টেনিদা মস্ত পালোয়ান। সাত বার মেট্রিক ফেল করে ফেলেছে। তার মতে, পাশ করাতে কোনো বাহাদুরি নেই। দু’পাতা বিদ্যে পড়ে কত ছেলেই পাশ করে যাচ্ছে টকাটক। খাতা ভরে লিখে আসার পরেও যে টেনিদাকে কেউ পাশ করাতে পারছে না, সেখানেই তো তার কৃতিত্ব। চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে খাঁড়ার মতো নাকওয়ালা টেনিদা আর তার সাগরেদদের নিত্যকার আড্ডা।
টেনিদার সাগরেদ সংখ্যা তিন। একজন হলো পটলডাঙার প্যালারাম। সারা বছর পালাজ্বরে ভোগে আর পটল দিয়ে শিং মাছের ঝোল খায়। একটু ভারী খাবার খেলেই তার পিলেটা নাকি বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। সব কাজের পাশাপাশি লেখাপড়াতেও সঙ্গ দেয় টেনিদাকে। তার লেখাপড়া বিশেষ ভালো চলে না। দুই বছর ফেল করে তার কান বেড়েছে আধা হাত। সাথে আছে এপার বাংলার হাবুল সেন। কথায় তার ঢাকাইয়া টান। সে লেখাপড়াতে নেহাত খারাপ নয়। আর আছে ক্যাবলা। ভীষণ ভালো ছাত্র, প্রতি ক্লাসে প্রথম। মেট্রিকে বৃত্তি। চারজনের এই দলে মগজাস্ত্র সবচেয়ে শক্তিশালী তারই।
চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে চলা তাদের আড্ডা, গল্প, কাজকর্ম নিয়েই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের যেমন ঘনাদা, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, তেমনই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী চরিত্র। সে ফেলুদা, ঘনাদা, কিংবা কাকাবাবু কারো মতো নয়। টেনিদা একজনই, টেনিদা একেবারেই স্বতন্ত্র। গালগল্পতে তার জুড়ি মেলা ভার। তাই বলে তাকে ফেলনা ভাবারও কারণ নেই। টেনিদা যেমন খায় তেমন খাটতেও পারে। ফুটবলের মাঠ থেকে ক্রিকেটের মাঠে টেনিদার জয়জয়কার। ভূতের ভয়ে কাবু যেই টেনিদা কিন্তু বস্তিতে আগুন ধরে গেলে নিজের কথা না ভেবে আগুনের ভেতরে ঢুকে বাচ্চাগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা তার বিশাল মনের উদাহরণ। টেনিদার গল্পগুলোতে কথক প্যালারাম। প্যালার ভাষায় টেনিদার ছাতির মতো তার মনও বিশাল। টেনিদাকে ছাড়া তাদের চারমূর্তির একটা দিনও চলে না।
টেনিদার স্রষ্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য অমূল্য কিছু রত্ন-ভাণ্ডার রেখে গেছেন। রত্নের সেই ভাণ্ডারে টেনিদা যেন এক কোহিনূর। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আসল নাম কিন্তু নারায়ণ নয়, তারকনাথ। লেখালেখিতে এসে নিজেই নিজের গোল্ডমেডেল পাওয়া নাম বদলে রেখেছিলেন। তার সৃষ্টি টেনিদা লেখাপড়ায় খারাপ হলেও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে কিন্তু বেশ ভালো ছাত্র ছিলেন। জন্মেছিলেন বাংলাদেশের দিনাজপুরে। স্নাতোকত্তোরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে শিক্ষকতায় মন দিলেন।
তিনি শুধু একজন সফল লেখকই নন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রের শ্রদ্ধার শিক্ষকও বটে। সব ছাত্রের মাঝে একজন ছাত্র নারায়ণের খুব পছন্দের ছিল। শুধু অভিনয় নয়, আবৃত্তির গলাও অসাধারণ, তাল মিলিয়ে করে বামপন্থী রাজনীতি। অভিনয় শেষে ছাত্রটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে জিজ্ঞাসা করতেন অভিনয় তার পছন্দ হয়েছে কিনা। শিক্ষক তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতেন, একদিন বিখ্যাত অভিনেতা হবে তার ছাত্র। ছাত্রটি আর কেউ নয়, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়। তার পটলডাঙার বাসায় ছাত্রেরা এসে আড্ডা দিত, ছাত্রদের তালিকায় ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, নির্মাল্য আচার্য্যের মতো ব্যক্তিত্বরা।
১৯৪৬ সালের দিকে স্ত্রী আশা দেবীর সাথে পটলডাঙায় এসে ওঠেন। বাড়িওয়ালার ছেলে ছিল প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তাকে দেখেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মাথায় আসে টেনিদার কথা। তাকে টেনিদা কল্পনা করে লিখে ফেলেন ‘খট্টাঙ্গ ও পলান্ন’। আর পায় কে? এর মাধ্যমেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্টি করে ফেললেন এক অমর চরিত্র। শিশু-কিশোর সাহিত্যিক হিসেবে বাড়তে লাগল নামডাক। ১৯৯৫ সালে ২৫ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। তার কথায় উঠে এসেছিল বাস্তব টেনিদা আর গল্পের টেনিদার ফারাক। আসে মিল এবং লেখক সম্পর্কে স্মৃতিচারণ।
বিখ্যাত সেই রোয়াকটা চাটুজ্যেদের ছিল না, মুখার্জীদের ছিল। হাবুল আর ক্যাবলা ছিল প্রভাতকুমারের দুই দূরসম্পর্কের ভাই। ‘হাবু’, আর ‘ক্যাবলা’ নাম সেখান থেকেই ধার করা। আর পালের আরেক সদস্য প্যালা তো লেখক নিজেই! লেখককে কিন্তু হাবুল সেনের সাথেও তুলনা করা যায়, দুজনের আদিনিবাস বাংলাদেশ, লেখাপড়াতেও ভালো। প্রভাতকুমারের স্ত্রীর ভাষায়, যে লেখক নিজের নাম তারকনাথ থেকে বদলে নারায়ণ করেছেন, তিনি আর এতটুকু বদল আনতে পারবেন না কেন?
প্রভাতকুমারের সাথে টেনিদার মিল অমিল আসলে কোথায়? একই বাড়িতে থাকার দরুন প্রায়ই আড্ডা দিতেন লেখক আর তিনি। তখন গল্পে গল্পে যেসব কথা হতো, সেসবকিছুর তিলকে নিজের কল্পনাশক্তিতে তাল বানিয়ে ছাড়তেন লেখক। যেমন একবার গল্পের সময় প্রভাতকুমার বলেছিলেন, ছোট থাকতে তিনি হাড়সর্বস্ব ছিলেন। ঢাউস এক ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে বেজায় নাজেহাল হতে হয়েছিল তাকে সেবার। লেখক এই সূত্র ধরে লিখে ফেললেন ‘ঢাউস’। গল্পে বিশালাকার এক ঘুড়ি টেনিদাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এক ম্যাচে বত্রিশটা গোল দেওয়া পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবের টেনিদার মতো ফুটবল খেলতে পারেননি প্রভাতকুমার। একবার ধরেবেঁধে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল খেলোয়াড়ের অভাবে, বাকিটা ইতিহাস।
টেনিদা, প্যালা, হাবুল আর ক্যাবলার কিন্তু ভালো নামও আছে। টেনিদা হলেন ভজহরি মুখার্জী, স্বর্ণেন্দু সেন হলেন হাবুল, মেধাবী ক্যাবলার নাম কুশল মিত্র, পালাজ্বরে ভোগা প্যালার নাম কমলেশ ব্যানার্জি। এসব নাম টেনিদার ভাষায় ‘পুঁদিচ্চেরি’, মানে সাংঘাতিক! এরকম শব্দের ভাণ্ডার নেহাত কম নয়। কুরুবকের মতো বকবক, এক চড়ে কান কানপুরে, নাক নাসিকে, দাঁত দাঁতনে পাঠানো তো টেনিদার কাছে নস্যি। টেনিদার গল্পের অন্যান্য চরিত্রও নামের বাহারে কম যায় না। স্বামী ঘুটঘুটানন্দ, থেকে তার গুরু উচ্চন্ড মার্তন্ড কুক্কুট ডিম ভর্জনান্দ,পাঁচকড়ি সাঁতরার ছেলে সাতকড়ি সাঁতরা থেকে চন্দ্রবদন চম্পটী, টেনিদার গল্পজুড়ে নামের কোনো অভাব নেই। এমনকি বাদুড়ের নামও অবকাশরঞ্জনী, ইঁদুরের নাম দেবী নেংটীশ্বরী! টেনিদার বানানো গল্পে মোক্ষদামাসী জায়গা পরিবর্তন করেছেন বার বার। কুট্টিমামা অন্যের মামা থেকে হয়েছেন তার নিজের মামা। অবশ্য এমন অনেক মামাই টেনিদার ছিল।
চারটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, তেরটি গল্প আর একটি নাটিকা রেখেই পরপারে চলে যান নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সুনন্দ’র জার্নাল প্রকাশিত হয়নি আর কখনো। ভক্তদের অনুরোধে কলম ধরেন তার স্ত্রী আশা দেবী। একটি উপন্যাসসহ কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন তিনি। নতুন চরিত্র হিসেবে যোগ হয়েছিল পটলা, মুসুরী।
কেন পড়বেন টেনিদা?
প্রতিদিন নতুন নতুন বাড়ি উঠছে আমাদের শহরে, গ্রামে। ছেলেবেলায় দেখা মাঠগুলো ভরে যাচ্ছে দালানকোঠায়। বড় বড় শহরগুলোতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে পারাটাও একটা সৌভাগ্যের মতো। নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোর হাটে ডাংগুলির বদলে তুলে নিচ্ছে স্মার্টফোন অথবা গেমিং কনসোল। প্রযুক্তির যুগে সেগুলোর একেবারে প্রয়োজন যে নেই তা নয়। কিন্তু বিকেলগুলো হতে পারতো ঘাসফড়িংয়ের। অথবা সন্ধ্যা হবার আগে, মায়ের বকুনি খেয়ে ক্লাসের পড়া পড়তে বসার আগে শেষ বিকেলের আলোতে তাড়াহুড়ো করে প্রিয় একটা বই পড়তে চেষ্টা করার।
উলটো তাদের সারাদিন কাটছে ক্লাসে, টিউশনে, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বা প্রশ্ন কেনার লাইনে। আমাদের বিকেলগুলো কাটছে স্ক্রিনের আলোক রশ্মিকে চোখের আরো কাছে টেনে নেওয়ায়। পরিবর্তন আমরাই আনতে পারি। শিশুকে, ভাই-বোনকে হাতে তুলে দিতে পাড়ি টেনিদা সমগ্রের মতো বই। নির্ভেজাল আনন্দ, নির্দোষ গালগল্প, আর সাহসী অভিযান তাকে বইয়ের জগতের দিকে টেনে আনবে নিঃসন্দেহে।
প্রাপ্তবয়স্করাও পড়তে পারেন। বইটি আপনাকে কখনো নিয়ে যাবে নিঝুম জঙ্গলে, কখনো কালোবাজারির ডেরায়। বইটির পড়তে পড়তে আপনি কখন পটলডাঙার গলি, তস্যগলি ঘুরে পৌঁছে যাবেন চাটুজ্যেদের সেই বিখ্যাত রোয়াকে টেরটিও পাবেন না। যদি দেখা পান বিখ্যাত চারমূর্তির, যদি দেখেন তারা আড্ডা দিচ্ছে সেই আগের মতোই, চুপচাপ তেলেভাজা নিয়ে বসে পড়ুন। তাদের সাথে সোল্লাসে চিৎকার করে বলতে ভুলবেন না “ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক ইয়াক”।
ফিচার ইমেজ: লেখক