লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলীর ২০২১ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত নতুন বই ‘ফ্রন্টলাইন’। লেখকের বই ‘আসমান’, ‘দারবিশ’, ‘রাখাল’-এর তুমুল জনপ্রিয়তার পর এবারের ‘ফ্রন্টলাইন’ ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তার লেখায় মূলত জাতি, দেশ এবং মানুষের উপর জুলুম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা ফুটে ওঠে। ফ্রন্টলাইন, তেমনি কয়েক যুগ ধরে নিপীড়িত একটি জাতির মুক্তির গল্প নিয়ে তৈরি। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্পেষিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে। বর্তমানে বাংলাদেশে চলমান অন্যতম এক সমস্যা রোহিঙ্গা ইস্যু। বইটিতে লেখক কাল্পনিকভাবেই খুব সুন্দর করে সেই শরণার্থী রোহিঙ্গা জাতির মুক্তি পথই দেখিয়েছেন।
মূল গল্প
উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, উখিয়ার আদম ব্যবসায়ী মোক্তার মাঝির অনুসরণে প্রায় তিনশো যাত্রী নিয়ে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেয় ছোট একটি মাছ ধরার ট্রলার। তারা বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম করলেও মুনাউ দ্বীপের কাছাকাছি এসে মায়ানমারের নেভির কাছে ধরা পড়ে। শেষে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নেভি অফিসারের হাত থেকে বেঁচে যায় তারা।
মায়ানমার নেভির হাত থেকে রক্ষা পেলেও তারা বর্হিবিশ্বে একটি বার্তা ছড়িয়ে দেয়- বাংলাদেশ করোনায় আক্রান্ত রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার জোর করে ঠেলে দিয়েছে বার্মার জলসীমায়। ঠিক এই খবর পেয়েই সমুদ্রতীরবর্তী কোনো দেশ তাদের ভিড়তে দেয় না।
গল্পের প্রধান চরিত্র নাসিরউদ্দিন ও তার মা ছিলেন নৌকার যাত্রী। কিন্তু অসুস্থতার দরুন নৌকায় তার মায়ের মৃত্যু ঘটে। নৌকায় মায়ের জানাজা শেষ করেই নিজ হাতে তাকে মায়ের লাশ ছুঁড়ে ফেলতে হয় আন্দামানের নীল পানিতে। ঠিক সেদিন যেন মায়ের সাথে সাথে নাসিরউদ্দিন নিজের ভয় ও জাগতিক দুর্বলতা ছুঁড়ে ফেলে। তার পরবর্তী আশ্রয় হয় কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখান থেকেই মূলত গল্পের শুরু। নিজ ভূখণ্ড থেকে নির্বাসিত হয়ে এই শরণার্থী ক্যাম্পে এসেও শান্তি নেই কারো। তাদেরই জাতভাই নশু গ্যাংয়ের ইয়াবা ব্যবসা, চাঁদাবাজি, জুলুম, মানব পাচার সহ্য করে যেতে হয় নিত্যদিন।
এদিকে দশ নম্বর ক্যাম্পের ছাপড়া মসজিদের ইমাম সামিউলের সাথে বসে রোহিঙ্গাদের মুক্তির এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আঁটছেন মেজর শাফায়েত। তার প্রথম কথাই ছিল, “উই নিড আ হিরো!” ইমাম নিজের জাতির অপারগতা জানলেও মেজর শাফায়াতের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নাসিরউদ্দিনকে রোহিঙ্গাদের নেতা বানানোর কাজ শুরু করেন।
প্রথম প্রতিরোধ হয় নশু বাহিনীর বিরুদ্ধে। ইমাম ও মেজরের কথামতো নশু বাহিনীর দুই সদস্যকে সকলের সামনে কুপোকাত করা মাধ্যমে সকলের মনে নশুভীতি কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে নাসিরউদ্দিন। এরপরই সকলকে নিয়ে গোটা নশু বাহিনীকে নির্মূল করার প্রয়াস শুরু করতে থাকে সে। আড়াল থেকে নাসিরউদ্দিনকে সমর্থন দিয়ে যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর শাফায়াত।
ধীরে ধীরে নাসিরউদ্দিরকে সমীহ করতে শুরু করে সকলে। সকলে যেন নাসিরউদ্দিনের মাঝেই নিজেদের মুক্তির স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। মেজর ও ইমামের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় নাসিরউদ্দিন নশু বাহিনীকে নির্মূল করতে ‘লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে। নাসিরের এই অভিনব পন্থায় গোটা দলসহ কুপোকাত হয় নশু বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নশু পালিয়ে যায়।
নশু বাহিনী পরাস্ত হওয়ার পর খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম। এরপর শুরু হয় তাদের মূল লক্ষ্যের দিকে হাঁটা। লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটি থেকে বেছে বেছে সুস্থ দেড়শো যুবক নিয়ে নিঝুমদ্বীপের একটি চরে নিয়ে যাওয়া হয়। সকলকে বলা হয়, দ্বীপে সরকারি বনায়ন কর্মসূচির জন্য তাদের কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু ডি-৩ নামক এই দ্বীপে পৌঁছেই তারা নিজেদের এক নতুন জীবন পায়। এখানেই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হবে রোহিঙ্গাদের মুক্তির যোদ্ধাদের।
এখানেই তৈরি হতে থাকে রোহিঙ্গাদের মুক্তিকামী বাহিনী। তাদের মূলত নিজের দেশে ফিরে তাতমাডাওয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আরাকানের মাটিকে মুক্ত করতেই এ প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। নিজেদের যোদ্ধারা তৈরি হয়ে গেলে নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে তারা রওয়ানা দেয় নিজ ভূখণ্ড আরাকানের উদ্দেশে। বাংলাদেশের বর্ডার ক্রস করে তারা মংডু জেলার সীমান্ত ঘেষা অঞ্চলে ক্যাম্প করে। এবং তারা প্রথম সফল আক্রমণ চালায় প্বার্শবর্তী তাতমাডাও ক্যাম্পে। এভাবেই শুরু হয় তাদের মুক্তির পথচলা।
নিহিত বার্তা
লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা বইগুলোতে একটা বার্তা নিহিত থাকে, যা সামগ্রিকভাবেই পরিবর্তনের। সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালনার ভাবার্থ আছে এতে। ‘ফ্রন্টলাইন’ তেমনি একটি জাতির মুক্তির জন্য নিজেদের পরিবর্তনের বার্তায় রচিত। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা গত কয়েক যুগ ধরে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে একতা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগরণের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। মূলত তারা কখনোই সংঘবদ্ধ হতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের মুক্তির জন্য এই একতা কী ভীষণ প্রয়োজন, সেটাই উঠে এসেছে এ বইয়ে।
কাল্পনিকভাবে লেখক রোহিঙ্গাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার যে দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন, তা সত্যিই দারুণ। বর্তমান সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সংঘবদ্ধ রোহিঙ্গাদের লড়াই ব্যতীত মুক্তির কোনো পথ নেই। তবে তাদের এই জাগরণে অবশ্যই প্রয়োজন একটি নীতিবান রাষ্ট্রের সার্বিক সাহায্য। এই দিকটি খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। গল্পের প্রেক্ষাপট, স্থান-কাল ও চরিত্র এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে বইটি পড়ার সময় মনে হবে দৃশ্যগুলো সামনে ঘটছে।
পরিশেষে
একজন পাঠক হিসেবে বইটিতে কিছু জায়গায় খটকা লেগেছে আমার। যেমন ধরা যাক, কাহিনীর শুরুতে, নাসিরউদ্দিনসহ যে যাত্রীরা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিল, তারা কীভাবে ফিরে এলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে? কেননা লেখক উল্লেখ করেছেন, সমুদ্রতীরবর্তী সকল দেশ তাদের নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে তারা আবার কীভাবে বাংলাদেশে ফিরে এলো, এ ব্যাপারে তেমন কিছুই উল্লেখ করেননি তিনি।
দ্বিতীয় আরেকটি খটকা লেগেছে, লাঠি বাঁশি সংগ্রাম কমিটির আক্রমণে যখন নশু বাহিনীর ২০ জন ধরাশায়ী হয়, তখন তাদের মধ্যে ১৯ জন মারা গেলেও নশু পালিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে দেখলে নশু ছিল দলের প্রধান এবং সাধারণ জনগণের তার প্রতিই ক্ষোভ ছিল বেশি। তো এত মানুষের গণপিটুনির রোষানল থেকে কীভাবে পালিয়ে গেল সে?
এই দুটো ব্যাপার বাদ দিলে পুরো বইটি ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনানির্ভর। চরিত্রগুলোর মধ্যে ভালো লাগার মতো চরিত্র ইমাম সামিউল হাসান এবং তার সংঘবদ্ধ করার শক্তি।
লেখক পরিচিতি
এ উপন্যাসের রচয়িতা লতিফুল ইসলাম শিবলীর জন্ম নাটোরে। তার প্রথম পরিচয় গীতিকবি হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণযুগ নব্বইয়ের দশক জুড়ে তিনি লিখেছেন প্রায় তিনশতাধিক গান। আমাদের উপহার দিয়েছেন ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘পলাশীর প্রান্তর’, ‘প্রিয় আকাশি’, ‘হাজার বর্ষারাত’, ‘জেল থেকে বলছি’-এর মতো তুমুল জনপ্রিয় কালজয়ী গান। নিজের কণ্ঠ, সুর ও কম্পোজিশনে করেছেন একক অ্যালবাম- ‘নিয়ম ভাঙার নিয়ম’ (১৯৯৮)।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ইচ্ছে হলে ছুঁতে পারি তোমার অভিমান’ (১৯৯৫)। বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে বাংলা ব্যান্ড মিউজিক নিয়ে তার গবেষণাধর্মী বই ‘বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীত আন্দোলন’ (১৯৯৭)। তার রচিত প্রথম নাটক ‘তোমার চোখে দেখি’ ও ‘রাজকুমারী’। তার কাহিনী-সংলাপে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘পদ্ম পাতার জল’ (২০১৫)। ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি লিখেছেন একাধিক বেস্ট সেলার উপন্যাস ‘দারবিশ’ (২০১৭), দখল (২০১৮), আসমান (২০১৯) ও রাখাল (২০২০)।
বই সম্পর্কে
বইয়ের নাম: ফ্রন্টলাইন
লেখক: লতিফুর রহমান শিবলী
প্রকাশক: নালন্দা প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: ওয়াহিদ তুষার
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
প্রথম প্রকাশ: মার্চ ২০২১