসম্মুখে পরপুরুষের সাথে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কারাদণ্ড ও জরিমানার ভয় দেখায়। অথচ গল্পটা ভিন্নও হতে পারত! অন্তত প্রথম চ্যাপ্টারে সেরকম ইঙ্গিত রয়েছিল।
দ্বিতীয় চ্যাপ্টার থেকে অকস্মাৎ মোড় পাল্টে অপরাধধর্মী রূপ নেয় তিউনিসিয়ান সিনেমা বিউটি এন্ড দ্য ডগস। একে সুস্পষ্টভাবে মোট নয়টি সিকোয়েন্সে ভাগ করা হয়েছে। এই নয়টি অধ্যায়ের সমন্বয়ে চলচ্চিত্রটি হয়েছে দীর্ঘ এবং ভয়ংকর এক রাতের ধারাবর্ণনা, যার প্রতিটিতে একটি একক সিকোয়েন্স শট রয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল কিছু কাজ আছে তাতে। যেমন- প্রথম দৃশ্যে সিনেমাটোগ্রাফার জোহান হলমকুইস্টে ক্যামেরার লেন্সকে আয়নার মতো ব্যবহার করেছেন। ফ্লুয়িড স্টেডিক্যাম শটে মারিয়ামের বাথরুম থেকে ক্লাবে যাত্রাকে এমনভাবে ক্যাপচার করা হয়েছে যেন সবসময় চরিত্রকে খুব কাছাকাছি অবস্থান থেকে দেখা যায়। পার্টিতে জয়েন করার পরে প্রায়ই লাউড ব্যাকগ্রাউন্ডে ভোকাল টোন হারিয়েছে। এই অধ্যায়ে নাচ-গানে উৎসবমুখর পরিবেশে কাহিনির প্রোটাগনিস্ট মারিয়ামের পরিচয় হয়েছে সুদর্শন অতিথি ইউসেফের সাথে।
ফেইড টু ব্ল্যাক হওয়ার পর, দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে ব্যাকগ্রাউন্ডের পিনপতন নীরবতা। তিউনিসের রাস্তায় মারিয়াম দৌড়ে পালাচ্ছে, পেছন পেছন ইউসেফও ছুটছে। মারিয়ামের মেকাপের অবস্থা আর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়া দেখে মনে হবে তাড়া করার দৃশ্য এটি। ঐসময় পাশ দিয়ে পুলিশের গাড়ি যেতে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায় মেয়েটি। ইউসেফ পাশে এসে সান্ত্বনা দেয়। ভিক্টিমের দেয়া বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি- ঠিক একটু আগে তাদের সাথে কী ঘটেছিল। প্রথম অধ্যায়ে ফলি সাউন্ডের কোনো কাজ না থাকলেও এই অংশে পায়ের আওয়াজের শব্দ শোনা যায়। সাথে রাতের রাস্তায় কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক। মুভির এরপরের পুরো ঘটনা ন্যায়বিচার পাবার জটিলতা এবং রাষ্ট্রের অসংবেদনশীল, অনমনীয় আচরণ নিয়ে। মেডিকেল টেস্টের জন্য হাসপাতালে গেলেও সেখানে তার আইডি কার্ড না থাকায় ভর্তি করানো হয় না। বরং সন্দেহ করা হয়- স্লিভলেস পোশাকের এই মেয়ে নিশ্চিতভাবেই অন্য কাউকে মিথ্যা ধর্ষণ মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।
পুরো ছবির কালার গ্রেডিং জুড়ে সবুজের আধিপত্য। কস্টিউম কিংবা হাসপাতাল ও থানার ইন্টেরিয়র কোথা থেকে বাদ পড়েনি সেটি। এমনকি বাকি রংগুলোও ম্রিয়মান মনে হয়েছে সবুজের কাছে। বিভিন্ন নারী চরিত্রকে বেশ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভূমিকায় অভিনয় করিয়েছেন পরিচালক বেন হানিয়া। এবং লক্ষণীয় হলো- এর প্রতিটি নারী চরিত্রই মুভিতে দুর্বল। ব্রেকআউট পারফর্মেন্স প্রত্যাশিত হলেও মারিয়াম চরিত্রের অভিনয়ে যথেষ্ট আড়ষ্টতা ছিল। তাছাড়া, হাসপাতালের কর্মরত নারী, সাংবাদিক কিংবা পুলিশ প্রতিটি চরিত্রেই তাদের সীমাবদ্ধতা সহজভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের (২০১১) ঠিক পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা টের পাওয়া গেছে নানা সংলাপে। পুলিশের ওপর আপামর জনসাধারণের ভয় ও অনাস্থাও ঠাই নিয়েছে মুভিতে। কাশবা আন্দোলনের বামপন্থী যুবক ইউসেফের সাথে রাষ্ট্রের নৈতিক ও আদর্শিক দ্বন্দ্ব নির্মাতা নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। এজন্য পুলিশ সদস্য ইউসেফকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে।
যদি পুরুষ হয়ে থাকো আমাকে মারো
না, তোমাকে মারলে আমাকে গ্রেফতার করা সহজ হবে।
অস্কারে মনোনীত ডিরেক্টর কাউথার বেন হানিয়ার সাড়া জাগানো এই রিয়েলটাইম চলচ্চিত্রের কাহিনি নির্মাতা নিয়েছেন ২০১২ সালে তিউনিসিয়ায় ঘটে যাওয়া বিতর্কিত বর্বরোচিত এক ঘটনা থেকে। আভা জমশিদির লেখা Coupable d’avoir été violé (বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্রের বয়স ২৮ এবং তিনি বিবাহিতা ছিলেন) বইয়ের উপর ভিত্তি করে চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিজেই। একদিকে যেমন দমনমূলক রাষ্ট্র-নিরাপত্তা যন্ত্রের পুলিশ বাহিনীর অরাজকতার বিরুদ্ধে তিউনিসিয়ানরা কত অসহায় আর নিশ্চুপ তার প্রমাণ মেলে। অন্যদিকে, রক্ষণশীল তিউনিসিয়ার আমলাতন্ত্র এবং বৃহৎ পরিসরের রাষ্ট্রচিন্তায় ক্ষমতার অবস্থানে পুরুষদেরকে অযাচিত সমর্থনের বিষয় চিত্রিত হয়। নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করেও নির্যাতিতা মেয়েকে থামানো যায় না। বিপরীতে, নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্রের পুলিশ বিভাগের একজনকে ন্যায়ের পথে সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। মারিয়ামকে সে নিজের অধিকার আদায়ে শুরু থেকে উদ্বুদ্ধ করে গেছে।
একটি জাতি এখনও তার কর্তৃত্ববাদী অতীতের সাথে লড়াই করছে। বেন হানিয়ার মুভিতে রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকলেও তাতে ভাবনার খোরাক আছে। রাষ্ট্রের প্রথম অগ্রাধিকার হলো নিজেকে রক্ষা করা, নাগরিকদের নয়! এমন স্পষ্ট অপ্রিয় সত্য বার্তা রয়েছে এ সিনেমায়। ফিল্মের সাহসী একটি শট বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। থানার মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে প্রটাগনিস্ট। পাশে স্মার্টফোনে তাকে ধর্ষণের ভিডিও ওভারহেড শটে দেখানো হচ্ছে (স্পষ্ট কিছুই দেখানো হয়নি)! বিউটি এন্ড দ্য ডগসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ —
“তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
পুরো দেশটাই তো একটা কারাগার।”
অন্ধকারের গল্পের শেষ দৃশ্যে ভোরের আলোর দেখা মেলে। বিউটি এন্ড দ্য ডগস নিয়ে একবাক্যে বলতে বললে- তিউনিসিয়ান মুভিটি সবুজাভ টিল্টে একরাত্তিরের পুলিশি নির্যাতন আর হয়রানির বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ের রোলারকোস্টার, যার প্রিমিয়ার হয় ২০১৭ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আন সারতেইন রিগারদে।