বইপোকা শব্দটির বাস্তব উদাহরণ আদনান (ছদ্মনাম)। পাঠ্য বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তে গিয়ে মায়ের কাছে কত বার যে কানমলা খেয়েছে বেচারা, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! এসএসসি পরীক্ষার বিদায় সংবর্ধনার সময় কৃতি শিক্ষার্থী হিসেবে আদনানকে অ্যালেক্স রাদারফোর্ডের ‘এম্পায়ার অফ দ্য মুঘল’ সিরিজের প্রথম দুটি বই উপহার দেয়া হলো কোচিং থেকে। বই পাগল আদনান খুশিতে ডগমগ হয়ে দিন গুনতে লাগল, কবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে, আর কবে সে এই বইগুলো পড়তে পারবে। সেদিন বাসায় আসার পর থেকে হঠাৎ করেই কী যেন হলো তার। পড়তেই আর মন চাইছে না। পড়ার বই তো দূরে থাক, গল্পের বইয়ের প্রতিও কোনো আকর্ষণ কাজ করছে না তার। আগেই সিলেবাস শেষ করা ছিল বলে কোনোমতে বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখে পরীক্ষাটা শেষ করলো সে।
পরীক্ষা শেষে বাবা তার হাতে ধরিয়ে দিলেন ২,০০০ টাকা। বললেন, আদনান এখন তার পছন্দমতো যেকোনো বই কিনতে পারে। বইপোকা আদনানের জীবনে এর চেয়ে খুশির আর কোনো সংবাদ হতে পারে কীনা সন্দেহ! সুন্দর করে বইয়ের লিস্ট বানিয়ে দোকানে গিয়ে একগাদা বই নিয়ে এলো সে। কিন্তু আবারও একই সমস্যা। বই বাসা অব্দি আনার পরেই সব আগ্রহ চলে গেল। কয়েকটা বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে পড়া হবে না বুঝতে পেরে সে মন দিল গেম খেলার দিকে। কিন্তু মনের ভেতরে কিছু একটা যেন খুঁতখুঁত করেই চলেছে। খুব ভালমতো উপলব্ধি করল আদনান, সময় নষ্ট করছে সে। তিন মাস দেখতে দেখতে চলে যাবে, এভাবে গেম খেলার নেশায় মত্ত হওয়ার কোনো মানে হয় না। বই দেখলে পড়তে ইচ্ছা করছে, কিন্তু হাতে নিলেই সে আগ্রহ চলে যাচ্ছে- এই সমস্যার সমাধান কী? অসমাপ্ত বইয়ের লম্বা তালিকা দেখে সমাধান পেতে গুগল না করে আর পারল না আদনান। সেখান থেকেই জানতে পারল, তার এই অসুখের নাম ‘রিডার্স ব্লক’।
লেখকদের যেমন ‘রাইটার্স ব্লক’ হয়, তেমনি পাঠকদের হয় ‘রিডার্স ব্লক’। তবে লেখকদের মতো অতটা কদর জোটে না পাঠকদের কপালে। জনগণ লেখকদের জন্য সহানুভূতি দেখান ঠিকই, কারণ তারা দেশ ও দশের জন্য সৃষ্টিশীল কিছু উপহার দিচ্ছেন। কিন্তু সেই সৃষ্টিকে গ্রহণ করার জন্য নিবেদিত প্রাণ পাঠকরাও যে ভুগতে পারেন সমস্যায়, তা যেন কারো মাথাব্যথার বিষয়ই নয়। আনভি দোশি নামক এক পাঠক যথার্থই বলেছেন, খালি চোখে দেখলে ঘর ভরা বই নিয়ে বসে রিডার্স ব্লক নিয়ে অভিযোগ করা আর ঘরভর্তি খেলনা নিয়ে বাচ্চাদের বিরক্ত হওয়াকে একই কাতারে ফেলা যায়। কিন্তু বই যিনি পড়তে পারছেন না, তিনিই কেবল জানেন এ যাতনা সহ্য করা কতটা কঠিন!
লেখালেখির চেয়ে পড়াকে কিছু নিষ্ক্রিয় হিসেবে মনে করা হলেও এমন অনেক পাঠকই আছেন, যাদের কাছে ব্যাপারটি মানসিক যন্ত্রণার সমতুল্য। চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো, দু’দিন পরে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরীক্ষা আর আজ আপনি পড়তেই পারছেন না, কী দশা হবে আপনার! আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই আছেন যারা রক্ত-মাংসের মানুষের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করার চেয়ে বরং বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়ে থাকাটাকেই প্রাধান্য দেন। তাদের কাছে রিডার্স ব্লক রীতিমতো এক বিভীষিকার নাম। সেই বিভীষিকা থেকে উত্তরণের কিছু টোটকা থাকছে আজকের আয়োজনে।
১. ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়ার চেষ্টা করবেন না
শুনতে খারাপ শোনালেও আপনার ভালোর জন্যই বলা হচ্ছে, সারা জীবনের জন্য বই পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করার বদলে কিছুদিনের জন্য বই পড়া বন্ধ করে দিন। লেখকদের ক্ষেত্রে বলা হয়, লেখার মান ভালো করতে হলে অবশ্যই অনেক ভালো লেখা পড়তে হবে। ভালো লেখা মানেই যে মোটাসোটা কোনো বই তা কিন্তু নয়। বেশি খারাপ লাগলে ছোটখাটো কোনো বই বা কমিকস বা আর্টিকেল নিয়ে বসতে পারেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা মনের উপরে জোর করে খুব ভালো একটি বই নিয়ে বসলেও দেখা যাবে বইটি আপনার কাছে বিরক্তিকর লাগছে। একবার মন থেকে সাড়া না পেলে আজীবন ঐ বইয়ের প্রতি আর কোনো আগ্রহ জন্মাবে না। কাজেই খামোখা বইগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা না জাগিয়ে সময় দিন নিজেকে, বিশ্রাম দিন কিছুদিন। একই কথা পাঠ্য বইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে কিছুদিনটা যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায় সেদিকেও কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে। সপ্তাহখানিক সময়ই কি যথেষ্ট নয় নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য? ভেবে দেখতে পারেন।
২. বইগুলোর সংস্পর্শে থাকুন প্রতিদিন
বই পড়ছেন না পড়তে পারছেন না বলে তাদের সাথে দূরত্ব তৈরি করবেন- তাই কি হয়? প্রতিদিন অন্তত একটু ছুঁয়ে দেখুন বইগুলোকে। কিংবা গুডরিডসে গিয়ে দেখে নিন আপনার পছন্দের জনরার জনপ্রিয় বইগুলোর হালহকিকত। চাইলে ভবিষ্যতে পড়ার জন্য একটি বুকলিস্টও কিন্তু বানিয়ে ফেলতে পারেন। তাতে বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমবে না মোটেও। আর যারা পাঠ্য বই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তারা সূচিপত্র দেখে একান্তই ব্যক্তিগত একটি শিডিউল তৈরি করে নিতে পারেন। সপ্তাহখানিক পর যখন আপনি পড়তে বসবেন, তখন কোন অধ্যায় দিয়ে পড়া শুরু করবেন তা নিয়ে যেন বেশি ভাবতে না হয়।
৩. দেখা করুন প্রিয় গ্রাফিক বইগুলোর সাথে
ছোটবেলায় কমিক্স পড়েনি এমন শিশু খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আপনি নিশ্চয় কমিক্সের সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা দলের অন্তর্ভুক্ত? তাহলে আর দেরি কীসের? ঘরের এক কোনায় পড়ে থাকা আপনার শৈশবকে সযত্নে কাছে টেনে নিন। আর যদি বইগুলো হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাতেও চিন্তার কিছু নেই। নীলক্ষেত ছাড়াও বাতিঘর, পাঠক সমাবেশ, বেঙ্গল, পিবিএসের মতো বেশ কিছু বুকশপ রয়েছে ঢাকাতেই, যেখান থেকে সহজেই পছন্দের কমিক্স কিনতে পারবেন আপনি।
৪. ঘুরে আসুন নো রিডিং জোন থেকে
জ্বী, পড়া থেকে বিরতি নিতে চাইলে যান্ত্রিক জীবন থেকেই কিছুটা বিরতি নেয়া ভালো। ব্যস্ত শহরের ঠাসবুনট ছেড়ে শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির ছোঁয়ায় কাটিয়ে আসুন কয়েকটি দিন। এখানেও কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়ার চেষ্টা করা যাবে না। ভাবছেন, বাবা-মাকে কী বলে সামলাবেন? প্রথমে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন, এই ছুটিটা সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে কাজে লাগাবেন। আর এই বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে মস্তিষ্ককে জানিয়ে দিতে হবে, আবারও এমন ছুটি পেতে হলে আপনাকে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে পড়ালেখায়। সেই মোতাবেক অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলুন, বইয়ের পাতা চোখের সামনে খুলে রেখে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে কল্পনার রাজ্য থেকে ঘুরে এসে সন্তুষ্ট চিত্তে পড়তে আপনি সদা প্রস্তুত। হয়তো এতে কাজ হতেও পারে! তবে এই ছুটির জন্য মস্তিষ্ক যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
৫. আপনার মতো পড়তে পারছে না এমন কাউকে সঙ্গী করে নিন
পেট যার খারাপ সে-ই ভালো জানে এর কী যন্ত্রণা! পেট ব্যথা আর মাথা ব্যথার রোগীকে পাশাপাশি রাখলেও দুজন দুজনার কষ্ট পুরোপুরি বুঝবে না। কাজেই দুজন পেট ব্যথার রোগীকে এক জায়গায় রাখাই ভালো। আপনি তেমনি বিশাল পড়ুয়া কারো সাথে নিজের দুঃখের কথা শেয়ার করতে গিয়ে উল্টো আরও ডিপ্রেশনকে সঙ্গী বানিয়ে ফেলবেন না যেন! তার চেয়ে বরং রিডার্স ব্লকে ভুগছে এমন কোনো বন্ধুকেই খুঁজে নিন না। দুজন মিলে মনের কথা শেয়ার করে একসাথে পরিকল্পনা করে পড়াশোনাও করতে পারেন। তাতে অন্তত নিজেকে একা তো মনে হবে না। আর রিডার্স ব্লকে ভোগা লোকের সংখ্যা অন্তত আমাদের মুল্লুকে যে নেহাতই কম নয়, পরীক্ষার আগে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় বৈকি! কাজেই এমন সঙ্গী জোটাতে খুব বেশি কসরত করতে হবে না আপনার।
৬. পড়ার জন্য খুঁজে নিন ছোটখাট লেখা
কমেডিয়ান হিসেবে রবিন উইলিয়ামস বেশ নামকরা। ধরা যাক উনি আপনারও পছন্দের কমেডিয়ান। এবার তাহলে সোজা গুগলে গিয়ে সার্চ করুন রবিন উইলিয়ামসের সেরা কমেডিগুলো। পড়ুন সেগুলো আর হাসুন প্রাণ খুলে। রবিন উইলিয়ামসের কমেডি পড়া শেষ হলে সার্চ করতে পারেন তার প্রিয় উক্তিগুলো। অথবা তার সময়ের আরও কয়েকজন বিখ্যাত কমেডিয়ানের কথাও পড়া যেতে পারে। অথবা ঘরে পড়ে থাকা গোপাল ভাঁড়ের গল্পটাই বা কেন বাদ যাবে? এভাবেই অল্প অল্প করে কিন্তু বেশ খানিকটা পড়া হয়ে যাবে আপনার। ঠিক তেমনি ধরা যাক রসায়নে আপনার পছন্দের টপিক রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল। মডেলটির ছবিটিই নাহয় একবার দেখে নিন। এখানে কী কী ভুল ছিল নিজের মতো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিন। তাতেও পড়া কিছুটা হলেও আগাবে।
৭. তুলে নিন পছন্দের বইটি
পড়ার জন্য যদি খুব বেশি মুখিয়ে থাকেন তাহলে সবচেয়ে পছন্দের বইটি আবার নতুন করে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। হতে পারে বইটির প্রতিটি পাতা আপনার মুখস্ত, হতে পারে প্রতিটি চরিত্রকে নিয়ে কল্পনা করতে করতে নিজের চারপাশে তাদের বিচরণও করতে দেখেছেন। সেজন্যই বইটিকে আরেকবার হাতে তুলে নিন। এরচেয়ে আপন আর কিছুই হতে পারে না। অন্তর দিয়ে অনুভব করুন আপনার সাথে তার সখ্যতা। এই বইটিই আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য বইদের দিকে। পাঠ্য বইয়ের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে পছন্দের টপিকটি দিয়ে শুরু করুন নতুন করে পথচলা।
৮. মুখ ডুবিয়ে দিন বুকিশ সিনেমায়
বই থেকে নির্মিত অনেক ভালো ভালো সিনেমা আছে, যা দেখলে অনেকটা বই পড়ার মতোই অনুভূতি হয়। সঙ্গত কারণেই সিনেমা বইয়ের মতো অতটা বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যেতে পারে না। কিন্তু তবুও ‘হাজার বছর ধরে’ মুভিটি দেখার পর উপন্যাসের মূল ফ্লেভার তো আপনি পেয়েই যাবেন। কাজেই এমনি আরও অসংখ্য সিনেমা আছে যাদের সাহায্যে আপনি নিমিষে ডুব দিতে পারেন বইয়ের জগতে। সাহিত্য ভিত্তিক সিনেমাগুলোও এক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।
বি: দ্র: বই পড়া নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা ‘বই পড়ার আনন্দ‘ বইটি পড়তে পারেন।