ধানাক শব্দের অর্থ রংধনু। একপশলা বৃষ্টি শেষে সাত রঙের বর্ণিল রূপে আকাশে যখন রংধনু উঁকি দেয়, সেই চোখধাঁধানো দৃশ্যের সঙ্গে মানুষের জীবনের একটি নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জীবন যখন দুঃখ-কষ্ট, হতাশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে, বেঁচে থাকাই যখন মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়, রংধনু তখন আশার আলো হয়ে মানুষকে নতুন উদ্যমে বাঁচতে শেখায়, জীবনের মানে উপলব্ধি করতে শেখায়। তখন ম্লান হয়ে পড়া জীবন রংধনুর মতোই বর্ণিল রূপ ধারণ করে। জীবন হয়ে ওঠে আরো বেশি সতেজ, প্রাণবন্ত! ধানাক সিনেমার গল্প মূলত এমনই এক অন্ধ শিশু ছোটু এবং তার বড় বোন পরীকে ঘিরে আবর্তিত। তাদের জীবন রংধনুর মতো রঙিন না হলেও, রংধনুর বিশেষত্ব থেকে কোনো অংশে কম নয়। পরিচালক নাগেশ কুকুনুরের এই অনবদ্য সিনেমা নিয়েই আজকের আলোচনা।
রাজস্থানের মফস্বল থেকে বেড়ে ওঠা দুই ভাই বোন— ছোটু, এবং পরী। বাবা-মা হারানো এই দুজনের আপনজন বলতে চাচা-চাচী ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের হাড়ির ভাত খেয়েই দুই ভাই-বোনের বেড়ে ওঠা। মাত্র চার বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা ছোটুর বয়স আট বছর। আট পেরিয়ে নয়ে পদার্পণ করতে আর দু-মাসের অপেক্ষা। অন্যদিকে দশ বছর বয়সী বড় বোন পরী, নিজের কাঁধে তুলে নেয় অসম্ভব এক দায়িত্ব! ছোট ভাইকে কথা দিয়েছে, আসছে নয় বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবে সে। কিন্তু কীভাবে তার অন্ধত্ব ঘুচিয়ে দেবে? জানে না পরী, জানে না কেউই!
পরী শাহরুখ খানের অন্ধভক্ত, ছোটু সালমান খানের। দুই খান নিয়ে তাদের ঝগড়া-খুনসুটি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা! প্রতিদিন স্কুল যাওয়ার আগে কুটির থেকে বেরিয়ে ছোটু কয়েন টস করে, যে জিতে যায় সে তার প্রিয় হিরোর গল্প শোনায়। একদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে শাহরুখ খানের ছবিসহ অন্ধকে চক্ষু দানের একটি পোস্টার নজরে আসে পরীর। প্রিয় হিরোই পারবে ছোটুর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে, এই ধারণা পরীর শিশুসুলভ মনে জেঁকে বসে।
পরী শাহরুখ খানকে চিঠি দিতে শুরু করে। কিন্তু সেই চিঠিগুলো খান অব্দি পৌঁছায় না। এদিকে ভাইয়ের জন্মদিনও ঘনিয়ে আসছে। অজানা এক দুশ্চিন্তা ভর করে তার উপর। এমতাবস্থায় সে জানতে পারে- শাহরুখ খান শুটিংয়ের জন্য জয়সলমের (রাজস্থানের একটি জেলা) এসেছে। পরী সিদ্ধান্ত নেয়, ছোট ভাইকে নিয়ে জয়সলমের যাবে, শাহরুখ খানের সাথে দেখা করবে। সে আশাবাদী, তার স্বপ্নের হিরো ছোটুর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করবে। একরাশ আশা বুকে নিয়ে জয়সলমেরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দেয় তারা। শেষ পর্যন্ত দুজন একসাথে ধানাক দেখতে পারবে কিনা তা সিনেমার শেষে জানা যাবে।
নাগেশ কুকুনুর একাধারে অভিনেতা, পরিচালক এবং স্ক্রিপ্ট রাইটার। শর্ট ফিল্ম ওয়ান কালচার অ্যাট অ্যা টাইম (১৯৯৪) দিয়ে মূলত পরিচালক হিসেবে হাতেখড়ি হয়। এরপর অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে প্রথম সিনেমা হায়দ্রাবাদ ব্লুজ (১৯৯৮) নির্মাণ করেন। সিনেমাটির জন্য সমালোচক মহলে বেশ ভালোই প্রশংসা কুড়ান তিনি। ধীরে ধীরে প্রশংসার ঝুলিতে যোগ হতে থাকে রকফোর্ড (১৯৯৯), থ্রি দিওয়ারেইন (২০০৩), ইকাবল (২০০৫), ডোর (২০০৬), লক্ষী (২০১৪), ধানাক (২০১৫)-এর মতো আলোচিত সিনেমাগুলো। ধানাক ৬৪ তম জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার অনুষ্ঠানে সেরা শিশুতোষ সিনেমা, ৬৫ তম বার্লিন চলচ্চিত্র অনুষ্ঠানে সেরা শিশুতোষ সিনেমা হিসেবে ‘ক্রিস্টাল বেয়ার গ্র্যান্ড প্রিক্স’ পুরষ্কারসহ আন্তর্জাতিক আরো বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করে। নাগেশ কুকুনুর বলেন,
রকফোর্ডের (১৯৯৯) পর আমি শপথ করেছিলাম, আর কখনো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ধানাকের মধ্য দিয়ে সে শপথটা আমি ভেঙে ফেলেছি। এখন অবশ্য ভবিষ্যতে আরো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের চিন্তা করছি।
ধানাক মূলত দুই ভাই-বোনের অকৃত্রিম ভালোবাসার এক বহিঃপ্রকাশ; পাশাপাশি মানুষের ভেতরে জমতে থাকা হতাশাগুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন এক ‘আমি’ সৃষ্টির প্রয়াস দেখানো হয়েছে। আত্মবিশ্বাসী দৃঢ়চেতা মনোভাব মানুষকে নিয়ে যেতে পারে অনন্য এক উচ্চতায়, এরকম একটি বার্তা দর্শকদের দেওয়া হয়। সিনেমার গল্প শুধু দুই ভাই-বোনের ভালোবাসা, তাদের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, সমাজের নির্মম বাস্তব চিত্র— ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও কুকুনুর দেখিয়েছেন। রাজস্থানের পরিবেশ, খাবার, সংস্কৃতি, সেখানকার মানুষের পোশাক-আশাক সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় ধানাক থেকে।
ছোটু চরিত্রে অভিনয় করে কৃষ ছাবরিয়া, পরী চরিত্রে অভিনয় করে হেতাল গাদা। ভাইজানের মতো ব্রেসলেট হাতে পরা, রসবোধে ঠাসা ছোটুকে সিনেমার প্রাণ বলা যেতে পারে। সে কখনো রসের খোরাক যোগাবে, কখনো আবেগী করে তুলবে, কখনো বা রাগ উঠিয়ে দেবে। তার সংলাপগুলো শুনে মনেই হবে না— সে আট বছরের কোমল শিশু। অন্যদিকে পরী সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র। ছোটু যেন পরীর চোখ দিয়েই পৃথিবীর আলো দেখে। তাকে শুধু বড় বোন হিসেবে কল্পনা করলে ভুল হবে, সে কখনো বড় বোন, কখনো বেস্ট ফ্রেন্ড, কখনো বা জন্মদাত্রী মায়ের মতো ছোট ভাইকে আগলে রাখছে, শাসন করছে। দুই ভাই-বোনের ঝগড়া-খুনসুটি, ভালোবাসা, দর্শককে কিছু সময়ের জন্য শৈশবের মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করার ফুরসত করে দেবে।
ভিপিন শর্মা থেকে শুরু করে সুরেশ মেনন, গৌণ চরিত্রে অভিনয় করা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে তাদের সেরা অভিনয় দিয়ে যান। তবে চরিত্রগুলো গল্পে খুব বেশি গভীর প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্যতিক্রম শুধু চাচী চরিত্রে অভিনয় করা গুলফাম খান। ভালো-মন্দ দুটো দিকেই তিনি যেন বাস্তবতার এক প্রতিবিম্ব!
ধানাক একটি রোড/কমেডি-ড্রামা সিনেমা। দুই দিক থেকেই মোটামুটি সিনেমাটি সার্থক। রোড সিনেমার কথা চিন্তা করলে সবার আগে সিনেমাটোগ্রাফি চলে আসে। এক্ষেত্রে গল্পের থেকে সিনেমাটোগ্রাফি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধানাক শুধু চোখধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, একটি সাধারণ গল্পকে অভিনব কায়দায় অনিন্দ্য সুন্দর করে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছে। তবে সিনেমার প্রথমার্ধ যতটা সাজানো-গোছানো ছিল, দ্বিতীয়ার্ধে সেখান থেকে কিঞ্চিৎ বিচ্যুতি ঘটতে দেখা যায়। ফরেনারের দেখা পাওয়া, রমাকান্ত দায়মার আকস্মিক উপস্থিত হওয়া এগুলো সিনেমার সৌন্দর্যে একটু ব্যাঘাত ঘটায়! সিনেমার শেষাংশও দায়সারা গোছের হয়ে যায়! গল্প যেভাবে এগোতে থাকে, শেষাংশ আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারত। পাশাপাশি রাজস্থানের মতো ধূলিমাখা পরিবেশে পোশাক-আশাকের চাকচিক্য একটু বেমানান বৈকি! এই ছোটখাট ভুলগুলো চিন্তা না করলে ধানাক যথেষ্ট সুন্দর মনে হবে!
ধানাককে নান্দনিক করার জন্য মিউজিক অনেক বড় ভূমিকা রাখে। মিউজিক কম্পোজের দায়িত্বে ছিল তাপস রেলিয়া, লিরিক্সে মানোজ যাদব এবং মীর আলী হুসেইন। পুরো সিনেমার শুটিং যেহেতু রাজস্থানে করা, তাই সেখানকার পরিবেশের কথা চিন্তা করেই মিউজিক সাজানো হয়। ফ্লক গানগুলো বেশ ভালোই মানিয়েছে এতে! ‘ডাম-আ-ডাম’ গানটি শ্রুতিমধুর মনে হবে।
লেখক-লেখিকার গল্প-উপন্যাস অ্যাডাপ্টেশনে সিনেমা বানানোর প্রচলন বহু আগে থেকেই সিনেমা পাড়ায় হয়ে আসছে। কিন্তু সিনেমা থেকে বই লেখার ঘটনা সাধারণত বিরল। ভারতে তো শোনা যায় না বললেই চলে! কিন্তু ‘ধানাক’ সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মাত্র সাত দিনের মধ্যে আনুশকা রবিশঙ্কর একটি বই লিখে ফেলেন। বইটি ‘ধানাক’ নামেই প্রকাশিত হয়।
বড় বোন হলো সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহারগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বাস না হলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনার আশেপাশের মানুষদের জিজ্ঞেস করুন, কিংবা ধানাক দেখুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।