গভীর রাতে মেয়ে ম্যাডিকে বুকে চেপে গুটিগুটি পায়ে, ২৫ বছরে পা দেওয়া এলেক্স তাদের ছোট্ট সাজানো সংসার ছেড়ে বাইরের জগতে পা বাড়াচ্ছে। পরিকল্পনা ছাড়াই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে। যখন সাবধানে পা ফেলছিল বাড়ির মেঝেতে তখন মেঝেতে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরো আর দেয়ালে ঘুষি দিয়ে গর্ত করে ফেলা দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে, হয়তো আর কয়েকটা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের গল্পের মতোই নেটফ্লিক্সের দশ পর্বের এই মিনি সিরিজ ‘মেইড’ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এ সিরিজ বাকি দশটা সিরিজ থেকে হয়তো কিছুটা আলাদা।
হাই স্কুলের পাট চুকিয়ে, ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নকে ধামাচাপা দিয়ে এলেক্স মন দিলো ঘর সংসারে। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, চায়নি তার মতো অসুস্থ কোনো শৈশবের স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠুক তার নিজের মেয়ে ম্যাডি। তবে এই যুগে একজন হাইস্কুল পাশ সিঙ্গেল মাদার, যার নেই কোনো ঠাঁই, কীভাবে তার মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে?
মূল চরিত্রে আছেন ২৭ বছর বয়সী আমেরিকান অভিনেত্রী মার্গারেট কোয়ালে। ২৫ বছরের এলেক্সের চরিত্রে তার চমৎকার অভিনয়ের প্রশংসা না করলেই নয়। এই মিনি সিরিজে তার মায়ের চরিত্রে রয়েছেন তারই বাস্তব জীবনের মা এন্ডি ম্যাকডোয়েল। সিরিজের নির্মাতা মলি স্মিথ এই গল্পের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন স্টেফেনি ল্যান্ডের বিখ্যাত বই, তার আত্মজীবনী ‘মেইড: হার্ড ওয়ার্ক, লো পে এন্ড এ মাদার্স উইল টু সার্ভাইভ’ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্রতার কঠিন সত্য তুলে ধরেছেন স্টেফেনি তার বইতে যা পরবর্তীতে অনেক সমালোচকদের প্রশংসা ঝুলিবদ্ধ করে নেয়। সিরিজে নিক রবিনসন, ছোট্ট রাইলি নেভায়া হুইটেট, বিলি বুর্ক সহ সকলের অভিনয়শৈলী ছিল অনবদ্য।
প্রথম এপিসোড থেকেই এলেক্সের জীবনযুদ্ধ শুরু হয় তার ৩ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে। সকলের দ্বারে দ্বারে কাজ আর মাথার ওপর এক রাতের ছাদের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অসফল হয়ে নিজের শেষ সম্বল একমাত্র গাড়িও এক্সিডেন্টের কবলে পড়ে। এক রাত মেয়েকে নিয়ে কাটিয়ে দেয় ফেরির মেঝেতেই। চারপাশটা যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল শেষ আশা হিসেবে সরকারি সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায়। কপালে জুটে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শেল্টার। তবে সে কি ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার? শরীরে বয়ফ্রেন্ড শনের দেওয়া কোনো চোটের চিহ্ন নেই। কিন্তু মানসিক নির্যাতনও যে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত তা প্রথমবার জানতে পারলো।
মাথার ওপর ছাদের বন্দোবস্ত হলেও নেই কোনো আর্থিক সচ্ছলতা। সরকারি অফিস থেকেই এক কোম্পানির নম্বর দেওয়া হয়। নাম ভ্যালু মেইডস। ঘরে ঘরে গিয়ে গৃহকর্মীর দায়িত্ব পালন করা আর সেই সাথে প্রতি ঘন্টায় কিছু ডলার পকেটে জুটতে পারে। এরই মধ্যে নেইট (রেইমন্ড এব্ল্যাক) নামের পুরনো এক বন্ধু সাহায্যের হাত বাড়ায় তার গ্যারেজে পড়ে থাকা পুরনো গাড়ি ধার দিয়ে। তবে দরিদ্রতা যেন পিছু ছাড়ছেই না। এত স্বল্প উপার্জনে কিছুই সামলে উঠতে পারছে না এলেক্স। এক বড়লোক বাড়িতে গিয়ে কাজ শেষ করেও, বাড়ির মালিক অসন্তোষ প্রকাশ করায় এলেক্স হারিয়ে ফেলে তার সোনার হরিণ সেই চাকরিটিও।
ওদিকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স শেল্টারে থাকার কারণে কেইস ফাইল করতে হয় বয়ফ্রেন্ড শনের বিরুদ্ধে। ভালো উকিলের সাহায্য নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও নেই তার। আর শেষমেশ হারিয়ে ফেলে মেয়ের হাফ কাস্টডি। শনের অদ্ভুতভাবে রেগে যাওয়া সন্তান ম্যাডির ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে এই ভেবেই নিজেকে দোষ দিতে শুরু করে এলেক্স। কিন্তু পায়ের নিচে মাটি নেই, মাথার ওপর ছাদটাও শক্ত নয়। ম্যাডির কাস্টডি পেতে হলে প্রয়োজন সন্তানকে ঠিকঠাকভাবে লালনপালনের দায়িত্ব নিতে পারার মতো সচ্ছলতা। মেয়েকে হারিয়ে দারিদ্রতার সাথে এই যুদ্ধে যেন হেরেই যাচ্ছিল। তবে নিজের মা, বাবার কাছ থেকে না পাওয়া ভালবাসা আর সুন্দর ভবিষ্যতের সবটাই ম্যাডির হাতে তুলে দিতে চায় মা এলেক্স। নতুন উদ্দমে আর কিছু মানুষের সাহায্যে ধীরে পরিবর্তন আনতে শুরু করে এলেক্স।
গল্পের মূল চরিত্র এলেক্সের দিকেই যে সকলের আকর্ষণ আটকে থাকবে তা কিন্তু নয়। এলেক্সের বয়ফ্রেন্ড শন, তার বিশাল মানসিক উত্থান পতনের দৃশ্যায়নও খুব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে প্রতিটি এপিসোডে। মাদকাসক্ত ও শৈশবের মানসিক আঘাতকে সাথে করে, নিজেকে পরিবর্তন করতে কম কসরত করছিল না সে। ৯ বছর বয়স থেকে মদ্যপ হয়ে থাকা শনের পক্ষে হয়তো এতো কম সময়ে এত দূরের পথ পারি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। মেয়ে ম্যাডিকে ভালবাসায় তারও কোনো কার্পণ্য নেই। রাতদিন কাজ করে যাচ্ছিল। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে আনার চেষ্টা করলেও শেষমেশ হয়তো সময় আর ধৈর্যটা কম পড়ে যাচ্ছিল।
শন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেক আমেরিকান অভিনেতা নিক রবিনসন যাকে আমরা অনেকেই হয়ত ‘লাভ, সাইমন’ এর সাইমন নামে চিনি। শন চরিত্রে হঠাৎ ভিলেন আবার হঠাৎ দর্শকের সহানুভূতি অর্জনের জন্য অভিনয় দক্ষতায় তাকে বেশ ভালো নম্বর দেওয়া যায়। গল্পের আরেক চরিত্র এলেক্সের মা, পওলা। পওলা তার স্বামীর কাছে মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের শিকার। সে কারণেই হয়তো মানসিকভাবে নিজেও তেমন একটা সবল না পওলা। মেয়ে এলেক্সকে চাইলেও তেমন কোনো সাহায্য করতে পারছিল না। উলটো নিজেই মদ-গাঁজায় মত্ত হয়ে, ভুল মানুষের কাছে ভালবাসা আশা করে যাচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত।
সিরিজের প্রত্যেকটি চরিত্রের নিজস্ব গল্পের সাথে দর্শক খুব সহজেই সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন। কখনো এলেক্স কখনো শন কখনোবা পওলা আর কখনো ম্যাডির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে দর্শক হয়তো নিজেই অধৈর্য হয়ে পড়বেন। তাই একবারেই ১০ এপিসোডের এই সিরিজ শেষ করেই উঠেছেন অনেকেই। সুন্দর চিত্রায়ন, পরিপক্ব অভিনয় আর গোছানো নির্মাণের কারণে ‘মেইড’ নেটফ্লিক্সে বেশ জনপ্রিয় সিরিজগুলোর মধ্যে একটি জায়গা পাকাপোক্ত করেছে ইতোমধ্যেই। আইএমডিবি’র কাছ থেকে পেয়েছে ৮.৫ আর রটেন টম্যাটোস দিয়েছে ৯৩%।
একজন সিঙ্গেল মায়ের, যুক্তরাষ্ট্রের এক শহরে, স্বল্প আয়ে নিজের নতুন সংসার চালানো, মেয়েকে শিক্ষিত করে তোলার যে যুদ্ধ যা হয়তো অনেকের চোখের আড়াল হয়, সেই কঠিন সত্যকেই তুলে ধরেছেন নির্মাতা রূপালী পর্দায়। এলেক্সের সাথে এক ইমোশনাল রোলার কোস্টারে চড়ে বসতে চাইলে দেখে ফেলতে পারেন সুন্দর এই মিনি সিরিজ ‘মেইড’।