প্রেমিক যুগলের ভালোবাসার উষ্ণ আদরে সিক্ত কিছু মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েই গল্পের শুরু হয়। গ্রহলস্কি এবং লিজা। নিজের শক্ত বুকের সাথে লিজার নরম দেহখানি আবদ্ধ করে, কোমল হাতের ছোট্ট আঙুলগুলোতে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে তাকে মখমলে মোড়া সোফায় আলতোভাবে শুইয়ে দিল গ্রহলস্কি। চেয়ার টেনে পাশে বসে চিবুকটাকে যতটুকু সম্ভব প্রেমিকার কাছাকাছি রাখল। অস্তমিত হতে চলা সূর্যের তেজহীন কিরণের দ্যুতি লিজার চেহারায় উদ্ভাসিত হয়ে, তাকে আরো বেশি মোহনীয় করে তুলল। সোনালি কিরণের দ্যুতিতে গোটা কামরাটাই উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এমন মুগ্ধকর বর্ণনায় গোটা সেটিংটা তুলে ধরার পরপরই চেখভ চলে যান চরিত্রের সাথে দর্শককে আরো গভীরভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাদের আন্তঃসম্পর্কের কথা প্রকাশ করতে।
গ্রহলস্কি, যে কিনা এর আগে শ’খানেক বার নারীঘটিত সম্পর্কে জড়িয়েছে আর বের হয়েছে, এই প্রথমবার একটা বন্ধনে সে আটকা পড়েছে। লিজার সাথে। তাদের প্রেমময় মুহূর্তের শেষেই প্রেমিক গ্রহলস্কি একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা ওঠায়। তা হলো, সে লিজাকে কারো সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চায় না। তার ভাষ্যে,
“একজন পুরুষ ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়াটা কখনোই পছন্দ করে না। এটা আসলে তার অহমবোধের পরিচায়ক না। বরং বেশি কিছুই। তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে ভাগ করে নেওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
এবং গল্পের এ পর্যায়ে এসেই পাঠক প্রথমবার জানতে পারে, এতক্ষণের এই সম্পর্ক আসলে একটি পরকীয়ার সম্পর্ক। তবে বিষয়টা যে শরীরী কামনার নয়, বরং ভালোবাসার আরেকটি কোণ, তা এর পরের লাইনেই স্পষ্ট হয়। গ্রহলস্কি, লিজার স্বামীর ভালোবাসার দিকটাকেও তুলে ধরে। সে জানে, লিজার স্বামী লিজাকে ভালোবাসে। আবার লিজা তাকে ভালোবাসে। সে এটাও জানে, ভালোবাসায় ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ প্রয়োজনীয় খুব। এটা একটা শর্তও। এরই পিঠে সে লিজাকে মনে করিয়ে দেয়, তার স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসাহীনতার কথা। ঘৃণার কথা। এবং তারা দু’জনেই যে স্বামী ব্যক্তিটিকে ধোঁকা দিচ্ছে, প্রতারণা করছে, সেটাও বলে। আর এখানে এসেই গ্রহলস্কি চরিত্রটি একমাত্রিকতার বেড়াজাল হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পড়ে। তার মানবিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার দোষী চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। আবার ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার মরিয়া ভাবের পরিচয় তো পাওয়াই হয়। সে ভালোবাসাটাকে পবিত্র করে পেতে চায়।
কিন্তু লিজা তাতে সায় দেয় না। তার স্বামী কেমনভাবে বিষয়টা নেবে, ভাবতে গিয়ে তার মূর্ছা যাবার অবস্থা হয়। তাছাড়া তাকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই তার স্বামী সুখ খুঁজে পায়। সেই সুখ নষ্ট করতেও সায় দেয় না লিজার মন। ফলে সৃষ্ট হয় দ্বন্দ্ব, জটিলতা। কিন্তু তাদের জানানোর আগেই তৃতীয় সেই ব্যক্তিটি কামরায় প্রবেশ করে এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকাকে আবিষ্কার করে। তাদের চোখের তারায় খেলে যাওয়া ভয়কে এড়িয়ে শান্ত স্বভাবেই কথা বলে কুশলাদি জানতে চায় স্বামী ব্যক্তিটি। নাম তার- ইভান পেট্রোভিচ বাগরভ। তার মুখেই লিজার আগের সম্পর্কগুলোর কথা জানতে পারা যায়।
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে এবারই সে প্রথম নয়। বাগরভ তাকে তিরস্কার করে। তাকে এই পাপ থেকে সরে আসতে বলে। সে একজনের স্ত্রী, একজনের মা। সেই অবস্থান বুঝতে বলে। ঈশ্বর বারবার ক্ষমা করবে না, তা-ও বলে। সেইসাথে নিজের রাগটা বাগরভ কমায়, আরেকবার এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে দু’জনকেই হত্যা করবে সেই হুমকি দিয়ে। কিন্তু একটু পরেই গল্পে মোড় আসে। গ্রহলস্কি ফিরে আসে। লিজাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা অসম্ভব বলে জানায়। বাগরভ যা চায়, বিনিময়ে তা-ই দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। বাগরভের বড় এই প্রতিদানের জন্য একটা ছোট্ট উপহারস্বরূপ গ্রহলস্কি তাকে ১০০ হাজার মুদ্রা দেওয়ার কথা বলে। বাগরভের চোখ ভেজে, ঠোঁট কাঁপে। নিজের শোচনীয় অবস্থার কথা ভাবে। সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা করে। লিজা তাকে ভালোবাসে না, এটাই মেনে নিয়ে বাগরভ মাথা নিচু করে ফেলে। টাকাটা তার কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে, এই প্রতিশ্রুতি দেয় প্রেমিক গ্রহলস্কি। বাগরভ মৃদু পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যায়, নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে। ওদিকে লিজা তখনো বুঝতেই পারে না, তার সওদা হয়ে গেছে। দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয়ে গেছে।
গল্প চলে যায় কয়েকমাস পরে। গ্রহলস্কি-লিজা একসাথেই আছে। তারা ক্রিমিয়ায় আছে একসাথে, একটা বিশাল ভিলাতে। পশ্চিমের এই অংশে, আগস্টে মস্কোর মতো ঠাণ্ডা, কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ নেই। চারদিকে একটা সতেজতা আছে। নেই শুধু লিজার মনে। কোথায় যেন একটা সুর কেটে গেছে। গ্রহলস্কি তার ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে সুখেই আছে। কিন্তু তার এই সুখ বেশিদিন আর রইল না। বিপরীতদিকে দাঁড়ানো সেই ভিলাতেই আগমন ঘটে বাগরভ আর লিজার ছেলে মিশুতকার। খুব শীঘ্রই পরিস্থিতি ফের জটিলতায় মোড় নেয়। পুরোনো সেই সওদার দাগ আরো একবার পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এগিয়ে চলতে থাকে ত্রিকোণ প্রেমের এই গল্প। আর কী কী ঘটতে চলেছে তাদের তিনজনের জীবনে?
‘চ্যাটল,’ যার বাংলা অর্থ হয়- অস্থাবর সম্পত্তি। গল্পের নামটা হলো, ‘আ লিভিং চ্যাটল।’ মানে, একটি জীবিত অস্থাবর সম্পত্তি। নামকরণের কারণটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। সেই জীবিত সম্পত্তি তো আসলে লিজা। সবকিছুতে চুপ থাকাই যেন তার একমাত্র অবস্থান। গল্পের প্রথম অংশে, স্বামী বাগরভ যখন স্ত্রীর পরকীয়ার কথা জানতে পারে, তখন স্ত্রীকে বলা কথাগুলোতেই নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য কায়েম এবং প্রভুসুলভ আচরণের দিকটি প্রকাশ পায়। সাথে উনিশ শতকের নারীদের ‘ইনফেরিয়র’ হয়ে থাকার দিকটিও এতে আসে।
স্বামীর প্রভুত্বের কিংবা তার চেয়েও বড় কোনো আকৃতিসুলভ আচরণের দিকটি উঠে আসে ওই সংলাপে,
“আমি তোমাকে পঞ্চম বারের মতো ক্ষমা করেছি। তবে ষষ্ঠবার ক্ষমা পাওয়ার কথা তুমি ভুলে যাও। আরে ঈশ্বরও তো এতবার ক্ষমা করবে না।”
এছাড়া ভালোবাসার প্রকৃতি সেই সময়ে কেমন ছিল, তা-ও এ গল্পে বাগরভের চরিত্রটিতে দেখা যায়। যেহেতু সে স্বামী, তাই স্ত্রীর স্বামীকে ভালোবাসতেই হবে। এতে করে সেই সময়ে ভালোবাসার জোরপূর্বক প্রকৃতি এবং সংকীর্ণতার দিকটি সম্পর্কে জানতে পারা যায়। গ্রহলস্কির সাথে লিজার সম্পর্কে জড়ানোর কারণই ছিল আসলে ভালোবাসা। সংকীর্ণবোধ হতে বেরিয়ে এক উদারতার দেখা সেখানে পেয়েছিল সে। তাতে যে জোর থাকে না বরং পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, সেই বিষয়টিই লিজা বুঝতে পেরেছিল গ্রহলস্কির ভালোবাসায়। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, সে স্বাধীনতাও আবার টাকায় বিক্রি হলো।
তিন অংশে বিভক্ত এই ত্রিকোণ প্রেমের গল্প চেখভের এই ঘরানায় নিপুণ দক্ষতাকেই আরেকবার নিশ্চিত করে। ত্রিকোণ প্রেমকে ঘিরে, গল্পের তিনটি অংশই জটিলতাপূর্ণ কোণের সৃষ্টি করে। এবং সেসব বিষয়ে চেখভের পরিপক্বতার দিকটিকেও খুব ভালোভাবে নিশ্চিত করে এই গল্প। এটা ছিল চেখভের প্রথম দিকের লেখা। কিন্তু এ গল্পের স্বকীয়তা এবং শৈলীই চেখভকে পরবর্তী জীবনে, ছোটগল্পে একজন ‘গ্রেট লেখক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এই গল্পের মূল বিষয়টি তো তার বৃত্তেরই। রাজনৈতিক এবং সামাজিক বক্তব্য নিয়ে অতি শব্দব্যয়ে না গিয়ে, মানুষ এবং ভালোবাসার প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করেছেন চেখভ। তার লেখনশৈলীই এই ত্রিকোণ প্রেমের গল্পকে করেছে বিশেষ। এই গল্প এবং তার বর্ণনা পরিপূর্ণ মাত্রায়, বাস্তবিক। এর প্রধান কারণ হলো, চেখভের ইমপ্রেশনিস্ট স্টাইল। মানুষের আকৃতিগত বর্ণনায়, আশপাশের পরিবেশ বর্ণনায় একদমই নিখুঁত তিনি। এবং অবজেক্টিভ নির্ভর। ফলে পাঠক, গোটা পরিস্থিতি চিত্রাকারে চোখের সামনে দেখতে পান রীতিমতো।
তাই বলে সেটা অতিরিক্ত করতে যান না মোটেও। বাহুল্য বিবর্জিত এবং একটা মিষ্টভাব তার গদ্যভাষায় জড়িয়ে থাকে। আর নাট্যকার হওয়ার দরুন একটা থিয়েট্রিক্যাল ভাবের অনুভূতি পাওয়া যায় তার গল্পে। তা মূলত সেটিংয়ে। এই গল্পে যেমনটা দেখা যায়। প্রথম অংশের সম্পূর্ণটাই মূলত একটা কামরায়; পরের দুই অংশেও বিশেষ হেরফের হয় না। তো, কামরার প্রত্যেকটা ছোটখাটো জিনিসের নিখুঁত বর্ণনায় তাঁর চিত্রানুগ দিকটার পাশাপাশি চরিত্রদের গতিবিধি আর আসা যাওয়ার মাঝে মঞ্চনাটকের ভাবটাই গাঢ় হয়ে বসে।
গল্পটি তৃতীয় পুরুষ জবানিতে বর্ণিত হয়েছে। আর এই বর্ণনাকারী তৃতীয় ব্যক্তিটি চেখভ নিজে। মাঝে মাঝে সুকৌশলে তিনি পাঠককে সরাসরি নিজের সাথে সংযুক্ত করেছেন। ফোর্থ ওয়াল ব্রেক করে, যেন গল্পটির প্রত্যক্ষদর্শী তিনিই। এবং তেমনভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করেছেন সমাপ্তিতে। এতে করে আলাদাভাবে একটা বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা তৈরি হয়েছে, যা তার ‘বাস্তবিক’ শৈলীটাকেই আরেকবার লক্ষণীয় করেছে।
ত্রিকোণ প্রেমের গল্প হওয়া সত্ত্বেও চরিত্রগুলোতে নতুন আঙ্গিক উপহার দিয়েছে ‘আ লিভিং চ্যাটল’। কাঠামোগত দিকে বৈচিত্র্য দিয়েছে। একদম মজ্জাগতভাবে সুপেরিয়রিটি ধরে রাখা বাগরভের মাঝেও অন্তর্দহনের দেখা মেলে। অপরাধবোধ তো আছেই। তবু সে কখনো খালি হাতে ফিরে যায় না। এখানেই তার চরিত্রের দ্বান্দ্বিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে আছে গ্রহলস্কি, যে নিজের সুখ হারানোর ভয়ে ভীত সর্বদা। যেকোনো কিছুর বিনিময়েই তার লিজাকে চাই। আবার বাগরভের সুখ কেড়ে নেওয়ায় তার ভেতরের দোষী মন তাকে যে যন্ত্রণায় দগ্ধ করে, তা-ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে গল্পে।
দুই পুরুষের এক নারীকে ভালোবাসার আখ্যান এই লিভিং চ্যাটল। কিন্তু সেটা জটিল। তাদের সুপেরিয়রিটি আর ভালোবাসার মাঝে ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণেই ভালোবাসার প্রকৃতিটা এত জটিল। আর এর মাঝখানে, নারীটি শুধু নিশ্চিত ভালোবাসা পাবে বলে দ্বারে দ্বারে ঠোকর খায়। বেঁচে থাকে একটি অস্থাবর সম্পত্তি হয়ে।