ড্যান ব্রাউনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের একটি ছোট্ট শহরে। শহরটির নাম এক্সিটার, এটি নিউ হ্যাম্পশায়ারে অবস্থিত। ড্যান ব্রাউনের বাবা পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকে একগাদা বই দেখে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ব্রাউন। এক্সিটারের অ্যামহার্স্ট কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি বাবার মতো শিক্ষকতায় যোগ দেন। সেখানে তিনি ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে আত্মপ্রকাশ করেন একজন লেখক হিসেবে।
‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাস দিয়ে পুরো পৃথিবীর পাঠকমহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোও পাঠকদের মধ্যে কম জনপ্রিয়তা পায়নি। মূলত দ্য দা ভিঞ্চি কোড বইটির ব্যাপক সফলতার পর তাঁর লেখা পূর্ববর্তী বইগুলোর চাহিদা বাড়তে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে ভিঞ্চি কোডের আগে লেখা যেসব বই সেভাবে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি, সেগুলোও বেস্টসেলার বনে যায়। বিশ্ব জুড়ে ৫৩টি ভাষায় তাঁর উপন্যাসগুলো অনূদিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ২০ কোটি কপি। দ্য দা ভিঞ্চি কোড, অ্যাঞ্জেলস অ্যাণ্ড ডিমন্স এবং ইনফার্নো উপন্যাস অবলম্বনে ইতোমধ্যে ৩টি হলিউড সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যেকার চিরন্তন দ্বন্দ্ব, সংকেত, গুপ্ত সংঘ আর কুয়াশার চাদরে ঘেরা রহস্যকে উপজীব্য করে উপন্যাস লেখেন ড্যান ব্রাউন। ২০১৭ সালের অক্টোবরের ৩ তারিখে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তাঁর নতুন বই অরিজিন। এবারের বইতেও দেখা যাবে তাঁর বিখ্যাত চরিত্র রবার্ট ল্যাংডনকে।
বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এই লেখকের একটি সাক্ষাৎকার উপস্থাপন করা হলো পাঠকদের জন্য।
লেখক হওয়ার পরিকল্পনা কি আপনার শুরু থেকেই ছিল?
না, ব্যাপারটা আসলে একটু অন্যরকম। বুঝিয়ে বলছি, কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর আমার সামনে দুটো রাস্তা ছিল। ১. ফিকশন লেখা, ২. গান লেখা। আমি হলিউড সিএ-তে বেশ কিছুদিন গান লেখার কাজ করেছি। কিন্তু আটলান্টা অলিম্পিক অনুষ্ঠানের বাইরে আমি মিউজিকে তেমন কোনো সফলতা পাইনি। তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করে ঠিক করে ফেললাম ফিকশন লিখব। ‘ডিজিটাল ফরট্রেস’ হলো আমার প্রথম চেষ্টার ফসল। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি, কারণ ওটা বেশ ভালই বিক্রি হয়েছিল। প্রথম বই যদি মুখ থুবড়ে পড়তো, তাহলে দ্বিতীয় কোনো বই লেখার মতো ধৈর্য আমার থাকতো কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে!
আপনি প্রথম দিকে শিক্ষকতা করতেন। লেখক হওয়ার পেছনে শিক্ষকতা কি কোনো প্রস্তুতির কাজ করেছে?
অবশ্যই। আমি অনেক ক্লাসিক বই পড়তাম। সেগুলোর প্লট, বর্ণনা, বিশ্লেষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতাম। আসলে, ক্লাসে ছাত্রদের সাথে এসব ফিকশন নিয়ে কথাবার্তা বলা, গল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করায় যখন নিজে বই লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন আমার অনেক উপকার হয়েছে।
আপনার প্রথম উপন্যাস ‘ডিজিটাল ফরট্রেস’ বইটি লেখার প্রেরণা পেয়েছিলেন কোত্থেকে?
গল্পটা বেশ মজার। ১৯৯৫ সালে আমি ফিলিপস এক্সিটারের ক্যাম্পাসে ক্লাস নিচ্ছি, এমন সময় ক্যাম্পাসে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজনের আগমন ঘটল। ব্যাপার কী? পরে জানা গেল, আমাদের এক ছাত্র নাকি ই-মেইলের মাধ্যমে আরেকজন ছাত্রকে আগের দিন রাতে বলেছে, সে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে খুশি নয়। নিজেকে খুশি করার জন্য সে প্রেসিডেণ্ট ক্লিনটনকে খুন করতে প্রস্তত! এরকম একটা ই-মেইলের পরিপ্রেক্ষিতে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন কলেজে এসেছে আমাদের সে ছাত্রটি প্রেসিডেন্টের জন্য কত বড় হুমকি সেটা দেখার জন্য।
এই ঘটনা আমার মনে দাগ কাটে। ছাত্ররা তাদের ব্যক্তিগত ই-মেইলে কী লিখছে সেটা সিক্রেট সার্ভিস জানল কীভাবে? নিশ্চয়ই ছাত্রদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সবার উপর নজরদারি হচ্ছে! ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি খুব বিস্মিত হলাম। ব্যাপারটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে একটু রিসার্চ করতে গিয়ে যা জানতে পারলাম তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম! সিআইএর মতো বড় একটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের মোট সংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ অবগত। এই এজেন্সির নাম ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ)। দেশের প্রত্যেকটি মানুষের উপর নজরদারি করা এদের কাজ। তারা বিভিন্নভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যায়। জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া ই-মেইলগুলোতে তারা Kill এবং Clinton শব্দ দুটো বাক্যে আছে কিনা সেটা জানতে স্ক্যান করে। এভাবেই তারা দেশে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার আগেই সেটাকে রুখে দিতে পারে। আর এরকম একটা ঘটনা থেকেই আমার মাথায় ‘ডিজিটাল ফরট্রেস’ লেখার আইডিয়া আসে।
‘ডিজিটাল ফরট্রেস’ লেখার সময় কোন জিনিসটা আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে?
শুনতে মামুলি মনে হলেও, সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল যে গল্পটা লিখছি সেটার উপর আস্থা রাখা। মাঝে মাঝে গল্প খুব বাজে অবস্থায় চলে যাচ্ছিল। নিজের মনের মতো করে লিখতে পারছিলাম না। কিন্তু তবুও দিনে ৫-৮ ঘণ্টা নিজের উপর জোর খাটিয়ে পাণ্ডুলিপির পেছনে সময় দিয়েছি।
বইটি কতটুকু ভাল হয়েছে সেটা পাঠকরা বলতে পারবে, তবে আমি এর পেছনে লেগেছিলাম ভেবে ভাল লাগছে। বইটা অন্তত বের করতে পেরেছি। ‘ডিজিটাল ফরট্রেস’ বইটির জন্য আমি প্রায় ১,০০০ পৃষ্ঠা লিখেছিলাম। সেখান থেকে যে অংশগুলো আমার পছন্দ হয়নি, সেগুলো বাদ দেয়ার পর ৩৫০ পৃষ্ঠায় দাঁড়ায়।
আপনি তো থ্রিলার লেখেন। কিন্তু পাঠক হিসেবে আপনি কোন ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?
অনেক বড় বড় লেখকদের লেখা পড়ে আমি লেখক হবার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তাদের সবার নাম মনে করতে পারছি না। একটা তালিকা করে রাখা উচিত ছিল! আর বর্তমান সময়ে আমি নিজের লেখালেখির পেছনে এতই ব্যস্ত যে ফিকশন তেমন একটা পড়া হয়ে ওঠে না। তবে নিজের লেখার জন্য নিয়মিত নন-ফিকশন আর রিসার্চ বইগুলো পড়তে হয়। যখন ছুটি কাটাই, তখন অবশ্য বই পড়ার ফুসরত পাই। বইয়ের দোকানে গিয়ে বেস্টসেলার র্যাক থেকে কয়েকটা সমসাময়িক থ্রিলার তুলে নিই। জানি, শুনতে খুবই মামুলি মনে হচ্ছে, কিন্তু এটাই সত্য।
এ পর্যন্ত আপনার পড়া বইগুলোর মধ্যে কোন বইটি আপনার সবচেয়ে পছন্দ?
Madeleine L’Engke-এর লেখা ‘A Wrinkle in Time’ বইটি আমার সবচেয়ে প্রিয়। মনে পড়ে, বইটা যখন পড়তে পড়তে যখন অর্ধেকে পৌঁছেছি তখন মা আমাকে বলেছিলেন, এখন আর পড়া যাবে না, ঘুমুতে হবে। সেই রাতে আমার ভালো করে ঘুম হয়নি। আমি বইটার ভেতরে একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম। পরদিন বইটা শেষ করে অঝোরে কাঁদলাম। একটা বইয়ের ভেতরে এতোটা আবেগ থাকতে পারে! এই ভাবনাটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। কাল্পনিক চরিত্রগুলোর প্রতি আমার টান, আবেগ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তারপর টের পেলাম গল্প বলার ধরন আর ছাপা অক্ষরের জাদুকরী ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী!
আপনার পছন্দের লেখক কে বা কারা?
জন স্টেইনবিককে ভালো লাগে তাঁর উপন্যাসে থাকা বিভিন্ন জায়গার জীবন্ত বর্ণনার জন্য। রবার্ট লুডলামকে ভালো লাগে তাঁর জটিল প্লটের জন্য আর জে. কে. রাউলিংকে পছন্দ করি ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়ার তৃষ্ণা জাগানোর জন্য।
পছন্দের সিনেমা?
‘ফ্যান্টাসিয়া’, ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ‘অ্যানি হল’ এবং ‘রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট’; এগুলো আমার সবচেয়ে প্রিয় সিনেমা। তবে যদি পপকর্ন মসলাদার সিনেমার ব্যাপারে বলতে হয়, তাহলে ‘ইণ্ডিয়ানা জোন্স’ ও ‘পিঙ্ক প্যান্থার’ সিরিজের মুভিগুলোর নাম আসবে।
আপনার লেখালেখির ব্যাপারে মজার কিছু বিষয় আমাদেরকে জানান। কীভাবে, কখন, কতক্ষণ লিখেন ইত্যাদি…
ভোর চারটায় যদি আমি আমার ডেস্কে লিখতে না বসি তাহলে আমার মনে হয় আমি লেখার জন্য সবচেয়ে সেরা সময়টা মিস করছি। এই সময়টায় আমাকে লিখতেই হবে। তবে আমি টানা এক ঘণ্টার বেশি লিখি না। ডেস্কে একটা পুরানো আওয়ার গ্লাস আছে। ওটা দেখে সময় বুঝে নিই। এক ঘণ্টা হয়ে গেলেই ডেস্ক ছেড়ে পুশআপ সহ কিছু ব্যায়াম করি।
আমরা ধারণা এতে শরীরের রক্ত সঞ্চালণে সুবিধার পাশাপাশি আমার আইডিয়াগুলোও পরিষ্কার হয়। এছাড়া আমি গ্রাভিটি বুটের বিশাল ভক্ত। ওটা পায়ে দিয়ে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকি। এভাবে সম্পূর্ণ উল্টো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্লটের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে সুবিধা হয়।
আপনি সব ধরনের বই পড়েন, নাকি বেছে বেছে পড়েন?
নন-ফিকশন যখন পড়ি, তখন একটু বেছেই পড়তে হয়। সেটা আমার রিসার্চের জন্য হোক কিংবা অবসর কাটানোর জন্য হোক। আর ফিকশন পড়ার সময় আমি থ্রিলার ধাঁচের বইগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তবে আমি হরর বই মোটেও পড়ি না। ১৫ বছর বয়সে একবার ‘দ্য এক্সোরসিস্ট’ এর কিছু অংশ পড়েছিলাম। সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ।
ছোটবেলায় বইয়ের কোনো চরিত্রকে ভাল লেগেছিল?
লেগেছিল। একবার এক গ্রীষ্মে আমি ‘হার্ডি বয়েজ’ সিরিজটার খোঁজ পেয়ে যাই। তারপর আমাকে আর পায় কে! সারাদিন ‘হার্ডি বয়েজ’ নিয়ে থাকতাম আর ওদের বুদ্ধিদীপ্ত আর সাহসী কাহিনীগুলো পড়ে রোমাঞ্চিত হতাম। এছাড়াও জ্যাক লণ্ডনের লেখা ‘কল অফ দ্য ওয়াইল্ড’ বইয়ের বার্নার্ড বাক চরিত্রটি আমার পছন্দ ছিল। তারপর ‘লর্ড অফ দ্য ফ্লাইস’ বইয়ের রাফল চরিত্রটির কথা মনে পড়ছে।
যদি আপনি কোনো জীবিত কিংবা মৃত লেখকের সাথে দেখা করার সুযোগ পেতেন, তাহলে কার সাথে দেখা করতেন?
জোসেফ ক্যাম্পবেল। মিথ ও ধর্ম নিয়ে তাঁর লেখাগুলো সত্যিই অসাধারণ। তাঁর লেখা পড়ার কারণে আমার রবার্ট ল্যাংডন চরিত্রটি তৈরি করতে অনেক সুবিধা হয়েছে।
এমন কোনো বই আছে যেটা আপনি বেশ আশা করে হাতে নিয়ে হতাশ হতে হয়েছে?
উইলিয়াম ফকনারের লেখা ‘দ্য সাউণ্ড অ্যাণ্ড দ্য ফিউরি’, ভাল লাগানোর অনেক চেষ্টাও করেছি কিন্তু ভাল লাগেনি।
আপনার নতুন বইয়ের জন্য শুভকামনা রইল। সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।